somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিটো ডায়েট : ভালো না মন্দ?

২৪ শে এপ্রিল, ২০২০ বিকাল ৫:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৩ বছর মেডিক্যাল সাইন্স পড়েও যখন নন-মেডিক্যাল ২-৩ জনের প্রশ্নের সম্মুখীন হলেম- 'কিটো ডায়েট' সম্পর্কে তুই কী জানস বল্ শুনি?

তখন আসমান থেকে পড়লুম বৈকী। যদিও মেডিক্যালে পুষ্টি নিয়ে অনেক পড়তে হয়, তবুও keto diet নামটা কভু পড়েছি বলে এয়াদ আসে না।

তারা বলল- সারা দুনিয়ার মাইনষে কিটো ডায়েট ফলো কইরা ২ সপ্তাহে ১০ কেজি উজন কমাই লাইল আর তুই নাম হুইনাই ভিরমি খাইলি।

গুগলে সার্চ দিয়ে ত বেকুব বনে গেলাম- কিটো ডায়েট নাকি এই সময়ের ক্রেইজ, ফিগার সচেতনদের ১ম পছন্দ। আর আমি কিনা এখনো এ ব্যাপারে বকলম। রাগে দুঃখে অভিমানে কিটো ডায়েট নিয়ে গত কয়েকদিন স্টাডি করলেম।

যারা লম্বা লেখা না পড়ে এখুনি সটকে পড়ার পায়তারা কষছেন তাঁদের সুবিধার্থে উপসংহারটাই আগে বলে দিচ্ছি- কিটো ডায়েট অধিকাংশ মানুষের জন্যই ক্ষতিকর। আপনারা এক্ষণে অন্যত্র মজা লুটতে যেতে পারেন।

★ নরমাল ডায়েট ও কিটো ডায়েট :

আমাদের দেহ জ্বালানি হিসেবে প্রধানত ২টি জিনিস ব্যবহার করতে পারে- glucose আর ketone body. স্বাভাবিক অবস্থায় শক্তি বা ক্যালরির মূল উৎস থাকে গ্লুকোজ, যা আসে শর্করা (carbohydrate) থেকে। দেহকে শর্করা সাপ্লাই দেয়া বন্ধ করে দিলে তা চর্বি (fat) ভেঙে ভেঙে কিটোন বডি তৈরি করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।

কেউ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ক্যালরি গ্রহণ করলে তা দেহে চর্বি আকারে জমা হয় ও ওজন বাড়ে। যেহেতু আমাদের খাদ্যে ক্যালরির প্রধান উৎস শর্করা, বেশি শর্করা গ্রহণ করলে (আমরা যেমন এক বেলায় ৩প্লেট ভাত গিলে ফেলি) অতিরিক্ত অংশ দেহে চর্বি হিসেবে জমা হয়।

তাই কিটো ডায়েটের মূলনীতি হোল দেহে শর্করা সাপ্লাই না দিয়ে তেলচর্বি সাপ্লাই করা, অর্থাৎ দেহকে কিটোন বডি থেকে (গ্লুকোজের পরিবর্তে) শক্তি সংগ্রহের অভ্যাস করানো। যেহেতু কিটোন বডি চর্বি থেকে আসে, সুতরাং খাদ্যের এবং দেহের চর্বি গলিয়ে কিটোন বডি তৈরি হয়ে হয়ে দেহের ক্যালরি চাহিদা মেটাতে থাকবে আর ফলশ্রুতিতে ওজনও কমে যাবে- এই হল আশা।

তাই বলা হচ্ছে কিটো ডায়েটে এমন সব উপাদান থাকবে যাতে ক্যালরির ৭০-৭৫% আসে চর্বি থেকে, ২০% আমিষ (protein) থেকে আর ৫% শর্করা। অথচ স্বাভাবিক খাদ্যে ক্যালরির ৫০-৭০% আসে শর্করা থেকে, বাকিটা তেলচর্বি ও আমিষ থেকে। উল্লেখ্য, অধিকাংশ ফল, ডাল, শস্য ও সবজিতে শর্করা থাকায় কিটো ডায়েটে এগুলো খাওয়া নিষেধ!

★ কিটো ডায়েটের প্রভাব :

১. শিশুদের মৃগীরোগ (epilepsy) উপশম- কিটো ডায়েট শিশুদের মৃগীরোগ ও খিঁচুনি হ্রাস করে। কিটো ডায়েট মূলত এই উদ্দেশ্যেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। যদিও কীভাবে তা মৃগীরোগ কমায় তার প্রক্রিয়া এখনো অজানা।

২. টাইপ ২ ডায়াবেটিস, টিউমার, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম, মেটাবলিক সিনড্রোম, আলজেইমার'স ডিজিজ এসব রোগে কিটো ডায়েট উপকারী বলা হয়। তবে এগুলো এখনো যথেষ্টসংখ্যক নির্ভরযোগ্য গবেষণায় প্রমাণিত নয়।

৩. ওজন হ্রাস- দেহকে শর্করা থেকে বঞ্চিত করলে প্রথমেই লিভারে সঞ্চিত শর্করা (glycogen) ভেঙে গ্লুকোজ তথা ক্যালরি তৈরি হয়। এই শর্করার সাথে সঞ্চিত পানিও বেরিয়ে যায়। দেহের মাংস ক্ষয় হয়ে গ্লুকোজ তৈরির চেষ্টা করে। কিটো ডায়েট শুরুর সপ্তাখানেকের ভেতর যে দ্রুত ওজন হ্রাস হয় তা মূলত ঐ সঞ্চিত শর্করা, পানি ও মাংস ক্ষয়ের কারণে। চর্বি ঝরার কারণে নয়। বোঝাই যাচ্ছে এই ওজন হ্রাস শরীরের জন্য ভালোও নয়। পরবর্তীতে তাই আর এত দ্রুত ওজন কমে না কারণ দেহের সঞ্চিত শর্করা, পানি এবং মাংস ক্ষয়েরও একটা লিমিট আছে। এগুলোর ক্ষয় ঐ লিমিটে পৌঁছে বন্ধ হলে পরে শুরু হয় চর্বি ক্ষয়জনিত ওজন হ্রাস, যা ধীরগতিসম্পন্ন। অধিকাংশ মানুষ দীর্ঘদিন সুকঠিন কিটো ডায়েট ফলো করতে পারে না এবং তখন দ্রুত এসব হারানো ওজন ফিরে আসে।

৪. keto flu- দেহকে গ্লুকোজ থেকে বঞ্চিত করায় দেহ প্রথমে এতদিনের অভ্যস্ত জ্বালানি ছাড়া চলতে পারে না। তখন মাথাব্যথা, দুর্বলতা, নির্ঘুমতা, বমিভাব, বদমেজাজ দেখা দেয়।

৫. ভিটামিন ও মিনারেল (লবণ) এর ঘাটতি- যেহেতু কিটো ডায়েটে অধিকাংশ শস্য, ফল ও সবজি খাওয়া বারণ, তাই দেহে ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতিজনিত অসুখ দেখা দেয়। কারণ শস্য, ফল ও শাকসবজি আমাদের দেহে ভিটামিন ও মিনারেলের প্রধান উৎস।

৬. কোষ্ঠকাঠিন্য- কিটো ডায়েটে ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়ার সুযোগ অতি সীমিত থাকায় ফাইবার কম খাওয়া হয়। ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়।

৭. রক্তের কোলেস্টেরল বৃদ্ধি- কিটো ডায়েটের প্রধান উপাদান তেলচর্বি জাতীয় (৭০-৭৫%)। যার ফলে রক্তে কোলেস্টেরল ৩০% পর্যন্ত বাড়তে পারে। ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক এর ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।

৮. হাড় ক্ষয়- শরীরে কিটোন বডি বাড়লে ঐ অবস্থাকে বলে কিটোসিস, যা একটি এসিডোসিস। এসিডিক কন্ডিশনে হাড় ক্ষয় হয় (bone demineralisation)।

৯. কিডনি পাথর- হাড় ক্ষয় হয়ে রক্তে ও প্রস্রাবে ক্যালসিয়াম বেড়ে যায়, যা থেকে কিডনিতে পাথর হতে পারে।

১০. শ্বাস ও প্রস্রাবে গন্ধ- কিটোন বডির উপস্থিতির কারণে অস্বাভাবিক গন্ধ হয়।

১১. লিভারে চর্বি জমা

১২. শারীরিক বৃদ্ধি হ্রাস- কিটো ডায়েট growth hormone, IGF-1 কমায় বলে শারীরিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়।

★ কাদের জন্য কিটো ডায়েট প্রযোজ্য :

১. মৃগীরোগী শিশু- যাদের মৃগীরোগ কোনো ওষুধে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় নি। কিটো ডায়েটের অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকায় শুরুতেই মৃগীরোগ কমাতে এটা চালু করা হয় না।

২. টাইপ ২ ডায়াবেটিস, টিউমার, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম, মেটাবলিক সিনড্রোম, আলজেইমার'স ডিজিজ যদি চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তবে কেবল চিকিৎসকের সাথে পরামর্শক্রমে কিটো ডায়েট ট্রাই করা যেতে পারে। কারণ এসব রোগে কিটো ডায়েটের প্রভাব এখনো বিতর্কিত।

৩. যাদের অতি অল্প সময়ে ওজন হ্রাস করা অতি জরুরী। উদাহরণত- চাকরির জন্য।

★ কাদের জন্য কিটো ডায়েট নিষেধ :

১. টাইপ ১ ডায়াবেটিস- এই রোগীদের এমনিই কিটোসিস ও কিটোএসিডোসিস এর প্রবণতা থাকে। কিটো ডায়েট ওদের গ্লুকোজ কমিয়ে ও কিটোএসিডোসিস বাড়িয়ে মৃত্যু ঘটাতে পারে।

২. যাদের পিত্তথলি (gall bladder) নেই /লিভারের অথবা অগ্ন্যাশয়ের রোগ (pancreatic insufficiency) আছে- পিত্তরস ও অগ্ন্যাশয়ের রস তেল-চর্বি হজমে সহায়তা করে। যাদের অপারেশন করে পিত্তথলি ফেলে দেয়া হয়েছে বা অগ্ন্যাশয়ের এনজাইম কম তারা কিটো ডায়েটের এত তেল-চর্বি হজম করতে পারে না। ফলে বদহজম হয় ও চর্বি-ডায়রিয়া লেগে থাকে।

৩. যাদের থাইরয়েড হরমোন কম- কিটো ডায়েট থাইরয়েড হরমোনকে দমিয়ে রাখে।

৪. binge eating disorder রোগী- এই ধরনের মানসিক রোগে মানুষ গলা অব্দি খায় এবং তারপর ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে। কিটো ডায়েট ফলো করলে এই রোগটা মাথাচাড়া দিতে পারে।

৫. লিভারের রোগী - কিটো ডায়েটের এত তেলচর্বিকে কিটোন বডিতে রূপান্তর করা অসুস্হ দুব্বল লিভারের ঘাড়ে পাহাড় চাপিয়ে দেয়ার মতো।

৬. কিডনি রোগী- কিটো ডায়েটে নরমাল ডায়েটের চেয়ে প্রোটিন বেশি থাকে। তা হজম হয়ে অনেক ইউরিয়া তৈরি হয় যা দেহ থেকে দূর করতে অসুস্হ কিডনি বড়ই নাজেহাল হয়।

৭. যারা বডিবিল্ডিং করছেন- কিটো ডায়েট মাংস ও হাড় ক্ষয় করে।

হুজুগে পড়ে বিতর্কিত কিটো ডায়েট ফলো করার আগে বিষয়গুলো মাথায় রাখা প্রয়োজন। সবচে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর উপায় হোল নিজের পেশা ও কাজ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ক্যালরি হিসাব করে পুষ্টিবিদ/চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে আদর্শ ডায়েট ফলো করা এবং ব্যায়াম করা।
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×