স্মরণে...............
ফজলে লোহানী
[জন্মঃ ১২ই মার্চ, ১৯২৮ - মৃত্যুঃ ৩০শে অক্টোবর, ১৯৮৫]
দেখতে লোকটা মোটেও সুদর্শন ছিলেন না। চেহারা এবড়ো-থেবড়ো, মাথায় পরচুলা। কিন্তু আশ্চর্য মায়াকাড়া ছিল তার চাহনি। তারচেয়ে চমৎকার ছিল তার কথা বলার ভঙ্গি আর অভিব্যক্তি। তিনি বাংলাদেশে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ও টিভি সাংবাদিকতার জনক সেই ফজলে লোহানী।
সাংবাদিক-সাহিত্যিক-চলচ্চিত্র প্রযোজক এতোসব পরিচয় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল তার 'যদি কিছু মনে না করেন'-এর আড়ালে। হ্যাঁ, টিভি মিডিয়ার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জনক তিনি। বাংলাদেশের টিভি মিডিয়ার প্রথম জনপ্রিয় উপস্থাপক। আজও তার গড়ে তোলা কাঠামোতেই ঘুরপাক খাচ্ছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সব ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান।
১৯২৮ সালের ১২ মার্চ সিরাজগঞ্জ জেলার কাউলিয়া গ্রামে এক শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফজলে লোহানী। তার বাবা আবু লোহানী ছিলেন সেই সময়ের সুপরিচিত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। মা ফাতেমা লোহানী ছিলেন কলকাতা করপোরেশন স্কুলের শিক্ষিকা।
ফজলে লোহানী ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, লেখক, টিভি উপস্থাপক ও চলচ্চিত্র প্রযোজক। বড় ভাই ফতেহ লোহানী ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতা, আবৃত্তিকার, চিত্রপরিচালক, সাহিত্যিক, অনুবাদক ও বেতার ব্যক্তিত্ব।
ফজলে লোহানী সিরাজগঞ্জ বিএল স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হলেও চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেননি। ভারত বিভাগের পর তিনি অন্য কয়েকজনের সাথে ঢাকা থেকে সাপ্তাহিক পূর্ববাংলা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের সাথে যুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে তার সম্পাদনায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মাসিক পত্রিকা অগত্যা।
পঞ্চাশের দশকে ফজলে লোহানী ইংল্যান্ড চলে যান এবং লন্ডনের বিবিসি’র ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে চাকরি করেন।
ষাটের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশে ফিরে এসে ফজলে লোহানী সাংবাদিকতা ও লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। এ সময় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন এবং মওলানা ভাসানীর সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৭ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনে শিক্ষা ও বিনোদনমূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ও পরিচালনা করে সুপরিচিত হয়ে উঠেন। তবে তুমুল জনপ্রিয়তা পান নিজের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘যদি কিছু মনে না করেন' ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করে। অনুষ্ঠানটি ১৯৭৯ সালে থেকে তার মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
আজকের সময়ে তো প্রতিদিনই বিভিন্ন চ্যানেলে ডজন ডজন টিভি রিপোর্টিং চোখে পড়ে। বাংলাদেশ টেলিভিশন মিডিয়ার ইতিহাসে সত্যিকার অর্থে টিভি রিপোর্টিং চালু করেন ফজলে লোহানী। প্রতি পনের দিন পর পর বিনোদনমূলক নানা আয়োজনে ভরপুর 'যদি কিছু মনে না করেন' অনুষ্ঠান নিয়ে দর্শকদের সামনে আসতেন তিনি। অনুষ্ঠানে শেষ অংশে থাকতো একটি করে টিভি রিপোর্টিং।
ফজলে লোহানীর এই টিভি রিপোর্টিং দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ টিভি দর্শক বিপুল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতেন। বিশ্বখ্যাত টিভি রিপোর্টারদের মতোই গভীর অভিব্যক্তি নিয়ে হৃদয়ছোঁয়া ভঙ্গিমায় তার করা টিভি রিপোর্টিং মানুষকে কখনো হাসাতো, কখনো কাঁদাতো, কখনোবা করে তুলতো বেদনা ভাড়াক্রান্ত কিংবা ক্ষুব্ধ। সেই আশির দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে টিভি রিপোর্টিং এর প্রবর্তন ঘটানোর মতো যুগান্তকারী কাজ তিনি করেছেন। এসিড-নিক্ষেপের ভয়াবহতা নিয়ে সচেতনতার শুরুটা তাঁর হাত ধরেই। বাল্য বিবাহর বিরুদ্ধেও তিনিন গনমত তৈরি করেন।
ফজলে লোহানী লেখক হিসেবে গল্প আর প্রবন্ধ লিখতেন। পেনশন নামে একটি সৃজনশীল চলচ্চিত্রও তিনি প্রযোজনা করেন।
প্রসঙ্গত, বিবিসির 'ইউ আস্ক ফর ইট' নামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের অনুসরণে প্রয়াত ফজলে লোহানী বিটিভির জন্য “যদি কিছু মনে না করেন” নামে ঐ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানটি করতেন। সে সময় হানিফ সংকেত ছিলেন একজন কৌতুকাভিনেতা এবং 'যদি কিছু মনে না করেন' অনুষ্ঠানে তিনি ফজলে লোহানীর সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। দর্শক সারি থেকে তাকে টিভিপর্দায় নিয়ে আসেন ফজলে লোহানী।
ফজলে লোহানী প্রয়াত হওয়ার পর হানিফ সংকেত এখনকার সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন 'ইত্যাদি' অনুষ্ঠানটি শুরু করেন। তার অনুষ্ঠানটিতেও রয়েছে 'যদি কিছু মনে না করেন' অনুষ্ঠানটির কিছুটা প্রভাব।
ফজলে লোহানী ১৯৮৫ সালের ৩০ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৫৮ বছর বয়সে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন । তার মৃত্যুতে সে সময় টিভি দশর্করা শোকাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল।
টিভি মিডিয়া কাজ করা আজকের প্রজন্মের অনেক নির্মাতাই হয়তো ফজলে লোহানী সম্পর্কে জানেন না। কিন্তু যারা পথ তৈরি করেছে এবং পথ দেখিয়েছে তাদের অবদান অবশ্যই আমাদের স্বীকার করতে হবে। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে ফজলে লোহানীর মতো কৃতিজনদের জীবন ও কর্ম।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০১৯ সকাল ১০:৫৬