(চমৎকার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, স্পষ্টভাষী, ফ্যাশন আইকন, দুর্দান্ত বুদ্ধিদীপ্ত, সুদর্শন, অভিজাত সুশিক্ষিত এই মানুষটাকে আমি জেনেছিলাম বেশ কাছে থেকেই। তার কাছে আমার কিছু ঋণ রয়ে গেছে। বহুবছর দেখা হয়নি তার সাথে- খুব ইচ্ছে ছিল করোনার ঢেউ যাবার পরেই তার সাথে দেখা করার। কিন্তু আমাকে সে সুযোগ না দিয়ে আমার প্রিয় এই মানুষটাকে করোনা নয় ডেঙ্গুতে কেড়ে নিল।
মাত্র ষোল বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে চরম বীরত্বের সাথে ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতা। বাংলাদেশের তৃতীয় কনিষ্ঠতম ‘বীরপ্রতীক’ প্রচার বিমুখ নিভৃতচারী এই মানুষটাকে নিয়ে বিশাল পরিসরে লেখার ইচ্ছে আছে আমার। আজ বিজয় দিবসে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে- তার লেখা নন-ফিকশনাল ‘দ্যা গেরিলা’ বই নিয়ে আলোচনা অতি সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরছি। তথ্যগত ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়।)
*****
সরাসরি মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা কোন মুক্তিযোদ্ধার বয়ানে ইংরেজি ভাষার বই নিশ্চিতভাবে ভীষণ কম।
বইটি লেখকের প্রতিটি যুদ্ধের বিবরণ বর্ণনা করেছে।
প্রথম ব্যক্তির আখ্যান;
দ্য গেরিলা লেখককে নিজেই বর্ণনাকারী হিসেবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। পাঠকরা যুদ্ধের ময়দানে আসলে কি ঘটেছিল - বীরত্ব, হত্যাকাণ্ড, রক্তপাত,মারাত্মক আঘাত এবং ট্র্যাজেডির প্রাণবন্ত ছবি তাঁর কলমে ফুটিয়ে তুলেছেন। দ্যা গেরিলা- একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধার গল্প যা প্রত্যেক পাঠককে নাড়া দেবে।
শাহজামান মজুমদার স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে ফেরত আসার পরে যুদ্ধে তাঁর অবদান ও অসীম সাহসিকতার জন্য বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম কমবয়সী বীর প্রতীক।
অত্যন্ত অভিজাত ও উচ্চবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া মজুমদারের বাড়ি থেকে একরকম পালিয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন ছিল বেশ ব্যতিক্রমী ও অস্বাভাবিক একটা ঘটনা।
পরবর্তীতে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের আইটি সেক্টরের তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। দুর্দান্ত স্মার্ট, সুদর্শন ও ফ্যাশন সচেতন কিন্তু নিভৃতচারী এই মানুষটা আই বি এম এর মত বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানিতে চাকুরি করেছেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় বিখ্যাত আইটি কোম্পানি ঠাকরানের সি ই ও। তিনি বাংলাদেশের আধুনিক ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট বিজনেসের’ পাইওনিয়ার।
বইয়ের শুরুতেই তিনি অত্যন্ত বিনয়ী হয়ে বলেছেন যে তিনি ‘কোনোভাবেই লেখক নন’, কিন্তু এই বইটি ভালভাবে প্রমাণ করে যে তিনি একজন লেখক,কারণ পুরো বই জুড়েই চমৎকার মুনশিয়ানার ছাপ রয়েছে। মজুমদার ভীষণভাবে গর্বিত ছিলেন যে, তিনি মাতৃভূমির স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন এবং অন্যদের কাছে সেই যুদ্ধের গল্প বলার জন্য বেঁচে ছিলেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি ভাষার কবি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক কায়সার হক বইটির একটি চমৎকার মুখবন্ধ লিখেছেন। জনাব হক স্বয়ং একজন মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি বলেছেন,পুরো বই জুড়ে রয়েছে এক শীতল বাস্তবতা,মাঝে মাঝে হাস্যরসের ছোঁয়া দিয়ে খামির।‘ এটা সত্য যে যুদ্ধ মৃত্যু এবং রক্তপাতের বিবরণ যা লেখক পুরো বই জুড়ে দেন তা পাঠকদের হতবাক করে দেয়।
যখন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল কিশোর মজুমদার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মতো অবস্থানে ছিলেন না।কিন্তু তার অদম্য চেতনা এবং মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ভয়ঙ্কর বর্বরতা তাকে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছিল।
মজুমদারের জন্ম হয়েছিল দিনাজপুরে । ১৯৭১ সালে ঢাকায় তিনি তাঁর বোনের বাসায় থাকতেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সম্পর্কে রাজনীতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শোনার জন্য তিনি রেসকোর্সেও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বক্তৃতাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন,
~’এটি ছিল অগ্নিময়,এটি ছিল বজ্রধ্বনি,এবং এটি ছিল সবচেয়ে বড় সিম্ফনির মত অতুলনীয়,এবং তিনি স্ক্রিপ্টের সাহায্য ছাড়াই সব বলেছিলেন। আমাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করার জন্য শক্তি ব্যবহার না করা এবং আমাদের বাকিদেরকে দেশ স্বাধীন করার জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান’। তাই বাঙালিরা এই ঘোষণার সাথে বুঝতে পেরেছিল ‘আমাদের এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।‘ দেশের স্বাধীনতার জন্য তাদের যা যা করা সম্ভব তা দিয়ে প্রস্তুত থাকতে হয়েছিল।
শেখ মুজিবের এই বক্তৃতা দ্বারা অত্যন্ত অনুপ্রাণিত হয়ে মজুমদার প্রতিজ্ঞা করেন যে যুদ্ধে যোগ দিবেন এবং দেশকে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য অবদান রাখবেন।
গেরিলা শিরোনাম সহ বেশ কয়েকটি অধ্যায়ে বিভক্ত। ‘আর্লি অ্যান্ড নট সো আর্লি ইয়ার্স’ শিরোনামের প্রথম অধ্যায় মজুমদারের পরিবার, তার শৈশব, স্কুল ও কলেজ জীবন এবং তার প্রাথমিক জীবনের অন্যান্য মধুর স্মৃতির অধ্যায়।
এই পর্বে তাঁর সেই বইয়ের‘আর্লি অ্যান্ড নট সো আর্লি ইয়ার্স’ অধ্যায়ের কিছু অংশ পাঠকদের জন্য আমি বাঙলা অনুবাদ তুলে ধরছি( অনুবাদে ভুলত্রুটি মার্জনীয়)
আমার বাবা, একজন সরকারি চাকরিজীবী-তিনি ছিলেন পাবনা’র এস ডি ও-এবং পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী সদস্য। তার অকাল মৃত্যু, আমাদের পরিবারকে আর্থিক অস্থিরতার মধ্যে ডুবিয়ে দিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই, তিনি মেজর মতিনের সাথে ঢাকায় একটি রাস্তা পার হচ্ছিলেন, তখন কেউ তাকে জানিয়েছিল যে, তার মা এবং ভাইকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যা করেছে।
‘তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস পরে’ তিনি মাটি চাপা দেয়া সেই দেহাবশেষ উদ্ধার করেন।‘মজুমদার বর্ণনা করেন, "আমি তাদের কঙ্কাল ও খুলি কাফনে মুড়িয়ে স্থানীয় মসজিদ থেকে একজন মৌলভীকে ডেকে পাঠালাম। সেখানে অল্পকিছু মুসুল্লি সমবেত হয়েছিল।
আমরা তাদের লাশের জানাজা দিয়ে একটি কাঁঠাল গাছের নিচে নিজের হাতে কবর খোদাই করে তাদের দাফন করেছিলাম।
*****
হিংস্র শ্বাপদের রাত
শিরোনামের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল-রাত্রির সাথে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের উপর কা-পুরুষোচিত আক্রমণ চালায়।
সমগ্র দেশ স্তম্ভিত হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা যেন নিস্তব্ধ মৃত নগরী হয়ে গেল।
লেখক বর্ণনা করেছেন, ‘আমাদের শরীরগুলো পাথর হয়ে গিয়েছিল-এবং আমাদের কণ্ঠ বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল’।
আমরা শুধু ইশারা আর অঙ্গভঙ্গি দিয়ে আমাদের অসাড় অনুভূতি প্রকাশ করছিলাম।
এমনটা শুধু আমাদের নয়, সে সময় যেন পুরো ঢাকার সব মানুষ নির্বাক হয়ে গিয়েছিল!
মজুমদার পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভগ্নস্তূপ,রক্ত, মানুষের অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ আর কোন মতে মাটি চাপা দেয়া গণকবর দেখলেন! তারা তাদের রক্তাক্ত হস্তশিল্পকে যথাযথভাবে ঢেকে রাখার জন্যও মাথা ঘামায়নি -মৃত মানুষের হাত পা সহ অন্য অন্য বাইরে থেকে দৃশ্যমান হচ্ছিল। এই ভয়াবহ নিঃস্বংশ অবস্থা দেখে তিনি বিহ্বল হতবাক হয়ে গেলেন।
তার ভাষায়, ‘পাকিস্তানিদের প্রতি আমার বিদ্বেষ নতুন উচ্চতা ছুঁয়ে গেল- আমি সেই মুহূর্তে প্রতিশোধের শপথ নিয়েছিলাম।‘
কাল-রাত্রির নৃশংসতার পর থেকে লেখক পাকিস্তানীদের ‘হিংস্র শ্বাপদ বা জানোয়ার’ বলে সম্বোধন করেছেন।
তিনি মনে করেন যে, তারা বাঙালিদের উপর যে অত্যাচার করেছে তা কেবল ‘ভয়ঙ্করতম জঘন্য কর্ম’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।
মজুমদার তার যুদ্ধে অংশগ্রহণ, প্রশিক্ষণ গ্রহণ, গেরিলা হিসেবে যুদ্ধ করা, সামনে থেকে যুদ্ধের সাক্ষী হওয়া, রক্তের পর মৃতদেহ দেখা, যোদ্ধাদের মৃত্যুর কান্না শোনা, জীবন বাঁচানো এবং তৃষ্ণার্ত থাকার গল্পের বিবরণ দেয়। গেরিলার পরবর্তী চারটি অধ্যায়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষুধা ও আঘাত নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন।
তিনি জানতেন যে তাকে যুদ্ধে যোগ দিতে দেওয়া হবে না, তাই তিনি পরিবারের কাছে মিথ্যা বলেছিলেন যে তার নাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তালিকায় আছে এবং যুদ্ধে যোগদান করা তার একমাত্র বিকল্প ছিল। পরিবারের সবাই তাকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বিদায় জানায়। যখন তিনি মুক্তিবাহিনীতে (মুক্তিযোদ্ধা) পৌঁছান, তখন তারা তাকে যুদ্ধ করার জন্য খুব ছোট মনে করত, কিন্তু তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ হতে তার সাহস এবং মানসিক শক্তি দেখিয়েছিলেন। যাত্রা শুরু হয়েছিল শিবিরে। মজুমদার তার প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা, শিবিরে খাবার, আবহাওয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং আরও অনেক কিছু শেয়ার করেন। তিনি যুদ্ধ করেছিলেন সিলেটের তেলিয়াপাড়ায়, একটি চা বাগানের কাছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, সেই অঞ্চলের বেশীরভাগ মানুষ( মুলতঃ পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রিত মুসলমান) পাকিস্তানের উগ্র সমর্থক হওয়ায় তাদের এলাকা থেকে সহযোগীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছিল।
বইটিতে গেরিলা এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধের প্রাণবন্ত বর্ণনা রয়েছে।
মজুমদার সামনে থেকে যুদ্ধ করেছেন এবং তিনি তার সমস্ত বর্ণনা বিভিন্ন অধ্যায়ে ভাগ করেছেন। তিনি এমন ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন যা বর্ণনার বাইরে, তবুও তিনি সেই সময়ের ঘটনাবলি যথাসম্ভব নিখুঁতভাবে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন; যখনই মুক্তিযোদ্ধারা কোন আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধে সফল হয়েছে তখনই তাদের শরীরে উন্মাদনা সৃষ্টিকারী স্লোগান ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে গর্জে উঠেছে। ‘জয় বাঙলা’ ছিল যেন একটা সঞ্জীবনী টনিক ।
লেখক প্রশিক্ষণের অভাব, যোগাযোগের অভাব, অগ্নি-শক্তির অভাব ইত্যাদি সহ কিছু ঘাটতি তুলে ধরেছেন, তবুও, তাদের বিশ্বাস ছিল, নৈতিক শক্তি যা তাদেরকে যুদ্ধের অন্তিম মুহূর্তে নিয়ে গিয়েছিল।
ডিসেম্বরে, মিত্র বাহিনী, ভারতীয় সেনাবাহিনী যোগদান করে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘রোলিং ব্যাক দ্য বিস্ট’ বলে পিছু হটতে শুরু করে।
দ্য গেরিলার শেষ অধ্যায় ইতিহাসের সেই সময়কালকে উল্লেখ করে। ১লা ডিসেম্বরের আগে-বিজয়ের ঠিক আগে; গেরিলারা শত্রুদের সন্ধান করেছিল, কিন্তু,শুধুমাত্র প্রচুর সংখ্যক মৃতদেহ আমরা খুঁজে পেয়েছি কিন্তু জীবিত পাকিস্তানিদের পাইনি’।
শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা এবং মূলত বাংলাদেশের সকল মানুষ জানতে পেরেছিল যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রমনা রেসকোর্সে আত্মসমর্পণ করেছে - বাঙালির জীবনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন; স্বাধীনতা।
মজুমদার লিখেছেন, স্বাধীনতার ঘোষণার পর তাদের কেমন অনুভূতি হয়েছিল; আমরা ছিলাম উচ্ছ্বসিত, উল্লসিত। আমরা শিশুদের মতো হয়ে গিয়েছিলাম, অস্ত্রগুলি যেন আমাদের খেলনা ছিল- আমরা বাতাসে আতসবাজির মত গুলি ছুড়ছিলাম। আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, বুনো উদযাপনে নাচছিলাম। আমাদের দেশ অবশেষে স্বাধীন, স্বাধীন, এবং আমরা জানোয়ারের জোয়াল ফেলে দিয়েছি’ এর থেকে বড় উদযাপন আর কি হতে পারে। দেশজুড়ে এই ধরনের মহান উদযাপন চলছিল - সাধারণ বাঙালির সেদিন চোখেও আনন্দের অশ্রু ছিল।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর সবচেয়ে নৃশংস অত্যাচার করেছিল। তাদের ‘নৃশংসতা ও বর্বরতা সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল’,আর সেজন্যই বাঙালিরা তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলেছিল।
অল্প কিছু মানুষ ছাড়া বাংলাদেশের সকল মানুষ স্বাধীনতা চেয়েছিল এবং তাদের মধ্যে অনেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই ভূমিতে গণহত্যা চালানোর গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতার অধীনে যুদ্ধ করেছিল। মাতৃভূমিকে বাঁচাতে তারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়।
*****
কিন্তু বইটির চূড়ান্ত অধ্যায়ঃ বিজয় ও এর মূল্য
মজুমদারের দ্যা গেরিলা বইয়ের সর্বশেষ এ অধ্যায়টিতে তিনি ক্ষেদ ও ক্ষোভের সাথে বলেছেন যে, কিভাবে অনেক সুযোগসন্ধানী মানুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসাবে উপস্থিত হয়েছিল!
মজুমদার বলেছেন,
"আমাদের বিজয়ের দাবিদারদের কোন অভাব ছিল না। যারা সীমান্ত অতিক্রম করেছিল তারা এখন নিজেদেরকে মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেছে। এই ধরনের লক্ষ লক্ষ 'মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে, যারা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিল তারা ছিল অতি তুচ্ছ সংখ্যালঘু এবং তাদের নিশ্চিতভাবে শীঘ্রই ভুলে যাওয়া হবে’।
এটি ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী আরেকটি ভয়ঙ্কর ছবি! লেখক তার যন্ত্রণা প্রকাশ করে চরম হতাশা নিয়ে করে বলেছেন, ‘আমি দেখেছি অনেক মধু-লোভী মানুষ তাদের কপালে একটি লাল কাপড় বেঁধে নিজেদেরকে তারা 'ক্র্যাক' প্লাটুন, ক্রাকার মুক্তিযোদ্ধা বা অন্য কোন সুবিধা-মত নাম দিয়ে নিজেদেরকে সর্বোচ্চ ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু আমরা যারা সত্যিকারে যুদ্ধ করেছি; সেই যুদ্ধ-ফেরত নিয়মিত সৈন্যরা দীর্ঘ যুদ্ধে অবসাদগ্রস্ত ক্লান্ত, রাতের পর রাত নিদ্রাহীনতায় তারা বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত এবং অধিকাংশই অপুষ্টিতে ভুগছিল যার কারণে স্বভাবতই তাদের চেহারা তুলনামূলক-ভাবে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছিল’।
স্বাধীনতার পর,আশেপাশের অনেক মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করার জন্য প্রচেষ্টা করেছিল, কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জন করে অবশেষে বিশ্রাম নিয়েছিল। তারা রক্তের বিনিময়ে দেশমাতার ঋণ শোধ করেছিল- কোন কিছু লাভের বা পাবার আশায় নয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১১:২১