somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শের শায়রী
অমরত্বের লোভ কখনো আমাকে পায়না। মানব জীবনের নশ্বরতা নিয়েই আমার সুখ। লিখি নিজের জানার আনন্দে, তাতে কেউ যদি পড়ে সেটা অনেক বড় পাওয়া। কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া আর কিছুই নেই।

আমাজন নারী যোদ্ধা মীথ বা বাস্তব কতটুকু?

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ২:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“ওয়ান্ডার ওম্যান” মুভিটা নিশ্চয়ই দেখছেন? সেখানে একজন “আমাজন” নারী রাজকন্যার কথা নিয়ে দারুন এক ছবি। আসলেই কি আমাজন নারী যোদ্ধা বলে কোন জাতি ছিল? যারা শুধু নারী ছিল? আবার নারী যোদ্ধাদের নিয়ে কিভাবে একটা জাতি বা রাষ্ট্র হয়? একি শুধু মীথ না কি এর সাথে সত্যের কোন লেশ মাত্র আছে? জানতে ভীষন মন চায়। সেই অনুসন্ধিৎসা থেকে আজকের এই লেখা।


William Moulton Marston

প্রথমেই আসি আমাজন শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে? কিভাবে এই শব্দটির উৎপত্তি হল? ওয়ান্ডার ওম্যান কমিকসের স্রষ্টা উইলিয়াম মুল্টন মার্সটন দারুন একটি কমিক বাজারে ছেড়ে বাজার মাত করেন কিন্তু তিনি এই ওয়ান্ডার ওম্যানের ঐতিহাসিক বা মিথোলজিক্যাল ব্যাপারে মোটেই ইন্টেরষ্টেড ছিলেন না। এই ব্যাপারটা একটা মীথ হিসাবেই গন্য ছিল যতদিন না সুইস প্রফেসর জোহান জ্যাকব ব্যাকোফেন এব্যাপারে একটা থিসিস প্রকাশ করেন যেখানে তিনি লেখেন আমাজনরা কোন মীথ না এরা সত্যিই ছিল।



যাই হোক আমাজন কথাটির উৎপত্তি নিয়ে কিছুটা মতভেদ বিভিন্ন জায়গায় লক্ষ্য করা যায়, সব থেকে প্রচলিত ধারনা এই যে আমাজন শব্দটি গ্রীকে “আ” মানে “হীন” (নাই, ইংরেজীতে উইদাউট) এবং “ম্যাজোস” মানে “স্তন” দুটোকে এক করলে দাড়ায় “আম্যাজোস” বা “স্তনহীন” অথবা “এক স্তনা”। অথবা “আমা-জোনিয়াস” মানে “কোমরবন্ধ যুক্ত”। আমাজন নারীদের অকুতোভয় যুদ্ধ, সেকালে পুরুষদের মনে এমনই ভীতির উদ্রেক করেছিল যে তারা কল্পনা করছিলো আমাজন নারীরা যুদ্ধে শক্ত কোমড়বন্ধ যুক্ত পোষাক পড়ত আর ঘোড়ার পিঠে থেকে সমান দক্ষতায় তীর ছুড়তে পারত। তীর ছোড়ার সুবিধার্থে তারা নিজেরা নিজেদের ডান স্তন কেটে ফেলত যেন ধনুকের ছিলা টানার সময় স্তন যেন কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরী না করে।



গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডাটাস (খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৪ থেকে ৪২৫/৪১৩) তার “হিষ্টোরিস” বইর (১১০-১১৭ পৃঃ) এই আমাজন নারী এবং স্কাইথিয়ানসদের মাঝে দীর্ঘ বৈঠকের বিবরন দেন, এই স্কাইথিয়ানসদের যুবক যোদ্ধারা এই নারী আমাজন যোদ্ধাদের দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় এক পর্যায়ে তারা আমাজনদের তাদের সাথে থাকার জন্য আমন্ত্রন জানায় এবং তাদেরকে এই বলে নিশ্চিত করে যে তাদের যুদ্ধবৃত্তিতে স্কাইথিয়ানস পুরুষরা কোনরূপ হস্তক্ষেপ করবে না বরঞ্চ তারা মিলে মিশে যুদ্ধ করবে। এক পর্যায়ে আমাজানদের একটি শাখা স্কাইথিয়ানসদের সাথে মিলে যায় এবং এই দুই জাতির মিলনে রাশিয়ার যাযাবর জাতি সারমাথিয়ানদের উদ্ভব হয়। ইতিহাসবিদ নিল এ্যাসারাসনের “দ্যা ব্লাক সী” বইটি পড়ে দেখতে পারেন এব্যাপারে জানতে চাইলে।



সারমাথিয়ানরা ছিল এক যাযাবর যোদ্ধা জাতি, যাদের নারী পুরুষ সবাই সমানভাবে যুদ্ধে পারদর্শী। যুদ্ধের সময় তারা প্রতিপক্ষকে পাহাড়ী এলাকায় টেনে নিত, কারন পাহাড়ী যুদ্ধে এই সারমাথিয়ানরা মারাত্মক দক্ষ ছিল। তাদের বুক থেকে কোমড় পর্যন্ত চেইনমেইল দ্ধারা আবৃত থাকায় তাদের নারী পুরুষ আলাদা করা সম্ভব হত না, এবং যুদ্ধ শেষে সারমাথিয়ানরা তাদের শত্রুর দেহ গুলো পাহাড় থেকে গড়িয়ে নীচে ফেলে দিত যাতে কোন অবস্থাতেই শত্রুরা তাদের দলের মৃতদেহও না পায়। মধ্যযুগে অবশ্য এই সামারথিয়ানরা বড় বড় পাথর দিয়ে নিজেদের ঘর বাড়ী বানাতে শিখে গিয়েছিল যা পরে “গথিক ষ্টাইল” হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।



আবার আপনি যদি “আমাজন” শব্দটির পারসিক মানে খোজেন তবে এর মানে পাবেন “যোদ্ধা”। সব শেষে এই আমাজন শব্দের উৎপত্তি নিয়ে আর একটা ব্যাপার জানাই “আমাজন” শব্দটি এসেছে আর্মেনিয়ান শব্দ থেকে যার মানে “চাঁদের দেবী”। এই চাদের দেবী বলতে আসলে তারা বোঝাত ব্ল্যাক সীর দক্ষিন তীরে বসবাস করা চাদের দেবীর উপাসনা করা মহিলা উপাসনাকারীদের যারা মন্দিরের বাইরে বের হলে হাতে অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে বের হত।



যদিও গ্রীক আমাজন মানে “স্তনহীন” বা এই টাইপের কিছু কিন্তু মজার ব্যাপার জানাই, তাদের বর্ননা অনুযায়ী এই আমাজন নারী যোদ্ধারা তাদের ডান দিকের স্তন কেটে ফেলত কিন্ত প্রাচীন গ্রীক আর্টের কোথাও যেখানে আমাজন নারীর ছবি আঁকা হয়েছে সেখানে তাদের ডান স্তনহীন দেখায় নি। তারা প্রায় সময়ই ঘোড় সওয়ারী হিসাবে হাতে বর্শা, পেছনে তীর ধনুক বহন কারী দেখানো হয়েছে। তবে মাঝে সাঝে হাতে কুড়াল সহ অঙ্কিত হয়েছে।


Hercules and Hippolyte

যদি মিথোলজির দিকে তাকাই তবে প্রথম আমাজনদের দেখতে পাই হারকিউলিকস এর সাথে আমাজনদের রানী হিপোলাইটের কোমড় বন্ধনী চুরি করে আনার মাধ্যমে। আর্গোসের রাজা ইউরেসথিয়াসের নির্দেশে হারকিউলিকসকে যে বারোটি অসাধ্য কাজ করতে হয় তার মাঝে নবম কাজটি ছিল আমাজন রানী হিপোলাইটার কোমরবন্ধনী চুরি করে আনা। যুদ্ধের দেবতা অ্যারিসের কন্যা হিপোলাইটা পিতার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন এই কোমরবন্ধনী, যা শুধুই সাজসজ্জার আনুষঙ্গিক ছিল না, এটি হিপোলাইটার শক্তিবৃদ্ধি করতো। একজন মেয়ের কাছে একটি কোমড়বন্ধ চুড়ি বা ছিনতাই করে আনা হারকিউলিকসের জন্য ডাল ভাত হবার কথা, কিন্তু সময় আসলে দেখা যায় হিপোলাইটের হাত থেকে কোন রকম জীবন নিয়ে হারকিউলিকস পালিয়ে বেচেছে।


Theseus and Antiope | Museum of Classical Archaeology Databases

গ্রীক মিথোলজিতে আমরা আমাজনদের দ্বিতীয় দেখা পাই থেসিউস এবং এ্যান্টিওপের ঘটনায় প্রাচীন গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীতে। গ্রিক নায়কদের উদাহরণ টানতে গিয়ে এবং তাদের বশ্যতা বোঝাতে গিয়ে আমাজন নারীদের প্রসঙ্গ আসতো। আমাজন নারীরা সেখানে ছিলেন সহায়তা, যৌনতা এবং উপদেশ দেয়ার জন্য। তাদের বেশিরভাগকে আবার ছিনিয়ে আনতে হতো অর্থাৎ জয় করতে হতো। যেমন আমাজন রানী অ্যান্টিওপের কথা বলা যায়। অ্যান্টিওপকে অপহরণ করেছিলেন রাজা থেসুস। এবং পরে তাকে স্ত্রী বানাতে বাধ্য করেছিলেন থেসুস। তৃতীয় উল্লেখ্য পাই বেলফোরন এবং আমাজনদের সাক্ষাতে। এই বেলফোরন ও ছিল হারকিউলিকসের মত আর এক অজেয় বীর, তার সাথে একবার এক পর্যায়ে আমাজনদের যুদ্ধ হয় এবং স্বভাবতঃ বেলফোরন বিজয়ী হয়।



এ পর্যায়ে আমাজনদের জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে পরের অংশ বুঝার জন্য। যদিও কোথাও এব্যাপারে সুনির্দিষ্ট উল্লেখ্য নেই তবে ধারনা করা হয় স্পার্টা নগরীর দেবী আর্টেমিসের মন্দিরের এক সেবাদাসী অট্রেরা আমাজনদের সূচনা করে। আমাজনেরা গ্রিক চিরকুমারী দেবী আর্টেমিস আর যুদ্ধদেবতা অ্যারিসের উপাসনা করত। কথিত আছে, অ্যারিসের সহায়তায় অট্রেরার গর্ভে হিপোলাইটা, অ্যান্টিওপি, মেলানিপ্পি আর পেনথেসিলিয়া নামের চার কন্যার জন্ম হয়, যারা পরবর্তীতে আমাজনদের রানী হয়অট্রেরাকে পূর্বদিকের বাতাসের দেবতা ইউরসের কন্যা বলেও অনেকে উল্লেখ করে।



এই বার সব শেষ বা চতুর্থবার উল্লেখ্য পাওয়া যায় আমাজনদের হোমারের ইলিয়াডে। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে হোমারের ইলিয়াড থেকে জানা যায় ভয়ংকর এক যোদ্ধা জাতির কথা, যাদের সবাই ছিল নারী। “আমাজন নারী যোদ্ধাদের এক বিশাল বাহিনী চালনা করছেন রণোন্মত্তা পেনথেসিলিয়া। অর্ধচন্দ্রের মতো ঝকঝকে ঢাল তাঁর হাতে। তাঁর উন্মুক্ত বক্ষের পাশ দিয়ে নেমে গেছে সোনার কোমরবন্ধনী। হাজার সৈন্যের মাঝে তিনি দ্যুতিময়ী। এই কুমারী যোদ্ধা পুরুষের সমান্তরালে দৌড়াতে পারার মতো ক্ষিপ্রগতি ও সাহসিকা” - ইলিয়াড, ৪৯০



হোমারের মতে, তারা ছিল 'পুরুষের সমান', অর্থাৎ যেকোনো পুরুষ যোদ্ধা থেকে তাদের দক্ষতা কিছু কম ছিল না। কোনো পুরুষ একেক যুদ্ধে কোনো আমাজনকে হারাতে পারলে তা নির্যাতন বা দুর্বলের উপর অন্যায় নয়, বরং কৃতিত্ব হিসেবে বিবেচিত হত।



হোমার পরবর্তী কবিরা আমাজনদের ট্রয় নগরীর পক্ষে যুদ্ধ করার কথা বলেন। আর্কটিনোস অফ মিলেটাস এর মতে, গ্রিক বীর অ্যাকিলিস আমাজন রানী পেনথেসিলিয়ার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধের একপর্যায়ে অ্যাকিলিসের হাতে মৃত্যু হয় পেনথিসিলিয়ার। নিঃসাড় দেহ মাটিতে আছড়ে পড়ার পর শিরস্ত্রাণ খুলে গেলে তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ প্রেমে পড়ে যান অ্যাকিলিস। মৃতদেহ ট্রয় নগরীতে ফিরিয়ে দেন তিনি, বারবার অনুরোধ করেন এই অসামান্য প্রতিভাশীল যোদ্ধা যেন সম্মানের সাথে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া লাভ করেন।


গ্রীকদের ধারণা ছিল, উত্তর তুরস্কের আশেপাশে অবস্থিত আমাজনদের দেশ; Source : Greek Mythology Link

পুরুষ বিহীন আমাজনদের প্রজন্ম কিভাবে টিকে ছিল এ নিয়েও আছে এক মজার মিথ এশিয়া মাইনরের উত্তর উপকূলে হ্যালিস নদীর তীরবর্তী ট্র্যাবসন শহর আমাজন অধ্যুষিত বলে প্রচলিত ছিল। বলা হয়ে থাকে, শুরুতে থেমিস্কিরা নগরীতে গারগ্যারিয়ান নামক পুরুষ যোদ্ধা ও আমাজনরা সহাবস্থান করত। পরবর্তীতে আমাজনরা গারগ্যারিয়ানদের থেমিস্কিরা থেকে তাড়িয়ে দিলেও জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার আশংকায় তাদের সাথে বছরে একদিন শারিরীক মিলিত হতে থাকে এই চুক্তিতে যে কন্যাসন্তান আমাজনেরা এবং পুত্রসন্তান গারগ্যারিয়ানরা লালনপালন করবে।



আমাজনদের নিয়ে বিভিন্ন গ্রীক উপখ্যান আর চিত্র আছে কিন্তু মজার ব্যাপার হল উপাখ্যানগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় এই সব নারী যোদ্ধারা জীবন দিয়েছে কিন্তু পিছু হটেনি, আবার গ্রীক চিত্রকলার অন্যান্য পরাজিত শত্রুর মত কোন চিত্র বা স্কালপচারে আমাজনদের পিছু হটতে দেখা যায়নি। এর থেকে বোজা যায় আমজনদের যে গ্রীকরা পরাজিত করছিলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাহিনীতে তা অনেকটা অতিরঞ্জিত।


বর্তমানে আবিস্কৃত ট্রয় নগরী

বর্তমান যুগে আমাজনদের নিয়ে কৌতুহলের অন্ত নেই, আপনাকে এ কথা মনে রাখতে হবে এক সময় মনে করা হত ট্রয় বুজিবা শুধু গল্প উপখ্যানের এক শহর কিন্তু আধুনা প্রত্নতাত্ত্বিকরা ট্রয় নগরীর ধ্বংসাবাশেষ আবিস্কার করার পর এটা অন্তত প্রমানিত হয়েছে, গল্পে যাই থাকুক না কেন ট্রয় বলে এক নগরী ছিল, যেখানে একদা বিশাল জনপদ ছিল।



আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিধরা সামারিটান মন্দির এবং বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ খুড়ে কিছু যোদ্ধা নারীর দেহ পায়, এগুলো মুলতঃ কাজাকস্থানের কাছাকছি এবং সময় হিসাব করে দেখা গেছে তারা গ্রীক ঐতিহাসিক হেরোডেটাসের সমসাময়িক। তবে সবচেয়ে অবাক করার বিষয়গুলো একই স্থানে তিন প্রজন্মের চার জনের দেহাবশেষ, তাদের ব্যবহৃত সরঞ্জাম এবং ওই সময়ের ঐতিহ্য অনুসারে সমাধিতে রাখা জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ জানিয়েছে, প্রথমবারের মতো গবেষকরা একই সমাধিতে বিভিন্ন বয়সের চার জন অ্যামাজন যোদ্ধা নারীর দেহাবশেষ পেলেন। সমাধিটি কাদামাটি এবং ওক গাছের গুঁড়ি তৈরি নির্মিত। চারজনের একজন কিশোরী, বয়স ১২ থেকে ১৩ বছর। বাকিদের বয়স যথাক্রমে ২০ থেকে ২৯, ২৫ থেকে ৩৫ বছর এবং ৪৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে।



শিথিয়ানরা হলো যাযাবর যোদ্ধা জাতি। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ৯০০ অব্দের মধ্যে সাইবেরিয়াজুড়ে তাদের বিচরণ ছিল। হলিউডের ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’ চলচ্চিত্রে গ্যাল গাদতকে যে শিথিয়ান নারী রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে অনেকটা তেমনই ছিলেন অ্যামাজন নারী যোদ্ধরা। পূর্ব ইউরোপ বসবাসরত অন্যান্য যাযাবর উপজাতির মধ্যে অ্যামাজনরাও ছিল।



সমাধি থেকে বেশ কিছু ধাতব জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। গবেষকদের অনুমান, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের এই চারজনকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। তবে প্রচীন সমাধি থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক জিনিস চুরি করার চক্রের কবলে পড়েছিল এ সমাধিক্ষেত্রও। তাদের হাতে সমাধিটিরও একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও এখানে পাওয়া গেছে লোহার তীর ফলা, একটি পাখির আকারের লোহার হুক, ঘোড়ার জিন, জিনের হুক, লোহার চাকু, পশুর হাড়, লাল প্যালেট আঁকা একটি ভাঙা কালো বার্নিশ ফুলদানি। ফুলদানি কিশোরী ও তরুণীর দেহাবশেষের সঙ্গে পাওয়া গেছে। সমাধির অন্য অংশে থাকা দুই নারীর জিনিসপত্র মোটামুটি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে।



কিশোরীটিকে সমাধিস্থ করা হয়েছে ‘অশ্বারোহী’ হিসেবে। ঐতিহ্য অনুসারে তার পায়ের রগ কেটে দেয়া হয়েছিল। তার বাম কাঁধের নিচে একটি ব্রোঞ্জের আয়না ছিল। তার বাম পাশ এবং হাতের সঙ্গে দুটি বর্শা এবং একটি কাচের পুঁতি বসানো ব্রেসলেট গোটানো ছিল। দুটি পাত্র, একটি কালো বার্ণিশ করা ছাঁচযুক্ত থালা ও একটি এক হাতলযুক্ত পানপাত্র তার দুই পায়ের মাঝখানে রাখা ছিল।



সবচেয়ে বয়স্ক নারীর বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন গবেষকরা। কারণ একজন শিথিয়ান নারীর গড় আয়ু হয় ৩০ থেকে ৩৫ বছর। কিন্তু এ নারীর বয়স ৪৫-৫০ বছর। তাকে কৌণিক ঝুড়ির মধ্যে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। শিরস্ত্রাণ, ফুল আঁকা অলঙ্কার পরিহিত ছিলেন। তার গহনাগুলোতে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ স্বর্ণ ছিল। বাকিটা ছিল তামা, রূপা এবং লোহার খাদ। সাধারণত, শিথিয়ান গহনায় স্বর্ণ খুব কম থাকে। তাকে ফ্যাব্রিকের মোড়কযুক্ত লোহার ছুরি এবং একটি বিরল লোহার তীরের ফলাসহ সমাহিত করা হয়।

প্রধান গবেষক ভালেরি গুলিয়েভ বলেন, গত দশকে আমরা তরুণ সশস্ত্র নারীদের প্রায় ১১টি সমাধি আবিষ্কার করেছি। অ্যামাজন যোদ্ধা পুরুষ ও নারীদের আলাদা করে সমাহিত করা হতো।



সবশেষে দাহোমির নারী যোদ্ধাদের নিয়ে দুটো কথা না বললে লেখা অসম্পূর্ন থেকে যায়, ১৮৯০ সালে প্রথম ফ্র্যাঙ্কো-দাহোমিন যুদ্ধে নারী সৈনিকদের অবদান ছিলো চূড়ান্ত। ফরাসি সৈন্যরা যখন ঘুমিয়ে থাকতো তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ নারীরা তাদের শিরচ্ছেদ করতো। ফরাসি স্ট্রিট আর্টিস্ট YZ Yseult ঊনবিংশ শতাব্দিতে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ দাহোমির হিংস্র নারী যোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে নিজস্ব প্রচারণা শুরু করেন। এসব নারী যোদ্ধারা সাধারণত আমাজন নামে উল্লেখিত।



ইউরোপিয়ান রেকর্ড অনুযায়ী কার্যকারীতা ও সাহসের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীদের উচ্চতর হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তাদের ইতিহাস সপ্তদশ শতকের। একটি তত্ত্ব অনুযায়ী তারা হাতি শিকার বাহিনীর অন্তভুক্ত ছিলো। তাদের স্বামীরা যখন অন্য আদিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো তখন তারা নিজেদের দক্ষতা দিয়ে দাহোমি রাজাকে আকৃষ্ট করে। অন্য একটি তত্ত্ব মতে, যেহেতু তারা নারী সেহেতু একমাত্র তারাই রাজার প্রাসাদে প্রবেশের অনুমতি পেতো। যার ফলে তারা রাজার দেহরক্ষীতে রূপান্তরিত হয়।



এ দুটোর যেটাই সত্য হোক, প্রশিক্ষণে কেবল শক্তিশালী-স্বাস্থ্যবান ও সাহসী নারীদের নিয়োগ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের যুদ্ধপাগল হত্যাকারী হিসেবে তৈরি করা হতো যারা দুই শতাব্দি ধরে সমগ্র আফ্রিকায় দাপট চালিয়েছে। তাদের যুদ্ধসামগ্রী হিসেবে শিরস্ত্রাণ ও চাপাতি দেওয়া হতো। ঊনবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে তারা রাজার প্রতি দারুণ অনুগত ও ভীষণ যুদ্ধপ্রিয় হয়ে ওঠে। মাত্র আট বছর বয়স থেকেই বাহিনীতে মেয়েদের নিয়োগ দেওয়া হতো, হাতে তুলে দেওয়া হতো অস্ত্র।



একদিকে সমাজের এক শ্রেণীর নারীরা স্বেচ্ছায় সৈন্যবাহিনীতে আসতে লাগলো, অন্যদিকে বাকি নারীদের স্বামীরা নিজেরাই তাদের স্ত্রীদের বাহিনীতে ভর্তি করতেন এবং নিজেদের বেপরোয়া স্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি বলে অভিযোগ করতো।

প্রশিক্ষণের শুরু থেকেই তাদের শক্তিশালী, নির্মম ব্যথা সহ্য করার অধিকারী হতে শেখানো হতো। লাফ দেওয়া, কাঁটাযুক্ত গাছে চড়ার পাশাপাশি হাঙ্গার গেম নামক একটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। হাঙ্গার গেম হলো দশ দিনের জন্য তাদের জঙ্গলে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। সঙ্গে কেবল অস্ত্র ছাড়া খাবার বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান দেওয়া হতো না। এখানে তাদের প্রমাণ করতে হতো যে তারা পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ শক্তিশালী।

যুদ্ধে পরাজয় হলে যদি রাজা তাদের আশ্রয় না দেন তাই, মৃত্যুদণ্ডই ছিলো তাদের জন্য একমাত্র পথ। দাহোমি নারী যুদ্ধ করবে নয়তো মরবে, পরাজয় বলে কিছু নেই। সেনাবাহিনীতে কর্মরত নারীদের বিয়ে ও সন্তান জন্মদানের অনুমতি ছিলো না। ধরে নেওয়া হতো রাজার সঙ্গে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক রয়েছে। রাজাও তাদের সঙ্গে বাহ্যিক সম্পর্ক ভেঙে ফেলার দৃঢ়তা প্রকাশ করতেন না। যে কারণে রাজা ছাড়া এসব নারীদের স্পর্শ করার দুঃসাহস কেউ করতো না।

রাজার সৈনিক হিসেবে তারা দক্ষতা, শৃঙ্খলা ও নির্মম হতে শিখতো। যদিও তারা হিংস্র ও নির্মম নারী বলে পরিচিত, তবুও আফ্রিকায় নারীদের বর্তমান সম্মানজনক অবস্থানের জন্য তাদের কৃতীত্ব অনেকখানি।


ছবি এবং কৃতজ্ঞতাঃ পোষ্টের বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োজন মত নীল রংয়ের লেখায় লিঙ্ক যোগ করা হয়েছে এবং ছবি অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:০৪
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×