ড্যান ব্রাউনের “ইনফার্নো” পড়ছেন? আমি আবার ড্যান ব্রাউনের মারাত্মক ভক্ত। ড্যান ব্রাউনের সব কয়টি বইই কালেকশানে আছে। ইনফার্নো হল ভাইরাস ছড়ানো নিয়ে ড্যান ব্রাউন ষ্টাইলের এক মহাকাব্য। অনেক আগে পড়ছিলাম, এই করোনা ভাইরাস আসার পর আবারো হাতে নিলাম পড়ার জন্য। এই পোষ্ট সেই ইনফার্নোর টুকরা টাকরা নির্যাস আর বিভিন্ন অন্তর্জাল থেকে নিয়ে তৈরী। কি করব বাসায় বসে তো সময় পাস করতে হবে সেক্ষেত্রে লেখা লেখি আর পড়াশুনা আমার জন্য সব থেকে আনন্দদায়ক ব্যাপার।
আচ্ছা কোয়ারেন্টাইন শব্দটির সাথে আমাদের এখন সবার পরিচয় ঘটছে, কিন্তু এর উৎপত্তি কোথা থেকে জানেন? মধ্যযুগ। ইতালির অন্যতম প্রধান বানিজ্যিক কেন্দ্র ভেনিস। সব দিক দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর সম্পদশালী সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী শহর। বিদেশীদের প্রতি অত্যন্ত বন্ধুশীল এই শহরের বাসিন্দারা। বাস্তবতা হল ইতালির সাথে আমাদের দেশের মানুষের চারিত্রিক অনেক মিল আছে। যাই হোক, প্রানঘাতী প্লেগ বানিজ্যিক জাহাজের মাধ্যমে জীবানু আক্রান্ত ইদুরের মাধ্যমে চীন থেকে ভেনিসে আসে। ততদিন চীনের এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা মারা গেছে সেই প্লেগে। ইউরোপে আসা মাত্র এই রোগের ছোবলে তিনজনের একজন আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কবলে ঢলে পরে। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু কেউই রক্ষা পায়নি সেই ছোবল থেকে।
সে প্লেগের আক্রমনে ভেনিসের অবস্থা এমন হয় যে, লাশ কবর দেবার মত মানুষ পাওয়া যেত না, উপায়ন্ত না দেখে প্লেগে আক্রান্ত মরা মানুষগুলো ভাসিয়ে দেয়া হত ভেনিসের খালে বিলে। কিছু কিছু খাল বিলে এত লাশ জমে গিয়েছিল যে সেখানে গন্ডোলা (ভেনিসে অসংখ্য খাল, বিল আছে সেখানে যে নৌকা গুলো চলে যাতে এখন পর্যটকরা ঘুরে বেড়ায় তাকে “গন্ডোলা” বলে) চালাতে গেলে লগি দিয়ে লাশ সরিয়ে তারপর জায়গা করে এগোতে হত।
শহরকে রক্ষা করার জন্য গির্জায় গির্জায় প্রার্থনা মৃত্যুর মিছিলকে সামলাতে পারছিলো না, এক পর্যায়ে শাসক শ্রেনী বুজতে পারে (যদিও ততদিনে দেরী হয়ে গেছে, এখনকার পরিস্থিতি কি খুব বেশী পরিবর্তিত হয়েছে?) বিদেশী জাহাজে করে প্লেগে আক্রান্ত ইদুরের মাধ্যমে এই রোগ ইতালিতে ঢুকছে। তারা একটা ডিক্রি জারি করে বাইরে থেকে কোন জাহাজ আসলে সরাসরি বন্দরে ঢুকতে পারবে না, বন্দর থেকে কিছুটা দূরে সে জাহাজ নোঙর করা থাকবে এবং চল্লিশ দিন থাকার পর জাহাজ থেকে মাল নামানোর অনুমতি দেয়া হত – ইতালিয় ভাষায় চল্লিশ সংখ্যাটিকে বলে “কোয়ারান্তা” – সেখান থেকে কোয়ারান্টাইন – ইতালিতে কোয়ারান্তা মানে “চল্লিশ” খুবই তিক্ত স্মৃতি। সেই তিক্ত স্মৃতি আবারো পৃথিবী জুড়ে ফিরে আসছে যার নাম কোয়ারান্টাইন।
এই ইনফার্নো বইতেই রহস্যময় একটা জাহাজের নাম আছে “মেন্দাসিয়াম”। মেন্দাসিয়াম হল সুইডোলোগোসের রহস্যময় দেবতা। এই দেবতা পারদর্শী হল মিথ্যাচার, জালিয়াতি আর বানোয়াট কাজকর্মে। বিশ্বাস করুন ইউরোপে এমন কিছু গোপন বেসরকারী সংস্থা আছে যারা টাকার বিনিময়ে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরায়। সেখানে ন্যায় অন্যায় বোধটা অপ্রয়োজনীয়। ক্লায়েন্ট এর চাওয়াটাই সেখানে মুখ্য। এদের কাজের দু একটা উদাহরন দেই। আমেরিকা ইরাক আক্রমন করার আগে সাধারন সেন্টিমেন্ট তাদের দিকে নিয়ে যাবার জন্য বিশাল এক কেমিক্যাল যুদ্ধাস্ত্রর গল্প ফাদে সে এমনই এক গল্প এর সমর্থনে প্রচুর প্রমানও হাজির হয় কিন্তু হাজার মানুষের জীবনহানির পরে যখন আমেরিকা যুদ্ধে জেতে দেখা যায় সব ফকফকা। ইরানে কন্ট্রা কেলেঙ্কারী মনে আছে? এই কাজগুলো করা হয় বেসরকারী এই সব কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে অঢেল টাকার মাধ্যমে। যেখানে পরবর্তী অন্যায়কে জায়েজ করার জন্য পাব্লিকলি একটা ইল্যুশান তৈরী করা হয়। আপাতত মেন্দাসিয়ামের কাহিনী এটুকুই থাকুক।
এইবার আসি জোবরিষ্ট ভাইরাসের কাহিনী। ইনফার্নোর পুরা কাহিনীই এই জোবরিষ্ট ভাইরাসকে নিয়ে। বারট্রান্ড জোবরিষ্ট নামক একজন জিনতত্ত্ব বিদ একটা পেপার লেখে তাতে সে হিসাব করে দেখায় মানবজাতি বিলুপ্তির একেবারে দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে আছে, পৃথিবীর জনসংখ্যা যদি কোন দৈব দুর্বিপাকে দ্রুত এবং ব্যাপকহারে হ্রাস না পায় তবে আমাদের প্রজাতি আগামী একশত বছরও টিকবে না। দুনিয়ার ডাক্তারদের উচিত প্রাকটিস বন্ধ করে দেয়া কারন মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেলে সেটা মানব জাতির জন্য ভয়াবহ পরিনতি বয়ে আনবে।
যাই হোক এই ইউরোপের ব্লাক ডেথের পর এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গেলে প্রকৃতি মানুষ্য প্রজাতির অযাচিত অংশ কমিয়ে আনে এবং রেনেসার পথ তৈরী করে দেয়, বারট্রান্ড জোবরিষ্ট এটা হিসাব করে দেখিয়েছিল ইউরোপে তিন জনের একজন মারা যাওয়ার যে রেশিও সেটা একেবারে যথার্থ একটা অনুপাত। বর্তমানে যে হারে মানুষ বাড়ছে তাতে সে এমন একটা ভাইরাস তৈরী করে যাতে মানুষ মারা যাবে না শুধু পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ তাদের প্রজনন ক্ষমতা হারাবে এবং এক প্রজন্ম পরই যথার্থ মনুষ্য প্রজাতি পৃথিবীতে থাকবে যারা নতুন পৃথিবী গড়বে। এই ভাইরাসকে ঠেকানোর জন্য শুরু হয় ট্রান্সহিউম্যানিষ্ট গ্রুপ বনাম রবার্ট ল্যাংডনের এক ক্লাসিক্যাল যুদ্ধ যা ইনফার্নো উপন্যাসের মুল উপজীব্য।
এখন চলুন দেখি ইনফার্নো কি? “ম্যাপ অভ হেল” নামেই যার পরিচয়। নরকের মানচিত্র। দান্তের ডিভাইন কমেডি যারা পড়ছেন তারা জানেন এখানে নরকের বর্ননা কত ভয়াবহভাবে দেয়া হয়েছে। মুলতঃ দান্তের এই লেখা প্রকাশ হবার পর পরই খৃষ্টান সম্প্রদায়ের মাঝে ওই যুগে ব্যাপকভাবে চার্চে যাবার আকুলতা দেখা যায়। অনেকের ই ভুল ধারনা আছে “ডিভাইন কমেডি” র ব্যাপারে। অনেকে ভাবেন যেহেতু এখানে কমেডি শব্দটা আছে এটা বোধ হয় স্যাটায়ার বা মজার কোন বই। আসলে এটা সম্পূর্ন ভুল ধারনা। মধ্যযুগে ইটালিয়ান সাহিত্য দুই ধারায় বিভক্ত ছিল ট্র্যাজেডি এবং কমেডি। ট্র্যাজেডি টাইপের লেখানি ছিল উচ্চ মার্গীয় আর লেখা হত ফর্ম্যাল ভাবে আর কমেডি প্রতিনিধিত্ব করত তৎকালীন পরিভাষায় নিম্ন মানের সাহিত্যকে আর লেখা হত কথ্য ভাষায়। অনেক টা আমাদের “আলালের ঘরের দুলাল” এর মত।
ডিভাইন কমেডির লেখক দান্তে অলিঘিয়েরি। এখন কার ইতালি তখন বিভিন্ন ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ছিল। দান্তে ফ্লোরেন্স এ জন্ম গ্রহন করেন ১২৬৫ সালে আর মারা যান ১৩২১ সালে। বিশ্ব সাহিত্যর অন্যতম অসাধারন এই লেখাটা তিন ভাগে বিভক্ত, ইনফার্নো, পারগেতোরিও আর পারদিসো। এটা ১৪২৩৩ লাইনের একটা মহাকাব্য। আসলে এই ডিভাইন কমেডির আগে ধর্মের নরকের বর্ননা এত ডিটেইলস আর কারো লেখায় আসে নি। রাতারাতি দান্তের নরক মানুষের কল্পনাকে বাস্তবতায় রূপ দেয়।
ধর্মীয় বই ছাড়া আর কোন বই শিল্পকলা, সাহিত্য আর সঙ্গীতের ওপর এত বেশী প্রভাব বিস্তার করতে পারে নাই। এটি প্রকাশ পাবার পর গত সাতটি শতাব্দী যেভাবে শিল্প সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে আর কোন লেখা সম্ভবতঃ এত প্রভাবিত করতে পারে নি। লংফেলো, চসার, মার্ক্স, বালজাক, বোর্হেস এমনকি বেশ কয়েকজন পোপ ও এটাকে ভিত্তি ধরে নিয়ে লেখা লেখি করেন।
মন্তেভারদি, চায়কোভকস্কি, লিসজিৎ, ওয়াগনার, পুচ্চিনি সৃষ্টি করে গেছেন মহান কিছু সঙ্গীত। আধুনিক অনেক ভিডিও গেমস এই দান্তের ডিভাইন কমেডির নরকের বর্ননায় অনুপ্রানিত। সিষ্টিন চ্যাপেলের স্রষ্টা মাইকেল এ্যাঞ্জেলো ও কিন্তু এই দান্তের ডিভাইন কমেডি দ্ধারা প্রভাবিত ছিলেন। সিষ্টিন চ্যাপেলের বেদীর ওপর এ্যাঞ্জেলো যে ছবি একেছেন তাও ইনফার্নোর তৃতীয় ক্যান্টো দ্ধারা অনুপ্রানিত হয়ে।
চিত্র শিল্পী বত্তিচেল্লী। সান্দ্রো বত্তিচেল্লী। রেনেসার কেন্দ্র বিন্দু ফ্লোরেন্স এ বত্তিচেল্লীর জন্ম ১৪৪৫ সালে। অসংখ্য জগৎ বিখ্যাত ছবির স্রষ্টা। তবে সমালোচকদের মতে তার সেরা কাজ লা মাপ্পা দেল ইনফার্নো বা ম্যাপ অভ হেল। দান্তের বিভীষিকাময় নরকের ছবি ভুগর্ভস্থ ফানেলের আকারে একেছেন বত্তিচেল্লি। আগুন, সালফার, নর্দমা, দানবে পরিপূর্ন একটি ফানেল যার একদম নীচে প্রানকেন্দ্রে শয়তান নিজে। ভয়ঙ্কর তিন মাথা বিশিষ্ট লুসিফার তার তিনটি মুখ দিয়ে তিন জন মানুষকে খাচ্ছে।
পুরা ছবিটা নয়টি স্তরে বিভক্ত। পাপীদের পাপের ভয়াবহতা অনুসারে এক এক দল এক এক স্তরে ঠাই পেয়েছে। একবারে উপরে কামুক দের জন্য। সেখানে দেখা যায় এক নারকীয় ঝড় তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মুলতঃ নিজেদের রিপু নিয়ন্ত্রন রাখার ব্যার্থতার প্রতীক হিসাবে এই ঝড়। তার ঠিক নীচেই পেটুকরা যাদের দেখানো মলমুত্রে নর্দমায় মুখ ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। অতিরিক্ত খাবার গ্রহনের শাস্তি। ভুলে যাবেন না আমরা মধ্যযুগের মানসিকতা নিয়ে আলাপ করছি। এর নীচে ধর্মদ্রোহীরা। এরপর আছে ঘুষখোররা। আছে বদরাগীদের জন্য আলাদা স্তর। ফ্রড, বিশ্বাসঘাতকদের জন্য ভিন্ন স্তর। সর্বশেষে, যে মানুষটা দান্তের ডিভাইন কমিডি আর বত্তিচেল্লীর চিত্র দ্ধারা অনুপ্রানিত হয়ে বিশ্ব সাহিত্য কে নাড়া দিয়ে গেলেন তিনি আর কেউ না দ্যা দ্যা ভিঞ্চি কোড এর লেখক ড্যান ব্রাউন তার “ইনফার্নো” বইর মাধ্যমে। আমার এখানকার অধিকাংশ তথ্য উনার বই অবলম্বনে। ড্যান ব্রাউন মানেই নিঃশ্বাস আটকে পড়া শুরু করা।
জানি না কো ইন্সিডেন্স নাকি ড্যান ব্রাউনের “ইনফার্নো” নিয়ে ছবি হয়েছে ২০১৬ সালে আর তাতে অভিনয় করছেন টম হ্যাঙ্কস যিনি কিনা করোনা ভাইরাসে ইনফেক্টেড হয় সবে মাত্র আজকে আইসোলেশান থেকে মুক্তি পেয়েছেন। ছবিটা দেখতে চান? লিঙ্ক (দেখুন Inferno ) তবে আমি কিন্তু বই পড়ার সমর্থন দেব, ড্যান ব্রাউনের সিনেমাগুলোর থেকে বই পড়ায় হাজার গুন বেশি উত্তেজনা। কেন যেন ড্যান ব্রাউনের বই সিনেমায় ঠিক ভাবে ফুটে ওঠে না। যেমনটা হয় নাই তার সব থেকে বিখ্যাত বই দ্যা দ্যা ভিঞ্চি কোড এ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০২০ রাত ১০:২৭