somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খোজাঃ পুরুষদের অসহায় হাহাকারের ইতিহাস

২৬ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



উইলবার স্মিথের রিভার গড, দ্যা কোয়েষ্ট, দ্যা সেভেন স্ক্রৌল, ডেজার্ট গড এই বইগুলো যারা পড়ছেন তারা জানেন প্রাচীন মিশরের পটভুমিতে কি এক অসাধারন মহাকাব্যিক উপন্যাস রচনা করছেন। শুধু অসাধারন বললেও কম বলা হয়, নিশ্চিত পড়তে পড়তে হারিয়ে যাবেন প্রাচীন মিশরে। বাংলায়ও এই বইগুলোর অনুবাদ করা হয়েছে, সেগুলোও দারুন। যারা পড়ছেন তারা জানেন এই বইগুলোর আবর্তিত হয়েছে এক প্রাচীন মিশরীয় খোজা ক্রীতদাস টাইটাকে কেন্দ্র করে।

টাইটা একজন খোজা ক্রীতদাস। যাকে ছোটকালে মিশরের বিকৃত রুচির উজির ইনটেপের মনোরঞ্জনের জন্য কিনে আনা হয়, এক পর্যায়ে কিশোর বয়সে টাইটা উজিরের এক দাসীর প্রেমে পরে, রাগে অন্ধ হয়ে উজির ইনটেপ টাইটাকে খোজা বানিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে এই টাইটার ওপর ভার পড়ে উজিরের প্রিয় মেয়ে লসট্রিসকে মানুষ করার। যাই হোক এই খোজা টাইটা একাধারে ছিল, কবি, চিকিৎসক, সেনা প্রধান, ওরাকল এবং সর্বোপরি রানী লসট্রিসের প্রেমিক। তবে এই প্রেমও স্বাভাবিক প্রেম ছিল না কারন টাইটা ছিল খোজা। স্মিথের ওই সব মহাকাব্যিক উপন্যাস নিয়ে আলোচনার জন্য এই পোষ্ট না, আজকে লিখতে বসেছি খোজাদের নিয়ে। ইংরেজীতে যাদের বলে “ইউনাখ”।


চীনা খোজা

খোজা বা ইউনাখ [Eunuch] শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ [Eunoukhos] থেকে যার অর্থ হচ্ছে শয়নকক্ষের পাহারাদার। গ্রীক শব্দ Eune অর্থ বিছানা এবং Ekhein অর্থ হচ্ছে পাহারা দেয়া। ঠিক একইরকমভাবে ল্যাটিন ভাষায় স্প্যাডো, ক্যাস্ট্রাটাস শব্দগুলোর মানেও খোজা। বাংলায় আমরা ইউনাখদের বলি ‘খোজা’। খোজা শব্দটি উর্দু, পুরো শব্দটি হল খোজা সারাহ। তবে ইউনাখ কিংবা খোজাকৃত পরুষরা কেবল মধ্যপ্রাচ্যে ছিল তা নয়। প্রাচীন চীনের অভিজাত সমাজেও এদের বিশেষ ভূমিকায় দেখা গেছে। চীনে শিশ্নচ্ছেদ (castration) বা ক্যাস্ট্রেশন ছিল একাধারে শাস্তি এবং ইউনাখ করার অন্যতম পদ্ধতি। ষোড়শ সপ্তদশ শতকে চীনে সম্রাট কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত ইউনাখের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০,০০০!

খোজাকরন ইতিহাস খুজতে গেলে দেখা যায়, আর্কিওলজিষ্টরা খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫০ বছর আগে দক্ষিন আনাতোলিয়ার ক্যাথালৌক নামক শহরে সিবেল নামক দেবীর সামনে খোজাদের প্রার্থনার প্রমান খুজে পায়। আর এক ইতিহাসে খোজাদের আবির্ভাব হয়েছিলো মেসোপটেমিয়ায়। খ্রিস্টপূর্ব ৮১১ থেকে ৮০৮ অব্দের আসিরিয়ার রাণীমাতা সামুরামাত নিজ হাতে তার এক ক্রীতদাসকে খোজা করেছিলেন। একটি উপকথায় তাকে সেমিরা মিস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসিরিয়ার রাণী মাতা কেন তার ক্রীতদাসকে খোজা করেছিলেন ইতিহাসে তার বিবরণ না থাকলেও অনেক গবেষক মনে করেন রাণীর বিকৃত যৌন লালসা নিবৃত্ত করার জন্য হতভাগ্য ক্রীতদাসকে বিকলাঙ্গ করা হয়েছিলো

হেরোডেটাস লিখছেন পারসিকরা আইওনিয়ানদের ধরে তাদের পুরুষত্ব কেড়ে নিতে লাগল, তারপর সুন্দরী মেয়েদের মত সাজিয়ে এদের নিয়ে চলল রাজার দরবারে। ঐতিহাসিক হেরোডোটাস-এর বর্ণনায় এই ধরনের একটি কাহিনী থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে যায়। হেরোডোটাস বলেছেন, সম্রাট জারেক্সেস-এর প্রিয় খোজা ছিলো হারমোটিমাস। বাল্যকালে তাকে অপহরণ করে দাস ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। এরপর দাস ব্যবসায়ীরা ভাল দাম পেয়ে তাকে এক ধনাট্য ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়। ঐ ব্যাবসায়ীর নাম ছিলো পানিওনিয়াস। সে ছিলো খোজাকরণে দক্ষ উস্তাদ। পানিওনিয়াস বালক হারমোটিমাসকে খোজা করে বাজারে নিয়ে আসে- এর পর আরেক ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেয়। এইভাবে হাত বদল হতে হতে হারমোটিমাস একদিন জারেক্সেস-এর দরবারে এসে পৌঁছে যায় এর পরের ইতিহাস- হারমোটিমাসের ভাগ্য বদলের ইতিহাস। ক্রমে ক্রমে সে সম্রাটের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে এবং সম্রাট তাকে নিজের অনুচর হিসেবে গ্রহণ করে নেন।

হারমোটিমাস হয়ে উঠে প্রভূত ক্ষমতার মালিক। সে স্বাধীনভাবে যে কোনো জায়গায় যেতে পারে-যখন যা ইচ্ছা করতে পারে। একদিন ঘটনাচক্রে সেই ব্যবসায়ীর সাথে তার দেখা হয়ে গেলো- যে নিজ হাতে তাকে খোজা করেছিলো। হারমোটিমাস ব্যবসায়ীকে দেখেই চিনতে পারলো- তার মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠলো- ব্যবসায়ীকে তার মনোভাব বুঝতে না দিয়ে বিনীতভাবে বললো- আপনি যদি ইচ্ছা করেন আমাদের সার্ভিসে চলে আসুন, এখানে আপনার যে মাল দৌলত আছে এর চেয়ে দ্বিগুণ হবে আপনার ধনভান্ডার। মান ইজ্জত শান শওকত বেড়ে যাবে, সুখে থাকবেন। পানিওনিয়াস রাজি হয়ে গেলেন। সে ঘূনাক্ষরে জানতে পারেনি যে তাকে সোনালী স্বপ্ন দেখাচ্ছে- সেই হবে তার যমদূত। ব্যবসায়ী লোভে পড়ে হারমোটিমাসের ফাঁদে পা দিলো। এবার প্রতিশোধের পালা, সার্ভিসে অন্যতম প্রভাবশালী খোজা হারমোটিমাস। সবাই তার কথা শোনে তাকে মান্য করে। পানিওনিয়াসের মুখোমুখি হয়ে একদিন হারমোটিমাস জানতে চাইলো “তোমার কি মনে পড়ে সেই বালকটিকে, যাকে নিজ হাতে খোজা করে বাজারে বেঁচে দিয়েছিলে? নিজ হাতে একজন বালকের সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছিলে?

পানিওনিয়াস বিস্ময় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।

-হ্যা, আমিই সেই বালক, ঐ দিন আমার কিছুই করার ছিলো না, কিন্তু আজ আমি যা আদেশ করবো তাই তোমাকে করতে হবে।

পানিওনিয়াস বললো- “আমাকে কি করতে হবে?”

“আমার আদেশ নিজ হাতে তোমার পুত্রদের খোজা করতে হবে।”

পানিওনিয়াসের চার পুত্র ছিলো। বিনাবাক্য ব্যয়ে সে নিজ পুত্রদের সে খোজা করলো।

হারমোটিমাস ফিরে এলো রাজ দরবারে- আবার কিছুদিন পর সেই ব্যবসায়ীর বাসভবনে গিয়ে হাজির হয়ে ঐ চার পুত্রদের জানালো- “এবার তোমাদের পিতাকে খোজা করতে হবে।”

পুত্ররা হতবাক- কিন্তু আদেশ অমান্য করার উপায় নেই। একটু এদিক ওদিক করলেই গর্দান যাবে। চারপুত্র মিলে পিতাকে ধরে খোজা করে দিলো। খোজার কারিগর এবার নিজেই খোজা হলো।

এভাবেই একজন বালক বয়সে পুরুষত্ব হারানো খোজা, পরবর্তী সময় প্রতিশোধ নিয়েছিলো।


খ্রিষ্টান ধর্মীয় খোজা

খোজা করনের বীভৎস রূপটি সর্বোচ্চতা লাভ করে তুর্কী সুলতানদের আমলে তবে ইতিহাস ঘটালে দেখা যায় এই নির্মম প্রথার প্রচলন অনেক প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত ছিল নানাবিধ ধর্মীয় কারনে। ম্যাথুর গসপেলে দেখা যায় Gospel of Matthew 19:12, which says: "For there are some eunuchs, which were so born from their mother's womb: And there are some eunuchs, which were made eunuchs of men: And there be eunuchs, which have made themselves eunuchs for the kingdom of heaven's sake. He that is able to receive it, let him receive it" (King James Version). মানে (‘একদল পুরুষত্বহীন মানুষ আছে যারা মাতৃগর্ভ থেকেই অসম্পূর্ণ অবস্থাতে ভূমিষ্ট হয়েছে। আর একদল আছে যাদের অন্য মানুষ খোঁজা করেছে। তৃতীয় দলের খোজা যারা তারা স্বর্গের কামনায় স্বেচ্ছায় পুরুষত্বহীন হয়েছে।)

খ্রিস্টানদের মধ্যে স্বর্গ কামনায় শুধু খোজাত্ব বরণ করতো তা কিন্তু নয়- গির্জায় প্রার্থনা সংগীত গাওয়ার জন্য খোজাদের কদর করা হতো। সিসটান চ্যাপেলে প্রার্থনা সংগীত গাওয়ার জন্য স্বয়ং পোপ তাদের আহ্বান করতেন। খোজাদের আহ্বান করার পিছনে যুক্তি ছিলো, খোজাদের কণ্ঠস্বর সমান তেজী, সমান গভীর এবং সমান নিখাদ। খ্রিস্ট সম্প্রদায় এই সংগীত আগ্রহভরে শ্রবণ করতো, তাদের বিশ্বাস ছিলো ঈশ্বরকে মুগ্ধ করার জন্য খোজা কণ্ঠের সংগীত সব থেকে ভালো এদের কে “কাসরাতি” বলা হয়। এই ধারণা থেকে ইতালীর অনেক বিখ্যাত গায়ক স্বেচ্ছায় খোজা হয়ে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে নিকোলিনি গ্রিমলডি, সেনেসিনো, ফারিনেসিসহ অনেক গায়ক ছিলেন যারা শুধু চ্যাপেলে নয়- নাবলিক গ্লেমেও সংগীত পরিবেশন করতেন।


তুর্কী খোজা

খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি বাইজান্টাইন শাষকদের দেখা দেখি তুর্কিরা খুজে পেল খোজা নামক এক নতুন প্রানী (!)। ইতিহাসে তাদের তখন প্রচন্ড গৌরবের কাল, চারিদিক দিয়ে তাদের বিজয় নিশান উড়ছে, বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, গ্রিস, এশিয়া মাইনর, সিরিয়া, মিশর থেকে তখন আসছে ঝাকে ঝাকে বন্দী। মহান সুলতান প্রথম মাহমুদ, এবং দ্বিতীয় মুরাদ এদের মাঝ থেকে কিছু খোজা নিযুক্ত করলেন প্রাসাদের বিভিন্ন অংশের প্রহরী হিসাবে। এরা শেতাঙ্গ খোজা। তুরস্কে তাদের নাম ছিল “কাপু আগাসি”। এদের প্রধানকে বলা হত “কাপি আগা”। ইনি ছিলেন প্রাসাদের রক্ষী বাহিনীর শীর্ষে। প্রচন্ড ক্ষমতার অধিকারী ছিল এই কাপি আগা কোন কোন ক্ষেত্রে সুলতানের উজিরের থেকেও বেশী। দ্বিতীয় প্রধান শেতাঙ্গ খোজাকে বলা হত “হাজিনেদার বাসি” যার অধীনে থাকত রাজকোষ, তৃতীয় প্রধানকে বলা হত “কিলারজী বাসি” যার কাজ ছিল সম্রাটের রান্নাঘরের খাদ্য নিয়ন্ত্রন করা থেকে খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এভাবে এক সময় অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ন পদে নিয়োগ পায় খোজারা।

শ্বেতাঙ্গ খোজাদের এই একচেটিয়া অধিকারে এক সময় ভাটা পড়ে যখন দেখা যায় এদের থেকে কৃষ্ণাঙ্গ খোজারা অধিক সবল, এবং বিশ্বস্ত। ক্রমে তুরস্কের কৃষ্ণাঙ্গ দাসের বাজার চাঙ্গা রাখতে নীল নদের তীর ভুমি শুন্য করে পুরুষদের ধরে আনা শুরু হল। এই সব দাসের মাঝে সব থেকে মুল্যবান দাস ছিল খোজারা। হারেম যদি কান্নার ইতিবৃত্তি হয় তবে খোজারা সেখানে কান্নার তীব্র আর্তনাদ। হারেমের সুন্দরীদের কান্নার ইতিবৃত্তি নিয়ে অসংখ্য গল্প, গাঁথা, বই, গবেষনা হয়েছে সে অনুযায়ী হারেমের আর্তনাদ খোজাদের সুতীব্র আর্তনাদ নিয়ে প্রায় কিছুই লেখা হয় নি, কারন খোজারা ছিল পুরুষ। নারীদের কান্না দেখা যায় কিন্তু জোর করে পৌরষত্ব নষ্ট করে দেয়া পুরুষ গুলোর বোবা আর্তনাদের খবর কোন কালেই খুব একটা খবর হয় নি।


মোগল হেরেমে খোজা

১২৯০ সালের দিকে বিশ্ব বিখ্যাত পর্যটক মার্কোপোলো তৎকালীন বাংলা প্রদেশ সফর করেন। তার ভ্রমন কাহিনী থেকে জানা যায় বাংলা মোগল অধিকৃত হওয়ার আগেই এখানে খোজা ব্যবসায়ের রমরমা বাজার গড়ে ওঠে। প্রথম দিকে খোজাদের পুরোটাই আসতো যুদ্ধবন্দিদের শিবির থেকে। মার্কোপোলো উল্লেখ করেছেন “to purchage which the merchants from varius parts of India resort thither. They likewise make purchases of eunuchs, of whom there are numbers in the country, as slaves; for all the prisoners taken in war are presently emasculated; and as every prince and person of rank is desirous of having them for the custody of their women,the merchants obtain a large profit by carrying them to their kingdom, and there disposing of them. যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুদ্ধ শিবির থেকে মানুষের আমদানিও বন্ধ হয়ে যায়। আগে শুধু সুলতানরাই খোজা রাখলেও এ আমলে উজিরদের সাথে সাথে তৈরি হয় নতুন নতুন আমির ও ওমরাহ্‌। তারাও অনেকটা আভিজাত্যের প্রমাণ দিতে খোজা কেনা শুরু করে। এর ফলে বাংলায় খোজা বাণিজ্যের জনপ্রিয় বাজার গড়ে ওঠে। কলকাতার খোজা বাজারে আফ্রিকান হাবশি এবং দেশীয় খোজা বেচাকেনা হতো।

দেশি এই খোজাদের প্রধান সরবরাহক ছিল সিলেট এবং ঘোড়াঘাট। প্রাচীন তথ্য উপাত্তে সিলেটের নামটিই বিশেষভাবে এসেছে। স্যার যদুনাথ সরকার সম্পাদিত The India of Aurangzib (topography, statistics and roads গ্রন্থে বলা হয়েছে “In this province (Sylhet) they make many Eunuchs” আবুল ফজলের বিখ্যাত ‘আইন-ই-আকবরীতে বলা হয়েছে ‘In the Sarkar of Sylhet there are nine ranges of hills. It furnishes many Eunuchs. স্যার এডওয়ার্ড এলভার্ট গেইট প্রনীত ‘A History of Assam’ গ্রন্থে বলা হয়েছে “ In the early times the Sylhet district supply India with eunuchs but Jahangir issued an edict forbidding it’s inhabitants to castrate boys. খোজা সরবরাহের একচেটিয়া বাণিজ্য করত সিলেট ও ঘোড়াঘাটের সরকারেরা। প্রাচীন কাল থেকেই সিলেট একটি বাণিজ্য বন্দর হিসেবে সুপরিচিত ছিল।

তুজুক ই জাহাঙ্গীরী থেকে জানা যায় মুসলমান আমলের বিস্তৃত সময়ে খোজাকরণ বা খোজা ব্যবসা বৈধ বলেই গণ্য ছিল। জাহাঙ্গীর প্রথমবারের মতো এর অমানবিক দিক বিবেচনা করে এ ঘৃণ্য প্রথা ফরমান জারি করে নিষিদ্ধ করে দেন। তারপরো বিভিন্ন সময় আবার বিভিন্ন শাসকদের সুবিধার্থে এই প্রথা নির্মম চালু হয়।

১৮৩৬ সালে সালে মুর্শিদাবাদে প্রাসাদে অনুসন্ধানে দেখা যায় সেখানে খোজা আছে ৬৩ জন, নাসিরুদ্দীনের আমলে (১৮৩৬-৩৭) লক্ষ্মৌর বেগম মহলে খোজা ছিল ১৫১ জন। হয়ত সংখ্যাটা বড় কিছু না, কিন্তু এর ভয়াবহতা বোঝা যাবে ১৯৫৬ সালে কার্ডিন্যাল ল্যাভিগেরাই মরক্কো থেকে ইউ এন ও সদর দপ্তরে জানিয়েছিলেন সুলতানের হারেমের জন্য সরকারী হাসপাতালে সম্প্রতি ৩০ টি শিশুকে অস্ত্রপচার করা হয়েছে তাদের কেউ বাঁচে নি। ইরাকের এক চিকিৎসক জানিয়েছেন সৌদী আরবের হাসপাতালে কুড়িটি শিশুকে খোজা করার জন্য অপারেশান করা হয়েছে বেঁচে ছিল মাত্র দুই জন। সেকালে পশ্চিম এশিয়া বা আফ্রিকায় আজকের মত হাসপাতাল ছিল না, এই হিসাব দিয়ে একটা আনুপাতিক হিসাব বের করতে পারেন একজন খোজা করতে কি পরিমান শিশুকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হত। তাও এই হিসাব বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে। মধ্যযুগের হিসাবটা নিজে নিজে এক বার কল্পনা করুন।


তিউনিশিয়ায় হারেমের পাহারারত অস্ত্রধারী খোজা। ছবিটি ১৯৩১ সালে তোলা।

আবিসিনিয়ার কুখ্যাত রাজা জন এর আমলে হিকস পাশার ইঙ্গ মিশরীয় সৈন্যবাহিনী থেকে একশ সুদানী সৈন্যকে ধরে খোজা বানিয়ে পাঠানো হয়েছিল খার্তুমে। উপহারের সাথে ছোট্ট একটা বার্তা মহামান্য সম্রাট যদি কিছু মনে না করে তবে এই সামান্য ডালিটি গ্রহন করতে পারেন। উপহারের ডালিটি যখন তার নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌছে তখন একশ খোজার মাঝে একজনও জীবিত ছিল না। অতএব প্রতিটা খোজা শুধু জীবন্ত হাহাকার না, প্রতিটা খোজার পেছনে অসংখ্য বিলাপ।


চীনা পদ্ধতিতে শিশুদের খোজা করন

খোজা করনের সাথে চৈনিক সাংস্কৃতির সম্পর্কও ছিল ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। প্রাচীন চৈনিক সাম্রাজ্যে খোজাকরণের কাজটি করা হতো মূল প্রাসাদের বাইরে বিচ্ছিন্ন কোনো স্থানে। রাজ প্রাসাদের চারদিকে দেয়ালঘেরা সীমানা থাকে। এই সীমানার কোনো একটি স্থানে ব্যবহার করা হয় না এমন একটি পাহারা কক্ষ থাকে, যা দরকার পড়ে না বলে ব্যবহার করা হয় না। এই ধরনের পরিত্যক্ত ঘরকে ব্যবহার করা হতো খোজাকরণের অপারেশন কক্ষ হিসেবে।

প্রথমে ব্যক্তিটিকে ঐ কক্ষে নিয়ে একটি কাঠের পাটাতনে শুইয়ে দেয়া হতো। তারপর হালকা গরম পানি দিয়ে যৌনাঙ্গ ও যৌনাঙ্গের আশেপাশের স্থান ধুয়ে নেয়া হতো। এরপর অবশ করতে পারে এমন উপাদানের প্রলেপ দিয়ে যৌনাঙ্গকে অবশ করে ফেলা হতো। তখনকার সময়ে অবশকারী হিসেবে প্রচণ্ড ঝালযুক্ত মরিচ বাটা ব্যবহার করা হতো। যিনি খোজা করবেন তিনি হচ্ছেন অপারেশনের প্রধান। প্রধানের পাশাপাশি কয়েকজন সহকারী থাকতো। অবশ করার পর সহযোগীরা মিলে দেহটিকে কাঠের পাটাতনের সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেলতো। তারপর দুইজন সহকারী দুই পা ফাঁকা করে ধরে রাখতো যেন যৌনাঙ্গ কাটার সময় পায়ের দ্বারা কোনো অসুবিধা না হয়। দুইজন তো দুই পায়ে শক্ত করে ধরে রাখতোই, তার উপর আরো দুইজন কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে একজন হাত দুটি বেঁধে চেপে ধরে রাখতো।

কর্তক ব্যক্তি সুবিধা করে দুই পায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শুক্রথলী ও পুরুষাঙ্গ হাতের মুষ্টির ভেতর ধরতো। যৌনাঙ্গ মুষ্টির ভেতরে রেখে চোখের পলকেই ধারালো ছুরি দিয়ে একসাথে কেটে ফেলা হতো মুষ্টির ভেতরে থাকা অণ্ডকোষ ও পুরুষাঙ্গ। এই অবস্থায় প্রচুর রক্তপাত হতো। এই ধাপ শেষ করার পর থাকে বড় চ্যালেঞ্জটি। রোগীটিকে এই ধাক্কা কাটিয়ে তুলে বাঁচানো যাবে কিনা। কর্তন প্রক্রিয়া শেষ করার পর পরই একটি মূত্রনালিতে একটি নল প্রবেশ করিয়ে দেয়া হতো। প্রস্রাব বের হবার রাস্তা যেন বন্ধ হয়ে না যায় সেজন্য এই নল প্রবেশ করানো হতো। নল ছিল অনেকটা আজকের যুগের স্যালাইনের পাইপের মতো, এর ভেতর দিয়ে প্রস্রাব বের হতো।

এরপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রোগীকে ঐ কক্ষে তিন দিন রেখে দেয়া হতো। ঐ সময়ে রোগীকে কোনো প্রকার খাবার দেয়া হতো না। এই ধাপ পার হতে পারলে চতুর্থ দিনে রোগীকে প্রস্রাব করতে বলা হতো। যদি প্রস্রাব করতে পারতো তাহলে অপারেশন সফল হয়েছে বলে ধরে নেয়া হতো, আর যদি প্রস্রাব করতে না পারতো তাহলে ধরা হতো এই অপারেশন সফল হয়নি। এক্ষেত্রে রোগী ব্যথা ও ইনফেকশনে মারা যেত।



মুলতঃ কেন এই অমানবিক খোজা প্রথা চালু হয়েছিল? খোজা শব্দটির সাথে হারেম শব্দটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এই উপমহাদেশে হারেম নামে পরিচিত হলেও ইউরোপীয়দের কাছে হারেম হচ্ছে ‘সেরালিয়ো’। এখানে ইতালিয়ান ও ফারসি ভাষার অদ্ভুত এক সম্মিলন ঘটেছে। ইতালিয়ান ভাষায় ‘সেররালিয়োন’ অর্থ হলো ‘বন্য প্রাণীর খাঁচা’। ‘সেররালিয়ো’ এসেছে ফারসি ‘সেরা’ থেকে। তবে ফারসি ‘সরা’ ও ‘সরাই’ অর্থ হলো ভবন বা প্রাসাদ বিশেষ। মূলত এই শব্দের সঙ্গে মিলিয়েই এমন অদ্ভুত নামকরণ। অবশ্য ১৬৩৪ সালে হারেম শব্দটি ইংরেজি ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়। সব শব্দের অর্থ মোটামুটি একই ধরনের, যার অর্থ নিষিদ্ধ। অন্যভাবে বললে এর অর্থ হচ্ছে নিষিদ্ধ বা গোপনীয় স্থান। রাজপ্রাসাদের যে আলাদা অংশে শাসকের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা, নারী কর্মচারী, উপপত্নী প্রমুখ বাস করতেন তা হারেম, হারিম বা হেরেম নামে অভিহিত হতো। বহিরাগতদের হারেমে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। যেহেতু এসব হারেমে প্রবেশাধিকার খুবই সংরক্ষিত ছিল সেহেতু এসব মহলে নারীদের রক্ষী ও বিভিন্ন কাজের জন্য বিশেষ এক অমানবিক প্রথা চালু করা হয়। যার নাম হচ্ছে খোজা প্রথা।

খোজারা কেবল শাসকের নিকটই অনুগত ছিল। সরাসরি শাসক ব্যতিত রাজ্যের অন্য কোনো উঁচু পদের কর্মচারী বা প্রশাসক হলেও খোজাদের নিকট খুব বেশি পাত্তা পেতো না। খোজারা রাজা বা প্রভু অন্তঃপ্রাণ থাকতো। এমনকি কোনো কোনো খোজা কোনো কোনো রাজার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিল। তারা তাদের বিশ্বস্ততার গুণটিকে খুবই সম্মান এবং মর্যাদার মনে করতো। যেহেতু এদের জৈবিক চাহিদা বলতে কিছুই ছিল না, সেহেতু এদর ব্যক্তিগত বংশ প্রতিষ্ঠা বা সংসার স্থাপনের ব্যাপারে কোনো ইচ্ছা ছিল না। তাদের শারীরিক অক্ষমতার কারণেই সমাজে তাদের অবস্থান ছিল খুব দুর্বল। এই দুর্বলতার কারণে তাদেরকে প্রচুর নির্যাতন সহ্য করতে হতো। কখনো কখনো খুব তুচ্ছ কারণে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হতো এমনকি হত্যাও করা হতো। তারা এতই সহনশীল ছিল যে এরপরও খোজাদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতো না।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, অস্বাভাবিক মানুষ গড়তে গিয়ে নিজেদের অজান্তে অনেক সময় সত্যিই অস্বাভাবিক মানুষ গড়ে ফেলছিলেন সেকালের সুলতান, রাজা বাদশাহরা। রোমান লেখক মারসিয়াল ব্যাঙ্গচ্ছলে বন্ধুকে বলেছিলেন – পানিকাস তুমি জানতে চাও তোমার সিলিয়া কেন খোজাদের নামে এত পাগল হয়ে গিয়েছে? কারন আর কিছু না সিলিয়া বিবাহিত জীবনের ফুল চায় - ফল নয়। কৃত্রিম ভাবে পুরুষদের পুরুষত্বহীন করে নারীদের সুরক্ষা দেবার জন্য খোজাদের প্রহরী হিসাবে নিয়োগ দিয়ে রাজারা যে নিশ্চিত থাকত তাতে কি এই খোজা নামের পুরুষদের দেহে কামের আগুন জ্বলত না? রোমান লেখক জুভেনাল এর লেখায় তার বর্ননা পাবেন। জাহাঙ্গীরের আমলে দিদার খাঁ নামে এক খোজা এবং বাদীর করুন কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে পরিব্রাজক বার্নিয়ের বর্ননায়। হারেম প্রভু সুলতান বা রাজারা তাদের নারী মহলে সুন্দরীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এই সব পুরষত্বহীন পুরুষদের নিয়োগ দিতেন, এদের হাহাকার নিয়ে কোন কালজয়ী লেখা কেউই লিখে নাই, কে জানে পুরুষ হয়ে এই সব নপুংশকদের নিয়ে লেখায় হয়ত শিভালরি নেই, কিন্তু এদের হাহাকার ইতিহাসের পাতা দিয়ে কিভাবে মোছা যাবে?

ছবিঃ অন্তর্জাল।

সূত্রঃ লেখায় অন্তর্জালের বিভিন্ন প্রবন্ধ ব্যাবহার করা হয়েছে তার কিছু নীল রং এর শব্দে লিংক যোগ করা হল। এর বাইরে শ্রীপান্থের হারেম, আইন ই আকবরী- আবুল ফজল ভলিউম-১, ট্রান্সলেটেড বাই এইচ ব্লচম্যান, দি অটোমান সেঞ্চুরিজ- লর্ড কিনারস, হারেমের কাহিনী- জীবন ও যৌনতা- সাযযাদ কাদির এর বইগুলোর সহায়তা নেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ৮:২২
২৮টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×