কলম্বো টেস্টের তৃতীয় দিনে দুই দলই আধিপত্য বিস্তার করেছে। তবে শুরুতে সকালের সেশনে বাংলাদেশ আধিপত্য বিস্তার করলেও দিনের শেষে যে শ্রীলঙ্কাই বাজিমাত করেছে, তাতে বাংলাদেশও এখন হার এড়ানোর কষ্টে ভুগতে শুরু করে দিয়েছে। গল টেস্টে ড্র করার যুদ্ধে নেমেছিল বাংলাদেশ। এবার যে অবস্থা তাতে হার এড়ানোর যুদ্ধেই আজ চতুর্থদিনে নামতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। দ্বিতীয় দিন ৫৪ রানে এগিয়ে ছিল শ্রীলঙ্কা। ৬ উইকেটে ২৯৪ রান করেছিল। কুমার সাঙ্গাকারা ১২৭ ও কুলাসেকারা ২ রানে ব্যাট করছিলেন। তৃতীয় দিন সকালে বাংলাদেশ বোলারদের নৈপুণ্য এতটাই উজ্জ্বল ছিল যে হাতে থাকা ৪ উইকেটে আর ৫২ রান যোগ করতে পারে লঙ্কানরা। ৩৪৬ রান করতেই অলআউট হয়ে যায়। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের করা ২৪০ রানের জবাবে মাত্র ১০৬ রানে এগিয়ে থাকতে পারে লঙ্কানরা। জবাবে বাংলাদেশ ৪ উইকেট হারিয়ে ১৫৮ রান করে দ্বিতীয় ইনিংসে ৫২ রানে এগিয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার এগিয়ে থাকার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে সাঙ্গাকারার। যদি এ ব্যাটসম্যানকে আটকানো না যায় তাহলে শ্রীলঙ্কা আরও এগিয়ে যাবে। সবারই সে বিষয়টি বোঝা ছিল এবং বাংলাদেশ বোলাররা তাকেই শুধু আউট করতে চেয়েছেন। সাঙ্গাকারা নেই মানে যে ম্যাচে শ্রীলঙ্কাই থাকবে না। তৃতীয় দিন ৭ ওভারের সময়ই বাংলাদেশের জন্য সুসংবাদ এসে পড়ে। ৯৯.৫ ওভারে গিয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে যেন পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। আবুল হাসান রাজু সেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন। সাঙ্গাকারা মুশফিকুর রহীমের তালুবন্দী হয়ে মাঠ ছাড়েন।
কিন্তু এ আউটটি নিয়ে রোমাঞ্চের তৈরি হয় ছয় মিনিট ধরে। ক্রিকেট বিশ্বে যার দেখা মেলা দায়। আবুলের বলটি অফসাইডের অনেকটা বাইরে দিয়ে চলে যাচ্ছে। এমন সময় সাঙ্গাকারা ড্রাইভ করেন। বলটি তার ব্যাটের কানায় লেগে যায়। কিন্তু এতটাই ক্লোজ ছিল যে বোঝাই যাচ্ছে না আসলে ব্যাটে-বল লেগেছে কিনা। থার্ড আম্পায়ারও ধোঁকায় পড়ে যান। কোন কোন ক্যামেরা দেখাচ্ছে ব্যাটে লেগেছে, আবার কোন কোন ক্যামেরায় এতটাই ক্লোজ দেখাচ্ছে মনে হচ্ছে ব্যাটে লাগেনি। ছয় মিনিট অপেক্ষার পর চিন্তা, উদ্বেগের পর আম্পায়ার আউটের সিদ্ধান্ত দেন এবং বাংলাদেশ ক্রিকেটাররাও উল্লাস করেন।
এমনই এক ব্যাটসম্যান যে এই দুই টেস্টেই তিনটি শতক করে ফেলেছেন। বাংলাদেশকে পেলেই শতক করেন। সেই ব্যাটসম্যানের আউটও আবার কতটা রোমাঞ্চ ঘটিয়েই হলো। অবশেষে ২৮৯ বলে ১১ চারে ১৩৯ রান করে সাজঘরে ফেরেন সাঙ্গাকারা। শ্রীলঙ্কার মূল্যবান এই উইকেটটি নেন রাজু। বাংলাদেশ হার থেকে বাঁচতে চাইলে এই উইকেটটি অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল। সেটি নিয়েছেনও রাজু। সাঙ্গাকারা আউট হন দলীয় ৩১৬ রানে। এরপর তিন উইকেট যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। আর ৭ রান স্কোরবোর্ডে যোগ হতেই রঙ্গনা হেরাথের (৩) উইকেটটি নেন সোহাগ গাজী। এরপর ৩৪৬ রানেই পরপর দুই উইকেট হারিয়ে অলআউট হয়ে যায় শ্রীলঙ্কা। কুলাসেকারাকে (২২) আউট করেন সোহাগ। ক্যাচ ধরেন মুশফিকুর রহীম। বাংলাদেশের হয়ে এক ইনিংসে সবচেয়ে ৫ ক্যাচ ধরার রেকর্ড তাঁর ছিল। ২০১০ সালে ভারতের বিরুদ্ধে গড়েছিলেন। এবারও ৫ ক্যাচ নিলেন। আর এরাঙ্গার (১৫) উইকেটটি তুলে নেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তবে এই উইকেটটি মাহমুদুল্লাহ শিকার করলেও আশরাফুলেরই সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে। লং অনে বাউন্ডারির উপর দিয়ে বল উড়ে যাচ্ছে এমন বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু আশরাফুল লাফিয়ে একেবারে বাউন্ডারি দড়ির কাছে থেকে ক্যাচটি লুফে নেন। শ্রীলঙ্কাও গুটিয়ে যায়। এবার নিয়ে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে দ্বিতীয়বারের মতো অলআউট করার কৃতিত্ব দেখিয়েছে। দুই দল চলমান টেস্টটিসহ ১৪তম টেস্টে লড়াই করছে। এরমধ্যে শ্রীলঙ্কার মাটিতে ১০ ম্যাচ খেলছে। দ্বিতীয়বারের মতো অলআউট করতে পেরেছে। এরআগে ২০০২ সালে সর্বপ্রথম শ্রীলঙ্কার মাটিতে প্রথম ইনিংসে ৩৭৩ রানে গুটিয়ে দিয়েছিল। মধ্যাহ্ন বিরতির আগে বাংলাদেশ কোন উইকেট না হারিয়ে ২৩ রান করে। ৮৩ রানে পিছিয়ে থাকে। মধ্যাহ্ন বিরতি শেষে যখন আবার মাঠে ফিরেন তামিম ও জহুরুল শুরুতেই নিজের ১২ ও দলীয় ২৬ রানের সময় জহুরুল নতুন জীবন খুঁজে পান। লাকমাল নিজে বল করে কট এ্যান্ড বোল্ড করতে পারেননি জহুরুলকে। সুযোগটি পেয়ে জহুরুল এগিয়ে যেতে থাকেন। সঙ্গে তামিমও। আউটফিল্ড তিন দিন ধরে স্লো থেকে গেছে। তাই অনেক কষ্টে বাউন্ডারি মারতে হয়। এ বুঝতে পেরে যেন শ্রীলঙ্কার সেরা স্পিনার হেরাথের এক ওভারে তামিম ও জহুরুল একটি করে ছক্কাই হাঁকিয়ে দিয়েছেন। বল মাটিতে গড়িয়ে বাউন্ডারি না হলে বাউন্ডারির ওপর দিয়েই নেয়া ভাল। এ যেন তারা বুঝতে পারলেন। ২২তম ওভারে গিয়ে ৬৭ বলে ৫০ রান তুলে নেন তামিম। প্রথম ইনিংসে দলকে তেমন রান দিতে না পারলেও দ্বিতীয় ইনিংসে গিয়ে অর্ধশতক করে ফেলেছেন। যেখানে গল টেস্টে প্রথম দুইদিনে দুই দল মিলিয়ে ৬ উইকেট হারিয়েছিল। সেখানে কলম্বো টেস্টে দুই দিনে দুই দলের দুই ইনিংস মিলিয়ে ১৬ উইকেট পড়েছে। তৃতীয় দিনে এসে আরও ৮ উইকেট শিকারে পড়েছে।
কলম্বো টেস্টে যেমন যাচ্ছে উইকেট, ঠিক তেমনি হচ্ছে রানও। সকালের সেশনে বাংলাদেশ বোলাররা দ্রুত শ্রীলঙ্কার ৪ উইকেট তুলে নিয়েছে। এরপর বাংলাদেশের ওপেনিং জুটিই যেমন ৯১ রান দলকে এনে দিয়েছে। অসাধারণ খেলছিলেন তামিম। ১০৭ বলে চার ৪ ও এক ছক্কায় ৫৯ রান করেও ফেলেন। কিন্তু হঠাৎ যেন বিগড়ে গেলেন নিজেই। এরাঙ্গার অফ স্টাম্পের বাইরের বলটি মারতে গিয়ে ব্যাটে লেগে বল স্টাম্পে লাগল। তামিমও ১২তম অর্ধশতক করে আউট হয়ে গেলেন। বাংলাদেশও প্রথম উইকেট হারাল।
চা বিরতির আগেই তামিমকে হারাল বাংলাদেশ। চা বিরতি যখন হয়েছে তখন দলের স্কোরবোর্ডে জমা ১ উইকেটে ৯৩ রান। চা বিরতির পর দ্বিতীয় ওভারে বাংলাদেশ আরেকটি উইকেট হারাল। এবার দ্রুতই যে উইকেটটি হারাল বাংলাদেশ তাতে দলের অনেক বড় ক্ষতিই হয়ে গেল। দলের স্কোরবোর্ডে আর ৫ রান যুক্ত হতেই আশরাফুল (৪) হেরাথের ঘূর্ণি বুঝতে না পেরে আউট হয়ে গেলেন। গল টেস্টের প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান আশরাফুল কলম্বো টেস্টে ম্লান হয়ে গেলেন।
শ্রীলঙ্কা প্রথম ইনিংসে ১০৬ রানে এগিয়ে থাকে। আর ১১ রান হলেই বাংলাদেশ লিড নিত। কিন্তু এরআগেই দল তামিমের পর আশরাফুলের মতো মূল্যবান উইকেট দুটি হারিয়ে ফেলে। তবে জহুরুল ঠিকই উইকেট আঁকড়ে থাকেন। এবার মমিনুলকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেন জহুরুল।
দুইজন মিলে ৪৭ রানের জুটিও গড়েন। কিন্তু হঠাৎ করেই দলীয় ১৪৩ রানে হেরাথ এসে যেন সব ল-ভ- করে দিলেন। পরপর দুই বলে দুর্দান্ত খেলতে থাকা জহুরুল (৪৮) এগিয়ে মারতে গিয়ে স্টাম্পিং হলেন। আর রানের খাতা খোলার আগেই মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের উইকেটটিও নিয়ে হ্যাটট্রিক করার সুযোগ পেয়ে গেলেন হেরাথ। কিন্তু মুশফিককে আর আউট করতে না পারায় হ্যাটট্রিক হলো না হেরাথের। তবে ৩ উইকেট নিয়ে আবারও বাংলাদেশের ইনিংসের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন ঠিকই।
দিনের শেষ দিকে আরও দুটি উইকেট পড়ত। আর হেরাথই এ দুটি উইকেট পেতেন। ভাগ্য ভাল বাংলাদেশের। মিডঅফে মমিনুলের ক্যাচটি লুফে নিতে পারেননি কুলাসেকারা এবং প্রথম স্লিপে মুশফিকের ক্যাচটি এ্যাঞ্জলো ম্যাথুসের হাত থেকে ফসকে যায়।
দিন শেষে তাই বাংলাদেশও ৪ উইকেটে ১৫৮ রান নিয়ে ৫২ রানে এগিয়ে রয়েছে। মমিনুল ৩৬ রানে ও মুশফিক ৭ রানে ব্যাট করছেন। আজ ম্যাচের চতুর্থ দিনে মুশফিক, মমিনুল, নাসির, রাজু, সোহাগ, রুবেল, রবিউল-সবাই মিলে দলকে বাঁচাতে হবে। তা না হলে এ ম্যাচে নিজেদের হারের সম্ভাবনা থেকে বাঁচা কঠিন। সেই হার এড়ানোর যুদ্ধই এখন চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।