''ভাবছো তুমি, ভাবছি আমি,
বেলা গেল
ঘরের ছেলে ঘরেতে ফিরলো না কেন
আসে গানের কথা, আসে সুর কিছু
আসে শরীরটা তার, তবু আসেনা সে তো
আসে ফিরে দেখা, আসে পথ কিছু
তবু কেন ঘরে ফেরে না মন।''
বলছিলাম 'মৈনাক ভৌমিক' পরিচালিত ২০১৮ সালের একটি মুভি 'জেনারেশন আমি'র কথা। মধ্যবিত্ত পরিবারের স্কুল পড়ুয়া ছেলের স্বপ্ন, বাবা-মায়ের সাথে মানসিক দূরত্ব আর খুড়তুতো বোনের উদ্যম, সাহসিকতায় তার স্বপ্ন পূরণের পথে হাঁটা এসব বিষয়কে আবর্তিত করেই মূলত সিনেমার কাহিনী এগিয়েছে। দুই প্রধান চরিত্রের নাম অপু আর দূর্গা, সম্পর্কে তারা ভাইবোন (কাজিন)। চরিত্রগুলির নামকরণ কিংবদন্তী চলচ্চিত্র লেখক, পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রসিদ্ধ বাংলা চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে করা হয়।
কাহিনীর শুরুতেই দেখা যায় ছেলেকে মানুষ করার জন্য মায়ের অতিরিক্ত উদ্বিগ্নতা, কেয়ারিং মানসিকতা ছেলেটার মধ্যে একধরণের বিরক্তির ভাব উদ্রেক করে। তাইতো সে ভাবতে থাকে যে অন্য বাবা-মার চেয়ে তার বাবা-মা একটু বেশি মানুষ করতে চায়। পরীক্ষার আগে মায়ের অতিমাত্রায় টেনশন, খাইয়ে দেয়া এসবের কোনোটিই তার পছন্দ নয়। এজন্য সে শঙ্কা প্রকাশ করে যে ‘বব ডিলানে’র মা যদি এমন করে খাইয়ে দিত তাইলে হয়তো 'ব্লোয়িং ইন দ্যা উইন্ড' তৈরী হতোনা। এমন অস্বস্তিকর জীবনে তার একমাত্র সুখের উপকরণ কোচিং সহপাঠী 'পিয়া' নামের মেয়েটাকে অপলক দেখা, যার জন্য তার মনে ভালোলাগা তৈরী হয়েছে। কঠিন শাসন বারণে পর্যুদস্ত ছেলেটার জীবনে যেন কিঞ্চিৎ আলোকছটা হয়ে আসে তার কাজিন দূর্গা।
দশম শ্রেণী পড়ুয়া অপুর মিউজিক নিয়ে অনেক স্বপ্ন। সেইসাথে লিরিক্স লিখা তার অনেক বড় প্যাশন। কিন্তু এসবে বাবা-মা মোটেও সায় দিতে চায়না। তাইতো বাবা তাকে ইডিয়ট আখ্যা দেয়। আক্ষেপ করেন, এই প্রজন্মটা নিতান্তই 'আমি আমি' করে ব্যস্ত। সেইসাথে শঙ্কায় ভুগেন, 'গান লিখে যে আয় হবে তাতে সংসার চলবেনা।' তারা চান, তাদের আদরের ছেলেটি আইআইটি তে পড়ুক। তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেন, সেখানে পড়লে ভালো চাকরি করে স্ট্যান্ডার্ড জীবন যাপন করা সম্ভব হবে। কিন্তু স্বপ্নের নেশায় বুদ্ হওয়া অপুর অনুযোগ, বাবা-মা তার কোনো কথা শুনতে চায়না! তবে দূর্গা দিদি ঠিকই তার প্রতিভার মূল্যায়ন করে। তাকে নিজের স্বপ্নের সাথে বাঁচতে উৎসাহ দেয়। বড় ব্যান্ড দলে গাওয়ার স্বপ ফেরি করা ছেলেটার গিটার পর্যন্ত নেই। কেনার সাধ্যিও নেই। দূর্গা তাকে একটি গিটার উপহার দেয়। সেই গিটারকে সাঙ্গ করে অপু তার স্বপ্নের পথে এক পা দু'পা করে এগিয়ে চলে।
মুভির আরেকটি দিক হলো দুর্গার সাথে তার বাবা-মায়ের মানসিক দূরত্ব। ভীষণ রকমের ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড আর প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন স্বামী-স্ত্রী নিজেদের ইগোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজেরা আলাদা হয়ে যায়, মেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে সেদিকটা না ভেবেই। একা হয়ে যাওয়া মেয়েটা মানসিক সমস্যায় ভুগে যার চিকিৎসা নিতে অপুদের সাথে কলকাতায় থাকা শুরু করে। এই অংশে দেখা যায়, মেয়েটা তার মনের কথা, তার প্রয়োজনের কথা বলার জন্য বাবা-মা কাওকেই কাছেই পায়না। বাবা -মা একে অন্যের উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে সরে যায়। তার মধ্যে একধরণের তীব্র অভিমানবোধ কাজ করে। নিঃসঙ্গ মেয়েটা সেজন্যই হয়তো বলে উঠে -
''ভুলে যেও আমাকে
কি আমার নাম? কে ছিলাম?
যা পেয়েছি না চাইতেই
চেয়ো না ক্ষতিপূরণ
যা দিয়েছি না চাইতেই
দিয়ো না তার দাম।''
বাবা-মায়ের স্নেহের পরশ, একটুখানি আদর মমতা মেয়েটার বড্ড ভীষণ প্রয়োজন। তাইতো তার আবদার ছিল -'' যদি আমাকে ভালোবাসো, তবে কিছুটা পাশে এসো।'' কিন্তু নাহ, হতভাগা মেয়েটা যান্ত্রিক যুগের কর্পোরেট বাবা-মায়ের থেকে একটুখানি সময়ও পায়নি। তীব্র অভিমান একসময় ক্ষোভের জন্ম দেয়। শেষমেশ সে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেয়।
মুভিটাতে মূলত “প্রজন্মের বৈসাদৃশ্য”ব্যাপারটাকেই তুলে ধরা হয়েছে। “প্রজন্মের বৈসাদৃশ্য” বলতে সাধারণ কথায় বলা যেতে পারে যে দুটো প্রজন্মের মধ্যে মানসিক দূরত্ব, ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ-সংঘাত,মতানৈক্য ও পরস্পরকে মূল্যায়ন করবার অমিল। এ যেন এক কঠিন বাস্তবতা। বড়োরা মনে করেন, তারা যা চান, তা আমাদের ভালোর জন্যই। কিন্তু তারা আমাদের অবস্থানে এসে বুঝাতে ব্যর্থ হন। হয়তো একধরণের কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব থেকে এমনটি করেন। তারা তাদের মতামত, ভালো-মন্দ যেভাবে চাপাতে চান তা আমাদের মধ্যে সূক্ষ ব্যক্তিত্ব সংকটের তৈরী করে। অবচেতন মনেই ভাবতে থাকি, তারা হয়তো আমাদেরকে সীমাবদ্ধ করে ফেলতে চাইছে। আমাদের ইচ্ছা -অনিচ্ছার বিন্দুমাত্র দাম নেই। ধীরে ধীরে বিট্রেয়াল মনোভাবের হয়ে উঠতে থাকি। তখন বাবা-মায়ের মধ্যে একধরণের আক্ষেপ তৈরী হয় যে আদরের সন্তানরা তাদের কথা শুনছে না। কোথায় যেন দুই জেনারেশনের মধ্যে এক প্রকার দুর্বোধ্যতা কিংবা অস্পষ্টতা থেকে যায়। ঠিক এইভাবে তাদের সাথে আমাদের চিন্তা-চেতনায় বড় রকমের বৈসাদৃশ্য তৈরী হয়।
পারস্পরিক মতানৈক্য দুই প্রজন্মের মধ্যে বিশাল বড় মানসিক ব্যবধান তৈরী করে দেয়, যেটা একজন ছেলে /মেয়ের মধ্যে প্রকট নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা নিজেদের জগৎ সংকুচিত করে ফেলে, ভালো-মন্দ কোনো ব্যাপার আপনজনদের সাথে শেয়ার করতে চায়না। এমনকি আবেগের বসে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। অনেক সেনসিটিভ বিষয়ে তারা নিজের মতো করে ভাবতে যেয়ে সঠিক সমাধান পায়না।
আমাদের অগ্রজদের একটা বড় ধরণের ভুল মানসিকতা হলো তারা নতুনকে সহজে গ্রহণ করতে চাননা। কিন্তু সময়ের সাথে সবকিছু আপডেটেড হবে, রুচিবোধ ভিন্ন হবে, সেটা খুব স্বাভাবিক। ক্ল্যাসিক গান শোনা জেনারেশন হিপহপ গানকে ওয়েলকাম করতে চাইবেনা সহজে। আর তখনই তৈরী হবে এক ধরণের মনস্তাত্বিক সংঘাত। সন্তানরা মনে করবে, তাদের অগ্রজরা ব্যাকডেটেড। অন্যদিকে, অগ্রজদের মনে হতে থাকবে যে তাদের অনুজরা নিতান্তই বখে গেছে।
জেনারেশন গ্যাপের এই অশুভ প্রভাব থেকে বাঁচতে হলে অগ্রজদের এগিয়ে আসতে হবে বলে আমার মনে হয়। নিজেদের সময়ের সাথে এই সময়ের পার্থক্যটা সঠিকভাবে বুঝতে হবে। নতুনকে বরণ করবার মানসিকতা আনতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে যে প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে নিয়তই আমরা অনেকদূর এগিয়ে যাচ্ছি। তাদের সেই পুরোনো যুগকে আঁকড়ে ধরে থাকলে চলবেনা। সন্তানের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করতে হবে। বন্ধু হয়ে তাদের চাওয়া-পাওয়ার গল্প শুনতে হবে, সুখ-দুঃখের সঙ্গী হতে হবে। তাদের এতটুকু নিশ্চয়তা দিতে হবে যে তার মনে যে চিন্তা-চেতনার ই উদ্রেক হোক তা অকপটে তাদের বাবা-মাকে বলতে পারবে। তারা তাদের সুন্দর স্বপ্ন-পূরণের সারথি হবে।
সন্তানদের কৃত ভুলগুলোকে তাদের অবস্থানে গিয়ে বুঝাতে হবে। তারা যা করতে চাইছে সেটা মনোযোগ সহকারে শুনতে হবে এবং সেই কাজটা করলে তার ইতিবাচক-নেতিবাচক দিকগুলো কী হতে পারে সেটা বুঝাতে হবে। তারপর তাদের থেকে সিদ্ধান্ত জানতে চাইতে হবে। অর্থাৎ তারা যেন অনুভব করতে পারে যে বাবা-মা তাদের মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন এবং যেসব পরামর্শ দিচ্ছেন তা ভালোর জন্যই। সন্তানদের মধ্যে মানবিকতাবোধ গড়ে তুলতে হবে। নিজেকে ভালোবাসতে শেখাতে হবে। আবার সাথে সাথে এটাও বুঝাতে হবে যে নিজেকে ভালোবাসা আর স্বার্থপরতা এক জিনিস নয়। ছেলেমেয়েরা যেন ভালো-মন্দের তফাৎটা বুঝতে পারে তেমন মানসিক বোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে হবে। তাদের শাসনের নামে কখনো আন্ডার-এস্টিমেট করা যাবেনা। সন্তানদের সাথে সহজ সম্পর্ক তৈরী করতে হবে। উচিত-অনুচিতের সঠিক পার্থক্যটা বুঝাতে হবে। ইমোশন আর বাস্তবতার মধ্যে ব্যালেন্স করা শেখাতে হবে।
নতুন প্রজন্মকে বুঝতে হবে, 'বয়োজ্যেষ্ঠরা আমাদের চেয়ে অনেকবেশি অভিজ্ঞ।' এখন আমরা যে পথ ধরে হাঁটছি সেই পথটা তারা অলরেডি মাড়িয়ে গেছেন। তাই ভালো-মন্দ বুঝতে পারেন। তাদের আদর-শাসন, বারণ সবকিছু আমাদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই আসে। রিপুর তাড়নায়, বয়সের দোষে আমাদের কাছে সবকিছু রঙিন মনে হয়। আমরা হয়তো কোনোকিছুর বাজে পরিণতি সম্পর্কে জানিনা। বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, ভদ্র ব্যবহার, সামাজিক মূল্যবোধের সুষ্ঠু চর্চা এবং গঠনমূলক চিন্তা -চেতনা আমাদের সুন্দর মানুষে পরিণত করবে।
প্রজন্ম বৈসাদৃশ্য দূর করতে কমিউনিকেশন গ্যাপ টা যথাসম্ভব কমাতে হবে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, বিবেকবোধ, সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি, উদার মানসিকতা ইত্যাদি গুণ আমাদের দুই -প্রজন্মের মধ্যে ব্যবধান কমাবে এবং অমূল্য জীবনটাকে সুন্দর করে সাজাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। সবাই ভালো থাকুক, আপনজনদের ভালোবাসায় বাঁচুক।
কৃতজ্ঞতা: সামহোয়্যার ইন ব্লগ কর্তৃপক্ষকে বিশেষ করে 'কাল্পনিক ভালোবাসা' ভাইয়াকে আন্তরিক ধন্যবাদ আমাকে সেফ করার জন্য। আর আমাকে লেখালেখিতে উৎসাহিত করবার জন্য শেরশায়রী ভাইয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত ফটো।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:২১