somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অশ্রুকুমার সিকদারের সাহিত্য সমালোচনার জগৎ

১৫ ই মার্চ, ২০১৯ দুপুর ২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্মরণ – অশ্রুকুমার সিকদার
সম্প্রতি চলে গেলেন বাংলা সাহিত্য সমালোচনা জগতের বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক অশ্রুকুমার সিকদার। সারা জীবন মূলত উত্তরঙ্গেই তিনি কাটিয়েছেন, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক দশক অধ্যাপণা করেছেন এক দরদী জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে এবং সেখানে বসেই সারস্বত সাধনায় নিমগ্ন থেকে আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন একের পর এক অমূল্য গ্রন্থ। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলির মধ্যে আছে - আধুনিকতা ও বাংলা উপন্যাস, আধুনিক বাংলা কবিতার দিগবলয়, কবির কথা কবিতার কথা, হাজার বছরের বাংলা কবিতা, নবীন যদুর বংশ, বাক্যের সৃষ্টি : রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও রোটেনস্টাইন, রবীন্দ্রনাট্যে রূপান্তর ও ঐক্য, কিল মারার গোঁসাই, ভাঙা বাংলা ও বাংলা সাহিত্য।
আধুনিকতা ও বাংলা উপন্যাস বইটিতে রবীন্দ্রনাথ থেকে সমরেশ বসু পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসের বিশ শতকী আধুনিকতার প্রথম অর্ধ ও তার কিছু পরবর্তীকালের স্বরূপ সন্ধান রয়েছে। আলোচিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, কল্লোলযুগের লেখক গোষ্ঠী, জগদীশ গুপ্ত, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, গোপাল হালদার, জীবনানন্দ দাশ, সতীনাথ ভাদুড়ী, অমিয়ভুষণ মজুমদার, কমলকুমার মজুমদার এবং সমরেশ বসু। অশ্রুকুমার সিকদার এই সময়কালের সমস্ত লেখকদের ইতিহাস এখানে লিখতে চান নি। যাদের নিয়ে আলোচনা করেছেন তাদের উপন্যাস জগতের সামগ্রিকতাকে তুলে আনাও এখানে তার লক্ষ্য ছিল না। তিনি বিশিষ্টতার সন্ধানই করেছেন এখানে। এই দিক থেকে তাঁর এই বইয়ের পরিকল্পনা শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ বা সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বাংলা উপন্যাসের কালান্তর’ থেকে আলাদা।
রবীন্দ্র উপন্যাস থেকেই কেন বাংলা উপন্যাসের আধুনিকতার সন্ধান শুরু করতে চান, বঙ্কিম থেকে নয়, সেই প্রসঙ্গে একতি কৈফিয়ৎ দিয়েছেন অশ্রুকুমার। তিনি মনে করেছেন স্রষ্টা বঙ্কিম আত্মসচেতন শিল্পী হলেও তাঁর চরিত্ররা তা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ থেকেই আত্মসচেতন চরিত্রদের আমরা উপন্যাসের মধ্যে পেতে শুরু করলাম। সেইসঙ্গে তিনি এও মনে করেছেন যে বঙ্কিমের উপন্যাস মূলত ঘটনা প্রধান আর রবীন্দ্রনাথ থেকেই শুরু হল মানুষের ব্যক্তিত্বের রহস্য নিয়ে লেখালেখি। বঙ্কিমের প্লট প্রধান উপন্যাসের রূপান্তর ঘটল রবীন্দ্রনাথের হাতে, তা হয়ে উঠল থিম প্রধান। অশ্রুকুমারের এই বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য আমরা পুরোপুরি একমত নই। বঙ্কিমের চরিত্ররা, সে নবকুমারই হোন বা আয়েষা, রাজসিংহই হোন বা সূর্যমুখী – তাঁরা আত্মসচেতনতার পরিচয় দেন নি এটা অশ্রুকুমার কেন মনে করছেন তা জানতে পারলে ভালো হত। সেই সঙ্গে মীরকাসিমের সমসময়ের ইতিহাস নিয়েই হোক বা নারীর দাম্পত্য বহির্ভূত পরপুরুষাসক্তির মত উনিশ শতকীয় বিতর্কের বিষয় নিয়েই হোক – বঙ্কিমের রচনায় থিমের অভাব কেন অশ্রুকুমার লক্ষ্য করলেন, তাও সহজবোধ্য নয়। বরং আখ্যানের টানটান বিন্যাসে বঙ্কিম তাঁর থিমকে যতটা নান্দনিক রাখতে পেরেছেন, রাবীন্দ্রিক নভেলে ডিসকোর্স এর বাহুল্য কখনো কখনো তাতে সমস্যা সৃষ্টি করেছে বলেই মনে হয়। আখ্যানের নির্মাণ নিয়ে বঙ্কিম যতটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন, চোখের বালির অভিনবত্ব এবং চতুরঙ্গের বিশিষ্টতার বাইরে রবীন্দ্রনাথ তা করতে পেরেছেন কীনা সেই সংক্রান্ত প্রশ্ন তোলাই যায়। বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ আর রবীন্দ্রনাথের চোখের বালিকে পাশাপাশি রেখে উপন্যাসের আধুনিকতার একটা তুলনামূলক আলোচনা করেছেন অশ্রুকুমার এবং বিনোদিনীর মত চরিত্র কল্পনার মধ্যে দিয়েই যে নতুন আধুনিকতার সূচনা করতে পারলেন রবীন্দ্রনাথ – এটা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে আধুনিকতার সমস্যা সংক্রান্ত আলোচনায় দুটি বিষয়ের দিকে অশ্রুকুমার জোর দিয়েছেন। একটি হল চরিত্রকল্পনার দিকে অসম্ভব জোর দেওয়া এবং প্লটকে চরিত্রের অনুগামী করে তোলা। প্রায়শই দুই বিপরীতধর্মী চরিত্রের সৃজনের মধ্যে দিয়ে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস এগিয়ে চলে, সেটাই কাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে। দত্তায় নরেন্দ্র – বিলাসবিহারী, পল্লীসমাজে রমেশ – বেণী, মেজদিদিতে হেমাঙ্গিনী – কাদম্বিনী, বামুনের মেয়েতে প্রিয়নাথ – গোলক, চরিত্রহীনে কিরণময়ী – সুরবালা, গৃহদাহে অচলা – মৃণাল, দেনাপাওনাতে জীবানন্দ – অলকা এবং নির্মল – হৈম। এই সূত্রেই দ্বিতীয় সমস্যাটির দিকেও নজর দিয়েছেন অশ্রুকুমার। দেখিয়েছেন শরৎচন্দ্র এই ধরনের ছকের মধ্যে উপন্যাস নির্মাণ করে গেছেন সারাজীবন এবং উপন্যাসের আঙ্গিক টেকনিক নিয়ে কখনো সেভাবে ভাবেন নি। শরৎচন্দ্রের নানা আলোচনায় বা চিঠিপত্রে উপন্যাসের বিষয় নিয়ে, তত্ত্ব নিয়ে, নীতি নিয়ে অনেক আলোচনা থাকলেও টেকনিক বা ফর্ম নিয়ে কোনও আলোচনা বা ভাবনা তেমন চোখে পড়ে না। এই বিষয়ে শরৎচন্দ্র অনেকটা উদাসীন ছিলেন বলেই অশ্রুকুমার মনে করেছেন।
বাংলা সাহিত্যের এক অত্যন্ত বিশিষ্ট ছকভাঙা কিন্তু পাঠকমহলে কম জনপ্রিয় জগদীশ গুপ্তের উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনায় অশ্রুকুমার দেখান ইউরোপে রেনেসাঁর মধ্য দিয়ে মানবধর্মের বিজয়ের যে সাহিত্যধারা শুরু হয়েছিল এবং বাংলা সাহিত্যের অধিকাংশ লেখকের রচনাতেই যার ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায়, সেখান থেকে জগদীশ গুপ্ত কীভাবে স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রমী। ইউরোপে পোস্ট রেনেসাঁ অমানবতন্ত্রী সাহিত্য হিসেবে একে উল্লেখ করেন অশ্রুবাবু এবং মনে করেন কবিতায় বদলেয়র এবং উপন্যাসে দস্তয়েভস্কির মত দিকপালদের রচনায় যে বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে, বাংলা সাহিত্যে তার নজির দেখা যায় জগদীশ গুপ্তের মধ্যে। ইউটোপিয়ার বিপরীত এক ডিসটোপিয়ার ধারাটি অল্ডাক্স হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড, অরওয়েলের ১৯৮৪, জামিয়াটিনের উই ইত্যাদিতেও পরিব্যাপ্ত, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে জগদীশ গুপ্ত অনেকটাই একক ও বিচ্ছিন্ন। তার সেরকম কোনও উত্তরাধিকার এখানে নেই। অসাধু সিদ্ধার্থ, গতিহারা জাহ্নবী,লঘুগুরু, রোমন্থন প্রভৃতি উপন্যাসে মানুষ ও তার প্রকৃতি সম্পর্কে তার তীব্র অনাস্থাই প্রকাশ করে গিয়েছেন জগদীশ গুপ্ত এবং অশ্রুকুমার একের পর এক রচনা বিশ্লেষণ করে বোঝান কেন তিনি ‘মনুষ্যধর্মের স্তবে নিরুত্তর’।
অশ্রুকুমার কতটা বহুপাঠী চিলেন, আন্তর্জাতিক উপন্যাসের জগৎ সম্পর্কে কতটা অবহিত ছিলেন তা বোঝা যায় যখন তিনি বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী বা অপরাজিত উপন্যাসের আলোচনায় সার্থকভাবেই জার্মান বিল্ডুংসরোমা ও কান্টসলেরোমা জাতীয় উপন্যাস রূপের প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। গ্যেটের উইলহেম মেস্টার, টমাস মানের টোনিও ক্রোগার, রোমা রঁলার জন ক্রিস্টোফার, রিলকের মাল্টের নোটবুক, মার্সেল পুস্তের রিমেমব্রেন্স অব দ্য থিংস পাস্ট বা জয়েসের পোর্টেট অব অ্যান আর্টিস্ট এর পাশে রেখে পথের পাঁচালী বা অপরাজিত উপন্যাসের আলোচনা বাংলা সাহিত্য সমালোচনার পরিধিকে নিঃসন্দেহে অনেকটাই প্রসারিত করে দিয়েছে।
তারাশঙ্করের উপন্যাস সম্পর্কিত আলোচনায় মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের বেশ কিছু দিককে অসামান্য পারদর্শিতায় ব্যবহার করেন অশ্রুকুমার। দেখান ব্যক্তিগত জীবনে জমিদার পরিবারের সন্তান হলেও এবং জমিদারতন্ত্র সামন্ততন্ত্রের প্রতি তাঁর মনোজগতের তুলনামূলক পক্ষপাত থাকলেও কালের গতির নিয়মকে তাঁর শিল্পীসত্তা কখনো অস্বীকার করে নি। সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে ধনতন্ত্রের লড়াইতে নতুন ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের ছবি যাবতীয় যন্ত্রণা নিয়েই তারাশঙ্করের লেখালেখিতে হাজির হয়। এই প্রসঙ্গে অশ্রুকুমার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বালজাক প্রসঙ্গে এঙ্গেলস এর আলোচনা বা তলস্তয় প্রসঙ্গে লেনিনের আলোচনা। লেনিন দেখান শ্রেষ্ঠ শিল্পী সাহিত্যিকরা তাঁদের ব্যক্তিগত প্রবণতার ভিন্নতা স্বত্ত্বেও তাঁদের শিল্প সাহিত্যে সবসময়েই তুলে ধরেন, “রিভোল্ট অব রিয়েলিটি এগেইন্সট ফলস কনশাসনেস”। তারাশঙ্করের সাহিত্যকর্মকেও এই লেনিনিয় সূত্রের আলোকেই বিশ্লেষণ করেন অশ্রুকুমার।
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে প্রকাশিত অশ্রুবাবুর “হাজার বছরের বাংলা কবিতা” বইটি সাহিত্যে উৎসাহী সাধারণ পাঠকদের জন্য রচিত একটি আনুপূর্বিক ইতিহাস। চর্যাপদ থেকে হাল আমলের বাংলা কবিতার ইতিহাসের নীরস তথ্য তুলে ধরার পরিবর্তে অশ্রুকুমার সিকদার এই বইতে বেছে নিয়েছিলেন এক অন্যরকমের রচনাভঙ্গী, যার ফলে বইটি বিশিষ্ট ও স্বাদু হয়ে উঠেছে। বাংলা কবিতার নানা দৃষ্টান্তের পাশাপাশি এখানে পাঠক পান একেকটি যুগে বাংলা কবিতার যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তার সম্যক পরিচয়, বিশিষ্ট কবিদের নিজস্ব স্বরটিকেও স্বল্প পরিসরে স্পষ্টভাবে তুলে আনতে এখানে সক্ষম হয়েছেন অশ্রুবাবু। বাংলা কবিতা নিয়ে তাঁর অন্য দুটি বই – আধুনিক কবিতার দিগবলয় এবং কবির কথা কবিতার কথা – অবশ্য মননশীল গভীর চিন্তাভাবনার আকর। আধুনিক কবিতার আধুনিকতা, ঐতিহ্য, কূটত্ব, আয়তন, শরীর নিয়ে অন্তর্ভেদী আলোচনা এখানে রয়েছে। জীবনানন্দ, সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, ভাষ্কর চক্রবর্তীর কবিতা নিয়ে অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণ রয়েছে বইদুটিতে।

দেশভাগ ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রয়েছে ভাঙা বাংলা ও বাংলা সাহিত্য বইতে। এই বইয়ের প্রথম প্রবন্ধটি - ভাঙা দেশ ভাঙা মানুষ, বোবা বাংলা সাহিত্য - বইয়ের প্রধান রচনা। প্রায় আশি পাতার দীর্ঘ এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল অনুষ্টুপ পত্রিকায়। এই প্রবন্ধে দেশভাগকে অবলম্বন করে লেখালেখির সংখ্যা পূর্ববাংলায় কম কেন তার ব্যাখ্যা দেবার পর অশ্রুবাবু চেষ্টা করেছেন পশ্চিমবাংলায় লেখা দেশভাগের সাহিত্যের চরিত্র বিশ্লেষণের।
অনেক সময়েই আমাদের সাহিত্যে পলিটিক্যাল কারেক্টনেস রক্ষার চেষ্টায় লেখকেরা কীভাবে বাস্তবতার ওপরে নীতিবাদকে স্থান দিয়েছেন এবং সম্প্রীতির কথা আড়ষ্টভাবে বলেছেন - তার বেশ কিছু উদাহরণ তিনি হাজির করেছেন। নারীদের কথা এবং অন্তজ মানুষের কথা দেশভাগের সাহিত্যে তুলনায় কম উল্লিখিত কীনা সে প্রশ্নও তুলেছেন। সুদীর্ঘ এই প্রবন্ধে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা কেন্দ্রিক বাংলা গল্প উপন্যাস এবং স্মৃতিকথার ব্যাপ্ত পরিক্রমা রয়েছে। পাঞ্জাবী সহ অন্যান্য ভারতীয় সাহিত্যের দেশভাগ কেন্দ্রিক লেখালেখির কথাও প্রসঙ্গক্রমে এখানে এসেছে। দেশভাগের সাহিত্য সম্পর্কে এই প্রবন্ধটি তথ্যসমাহার ও বিশ্লেষণ - উভয় দিক থেকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রবন্ধে অশ্রুবাবু দেখিয়েছেন দেশভাগের সাহিত্য পশ্চিমবঙ্গেই মূলত লেখা হয়েছে, পূর্ববঙ্গে নয়। কারণ ওপার বাংলা থেকে অগণিত হিন্দু বাঙালি বিভিন্ন পর্বে দলে দলে এদেশে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছেন। বিপরীত ঘটনাটি, এপার বাংলার মুসলিম ওপার বাংলায় গেছেন, এই সংখ্যা তুলনায় অনেক অনেক কম। ভারত থেকে মোট সত্তর লক্ষ মানুষ দেশভাগের পর পাকিস্থানে গেছিলেন। তার মধ্যে পশ্চিম পাকিস্থানে গেছিলেন তেষট্টি লক্ষ মানুষ আর পূর্ব পাকিস্থানে সাত লক্ষ মানুষ। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত সরকারী রিপোর্ট অনুযায়ী এই সাত লক্ষ মানুষের মধ্যে পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ আবার ফিরে এসেছিলেন। বাকী মানুষদের মধ্যে অবাঙালিদের সংখ্যাই ছিল বেশি। দেশভাগের ফলে বাঙালি ছিন্নমূল মানুষের গতি ছিল মূলত একমুখী। পূর্ব থেকে পশ্চিমে। উদ্বাস্তু সমস্যার নির্দিষ্ট প্যাটার্নটির অন্যতম কারণ দাঙ্গা ও ধর্ম পরিচয়। ১৯৪৬-৪৭ সালে নোয়াখালির দাঙ্গায় ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু বাঙালি পূর্ববঙ্গ ছাড়েন। দেশভাগের ঘোষণার পর সেই স্রোত বাড়ে। ১৯৫০ সালে দাঙ্গার ও হিন্দু বাঙালির ওপর পূর্ব পাকিস্থানে রাষ্ট্রের আক্রমণ নেমে এলে বন্যার জলস্রোতের মতো সেখান থেকে বাঙালি হিন্দুর নির্গমন ঘটে।
এই পর্বে নমশুদ্র বা মতুয়ারা দলে দলে পূর্ব পাকিস্থান ছাড়তে বাধ্য হন। তাদের নেতা যিনি মতুয়াদের পাকিস্থানে থাকার পক্ষেই একদা ওকালতি করেছেন এবং পাকিস্থানের প্রথম আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই যোগেন মণ্ডল নিজে পর্যন্ত মন্ত্রীত্ব ছেড়ে প্রবল লাঞ্ছিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসতে বাধ্য হন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ এই কালপর্বে বাঙালি হিন্দুর পূর্ব পাকিস্থান ত্যাগের ঘটনা ঘটে পাসপোর্ট প্রবর্তনের ফলে, দাঙ্গার ফলে এবং বিশেষভাবে সম্পত্তি বিক্রয় সংক্রান্ত আইনের ফলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাত এবং শফিকউজ্জামানের করা এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে শত্রু সম্পত্তি ও অর্পিত সম্পত্তি আইনের দরুন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কুড়ি লাখ একরের বেশি জমি হারিয়েছে। শরিফা বেগমের হিসাব অনুযায়ী ১৯৬১ থেকে ১৯৭৪ এই পনেরো বছরে বাংলাদেশ থেকে পনেরো লক্ষ মানুষ পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এই ইতিহাসগুলো আছে। তথ্য হিসেবে আছে। বাস্তব হিসেবে আছে। এই ইতিহাসগুলিকে বিজেপি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চায়। দেশভাগ নিয়ে আলোচনা কথাবার্তায় হিন্দুত্ববাদ ও বিজেপির রাজনৈতিক অভিসন্ধিগুলি আমাদের অতি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। অশ্রুবাবুও প্রবন্ধের শেষে বীজবাক্যের মতো একটি কথাকে মাথায় রাখতে বলেছেন। ধর্মের নামে দেশভাগ ও নিদারুণ রক্তস্নান ঘটলেও “নো রিলিজিয়ন অ্যালাউজ সাচ ব্লাডলেটিং”।
এই বইয়ের একটি প্রবন্ধ মরিচঝাঁপি কাণ্ডকে কেন্দ্র করে লিখিত। যে কমিউনিস্টরা উদ্বাস্তু আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিল, তারাই মরিচঝাঁপিতে কীভাবে এত নৃশংস হয়ে উঠতে পারল রাজ্য সরকারে আসার পর পরই সে কথা সক্ষোভে যৌক্তিকভাবেই তুলেছেন অশ্রুবাবু। দেশভাগ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে বিহারী মুসলমানদের আইডেনটিটি ক্রাইসিস, যার কথা সাহিত্যে সেভাবে আসতেই পারে নি - তাই নিয়ে রয়েছে একটি প্রবন্ধ। দেশভাগ কেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য চর্চায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ আকর হিসেবে দীর্ঘদিন বিবেচিত হবে এই বইটি।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অশ্রুবাবুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘রবীন্দ্রনাট্যে রূপান্তর ও ঐক্য’বাংলা সাহিত্যে সমালোচনার একটি চিরন্তন ক্লাসিক হিসেবে গণ্য হবে। এই বইতে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাতকে সংস্করণগত পরিবর্তন নিয়ে যেমন অশ্রুবাবু আলোচনা করেছেন, তেমনি সাহিত্যের অন্যান্য ফর্ম থেকে কীভাবে নাটকে বা নাটক থেকে সাহিত্যের অন্যান্য ফর্মে যাতায়াত করেছেন রবীন্দ্রনাথ, তাও সবিস্তারে জানিয়েছেন। মুকুট বা মুক্তির উপায় গল্প থেকে একই নামের নাটকে, শেষের রাত্রি গল্প থেকে গৃহপ্রবেশে, একটি আষাঢ়ে গল্প থেকে তাসের দেশ নাটকে রূপান্তরের মধ্যে ঐক্য ও পার্থক্যের নানা মাত্রা দিয়ে এই আলোচনার শুরু। এরপর নানা অধ্যায়ে বউঠাকুরানীর হাট থেকে প্রায়শ্চিত্ত নাটকে, রাজর্ষি উপন্যাস থেকে বিসর্জন নাটকে, কবিকাহিনী কাব্য থেকে নলিনী নাটকে, পূজারিণী কবিতা থেকে নটীর পূজা নাটকে রূপান্তরের বিষয়গুলি আলোচনা করেছেন অশ্রুবাবু। দেখিয়েছেন একই গদ্যনাটকের বিকল্পরূপ নির্মাণেও রবীন্দ্রনাথের প্রবণতার দিকটি। এই প্রসঙ্গে আলোচনায় এসেছে গোড়ায় গলদ থেকে শেষরক্ষা, শারোদোৎসব থেকে ঋণশোধ, রাজা থেকে অরূপরতন নাটকে রূপান্তরের কথা। পদ্যনাটক থেকে গদ্যনাটকেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বকৃত লেখাকে সরিয়ে এনেছেন রাজা ও রাণী থেকে তপতীতে, আবার কালের যাত্রায় গদ্যনাটক থেকে গদ্যছন্দে রূপান্তর ঘটিয়েছেন পরবর্তীকালে। গীতিনাট্যেও বেশ কিছু রূপান্তরের চিহ্ন রয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্যে। বাল্মীকি প্রতিভা থেকে কালমৃগয়া, নলিনী থেকে মায়ার খেলাতে এই রূপান্তরের বিভিন্ন দিকগুলি নিয়ে চিত্তাকর্ষক আলোচনা করেছেন অশ্রুকুমার। বাংলা থেকে ইংরাজীতে ভাষান্তরকালীন রূপান্তরগুলি নিয়েও বিশ্লেষণী আলো ফেলা হয়েছে এই বিশিষ্ট আলোচনা গ্রন্থটিতে।

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৯ দুপুর ২:৩৭
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×