আমরা জানি বাংলায় মুগল আগ্রাসন প্রতিহতকারী দেশপ্রেমিক ভূঁইয়াগন বারো-ভূঁইয়া বা বারোজন ভূঁইয়া নামে খ্যাতিলাভ করেছেন। তারা সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে এই অঞ্চলে মুগলবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। সাধারণভাবে বারো-ভূঁইয়া শব্দের অর্থ বারোজন ভূঁইয়া ধরা হলেও প্রকৃত অর্থে সমগ্র বাংলাকে বিবেচনায় নিলে ভূঁইয়াদের সংখ্যা আরও অনেক বেশী ছিল। এ নিয়ে ইতিহাসবেত্তা পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
অনেকের মতে বারো-ভূঁইয়া মানে নির্ভুলভাবে বারোজন ভূঁইয়া নয়। বহু সংখ্যক বুঝাতে বারো-ভূঁইয়া শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। হিন্দু শাস্ত্রে বারো শব্দটি পবিত্রতার প্রতীক। তাই হিন্দু ধর্মশাস্ত্রবিদগণ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত মানুষদের বুঝাতে বারো শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের যোদ্ধার সংখ্যা ছিল অনেক বেশী।
পরবর্তীতে এই মতবাদকে সংশোধন করে বলা হয় যে, যারা মুগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন শুধু তারাই বারো ভূঁইয়া নামে পরিচিত। এই হিসেবে বারো ভূঁইয়ার স্যখ্যা বারো এর চেয়ে অনেক বেশী। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বারো ভূঁইয়াদের সংখ্যা ও পরিচয় নিয়ে পরীক্ষ-নিরীক্ষা করে একটি সন্তোষজনক সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়েছে। এজন্যে ভিত্তি হিসেবে ধরা হয়েছে আবুল ফজলের লেখা আকবরনামা ও মির্জা নাথানের লেখা বাহারিস্তান-ই-গায়েবীকে। এর কারণ হলো আফগান শাসনের গোলযোগপূর্ণ সময়ে মুগল সম্র্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের বাংলা বিজয়ের প্রক্রিয়াকালে বাংলায় বারো ভূঁইয়াগণ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন। পরবর্তীতে আকবরনামা ও বাহারিস্তান-ই-গায়েবীতে এই দুইজন ইতিহাসবিদ দ্বারা তারা যথাযথভাবে আলোচিত হয়েছেন। তারা দু’জনই বারো ভূঁইয়াদের বুঝাতে ইছনা-আশারা (বারো) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এ থেকে বুঝা যায় যে বারো-ভূঁইয়া শব্দটি কোন নাম নয়, বরং এটি ভূঁইয়াদের সঠিক সংখ্যা বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। এই দু’জন ইতিহাসবিদ তাদের লেখায় এও বলেছেন যে, বারোজন ভূঁইয়া ছিলেন ভাটি এলাকার লোক এবং ভাটিতেই তাদের উত্থান ঘটেছিল। কিন্তু ভাটি এলাকাকে শনাক্তকরণ কাজ সহজ নয়।
তবে আকবরনামা ও বাহারিস্তান-ই-গায়েবীর তথ্যের ভিত্তিতে ভাটি অঞ্চলকে শনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে। এ হিসেবে বাংলার সমস্ত নিম্নাঞ্চলই ভাটি। কারণ, নদীমাতৃক আমাদের এদেশটির অধিকাংশ অঞ্চলই বছরের বেশীরভাগ পানিতে ডুবে থাকে। মতভেদে ভাগীরথী থেকে মেঘনা পর্যন্ত সমস্ত নিম্নাঞ্চলই ভাটি। কারও কারও মতে হিজলী, যশোর, চন্দ্রদ্বীপ - এই অঞ্চলগুলো মূলত ভাটি অঞ্চল। আবুল ফজল ও মির্জা নাথানের বর্ণনা অনুযায়ী বারো ভূঁইয়াগণ যে ভাটি অঞ্চলে সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন সেটার সীমানা হলো পশ্চিমে ইছামতি নদী, দক্ষিণে গঙ্গা নদী, পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য ও উত্তরে আলপসিংহ পরগণা (বৃহত্তর ময়মনসিংহ ) এর উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বানিয়াচং (বৃহত্তর সিলেট) পর্যন্ত।
যদিও আবুল ফজল ও মির্জা নাথান উভয়ই ভূঁইয়াদের সংখ্যা বারো বলে উল্লেখ করেছেন, তথাপি একটি কথা মনে রাখতে হবে যে মধ্যবর্তী সময়ে তাদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করায় সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে বারো ভূঁইয়াগণ সকলক্ষেত্রে একই ছিলেন না। যেমন সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে ঈশা খাঁন মারা যান এবং এরপর তার ছেলে মুসা খান তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তেমনি সম্রাট আকবরের আমলে চাঁদ রায় ও কেদার রায় ছিলেন বিক্রমপুর ও শ্রীপুরের জমিদার। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সম্ভবত এই পরিবারের বিলুপ্তি ঘটেছিল এবং পরগণাগুলো মুসা খানের দখলে চলে গিয়েছিল। এ কারণে আবুল ফজল ও মির্জা নাথানের বর্ণনা অনুযায়ী বারো ভূঁইয়াদের নামের তালিকা এক নয়। তবে এই দুইজনের তালিকায় একটি মিল আছে। সেটা দু’জনই তেরজন করে ভূঁইয়ার নামের তালিকা করেছেন। বস্তুত নেতাসহ বারো ভূঁইয়াগণ ছিলেন তেরজন। যেমন আবুল ফজল এবং মির্জা নাথান দু’জনই তাদের বইতে বলেছেন যে, ঈশা খাঁন বাংলার বারোজন জমিদারকে তার অধীনে এনেছিলেন। তাছাড়া মির্জা নাথান তার বইয়ের এক জায়গায় বলেছেন যে, মুসা খান ও তার বারোজন জমিদার।
যাই হোক, আমরা এখন দেখে নিই যে দুইজনের তৈরী করা তালিকা অনুযায়ী বারো ভূঁইয়াগণ কারা। প্রথমে আবুল ফজলের তালিকা ঃ
১) ঈশা খাঁন মসনদ-ই-আলা
২) ইবরাহিম নরল
৩) করিমদাদ মুসাজাই
৪) মজলিস দিলওয়ার
৫) মজলিস প্রতাপ
৬) কেদার রায়
৭) শের খান
৮) বাহাদুর গাজী
৯) তিলা গাজী
১০) চাঁদ গাজী
১১) সুলতান গাজী
১২) সেলিম গাজী ও
১৩) কাসিম গাজী।
বাহারিস্তান-ই-গায়েবীতে মির্জ নাথান কর্তৃক উল্লেখ করা বারো ভূঁইয়াদের নামের তালিকা নিম্নরূপ ঃ
১) মুসা খান মসনদ-ই-আলা
২) আলাউল খান
৩) আবদুল্লাহ খান
৪) মাহমুদ খান
৫) বাহাদুর গাজী
৬) সোনা গাজী
৭) আনোয়ার গাজী
৮) শেখ পীর
৯) মির্জা মুনিম
১০) মাধব রায়
১১) বিনোদ রায়
১২) পাহলওয়ান ও
১৩) হাজী শামসুদ্দীন বাগদাদী।
এই বারো ভূঁইয়াগণ কেউ কোন রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন না। তারা ছিলেন জমিদার বা জমির মালিক। তবে বারো ভূঁইয়া হিসেবে সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য যেটা দরকার ছিল সেটা হলো তারা ছিলেন দেশপ্রেমিক। অদম্য সাহস আর বীরত্বের সংগে তারা দীর্ঘ তিন যুগ ধরে বাংলায় মুগল আগ্রাসন প্রতিহত করেছিলেন। ১৬১২ খ্রীষ্টাব্দের পর সুবেদার ইসলাম খান তাদেরকে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। এরপর থেকে বারো-ভূঁইয়া নামটি লোককাহিনীতে আশ্রয় নিয়ে আজও বেঁচে আছে আমাদের মাঝে।
তথ্যসূত্র ঃ-বাংলাপিডিয়া।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৪ সকাল ১০:৪৮