স্কুলের পিছনে গাছের ছায়ায় বসে বিথী ভাবছিল আকাশের কথা । ভাবছিল ঠিক এমনি এক দিনেই শিলা আর বিথী
এখানে বসে গল্প করছিল। তার পর হটাত আকাশ এসে কোন ভনিতা না করেই তাকে বলেছিল –
বিথী, ‘আমি তোমায় ভীষন ভালোবাসি ‘। সেদিন আকাশের কথায় কেমন হয়ে গিয়েছিল বিথী। লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে গিয়েছিল।
সোজা দুপায়ে ভড় দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সজোড়ে আকাশের দুই গাল দুই থাপ্পরে লাল করে দিয়েছিল । কি বিশ্রী কান্ড করেছিল বিথী।
সেদিন আকাশের সেই লজ্জা আর ভয়ংকর অপমানের সাক্ষী ছিল শিলা আর সুর্য । সুর্য,শিলা,বিথী,আকাশ এরা সবাই ছিল ক্লাশমেট।
দূর থেকে নিজের চোখে এ ঘটনা দেখে সুর্যের চোখে জল এসে গিয়েছিল ।
আকাশ কিছুই বলেনি সেদিন, নির্বিগ্নে বিথীর কড়া থাপ্পর খেয়েও প্রতিবাদ না করে নিঃশব্দে মাটির দিকে মুখ নামিয়ে চলে গিয়েছিল ।
শুধু একবার ফিরে তাকিয়েছিল বিথীর দিকে। উফ মনে পড়ে বিথীর। সে ছিল নীরব এক বেদনাময়,করুনামাখা আর্তদৃষ্টি ।
শিলার বদান্যতায় হেডস্যারের কানে গিয়েছিল আকাশের কথা। সরস্বতী পুজার পর যখন ক্লাশ চালু হলো আকাশকে স্কুল ছাড়তে হল
হেডস্যারের দেওয়া অপমান বুকে আর টি.সি. হাতে নিয়ে। গোটা স্কুল সেদিন বিদ্রুপ করেছিল আকাশকে। সে এক করুণ কাহিনী ।
আকাশ ছিল মেধাবী । ক্লাশে প্রথম না হলেও দ্বিতীয় স্থান ছিল আকাশের। আকাশের সারল্য নম্রতা আকাশ কে আলাদা স্থান করেদিয়েছিল ।
সেই আকাশ বিথী কে নিজের মুখে এ কথা বলতে পারবে কেউই বিশ্বাস করতে পারে নি। হয়তো সরল বলেই কঠিন কথাটি এ ভাবে
বলতে পেরেছিল আকাশ । না বললেও হয়ত ভুল ই হত- কারন বিথীর সৌন্দর্য-মাধুর্য যাই বলা হোক না কেন যা ছিল প্রকৃত সুন্দরীর
আইকন। শান্ত স্বভাবী বিথী ছিল পড়াশুনার ক্ষেত্রেও আকাশের কাছাকাছি ।
এরপর দিন গেছে,এঘটনা সবাই ভুলে গিয়েছিল। যে যার মত পাশ করে স্কুল থেকে বিদায় নিয়েছিল। শুরু করেছিল চাকুরী জীবন, সংসার ।
সময় নিয়ে গিয়েছে তাদের আজ প্রৌরত্বে । সুর্য-শিলার সংসারে বাড় বারন্ত হয়েছে। তাদের কচি কাঁচারা আজ এই স্কুলেই আসে নিয়মিত।
কি সাঙ্ঘাতিক ভুলটাই না করেছিল বিথী । ভাবে আকাশ কে এত কিছু না করলেই ভাল হত । যা করেছি তা আর কোন ভাবেই
ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না কোন দিন। যার জন্য সারা জীবন বিথী কে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে চলেছে ।
বিথী আজও জানে না আকাশ আজ কোথায় । জানে না সুর্য , জানে না শিলা, জানে না আকাশের মা-বাবা ।
সবকিছুই বদলে গেছে, সেই স্কুল-বাড়ী, সেই গাছ তলা , খেলায় মাঠ। বয়ে গেছে কত দিন-কাল-মাস-বছর।
এক মাত্র পুত্রহারা শোকে আজও দুজনে অন্ধকারে অদৃশ্য কায়ায় ভগ্ন কুঠিতে আকাশের ফিরে আসার প্রতীক্ষারত। শোনা যায় তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। অনুভব করা যায় তাদের উপস্থিতি।
আকাশ আর বাড়ি ফেরেনি সেদিন থেকে। শেষ বারের মত স্কুল থেকেই চলে গেছে কোথায় কেউ ই জানে না । কেউই ওকে খুঁজে পায় নি।
বিথী আজ অনুতপ্ত ভারাক্রান্তা। সে নিজেকেও সাজিয়ে রেখেছিল আকাশের জন্য। অপেক্ষা করেছিল আকাশের জন্য । কিন্তু আকাশ আসে নি।
বিদায়ী শীতের এলোমেলো হাওয়া বিথীর পাকাচুলে বিলি কেটে চলেছে। ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ডুকরে কেঁদে ওঠে বিথী। গাছের হলুদপাতা হাওয়ায় ঝরে পড়ে বিথীর কোলে। মনে মনে ভেবে নেয় বিথী এ বুঝি আকাশের প্রেমপত্র ।
কুড়িয়ে নিয়ে বুকে চেপে ধরে আর্তনাদ করে ওঠে বিথী "আকাশ আমার আকাশ" ।