স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত “শিন্ডলার্স লিস্ট” ও রোমান পোলানসকি পরিচালিত “দ্য পিয়ানিস্ট” সিনেমা দেখেনি — এমন চলচ্চিত্রপ্রেমী খুজে বের করা দুর্লভ। এই দুটি চলচ্চিত্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের উপর নির্মিত দুই অনবদ্য কাব্য। ঐতিহাসিক সেই যুদ্ধের একই সময়(নাৎসিদের বহিরাক্রমন) ও অবস্থানকে(গেটো,ক্র্যাকো) কেন্দ্র করে গড়ে উঠে সিনেমা দুটির কাঠামো। হিটলারের নাৎসি বাহিনী অনধিকার স্বত্বেও পোল্যান্ড আক্রমন করে পোলিশ ইহুদিদের ক্র্যাকোর গেটোতে সীমানা দিয়ে- দেয় এবং ক্র্যাকোর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে কিভাবে খুব যত্ন করে নাৎসিরা তাদের নির্মম হত্যাকান্ড চালায় সেই বীজ নিয়েই এই দুটি চলচ্চিত্রের প্রণয়ন।
শিন্ডলার্স লিস্টঃ অস্কার শিন্ডলার একজন জার্মান ব্যবসায়ী ও নাৎসি বাহিনীর সদস্য। ব্যবসার প্রসারের আশা নিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে সুযোগ খুজতে আসা এই জার্মান ক্র্যাকোতে নাৎসি বাহিনীর সহায়তায় একটি ফ্যাক্টরি চালু করেন যার শ্রমশক্তি হিসেবে কাজ করে পোলিশ ইহুদিরা। ইতজাক স্টার্ন একজন পোলিশ ইহুদি যিনি ব্ল্যাক-মার্কেট ও পোলিশ ব্যবসায়ী সমিতির সাথে গোপনে যোগাযোগ ছিল যার ফলে স্টার্ন হয়ে উঠে শিন্ডলারের প্রধান সহকারি। এমোন গোথ কিছুদিন পর ক্র্যাকোর কমান্ডেন্ট অফিসার হিসেবে আসে যার মূল উদ্দেশ্য ইহুদি নিধন। সকালে ঘুম থেকে উঠে যেন নাস্তা খাওয়ার উদ্দেশ্যে সে বাড়ির বারান্দা দিয়ে পশু শিকার করার নেয়, স্নাইপার রাইফেল দিয়ে ইহুদি শিকার করে। প্লাসো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কন্সট্রাকশন চলা সময়েই তার দায়িত্ব পরে। হেলেন নামের এক ইহুদি মহিলাকে তার বাড়ির দাসী হিসেবে নিযুক্ত করে। হেলেনকে মারা ও নির্যাতন করা এমন গোথের ব্যক্তিগত বিনোদন। ক্যাম্পটি নির্মান সমাপ্তির পরই এমোন গোথ হলোকস্ট চালানোর নির্দেশ দেন। হলোকস্টের এই নৃশংস ঘটনা অস্কার শিন্ডলারের চোখের সামনে দিয়ে হয়। নাৎসি বাহিনীর এই পশু বৃত্ত্যান্তের আয়োজন কোন গর্ভবতীর মাতৃজঠরে প্রবেশ করে কোন অভুমিষ্টকে সচকিত করতে সক্ষম। এই বর্বরতার একজন উপস্থিত সাক্ষী অস্কার শিন্ডলার, যেখানে নিস্ক্রিয় থাকার চেয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া উত্তম। ইতিহাসের এই লজ্জা তাকে মানসিকভাবে আহত করে। সে অত্যন্ত কৌশলের সাথে ইতযাক স্টার্নকে কাজে লাগিয়ে কয়েক-দফায় বিভিন্ন প্রতিকুলতার সন্মুক্ষীন হয়েও একটি তালিকা বানায়। অস্কার শিন্ডলারের বানানো এই লিস্টের লিপিবদ্ধ হওয়া সব ইহুদি সেই হলোকস্টের হাত থেকে রক্ষা পায়। (প্লট)
দ্য পিয়ানিস্টঃ ভ্লাদিসভ স্পিলম্যান পোল্যান্ড ওয়ারসোর একটি রেডিও স্টেশনে পিয়ানো বাজায়। একদিন রেডিও স্টেশনে পিয়ানো্ বাজাচ্ছে এমন সময় নাৎসি বাহিনীর বোমা এসে পড়ে(যুদ্ধ শুরু)। চারিদিকে ছোটাছুটি কোলাহল, কিন্তু তবুও যেন তার পিয়ানো বাজানো থামে না। স্পিলম্যান পরিবার বাবা মা ভাই বোন দুঃস্বপ্নে রাত পার করে। শহরে নেমে আসে ঘোর আধার। নাৎসিরা পোল্যান্ড দখল করে। পোলিশ ইহুদিদেরকে অপমানের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কখনও বয়স্ক কোন লোককে বিনা অপরাধে চপেটাঘাত করে আবার কখনও তাদেরকে রাস্তায় নাচ গান করিয়ে। ক্রমান্বয়ে নাৎসিরা ইহুদিদের বাড়ি-সম্পত্তি কেড়ে নেয়। স্বাধীনতা বলে তাদের আর কিছু থাকেনা। শহরের সকল ইহুদিকে গেটোতে স্থানান্তর করে একটি ছোট গন্ডির ভেতর বলতে গেলে আটকিয়ে সীমানা দেয়া হয়। শুরু হয় ইহুদি মারা। রাস্তায় পড়ে থাকে এক-একটি লাশ। একদিন স্পিলম্যানের পরিবার খবর পায় তাদেরকে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। আতঙ্কের গোলা ছড়িরে পড়ে ইহুদিপাড়ায়। সবাই জানে যে কাজের বাহানা দিয়ে তাদেরকে নাৎসিরা নির্মমভাবে হত্যা করার জন্যেই নিয়ে যাচ্ছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। কিন্তু, তবুও যেন মনকে তারা সান্ত্বনা দেয়। ট্রেনে উঠানোর ঠিক আগ মুহুর্তে স্পিলম্যানের পরিচিত একজন ইহুদি পুলিশ যে কিনা নাৎসি বাহিনীর সাথে কাজ করছে এসে তাকে থামায় এবং ট্রেনে যাওয়া থেকে বিরত রাখে। এই ট্রেনটিতে যারা উঠেছিল তারা মোটামুটি শেষবারের মতন ক্র্যাকো থেকে বিদায় নিচ্ছেন। একটি ইহুদিশূন্যে শহরে পরিবারহারা স্পিলম্যান নাৎসিদের তত্বাবধানে সাধারণ শ্রমিকের কাজ নেয়। ইহুদি শ্রমিকদের মাঝে সে বিদ্রোহের ঘ্রাণ পায়। সেখানে সে সম্পৃক্ত হয়। কিছুদিন পর সে তার এক বন্ধুর তদারকিতে গেটো থেকে পালাতে সক্ষম হয়। তার জন্য মরণের ঘন্টা শহরের প্রতিটি যায়গায় বাজতে থাকে। এমন মর্মান্তিক পরিস্থিতেও কিছু মানুষকে স্পিলম্যান কাছে পায় তাকে সাহায্যে করার জন্যে এগিয়ে আসে। বিদ্রোহ,অপমান আর স্বজনহারা দুঃখের ভেতর দিয়ে যেয়েও কোন কিছুই যেন তাকে আর ভাবাতে পারে না। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, তাকে এই বর্বরতা থেকে বাঁচতে হবে। খাদ্য হয়ে উঠে তার চিন্তার মূল বিষয়বস্তু।পালিয়ে বেড়াতে হয় যুদ্ধবিধ্যস্ত এই শহরে আরও একটি দিন বেশি বাঁচার তাগিদে। নাৎসিদের বোমা-বিধ্বস্ত-শহর ও লাশের স্তূপ প্রতিটি মুহুর্ত তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় শুধু একটা কথাই “মৃত্যু অনিবার্য”। (প্লট)
গেটোর সেই নির্মম পরিস্থিতি পৃথিবীর সকল মানুষকেই নাড়া দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অসংখ্য উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে নাৎসিদের পোল্যান্ড দখল ও বিপুল পরিমানে গণহত্যা ছিল সবচেয়ে আলোচিত ও তাৎপর্যপুর্ন ঘটনা। কারন নাৎসিদের পোল্যান্ড দখলের মধ্যে দিয়েই এই যুদ্ধের শুরু হয়। নাৎসিরা পোল্যান্ড আক্রমন করার দুইদিন পরই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স একইদিনে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। বলা যায় মূল যুদ্ধের সূত্রপাত এখানেই। এই প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক ডকুমেন্টারি থাকলেও খুব ভাল সিনেমা ও তার ডিটেইল চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কমই আছে। ক্লড লেঞ্জম্যানের ‘সোহা’ নামের লম্বা ডকুমেন্টারিতে অনেক ডিটেইল থাকলেও অনুসন্ধিৎসু দর্শক আরও কিছু যেন চেয়ে খুজছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই ঘটনার মধ্যে থেকে বেচে আসা এক ইহুদি লিউপদ পেফারবার্গ একজন অস্টেলিয়ার লেখক থমাস কেনেলির সাথে দেখা হয়। থমাস কেনেলি সেই বেঁচে আসা লোকটির মুখে নির্মম একটি কাহিনী শোনার পর একটি বই লেখে যার নাম ‘শিন্ডলার্স আর্ক’। বইটি বের হওয়ার পর পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ ইউনিভার্সেল কে বইটির রাইট কিনে নেয়ার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন। স্পিলবার্গ থমাস কেনেলির এই বইকে এডাপ্ট করে চিত্রনাট্য করার জন্য স্টিভেন জাইলেনকে বললেন। চিত্রনাট্য শেষ হওয়ার পর চলচ্চিত্র নির্মানের কথা ভাবতে লাগলেন। যদিও এই চলচ্চিত্রের পরিচালক সে নিজে হতে রাজি ছিলেন না। কারণ, গল্পটি সত্য ও এতই স্পর্শকাতর যা বানাতে গেলে তাকে একটি সত্যিকারের জেনোসাইড নির্মানের প্রাকটিসের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। যেটা নির্মান করা কোন পরিচালকের কাছে সুররিয়ালিস্টিক
স্টিভেন স্পিলবার্গ প্রথমে বিখ্যাত পরিচালক মার্টিন স্করসিসের কাছে যান কিন্তু স্করসিস তাকে অভিভাবন করে যে এই চিত্রনাট্য কোন পোলিশ ইহুদি নির্মাতার হাতেই দেয়া উচিৎ। স্পিলবার্গ এই গল্পের মর্ম বুঝতে পারে এমন একজন পরিচালকের কাছে যান চলচ্চিত্রটি নির্মান করার জন্য। তিনি আর কেউ নন বিখ্যাত পোলিশ নির্মাতা রোমান পোলানসকি। পোলানসকি ছিলেন একজন পোলিশ ইহুদি। যুদ্ধের সেই সময়কালে তার বয়স ছিল ছয় বছর বয়স। যুদ্ধে তার মাকে সেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে মারা হয়। সেই হলোকস্টের মধ্যে সে পালিয়ে এসেছিল। স্পিলবার্গ তাকে প্রস্তাব করে চিত্রনাট্যটির ভিজ্যুয়াল দেয়ার জন্য। কিন্তু, রোমান পোলানসকি তার এই প্রস্তাব নিতে রাজি হননি। কারন চিত্রনাট্যটি তার শৈশবের সাথে ঘটে যাওয়া সময়ের সেই নির্মম পরিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যা তার জন্য খুবই ব্যক্তিগত বিষয়। এরপর স্পিলবার্গ আরও অনেকের কাছেই যান এর মধ্যে বিলি ওয়াইল্ডার ছিলেন হলোকাস্টের আরেকজন ভুক্তভোগি। তিনি তার পরিবার এই হলোকস্টেই হারান। তিনি স্পিলবার্গকে জানালেন এই সিনেমা বানালে এটিই হবে তার বানানো শেষ সিনেমা। পরবর্তীতে বিলি ওয়াইল্ডার স্পিলবার্গকেই অনুরোধ করলেন যে তিনি নিজেই যেন এই সিনেমাটির নির্মাতা হিসেবে থাকেন। তারপর স্পিলবার্গ দৃঢ় হলেন যে সেই ভিজ্যুয়াল দিবেন এবং এই সিনেমার জন্য কোন অর্থ নিলে তা হবে ‘ব্লাড মানি’। তার সিনেমার নাম ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’।
শিন্ডলার্স লিস্ট সিনেমাটির মূলভাব একজন ব্যক্তি যার নাম অস্কার শিন্ডলার যিনি নাৎসি বাহিনীর সদস্য হয়েও, তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভালত্বকে কাজে লাগালেন অসংখ্য ইহুদি বাচানোর তাগিদে। আর তার বিপরীতে একজন নাৎসি অফিসার এমোন গোথ যার কাছে ইহুদি হত্যা করা ছিল মামুলি ব্যপার। হাজার-হাজার ইহুদি হত্যার মধ্যে যে পৈশাচিক বিনোদন যে পায় — তাকেই অস্কার শিন্ডলার বশ করতে চেয়েছিলেন কৌশলে। সক্রেটিসের একটি বচন আছে ‘ভালোত্বই জ্ঞান’। খারাপত্ব কখনও জ্ঞান হতে পারে না। কিন্তু, খারাপত্ব একটি নেশা। এমোন গোথ বশ হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু যে খারাপত্বের বীজ তার ভেতরে রয়েছে তা এই সিনেমায় গোথ আবারও প্রকাশ করে দেন। শিন্ডলারের ভালত্ব কিছু সময় গোথকেও ভাবায় এবং সে এক ইহুদি কিশোরকে ভুল করা স্বত্বেও এমন গোথ তাকে মাফ করে দেয় যেখানে গোথ ভুল ছারাই ইহুদি হত্যা করে থাকে। কিন্তু, তার খারাপত্ব এতই গভীর যে তা কিছুক্ষণ পর জানান দেয়। গোথ সেই কিশোরকে পরবর্তিতে হত্যা করে। যদিও বাস্তবে সেই কিশোরকে এমোন গোথ হত্যা করে্ননি এবং মাফ করে দিয়েছিলেন — কিন্তু সিনেমার থিম ঠিক রাখার জন্য স্পিলবার্গ কান্ডটি ঘটান। শিন্ডলার্স লিস্টে ক্র্যাকো শহরের সেই অন্ধকার দিনগুলো অনেকগুলো কোণ থেকে দৃষ্টিপাত হয়। নাৎসি বাহিনীর গণহত্যা চালানোর যেই আয়োজন এই সিনেমাতে দেখানো হয় তা যেন এলেম ক্লিনভের ‘কাম এন্ড সি’ সিনেমার সেই নৃশংস দৃশ্যগুলোকেও ছাড়িয়ে যায়। অস্কার শিন্ডলার যে ব্যক্তি ধনী হতে এসেছিলেন ক্র্যাকোতে সে কিনা অর্থ দিয়ে কিনে নিলেন এক একটি ইহুদিদের প্রান। ধনী হতে এসে মহান হয়ে ফিরে গেলেন। যে নিয়ে গেলেন অজস্র মানুষের ভালোবাসা এবং পৃথিবীর ইতিহাসে একজন এমনই কীর্তিমান যে মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন আজীবন। যেখানে একজন এমন গোথের একটি মাত্র খারাপ দিক সেখানে একজন অস্কার সিন্ডলার তার ভেতরে লুকিয়ে রাখে অনেকগুলো ভালো দিক। ভালোবেসে ইহুদিদের পক্ষ থেকে একটি উপহার তাকে দেয় স্টার্ন এবং টালমুড জিউস ‘ল’ থেকে একটি উদ্ধৃত শোনায় তাকে ‘Whoever saves one life saves the world entire’।
ক্র্যাকোর গেটোর নির্মম সেই ইতিহাসের সাক্ষী রোমান পোলানসকি। স্পিলবার্গের প্রস্তাবকে অসম্নতি জানানোর ব্যপারটি ইতিবাচক হিসেবেই সবাই নিয়েছিল। যেই ভয়ানক শৈশব থেকে পোলানসকি ফিরে এসেছিল ও যে ঘটনার জন্য তার মাকে সে হারিয়েছে। সেই ঘটনার উপর চলচ্চিত্র নির্মান করা কোন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু, মানুষের চাহিদার তো শেষ নেই। রোমান পোলানসকি এমনই এক ব্যক্তি যে শুধু একজন দক্ষ পরিচালকই নন, যাকে নিয়ে অনেকগুলি চলচ্চিত্র বানানো সম্ভব। যে কিনা দর্শকদের অসংখ্য ভালো চলচ্চিত্র ইতিমধ্যে উপহার দিয়েছেন, যার জীবন হলোকস্টের সাথে খচিত, তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানাবেন না ভাবতেই কেমন জানি খাঁকতি লাগে। প্রায় এক দশক পর বরফ গলা শুরু করল। তার মূল কারন ছিল ভ্লাদিসভ স্পিলম্যান। যে একজন হলোকস্ট সারভাইভার। স্পিলম্যান একটি মেমোয়ার বের করেছিলেন যা কিনা তার নিজের উদ্বর্তন ঘটনার উপর যার নাম ‘Śmierć miasta’। স্পিলম্যানের এই বইটি পোলানসকি তার মনের গহিনে লুকিয়ে রাখা কোন এক বিষাদ মেশানো সৃতিকে আন্দোলিত করেছিলেন। কারন, তিনি নিজেও সেই যুদ্ধের একজন সারভাইভার। তিনি যেন স্পিলম্যানের মাঝে নিজেকে সেই প্রতিকুলতার মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন। যে মৃত্যুজাল শহরের প্রতিটি ইঞ্চিতে বেছানো ছিল, সেখান থেকে বেঁচে তিনি আজ রোমান পোলানসকি। স্পিলম্যানের কাহিনীও একটি অসাধারন কাহিনী। দুঃখভরা ও দুঃস্বপ্নের সেই সৃতি থেকে মাত্র একটি ব্যপারই পোলানসকিকে আরাম দেয়, যে সে বেচে এসেছিল। যুদ্ধের পর তার বাবাকে খুজে পেয়েছিলন। উদ্দ্যেগ নিলেন স্পিলম্যানের কাহিনীর উপর সিনেমা বানাবেন। রোনাল্ড হারউড চিত্রনাট্য লিখলেন। পোল্যান্ড,ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে প্রযোজকরা এগিয়ে আসলেন সামিল হতে। স্পিলম্যানের চরিত্রের জন্য প্রায় ১৪০০ অভিনেতা অডিশন দিতে এসেছিলেন। সেখান থেকে আদ্রিয়ান ব্রডিকে পছন্দ করলেন। শুরু হয় আরেকটি যুদ্ধ জার্মানির ব্যবেলসবার্গের স্টুডিও্তে যা ইউরোপের সবচেয়ে বড় স্টুডিও।
একজন শৈল্পিক যার পেশা পিয়ানো বাজানো। তার দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধের পটভূমি তুলে নিয়ে সেই অনুযায়ী উপস্থাপনই ‘দ্য পিয়ানিস্টের’ মূল উদ্দেশ্যে। যে যুদ্ধ থেকে সে বেঁচে এসেছিলে্ তা কোন সাধারণ যুদ্ধ নয়। সিনেমাতে হলোকস্টকে অনেকভাবে এরাতে দেখা গেছে পোলানসকিকে। হলকস্টের মাত্রা বারানোর আগেই প্রটাগনিস্টকে সেসব যায়গা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। একটি দৃশ্য ছিল এমন যে ক্ষুধার্ত প্রটাগনিস্ট একটি হাসপাতালের ভেতর আশ্রয় নেয়— সেখানে অনেক গোলাগুলি হয়। নাৎসি ও পোলিশদের সংঘর্ষে জানালার একটি কাঁচ গুলি লেগে ভেঙে ফুঁটা হয়ে যায়। সেই ফুটা দিয়ে প্রোটাগনিস্ট এক নজর দেখে নেয় যে নাৎসিরা অসংখ্য তাজা লাশ পোড়াচ্ছে (যেন অনেক কস্টে দেখতে হচ্ছে এই দৃশ্যটি সেই ফু্টা দিয়ে যা কিনা, না দেখাই শ্রেয়)। আরেকটি দৃশ্যে নাৎসিরা তাদের নববর্ষ উদযাপন করে ইহুদি পিটিয়ে, যেন দাসী পেটাচ্ছে। এই দৃশ্য থেকে নাৎসি বাহিনীর মানসিকতা বের হয়ে আসে যে তারা কতটা বর্বর হতে পারে। যদিও দর্শক ততক্ষনে একটি ব্যাপারে মনোযোগী যে এই নির্মম পরিস্থিতিতে স্পিলম্যান কিভাবে বেঁচে আসবে কিংবা তার দেহপাত হতে হলে আর কতটা তিক্ত আয়োজনের মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হবে। যেখানে খাবারের পরিবর্তে চারিদিকে খুজে পায় অগণিত তাজা লাশ। খাদ্যের জন্য সে তার এক ভক্তের(হলেও হতে পারত প্রেমিকা কিন্তু তার আগেই যুদ্ধ শুরু) বাড়িতে তার স্বামীর কাছে জীর্নতার সাথে জিজ্ঞেস করে ‘আপনাদের কাছে খাওয়ার জন্য পাউরুটি আছে?’ এই দৃশ্য যেন প্রতিটি মানুষকে একটি প্রশ্নের প্রান্তস্থে নিয়ে যায় ‘এই লজ্জাকর ঘটনার শেষ কোথায়?’। নাৎসি বাহিনীর এক অফিসার যখন স্পিলম্যানকে খাবার এনে দেয় তখন প্রতিটি দর্শক যেন খুজে পায় পৃথিবীর এই মহাকলঙ্ক ঘোচানর একটি দরজা। যে দরজার ভেতর দিয়ে স্পিলম্যান বেঁচে আসে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট ধারনা করেছিলেন, স্পিলম্যানের ছায়ায় পোলানসকি হয়ত নিজের গল্প প্রতিবিম্ব করলেন। একটি দৃশ্যে স্পিলম্যান যখন ট্রেনে উঠতে না পেড়ে মৃত্যুনগরি ক্র্যাকোর গলিতে একটি শিশুর মতন ভেউ ভেউ করে কাঁদছিলেন তখন মনে হচ্ছিল পোলানসকি নিজে কাঁদছেন। যুদ্ধের পর স্পিলম্যান একজন বিখ্যাত কম্পোজার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হল, তিনি বেঁচে এসেছিলেন সেই নরক থেকে। বলা হয়- ‘Music was his passion. Survival was his masterpiece’।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৬ দুপুর ২:০০