এই অবসরে আমাদের বন্ধু পবন পাড়ার মেয়ে মমীর প্রেমে পড়ে গেল।বন্ধুর শয়ণে স্বপনে জাগরণে শুধুই মমী আর মমী। দূর থেকে মমীর বাসার দিকে লক্ষ্য রাখা, কখন ব্যালকনীতে আসে, কখন জানালার পাশে দাঁড়ায়, কখন স্কুলে যায়, কখন কোচিং সেন্টারে যায় এসবের খেয়াল রাখা ছিল আমাদের ছিল আমাদের প্রতিদিনের রুটিন।মমী মেয়েটা কালো, তাতে কি? বন্ধু আমাদের দিওয়ানা হয়েছে এই মমীর প্রেমে, তাকে সহায়তা করা আমাদের দায়িত্ব, এবং অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে আমরা সেই দায়িত্ব পালন করতে থাকলাম। মমী কালো হলেও চেহারায় একটা সুইটনেস ছিল আর তাতেই আমাদের বন্ধুর এই হাবুডুবু খাওয়ার অবস্থা। আমাদের সবারই তখন চিন্তা একটাই যেকোনো মুল্যে আমাদের বন্ধুকে মমীর সাথে প্রেম করিয়ে দিতেই হবে। কিন্তু আমরা পাড়ার ভাল ছেলে, মেয়েদের বিরক্ত করাটা আমাদের কাজ নয়, তাহলে কিভাবে হবে?এ নিয়ে আমরা বন্ধুরা একদিন মিটিং বসালাম। নানাজন নানা প্রস্তাব দিল, এরমধ্যে লিটনের প্রস্তাবটাই সবার মনে ধরলো। প্রস্তাবটা ছিল এমন
-প্রতিদিন মমীর ছোটভাই পাড়ার রাস্তায় খেলতে আসে, যেকোনো একসময় তাকে আলাদাভাবে ডেকে চকলেট চিপস দিয়ে পটাতে হবে। তারপর সুযোগ বুঝে পবনের লেখা আবেগঘন ভালবাসার চিঠিখানা তার হাতে গুজে দিয়ে মমীর কাছে পাঠাতে হবে।
পরিকল্পনা অনুয়ায়ী মমীর ভাইকে খেলার ফাকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে দু'চারটে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে হাতে একটা ক্যাডবেরি ডেইরি মিল্ক চকলেট গুজে দেওয়া হল। প্রথমে নেবো না করলেও তার চেহারা দেখেই বোঝা গেল চকলেট দেখে তার চোখ লোভে চকচক করছে। আমরা আদর যত্ন করে বন্ধুর হবু শ্যালককে চকলেট খাওয়ালাম। এরপর হাতে পবনের চিঠি গুজে দিলাম, এবং বারবার সাবধান করে দিলাম এই চিঠি যেন অন্য কারো হাতে না পড়ে।
এরপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেল কিন্তু মমীর কাছ থেকে কোন উওর আসলো না। ওদিকে আমাদের বন্ধুর অবস্থা কাহিল।
একদিন মমী স্কুলে যাচ্ছিল, প্রতিদিনের মত আমরাও দূর থেকে তাকে ফলো করছিলাম, হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম মমী তার ব্যাগ থেকে ইচ্ছে করেই একটা কাগজের টুকরা রাস্তায় ফেলে দিল। মমীর হাত থেকে ভাজ করা কাগজ পড়তে দেখে আমাদের বুঝতে বাকী রইলো না কাগজটা আমাদের উদ্দেশ্যেই ফেলা হয়েছে। আমরা দ্রুত গতিতে কাগজটা তুলে নিলাম। কাগজে লেখা ছিল মাত্র দূটো শিশুতোষ লাইন,
'পবন নামের ছেলেটি ক্লাশ টেনে পড়ে
যতসব দুষ্টু ছেলেরা তার সাথে ঘোরে'
এই চিঠি পাওয়ার পর আমাদের সবার চোখে বিশ্বজয়ের আনন্দ। যদিও আমাদেরকে দুষ্টুছেলে বলা হয়েছে তবুও আমরা মাইন্ড করিনি। সবাই মিলে পবনকে ছেঁকে ধরলাম, 'আজ খাওয়াতেই হবে' ওর কাছে টাকা ছিল না, আমরাই ওকে টাকা ধার দিলাম।
শুরু হল ওদের দুরন্ত প্রেম, এখন আর মমীর স্কুলে বা কোচিং সেন্টারে যাওয়ার সময় পবনকে দূর থেকে ফলো করতে হয় না পাশাপাশি হেটে স্কুল এবং কোচিং সেন্টার পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে পারে। তাই আমাদের আর ওর সাথে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, এভাবেই বেশ কয়েকমাস খুব ভালভাবেই চলছিল ওদের প্রেমের তরী। ঈদে এখন পবনকে আমাদের সাথে পাই না,অবশ্য এতে আমাদের খুব বেশি আক্ষেপ ছিল না,আমাদের বন্ধু ভাল আছে এতেই আমরা খুশি।
কিন্তু নিয়তি বড়ই নিষ্ঠুর, পবন এবং মমীর এই সুখ খুব বেশিদিন স্থায়ী হল না। একদিন পবনের সব চিঠিসহ মমী ধরা পড়ে গেল তার মায়ের হাতে। পরে জেনেছি মমী মা সেদিন মমীকে শুধু বকাঝকাই করেনি রীতিমতো গায়ে হাত তুলেছিল। এরপর থেকে বন্ধ হয়ে গেল মমীর সাথে পবনের গোপন অভিসার। মমীর বাবা মা শুধু পবনকে নয় আমাদেরকেও সন্দেহের চোখে দেখতো। একদিন মমীর বাবা পবন এবং আমাদের সবাইকে ডেকে রীতিমতো হুমকি দিয়ে বললেন, তার মেয়ের আশেপাশে দেখলে আমাদেরকে জেলের ভাত খাওয়াবেন। আমরা ছোট মানুষ এই হুমকি ভয় পেয়ে পবনকে বললাম
'বন্ধু মমীর আশা ছেড়ে দেও'
এখন আর মমী একা স্কুলে বা কোচিং সেন্টারে যেতে পারে না তার সবসময়ের সঙ্গী তার মা অথবা আন্টি। মমীর সেই ছোট ভাইটিকেও এখন আর চকলেটের লোভে ভুলিয়ে চিঠি পাঠানো যায় না, আমাদের দেখলে দৌড়ে পালিয়ে যায়। পবন বেচারার দুঃখে আমাদের দুঃখিত হওয়া ছাড়া কিছুই করবার নেই। পবন মমীর বিরহে ইতিমধ্যেই সিগারেট ধরেছে।
এভাবেই প্রায় ছয়মাস কেটে গেল একসময় আমরা ধরেই নিয়েছিলাম পবন আর মমীর প্রেমের সমাপ্তি ঘটেছে। আমরা তখন কলেজে ভর্তি হয়েছি, পড়াশুনার খুবই চাপ তাই পবন মমীকে নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা আগের মত নেই। একদিন পবনের কাছ মমী তার বান্ধবীর মাধ্যমে একটা চিঠি আসলো চিঠি ভাষা ছিল এমন
প্রিয় পবন
আমার আব্বা তোমার আমার ব্যাপারটা জানার পর থেকে আমাকে বেশ কয়েকবার মেরেছে। এখনও উঠতে বসতে আমার বাবা মায়ের কাছ থেকে নানারকম কটু কথা শুনতে হয়। আমার জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে আমার পক্ষে এভাবে বেচে থাকা সম্ভব নয়। বাবা মায়ের কাছে এভাবে কটু কথা শোনা আর মার খাওয়ার চেয়ে তোমার সাথে ফুটপাতে থাকাও ভাল। তাই আমি ঠিক করেছি আমি তোমার কাছে চলে আসবো, আগামী রবিবার আমি স্কুলের নাম করে বাসা থেকে বের হয়ে তোমার কাছে চলে আসবো। তুমি আগামী রবিবার আমাদের স্কুলের গেটের সামনে অপেক্ষা করবে।
ইতি
তোমার মমী।
বুঝলাম বিষয়টি এখন সিরিয়াস পর্যায়ে পৌছেছে।আসলে বাবা মা তাদের মেয়েকে সুন্দরভাবে না বুঝিয়ে শুধুই মারধোর করেছে বলেই মেয়ে বিগড়ে গেছে। পবন আমাদের কাছে পরামর্শ চাইলো কি করা যায়? আমরা কোন সমাধান দিতে পারলাম না। শেষমেষ পবন সিদ্ধান্ত নিলো রবিবার মমীর স্কুলের সামনে ওর জন্য অপেক্ষা করবে।
নির্ধারিত দিনে পবন যথারীতি মমীর স্কুলের গেটে হাজির তার সঙ্গী ছিল আমার অপর দুই বন্ধু লিটন এবং মাসুদ। ওরা তিনজন স্কুলের গেট থেকে একটু দূরে অপেক্ষা করছিল, কিন্তু বিধিবাম সেদিন মমীর সাথে ওর আম্মুও ছিল। মমী স্কুলের গেটে ঢোকার আগ মুহুর্তে চারিদিকে তাকাচ্ছিল এবং পবনকে খোঁজার চেষ্টা করছিল। দশ পনের মিনিট অপেক্ষার পর ওরা যখন ধরেই নিয়েছিল মমী বের হবে না। তখন ওদেরকে অবাক করে দিয়ে মমী স্কুল থেকে বেরিয়ে এলো, ততক্ষণে মমীর মা বাসায় চলে গেছেন।
একটা বেবিট্যাক্সি ভাড়া করে ওরা রওনা দিল, গন্তব্যে পবনের বোনের বাসা, পবনের বোন দুলাভাই গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল পবনের কাছে বাসার চাবি দিয়ে। মমীর প্রথম কথা ছিল আগে বিয়ে করতে হবে পবনও তাতে সায় দিল। পবনের বোনের একটা লাল শাড়ি পারে নিল মমী আর পবন পরলো ওর দুলাভাইয়ের পাঞ্জাবি। কিন্তু বাদ সাধলো স্থানীয় কাজী, তারকথা ছেলে মেয়ে দুজনেই অপ্রাপ্ত বয়স্ক তাই এই বিয়ে তিনি পড়াবেন না। যদি ওরা নিজেদের গার্জিয়ান নিয়ে আসতে পারে তবে তিনি বিবেচনা করে দেখবেন। কি করা? লিটন আর মাসুদ বাসায় আগেই বলে এসেছিলো রাতে বাসায় ফিরবে না, তাই ওরাও পবন মমীর সাথে ওদের পবনের বোনের বাসায় থেকে গেল।
ওদিকে মমীর মা বাবা হন্যে হয়ে পবনকে খুজতে লাগলো। লোক জানাজানির ভয়ে মমীর বাবা প্রথম দিন কাউকেই ঘটনাটা বললেন না এমনকি পবনের মা বাবাকেও নয়। লিটন মাসুদের বাসায় গিয়ে ওদেরও খুজতে লাগলেন ওদেরকে না পেলেও ওদের বাসা থেকে জানতে পারলেন ওরা তিনজন একসাথেই পবনের বোনের বাসায় আছে তখন শিওর হয়ে গেলেন ওদের সাথেই মমী আছে।
পরদিন ভোরে লিটন এবং মাসুদ বাসায় ফিরে এল ওদেরকে রেখে আর ঠিক তখনই ওরা দুজন মমীর বাবার হাতে ধরা পড়লো। মমী বাবা সাথে আরও দুইতিনজন পুরুষ মানুষ ছিলেন সম্ভাবত ওর মামা বা চাচা হবেন।
-বল আমার মেয়ে কোথায়? নইলে তোদের দুজনকে জেলে ভরবো।
ওরা ভয়ে সব স্বীকার করলো। ওদের দুজনকে নিয়ে পবনের বোনের বাসায় হানা দিলেন এবং পবন এবং মমীকে হাতে নাতে ধরলেন। মমীর বাবা সবাইকে শপথ করালেন গত রাতের ঘটনা যেন পৃথিবীর আর কেউ না জানে,আর যদি জানাজানি হয় তবে ওদেরকে মেরে হাড়গোড় ভেঙে দেবেন।
এরপর থেকেই মমীকে পুরোপুরি বন্দী করা হল, ওর মা ওকে স্কুলে নিয়ে যেতো এবং যতক্ষণ ক্লাসে থাকতো ততক্ষণ তিনিও স্কুলের বাইরে বসে থাকতেন। ওদিকে পবনের যাচ্ছেতাই অবস্থা, মমীর বিরহে সিগারেটের পাশাপাশি গাজাও ধরেছে। আমরা ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু পৃথিবীর কোন কিছুতেই যেন ওর আর আগ্রহ নেই।
একদিন বিকেলে খেয়াল করলাম মমীদের বাসা লাইটিং করা হয়েছে, আশপাশের মানুষের কাছ থেকে জানলাম কাল মমীর বিয়ে। মমীর চেয়ে তিনগুণ বয়সের এক লোকের সাথে মমীর বিয়ে হয়ে গেল। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার রইলো না। সময়ের সাথে সাথে আমাদের বন্ধু পবনও স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। সবকিছুই স্বাভাবিক সেই একটি রাতের ঘটনাও আমরা কখনোই কারো কাছে প্রকাশ করিনি।
সৈয়দ তারেক মাহমুদ
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৪:১৩