ইচ্ছা ছিল না করোনা নিয়ে কোনো কথা বলব। কারণ লেখালেখি করে সচেতনতা বাড়ানো সম্ভব না শিক্ষিত মূর্খদের মাঝে। কারণ যে সচেতন হবার এমনিতেই হবে নিজের গরজে, আর যে হবার না তাকে মাথায় শটগান ঠেকিয়েও সতর্ক করা সম্ভব না।
আচ্ছা, আগে কিছু ভয়াবহ তথ্য দিই, যেগুলোর অনেকখানিই গত কয়েকদিনে শুনেছেন-পড়েছেনঃ
১। ইউরোপের অষ্টম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ইতালি এখন আইসিইউ সঙ্কটে, নেই পর্যাপ্ত হাসপাতাল শয্যা, ওয়েটিং রূম-হলওয়েতে মিলছে ঠাঁই।
সূত্রঃ https://bit.ly/3be7Grs
২। গত ২০ মার্চ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইতালিতে মৃতের সংখ্যা ৪,০৩২ জন। আক্রান্ত ব্যক্তি ৪৭,০২১ জন।
সূত্রঃ https://bbc.in/2QATfpH
৩। ২১ মার্চের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এক দিনে মারা গেছে ৭৯৩ জন করোনা রোগী।
সূত্রঃ https://bit.ly/2UvKJsW
৪। ৮৫+ উপরে বয়সী মানুষদের চিকিৎসা দিচ্ছে না হাসপাতালগুলো। যাদের সার্ভাইভাল চান্স বেশি- তাদেরই বেছে বেছে চিকিৎসা দিচ্ছে। ডাক্তাররা নিরুপায় হয়ে ঠিক করে দিচ্ছেন কে বাঁচবে আর কে মরবে।
ইতালির কোমর ভেঙে যাবার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে সময় মতো জনগণের মাঝে সচেতনতার অভাব ও সরকারের উদ্যোগ গ্রহণ না করা।
এখন আসি সোনার দেশ বাংলাদেশের কথায়। তার আগে কিছু টুকরো ঘটনা শেয়ার করি-
১। ফ্রান্স থেকে দেশে ফিরে সরকারি নির্দেশনা না মেনে বিয়ে করেন হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার করাব গ্রামের বাসিন্দা মাসুক মিয়া। বিষয়টি জানতে পেরে আজ মঙ্গলবার তার বৌভাত অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। স্ত্রীসহ মাসুক মিয়াকে বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে।
সূত্রঃ https://bit.ly/33C1aIl
২। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে এক ব্যক্তি ফিরেছেন গত মঙ্গলবার। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে নিজ ঘরে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা তাঁর। কিন্তু এসবের কিছুই মানছিলেন না তিনি। উঠোনে ঘুরছিলেন তিনি। হঠাৎ পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন দেখে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলেও ধরা পড়ে গেছেন। এ কারণে তাঁকে জরিমানাও করা হয়েছে। এই ঘটনা ঘটেছে আজ শনিবার সিলেটের গোলাপগঞ্জের রনকেলি গ্রামে।
সূত্রঃ https://bit.ly/33DFzPH
৩। করোনা নিয়ে তর্কাতর্কি-হাতাহাতিতে এক জন নিহত, ১২ জন আহত।
সূত্রঃ https://bit.ly/2U7Ze7l
৪। মিরপুরের টোলারবাগে মারা যাওয়া ব্যক্তি নিজের এক্সপোজার হিস্ট্রি গোপন করে ঘুরেছেন তিন হাসপাতাল, অবশেষে মারা গেছেন ডেল্টা মেডিকেলে। তাদের লক ডাউন করা বিল্ডিং দেখতে ভিড় জমিয়েছে এলাকাবাসী। মৃতব্যক্তির পরিবার পলাতক।
সূত্রঃ https://bit.ly/2xYEq9U
সূত্রঃ https://bit.ly/2wjJEwy
৫। লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে সৌদিপ্রবাসী এক নারী ভর্তি হয়েছেন শুনে পালালেন ৩৮ রোগী।
সূত্রঃ https://bit.ly/2vJMzOM
৬। করোনা ভাইরাস সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পরেও সৈকতে মানুষের ঢল। তাদের অবশ্য পরবর্তীতে প্রশাসন তাড়িয়ে দেয় মাইকিং করে।
সূত্রঃ https://bit.ly/2vBkicW
৭। বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ও সতর্কবাণী উপেক্ষা করে ধানমন্ডি লেকে সন্ধ্যায় জনসমাগম, যাদের বেশির ভাগই তরুণ-তরুণী আর মধ্যবয়সী নারী-পুরুষ।
সূত্রঃ https://bit.ly/2UpvIc9
৮। দিয়াবাড়িতে প্রস্তাবিত কোয়ারেন্টাইন জোন প্রতিবাদের মুখে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
সূত্রঃ https://bit.ly/2WxchRx
৯। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ঘরে নামাজ আদায়ের পরামর্শ’র প্রতিবাদে হবিগঞ্জের বাহুবলে বিক্ষোভ। উল্লেখ্য, কাবা ও মসজিদে নববীতে করোনা প্রতিরোধে নামাজ স্থগিত করা হয়েছে)
সূত্রঃ https://bit.ly/2J2vuCA
১০। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের কোভিড-১৯ রেসপন্স টিমের সাম্প্রতিক কালের খুবই ইনফ্লুয়েন্সাল একটা রিপোর্টের মডেল ও বাংলাদেশের জনমিতির তথ্য ব্যবহার করে এই ভবিষ্যৎবাণী করা যে- বাংলাদেশে করোনা মহামারীতে মোট ৮৯, ১২০,১৬১ ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে। যার মাঝে ৩,৩০৭,৩৯৩ জন রোগীর হসপিটাল ট্রিটমেন্ট লাগতে পারে। ৬৯৬,৫৯৫ জন রোগীর আইসিইউ সাপোর্ট লাগতে পারে। এবং ৫০৭,৪৪২ জন রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
সূত্রঃ https://bit.ly/2xVPMeF
১১। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে করোনা আক্রান্ত ২৪ জন, মারা গেছে ২ জন। মৃতের হার চীনের ২% থেকে অনেক বেশি (১০%)।
সূত্রঃ https://bit.ly/2QCnQTD
এসব ঘটনা উল্লেখ করলাম কেন? সবগুলোই তো নেতিবাচক, মহামারির সময় জনমনে আতঙ্ক ছড়ানো আমার উদ্দেশ্য না। এসব ঘটনা একসাথে তুলে ধরার একটাই কারণ- আমরা সাধারণ জনগণের একটা বড় অংশই প্রস্তুত নই, প্রাণঘাতী ভাইরাসকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে ব্যর্থ হচ্ছি, ঝুঁকিতে ফেলছি নিজেকে-চারপাশের মানুষকে।
আমি সরকারি উদ্যোগের কথা বলছি না। সরকার কী করছে, কী করছে না- তা আমার পোস্টের উদ্দেশ্য না (কারণ…)। সরকার যে উদ্যোগই নিক না কেন, আপনি-আমি যদি সচেতন না হই, আশেপাশের মানুষকে সচেতন করে তুলতে না পারি- তাহলে কোনো রাষ্ট্রযন্ত্রই কুলিয়ে উঠতে পারবে না। সেটা বাংলাদেশ হোক কিংবা চীন সরকার। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কিছু কিছু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, বেসরকারি ভাবেও স্বল্প উদ্যোগ চোখে পড়ছে- তবু তা যথেষ্ট না! না! না!
ইতালিয়ানদের মতোই আমরা অসচেতন ছিলাম, এখনো আছি। দেশের শিক্ষার হার ৭৩% হলেও প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের বড্ড অভাব। সার্টিফিকেটধারী হতে পারলেই সত্যিকারের শিক্ষিত হওয়া যায় না, মানুষ হওয়া যায় না। আর সেটাই ফুটে উঠছে বিপদের সময় আমাদের গণ্ডমূর্খের মতো আচরণের মাধ্যমে। ঠিক এই কারণেই উপরের পয়েন্টগুলো তুলে ধরেছি। অন্য কে কী করছে তা ভাববেন না, নিজে কী করছেন তা খেয়াল করুন। যেচে পড়ে বিপদে পড়বেন না, অন্যকে বিপদে ফেলবেন না দয়া করে। নয়তো ইতালির চেয়ে বহুগুণ বড় হয়ে থাবা বসাবে কোভিড-১৯, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আর চিকিৎসা সুবিধা নিয়েও ইতালি সামলে উঠতে পারছে না, সেবা দিতে পারছে না- এটা দয়া করে একটু ভাবুন। চীনের আনবেন না দয়া করে, কারণ চীন যেভাবে দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে সেভাবে মোকাবেলা করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না, নেই, হবেও না। একবার প্রকোপ শুরু হয়ে গেলে মসজিদ-মন্দির-গীর্জায় ভিড় জমালেও মৃতরা ফিরে আসবে না।
FAQ:
১। উপায় না বাতলে অহেতুক সমালোচনা আর ভুলত্রুটি কেন দেখাচ্ছেন?
উঃ আঁতে ঘা না লাগলে আপনারা নড়েচড়ে বসেন না, তাই…
২। তো এখন কী করার আছে?
উঃ সরকারি সাইটের লিঙ্ক দিচ্ছি, কষ্ট একটা পিডিএফ নামিয়ে দেখুন কী লেখা আছে। (https://bit.ly/2J1VUo7) নিয়মগুলো অভ্যাসে পরিণত করতে একটু কষ্ট হবে, কিন্তু কিছু করার নেই। এছাড়া আরও কিছু উপায় বাতলে দিচ্ছিঃ
• অন্তত ১৫ দিনের জন্য নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখুন, যাতে বিল্ডিং-এর সিঁড়ির রেলিং, লিফট, গেট স্পর্শ করতে না হয়, কারও আচমকা হাঁচি-কাশির শিকার হতে না হয়,
• বিদেশ ফেরত আত্মীয় থাকলে তাকে দেখতে যাবার দরকার নেই,
• বাসায় রোগী থাকলে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র-জরুরী ওষুধ একটু বেশি করে কিনে আনুন।
• বয়স্কদের প্রতি বাড়তি যত্ন নিন। সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে তারাই আছেন।
• কর্মস্থলে যেতে হলে মাস্ক-গ্লাভস ব্যবহার অবশ্যই করতে হবে। করমর্দন এড়িয়ে চলুন।
• শুকনো খাবার আর সাধারণ কিছু ওষুধ কিনে রাখুন (পেইনকিলার, প্যারাসিটামল, হিস্টাসিন, স্যালাইন- তবে কোনো ওষুধই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করবেন না।)
• হ্যান্ড স্যানিটাইজারের জন্য পাগল হবেন না। সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধুলেই হবে। কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত পরিষ্কার করবেন।
• হাঁচি-কাশি মুখ ঢেকে দেবেন। রুমাল ব্যবহার করুন। মাস্কে হাঁচি দিলে তা পরিবর্তন করুন।
• মাস্কে বার বার হাত দেবেন না, বার বার খুলবেন-লাগাবেন না।
• নির্বোধের মতো বস্তা বস্তা ওষুধ, ম্যাচ, ন্যাপকিন, টিস্যু, সাবান, তেল, খাবার কিনে রাখবেন না। অন্যকেও কেনার সুযোগ দিন।
• পানির অপচয় কমান।
• পরিষ্কার থাকুন সর্বদা।
• আর্থিক ভাবে দুর্বল মানুষকে সম্ভব হলে সাহায্য করুন অর্থ কিংবা খাদ্য দিয়ে।
• ডাক্তারকে সহযোগিতা করুন ও তার নির্দেশনা মেনে চলুন।
• জনসমাগম এড়িয়ে চলুন।
• অহেতুক ভ্রমণ করবেন না।
• কাজের লোকদের হাত পরিষ্কার করে তারপর কাজ করতে বলুন।
• সর্বশেষ ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণঃ তথ্য গোপন করবেন না। এতে প্রাণনাশের আশঙ্কা বেড়ে যাবে।
আমাদের হাতের অস্ত্রগুলো খুব সাধারণ, প্রতিরোধক মাত্র। প্রতিষেধক না। ভ্যাকসিন বা ওষুধ না আসা পর্যন্ত যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। আর এই শতাব্দীতে তথ্যের চেয়ে বড় অস্ত্র আর নেই। সেই জ্ঞানকেই কাজে লাগান। বিপদকে এড়িয়ে যান, প্রতিহত করার সময় আসবে একদিন। আজকে না।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০২০ রাত ২:০৮