“আগে বলেছিলেন, কোন কোটায় (কোটাই*) থাকবেনা। আর এখন বলছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা পরিবর্তন সম্ভব নয়। সম্ভবত এটা কুরআনিক আইন, তাই পরিবর্তন সম্ভব না।
কেউ কথা রাখেনি...
#মাদারঅবহিউমেনিটি
#মাদারঅবএডুকেশন”
- Mir Sabbir
এই স্ট্যাটাসটা দেয়ার জন্য চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল সাইন্স ইউনিভার্সিটির ছাত্র মির সাব্বিরকে বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন৷ এই স্ট্যাটাসে বহিষ্কার করার মত কিছু কি ছিল? আমাদের প্রধানমন্ত্রী এমন কি হয়ে গেলেন যে তাকে নিয়ে একটু বাঁকা কথাও বলা যাবে না?
কেন মির সাব্বিরকে বহিষ্কার করল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, তা জানতে, বিবিসি বাংলা মুখোমুখি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা ফারুক ইমামের। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ীই এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল রুলসের ১৬ ধারায় আছে যে - এমন কোন কাজ যদি কোন ছাত্র করে যা দেশের আইন অনুযায়ী অনৈতিক বা সামাজিক অপরাধ বলে বিবেচিত - তাহলে তার বিরুদ্ধে শৃংখলাভঙ্গের অভিযোগে পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার কর্তৃপক্ষের আছে।“
তার কথা অনুসারে, মির সাব্বিরের স্ট্যাটাসটা দেশের আইন অনুযায়ী অনৈতিক।
তারা কী বোঝাতে চাইছে, প্রধানমন্ত্রীর সামান্য সমালোচনা দেশের জন্য এতোই ক্ষতিকর যে তা সামাজিক অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং তা শাস্তির যোগ্য? বাংলাদেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা কি এতটুকুও নেই? তারা না সরকারী দল করেছে বলে উপাচার্য-প্রোক্টর ইত্যাদি হতে পেরেছে, তারা নাহয় সরকারের কাছে জিম্মি। তাই বলে কি শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতাটুকু বেচে দিতে হবে?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হওয়া উচিত মুক্তবাকের মুক্তমতের সর্বোচ্চ মঞ্চ৷ আর আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শেখাচ্ছে, স্বৈরাচারকে দ্বিধাহীনভাবে মেনে নিতে। বাংলাদেশের অবস্থা আজ কেন এমন, সেটা বুঝতে আর বেশি কিছু খুঁজতে হয় না৷
এলেক ব্যাল্ডউইন নিয়মিত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোলান্ড ট্রাম্পকে মোক করে টিভি শো করছেন। জিমি ফ্যালনও লোক হাসাচ্ছেন ট্রাম্প সেজে। তাদের কারো বিরুদ্ধেই কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি ট্রাম প্রশাসন। তিনি জানেন, জনগণের বাকস্বাধীনতায় হাত দেয়ার ক্ষমতা তার নেই। আর সে দেশের জনগণ এতোটাই সচেতন যে এমন কিছু হলে ট্রাম্প সরকারের পতনও হয়ে যেতে পারে।
এদিকে গণতন্ত্রের মানসকণ্যা কিংবা মাদার ওফ হিউম্যানিটির একটু সমালোচনা করলে ভূমিকম্প হয়ে যায়। এভাবেই জনগণের বাকরোধ করে করেই তিনি গণতন্ত্রের মানসকণ্যা হয়ে গেছেন!
আর আমাদের সমাজের বিবেকেরা এসব ব্যাপারে কী নির্লিপ্ত! মোহাম্মদ জাফর ইকবাল ছাত্রদের নিয়ে কত পাতা লিখেই না পত্রিকা ভরিয়েছেন৷ কত মোটিভেশনাল স্পিকার ছাত্রদের প্রেরণা দিতেন এতোদিন। আর যখন ছাত্ররা একটা বাঁচামরার লড়াই করছে, তখন তারা হাওয়া!
২
এইতো কিছুদিন আগে কাতালোনিয়া স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেতে লড়ছিল। যুদ্ধের মাধ্যমে নয়; তারা চেয়েছিল গণভোট নির্ধারণ করুক তাদের ভাগ্য।
স্পেনে তাদের অবস্থাটা ঠিক তেমন যেমনটা ছিল পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার।
বার্সেলোনার রাস্তায় নেমেছিল তখন লাখো মানুষের ঢল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সব সরকারী কাজ, অফিস-আদালত-স্কুল-কলেজ। তাদের সেই মিছিলে আমাদের মত “জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও” টাইপ স্লোগান ছিল না৷ রঙ বেরঙের পোশাক পড়ে, গান গেয়ে আন্দোলন করছিল তারা। সেই বিষহীন মিছিলেও লাঠিচার্জ করে স্পেইন প্রশাসন। পুলিশি হামলা ভেঙে দিতে চেষ্টা করে আন্দোলনের স্রোত। সেদিন স্পেন সরকারের লেলিয়ে দেয়া রায়ট পুলিশকে আন্দোলনকারীরা ফুল দিয়েছিল। আক্রমণ নয় ভালবাসা দিয়েই তারা অনেক জায়গায় ঠেকিয়ে দিয়েছিল পুলিশকে।
খবরটা ছড়িয়ে পড়ে খুব তাড়াতাড়িই। এর কিছুদিন পরই, স্পেন প্রশাসন ক্ষমা চেয়ে নেয় হতাহতদের কাছে৷
এদিকে আমাদের কোটা আন্দোলনেও শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান করে সাধারণত টিএসসিতে। তারাও ফুল দিয়ে থামানোর চেষ্টা করেছিল পুলিশি হামলা। অথচ পুলিশ তাদের কতজনের পিঠে লাঠি ভেঙেছে, তার হিসেব নেই।
ছাত্রলীগ আর পুলিশ বারংবার হামলা করছে কোটা আন্দোলনকারীদের উপর। মেয়েদের পর্যন্ত ছাড়ছে না তারা৷ শিক্ষদের উপর আসছে হামরা হুমকি। গায়েও হাত তুলেছে ছাত্রলীগ এক শিক্ষকের। এসব হামলার ছবি সবাই দেখেছে; ভিডিও দেখানো হয়েছে টিভিতে। অথচ আমাদের প্রশাসন আর সরকার বারবার বলে আসছে, “ছাত্রলীগ হামলার সাথে জড়িত নয়!”
এটাই পার্থক্য এই দুই দেশের৷ দুই দেশের গণতন্ত্রের৷ বলছি না স্পেন সরকার কাতালোনিয়ার সাথে যা করেছে তা ভাল। কিন্তু তারা অন্তত স্বীকার করেছে হামলার ব্যাপারটা। আর আমাদের সরকার এসব ব্যাপার সবাই জানার পরও পুরোপুরি অস্বীকার করে যাচ্ছে শুরু থেকেই।
প্রধানমন্ত্রীকে কবে কোন পত্রিকা কী বিশেষণ দিয়েছে, সে বিশেষণকে উপাধিতে পরিণত করতে আওয়ামীলীগের নেতারা যতটা পারদর্শী, ততটা পারদর্শী মানুষের মন বোঝায় হলে বুঝতো, মানুষ তাদের কতটা ঘৃণা করছে। এতো ঘৃণা উপেক্ষা করে চেয়ারে বেশিদিন হয়তো তারা থাকতে পারবে না।
৩
ক্লাস ওয়ানের বাংলা বইয়ে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান কীভাবে বিমান চুরি করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, সেটা পড়ে শিহরিত হয়েছিলাম খুব। ক্লাস ওয়ান থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ভাললাগাটা ছিল অন্যরকম। জানি না এখনো ক্লাস ওয়ানে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে নিয়ে সে অধ্যায়টা আছে কিনা।
যদিও আজকের এই বাংলাদেশ কারোই কাম্য নয়, হতে পারেই না, তারপরও এদেশের স্বাধীনতা এনেছিলেন তারাই, মুক্তিযোদ্ধারা। অন্তত গোলামি থেকে মুক্ত করিয়েছেন আমাদের৷
কিন্তু যখন সে মুক্তিযোদ্ধারাই কোটার পক্ষে বিবৃতি দেয়, তাদের সন্তানেরা যখন কোটা সংস্কার রুখতে নামে মানববন্ধনে, তখন তাদের জন্য তিলে তিলে গড়ে ওঠা সম্মানটা ঝাড়ঝুড় করে ভেঙে পড়ে। যে যোদ্ধারা একদিন ৫৬% বাঙালির উপর চলা বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তারাই এখন লড়ছেন ৫৬% কোটার জন্য।
আজ অবস্থা এমন, মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা শুনলে, আর তাদের বীরত্বের কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ে শুধু ৩০% কোটার কথা।
এইতো শতবর্ষ আগেও সমাজতন্ত্র ছিল একটা স্বপ্ন। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে কত প্রাণ গেল, দেশ ভাগ হলো। স্ট্যালিনের আমলের অত্যাচারের কথা আর এখনকার নর্থ কোরিয়ার অবস্থা জানলে হয়তো কেউ আর সমাজতন্ত্রের কথা মুখেও আনবে না।
সমাজতন্ত্রের এ হাল হয়নি একদিনে। মানুষ অত্যাচারীত হয়েই ত্যাগ করেছে সে ইউটোপিয়া। কিছুদিন পর মানুষ এভাবেই হয়ত ত্যাগ করবে মুক্তিযোদ্ধাদের। আজ থেকে শতবছর পর যখন ইতিহাস লিখবেন কোন ঐতিহাসিক, তখন কোটা আন্দোলন নামক অধ্যায়ে ভিলেন হিসেবে তাকে মুক্তিযোদ্ধা আর ছাত্রলীগকে বসাতে হবে। গণতন্ত্রের মাতা চিহ্নিত হবেন স্বৈরশাসক হিসেবে৷
ইতিহাস এই সরকারকে ক্ষমা করবে না। অবশ্য মনে হয় না, ইতিহাস নিয়ে ভাবার মত মাথা তাদের আছে।
৪
বারবার শুনে আসছি একটা কথা- “যারা কোটা সংস্কার আন্দোলন করছে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী!”
তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী কারা? যারা কোটা সংস্কার চায় না, তারা? আওয়ামীলীগে দলে দলে জামাতের লোকেরা যোগ দিয়েছে, পেপারে পড়েছি। জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা মমিনুল হক চৌধুরির জামাতা বর্তমানে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া আসনের আওয়ামীলীগের এমপি। এই জামাতি নেতারাই কি আজ পালটি খেয়ে আওয়ামীলীগ করছে বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ হয়ে গেল?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৩:০৪