ভালো নাম আবুল মনসুর মীর্জা মুহাম্মদ ওয়াজেদ আলি শাহ। কিন্তু এই নামে তাঁকে কেউ ডাকতেন না, তাঁর খেতাব ছিলো মির্জা। আওধের নবাব!
নবাব ছিলেন সৌখিন মানুষ। তিনি গান বাজনা নিয়ে মেতে থাকতেন। তিনি সৃজনশীল ছিলেন। লিখেছেন অজস্র গান, কবিতা। কেউ কেউ তাকে হিন্দুস্তানি থিয়েটারের প্রথম নাট্যকার বলে থাকেন। ভাই সিকন্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসার আয়োজন করেন নবাব। সেখানে নিজের লেখা নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেন। এই কিস্সাকেই বলা যায় প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক। কৃষ্ণ ছিলেন তাঁর রোল মডেল। যমুনাতীরে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা নবাবের চিরকালীন অনুপ্রেরণা ছিল!
কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বাহাদুরের কর্মকর্তার এইসব পছন্দ হতো না মোটেও। তিনি নবাবের মাসিক ভাতা কেটে সংকোচন করতে চেয়েছিলেন। এতে নবাব অপমানিত বোধ করে কড়া করে দু'কথা শুনিয়ে দিলে, তাঁর মাসিক ভাতার তো সংকোচন করেনই, তাঁর নবাবীতে উদাসীনতার অপবাদ দিয়ে ইংল্যান্ডে চিঠি লেখেন এবং তাঁর নবাবী কেড়ে নিয়ে তৎকালীন মেটিয়াবুরুজ, কোলকাতায় নির্বাসনে পাঠান।
ভাতা সংকোচন এর চেয়ে মির্জার নবাবী নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি মনে খুবই আঘাত প্রাপ্ত হন। তিনি তো কখনো তাঁর প্রজাদের কম ভালোবাসা দেননি। বলা হয়ে থাকে তিনি ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য ময়দানে হাতে গোনা সৈন্যদের কুচকাওয়াজও করান।
কিন্তু তাঁর মা ছেলে হারাতে চাননি। তাই ইংরেজদের সাথে মোটামুটি একটা মাসিক ভাতার দফারফা করে ছেলেকে নির্বাসন নিতে বাধ্য করেন।
ব্রিটিশ রাজের চিঠি আসার সাত দিনের মাথায় এক ভোর বেলা তিনি আওধ ত্যাগ করে কলকাতা রওনা হন। অনেকেই বলে থাকেন তাঁর বিখ্যাত গজল “Jab Chhorr chale Lucknow nagari, kahe haal ke hum par kya guzari” তখনই রচনা করেন মির্জা এক দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে।
শোনা যায়, কোলকাতায় নবাবের দোতালা হাওয়েলীতে যে পরিমান লোক সে সময় ছিলো, তাদের প্রতিদিন বিরিয়ানি খাওয়াতে প্রায়ই মাংস কম পড়তো। এতে করে মির্জা লজ্জায় পড়ে যেতেন। তাই একদিন বাবুর্চিকে ডেকে বলেন বিরিয়ানিতে মাংসের সাথে আলু মেশাতে। তখন আলু স্পানিশরা নতুন নিয়ে এসেছে, দামও কম। তখন থেকে প্রচলিত হলো কোলকাতার বিরিয়ানিতে আলু মেশানো।
মির্জা সাধারণত দোতলা থেকে নামতেন না। তাঁর শিকারের একবার বড় শখ হলো। কিন্তু নরম হৃদয়ের নবাব রক্তপাত পছন্দ করতেন না। তিনি তাঁর বিশ্বস্ত এক মুলাজিম কে বুঝিয়ে বললেন ব্যাপারটা। মূলাজিম বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি দোতালার বড় বারান্দায় গাছ পালা লাগিয়ে জংগল তৈরি করলেন। সার্কাস থেকে কেনা হল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঘ। এরপর সে বাঘ ছেড়ে দেয়া হল জংগলে। মির্জা বের হলেন ফাঁকা বন্দুক নিয়ে শিকারে। দৌড়ে দৌড়ে বাঘ খুঁজে বের করলেন। চালালেন ফাঁকা গুলি, অভিনয়ে পারদর্শী বাঘ সাথে সাথেই মরার মত মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। মির্জা এই খেলায় বেশ মজা পেলেন। এরপর প্রায় তিনি শিকারে যেতেন তাঁর বারান্দায়। হয়তো মির্জার খেলায় বাঘও মজা পেত।
১৮৮৭ (বয়স ৬৫) সালে এই বিখ্যাত মির্জা মারা যান। কিন্তু তাঁর নাম তিনি রেখে গেছেন হিন্দুস্থানি সংগীত এবং যন্ত্রশিল্পর ভাঁজে ভাঁজে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০২০ রাত ১০:৫৪