somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: বুকের ভেতর অন্ধকার

২৬ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ঘাড়ের কাছে তপ্ত নিঃশ্বাস। না তাকিয়েও বুঝলাম জেনি ঝুঁকে আছে আমার কাঁধের উপর। ল্যাপটপে চলা ভিডিওটা পজ দিলাম। পেছনে ঘুরে তাকাতেই জেনি জিজ্ঞেস করলো, “কি দেখো?”

জেনি কথাটা বললো বাংলায়। উচ্চারণ শোনালো- “কি ধ্যাকো?” অল্প কদিনেই জেনি ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে শিখে গেছে। ভালোবাসার শক্তি অনেক! এই শক্তির সন্ধান পেলে মানুষের পক্ষে আর অসম্ভব বলে কিছু থাকে না!

আমি বললাম, “বাংলাদেশে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেটাই দেখছিলাম।”

জেনি আগ্রহী হয়ে উঠলো, “আমিও দেখবো!”

আমি মৃদু হেসে ভিডিওটা প্লে করলাম আবার। আমার জন্ম নিউ ইয়র্কে, বড় হয়েছি এখানকার আলো-বাতাসে। কিন্তু মনটা সব সময় পড়ে থাকে বাংলাদেশে। বাবা ছোটোবেলা বাংলাদেশ থেকে চলে আসেন দাদির হাত ধরে। আর কখনও ফিরে যান নি। আমিও কখনো যাই নি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট ঐ দেশটার প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি সবসময়। দেশটাতে কি হচ্ছে না হচ্ছে- রেগুলার খোঁজ রাখি অনলাইনে।

ভিডিও প্লে করতেই দেখা গেলো একজন বয়স্ক মহিলা ক্যামেরার সামনে কথা বলছেন। হ্যান্ড হেল্ড ক্যামেরা, সারাক্ষণ মুভ করছে। ভিডিও করছে তাঁর ছেলে। মহিলা বাংলায় কথা বলছেন, আমি ইংরেজিতে জেনিকে বুঝিয়ে দিচ্ছি- “এই মহিলার নাম নুসরাত সুলতানা। উনার পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। একাত্তরে শহীদ হন। পিতার সব স্মৃতি উনি এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছেন।”

মহিলা ভিডিওতে বাবার স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখাচ্ছেন- “এইযে ভাঙা চশমাটা দেখছেন, এটা আমার বাবার সারাক্ষণের সঙ্গী ছিলো। কিন্তু যুদ্ধে যাওয়ার আগে বাবা চশমাটা রেখে যান, বলেন চশমা চোখে নাকি যুদ্ধ করা যাবে না! তারপর এই যে দেখছেন সাদা পাঞ্জাবিটা, এটা বাবার খুব পছন্দের ছিল। শুধুমাত্র শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় পড়তেন, অন্যান্য দিন তুলে রাখতেন। আর এই যে এইটা দেখছেন, এটা নজরুলের সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থ, বাবা প্রায়ই পড়তেন…”

ক্যামেরা ধরে রাখা মহিলার ছেলে প্রশ্ন করলো- “মা, ঐ কালো লোহার ট্রাংকটা? ওটার ভেতর কি আছে?”

নুসরাত সুলতানা এক মুহূর্ত থেমে থাকলেন। তারপর ট্রাংকটা ধরে বললেন, “এটা বাবার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর সুবিমল রায়ের, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের…”

আমি ঝট করে সোজা হলাম। শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে! হাত কাঁপছে…

“হোয়াট হ্যাপেনড?” জেনি উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো।

আমি উত্তর দিলাম না। তাকিয়ে আছি ভিডিওর দিকে। মহিলা বলে যাচ্ছেন- “…স্যার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। মৃত্যুর আগে তিনি কিছুদিন আমাদের বাড়িতে ছিলেন…”

জেনি আমার কাঁধে-পিঠে হাত হাত বুলিয়ে বলছে, “কি হলো তোমার? এমন করছো কেন?”

আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম, “প্র… প্রফেসর সুবিমল রায়… হি ইজ মাই গ্রান্ড ফাদার!”

***

একবার কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দিলো একটা টিনএজ মেয়ে। সম্ভবত বাসার কাজের মেয়ে। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কারে চান?”

আমি একটু হেসে বললাম, “জি আমি এসেছি নুসরাত সুলতানা ম্যাডামের সাথে দেখা করতে।”

মেয়েটি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো, “আপনের কি আওয়ার কতা?”

আঞ্চলিক টানের বাংলা বুঝতে আমার একটু কষ্ট হয়। তবে মেয়েটির চেহারা দেখেই বুঝতে পারছি কি বলতে চাইছে। আমি হাসি ধরে রেখে বললাম, “আমি ফোন করে আগেই বলেছিলাম আসবো।”

মেয়েটি এক পাশে সরে গিয়ে ভেতরে ঢুকতে ইঙ্গিত করলো। আমি ভেতরে ঢুকলাম। ছিম ছাম গোছানো একটা ড্রায়িং রুম।

“আপনে বসেন। ম্যাডামরে ডাইকা দিতাছি।” বলে মেয়েটি ভেতরে চলে গেলো।

আমি একটা সোফায় বসলাম। দেয়ালগুলোতে নজর বুলাচ্ছি। সুন্দর সুন্দর আর্টওয়ার্ক বাধাই করে রাখা। মনে হচ্ছে বড় কোন পেইন্টারের আঁকা।

সেদিন ভিডিওটা দেখার পর আমি আর এক মুহূর্তও দেরি করিনি। সাথে সাথে বাংলাদেশে আসার ব্যবস্থা করার জন্য উঠে পড়ে লাগি। তবে জেনির সহযোগিতা ছাড়া এত দ্রুত বাংলাদেশে আসার ব্যবস্থা হতো না! আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবান যে জেনির মতো একটি মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। মাত্র এক সপ্তাহ পরেই আমাদের বিয়ে। এই সময় কোনো মেয়ে চাইবে না তার হবু হাজব্যান্ড দেশ ছেড়ে অচেনা যায়গায় গিয়ে অনুসন্ধানের কাজে নেমে পড়ুক!

“ছবিগুলো আমার বড় মেয়ের আঁকা।”

কথাটা শুনে আমি উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম নুসরাত সুলতানা ঢুকছেন ঘরে। মহিলার বয়স ষাটের মতো হবে। সুন্দর করে হাসছেন। আমাকে দাঁড়াতে দেখে বললেন, “আরে, বসুন বসুন! চা-কফি কিছু খাবেন?”

আমি বসলাম। বললাম, “থ্যাংকস, কিছু খাবো না আমি।”

মহিলা আমার মুখোমুখি বসলেন। বললেন, “তাহলে বলুন, কি জন্য এসেছেন?”

আমি একটা ঢোক গিলে বললাম, “আমার নাম শুভ্র রায়। নিউইয়র্ক থেকে ফোন করেছিলাম আপনার কাছে। ঐ ভিডিওটা দেখে…”

‘হ্যাঁ, আমার ছোটোছেলে ভিডিওটা করে ফেসবুকে দিয়েছিল। অনেক মানুষ নাকি দেখেছে। কিন্তু ভিডিওতে কি এমন দেখলেন যে নিউইয়র্ক থেকে চলে এলেন?’

‘প্রফেসর সুবিমল রায়, আপনার বাবার শিক্ষক…’ এক মুহূর্ত থেমে থাকলাম। ‘উনি আমার দাদা।’

মহিলার চেহারা দেখে মনে হলো শক খেয়েছেন। কিছু বলছেন না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন।

‘আমি এসেছি দাদার শেষ স্মৃতি ঐ ট্রাংকটা নিয়ে যেতে। যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে…’

‘তুমি সুবিমল স্যারের নাতি!’ নুসরাত সুলতানার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস। ‘এইজন্যই চেনা চেনা লাগছিল! অবিকল স্যারের মতোই নাক- মুখ- চোখ। তুমি বসো, আমি এক্ষুনি ট্রাংকটা নিয়ে আসছি…’

বলে নুসরাত সুলতানা প্রায় দৌড়ে ভেতরে চলে গেলেন। একটু পর কাজের মেয়েটি আর একটা ছেলে মিলে ট্রাংকটা ধরে নিয়ে এলো। আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো ট্রাংকটা দেখে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছি। মোটা লোহার ট্রাংক, মজবুত করে বানানো। এত বছরেও মরিচা পড়েনি।

‘দেখতে চাও ভেতরে কি আছে?’ নুসরাত জিজ্ঞেস করলেন।

আমি প্রবলবেগে হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়লাম।

ট্রাংকে একটা ছোট্ট তালা লাগানো। নুসরাত তালা খুলে দিলেন। ভেতরে সাজিয়ে রাখা কিছু বই, কাপড়-চোপড় আর টুকটাক জিনিসপত্র আছে।

আমি হাত বাড়িয়ে সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। হাত কাঁপছে! আমার দাদার ব্যবহৃত সব জিনিস। দেশের জন্য জীবন দিয়েছিলেন তিনি। গর্বে বুকটা ভরে যাচ্ছে! একটা বই হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলাম। কেমিস্ট্রির বই। বইয়ের ভেতর থেকে ভাজ করা একটা কাগজ পড়লো পায়ের কাছে। বইটা রেখে আমি কাগজটা তুললাম। একটা চিঠি মনে হচ্ছে!

চিঠির ভাজ খুললাম আমি। চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে হতবাক হয়ে গেলাম! পুরোটা পড়ার পর স্তব্ধ হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ!

***

দুই বছর পর…

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ আলোচনা ও সাংস্কৃতিক সন্ধার আয়োজন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্ররা যারা বিভিন্ন সেক্টরে অবদান রেখেছেন তাঁদেরকে ইনভাইট করা হয়েছে এই অনুষ্ঠানে।

আমি বসে আছি দর্শকসারিতে একদম পেছনের দিকে। এখান থেকে আমার স্ত্রী জেনির মাথা দেখতে পাচ্ছি। সামনের সারিতে কিছু ফরেন ডেলিকেটদের সাথে বসে আছে সে। জেনি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো। আমার সাথে চোখাচোখি হলো। আমি হাসলাম।

উপস্থাপিকা মাইক্রোফোনে বললেন, “এবার আমাদের সামনে বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর, নোবেলবিজয়ী কেমিস্ট ড. আলমগীর হায়দারকে।”

দর্শক সারিতে তুমুল করতালি।

ড. আলমগীর স্টেজে উথলেন। লোকটার বয়স ৭০ এর বেশি। এখনও শারীরিকভাবে খুব স্ট্রং আছেন! সবাই ভেবেছিল ড. আলমগীর হয়তো ইংরেজিতে বক্তব্য রাখবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি বাংলায় বলতে শুরু করলেন-

‘আমাকে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সবাইকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। আজকের এই দিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সকল শহীদদের, যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এসেছিল বিজয়।

আপনারা হয়তো আমি বাংলা বলছি দেখে অবাক হয়েছেন। ভাবছেন ৫০ বছর দেশের বাইরে থেকেও লোকটা বাংলা ভোলেনি? আসলে বাংলা এমন এক ভাষা যা একবার কারো হৃদয়ে গেঁথে গেলে, কোনোদিন ভোলা সম্ভব নয়! যদিও আমি ব্রিটিশ নাগরিক, থাকি লন্ডনে, কিন্তু আমরা মনটা সব সময় বাংলাদেশেই পড়ে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধের মাত্র এক বছর আগে, ১৯৭০ সালে আমি পড়াশুনার জন্য অক্সফোর্ডে চলে গিয়েছিলাম। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমার সারাক্ষণই মনে হতো- ইস! যদি এই মুহূর্তে দেশে থাকতাম, তাহলে আমিও যুদ্ধে অংশ নিতাম! হয়তো যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর গুলিতে আমিও শহীদ হতাম। তারপরও জীবনটাকে সার্থক মনে হতো! আজ আমি অক্সফোর্ডের প্রফেসর, নোবেল প্রাইস জিতেছি, এত নাম-ডাক হয়েছে, যেখানেই যাই সম্মান পাই। তারপরও তৃপ্তি পাই না! এরচেয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে জীবন দেওয়াটা আমার কাছে বেশি মর্যাদাপূর্ণ বলে মনে হয়…’

এভাবে অনুষ্ঠান চললো ঘন্টা দুয়েক। অনুষ্ঠান শেষে জেনিকে দেখলাম প্রফেসর আলমগীরের সাথে হাত মেলাতে। কী নিয়ে যেন কথা বলছে দুজনে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। কনফারেন্স হলের বাইরে একটা নির্জন করিডোরের দিকে এগিয়ে গেলাম। একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট টানতে টানতে ভালো করে দেখে নিলাম চারিদিক- এই দিকটাতে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। পায়ের আওয়াজ পেলাম। দেখলাম করিডোর ধরে হেঁটে আসছে জেনি আর প্রফেসর আলমগীর। কিছু একটা বিষয়ে কথা বলছে দুজন। আমি আলগোছে পকেট থেকে একটা রুমাল বের করলাম।

পাশ দিয়ে দুজনে হেঁটে যাওয়ার মুহূর্তে আমি রুমাল চেপে ধরলাম প্রফেসর আলমগীরের মুখে। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করলেন তিনি। তারপর জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লেন। জেনি একা হেঁটে চলে গেলো সামনে। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব। আর আমি প্রফেসরের দেহটা টানতে টানতে কাছেই পার্ক করে রাখা একটা গাড়িতে নিয়ে তুলতাম। তারপর ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। ভার্সিটির গেটের সামনে এসে গাড়ি থামালাম। হেঁটে এলো জেনি। সে দরজা খুলে আমার পাশের সিটে বসে পড়লো। তারপর আবার গাড়ি স্টার্ট দিলাম। স্বাধীনতা দিবসে রাস্তাঘাট ফাঁকা। ফুল স্পিডে গাড়ি ছোটালাম। কেউ টের পাওয়ার আগেই সরে যেতে হবে। শহর ছেড়ে অনেক দূরে…

***

অন্ধকার ঘর।

প্রফেসর আলমগীরকে একটা চেয়ারে বেঁধে রেখেছি। আমি বসে আছি তার মুখোমুখী একটা একটা চেয়ারে। জেনি দাঁড়িয়ে আছে জানালার কাছে, নজর রাখছে বাইরে।

অল্প আলোর একটা বাল্ব জ্বলছে প্রফেসরের মাথার ওপর। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে আসছে তার। বার কয়েক চোখ পিট পিট করে চোখ খুললেন তিনি। প্রথমে সম্ভবত বুঝতে পারলেন না কোথায় আছেন। তারপর আমার উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠলেন।

প্রফেসর চিৎকার করে উঠলেন- ‘হু আর ইউ? হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?’

‘শান্ত হোন স্যার’। আমি অভয় দিয়ে হাসলাম। ‘আমরা আপনার সাথে একটু কথা বলবো’।

প্রফেসর থামছেন না। ইংরেজিতে চিৎকার করছেন- ‘ডু ইউ নো হু আই এম? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান?’

আমি হাসলাম, ‘জানি স্যার। আপনি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা কেমিস্টদের মধ্যে একজন। আপনার খোঁজে এতক্ষনে সারা বাংলাদেশের পুলিশ হয়তো রাস্তায় নেমে গেছে। কিন্তু আমরা আপনার কোনো ক্ষতি করবো না স্যার। শুধু একটু কথা বলতে চাই’।

প্রফেসরের রাগ পড়ছে না। “কথা বলার জন্য কিডন্যাপ করতে হবে? আর ইউ ম্যাড?”

“স্যার, আমি আপনার পোগ্রাম স্কেডিউল দেখেছি। আপনি আগামী চারদিন বাংলাদেশে আছেন। খুবই বিজি স্কেডিউল। এই পোগ্রাম, ঐ কনফারেন্স, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান… কথা বলার মতো স্কোপ আপনার ছিলো না। তাছাড়া আমি যে বিষয়ে কথা বলতে চাই, স্বাভাবিক অবস্থায় হয়তো আপনি সে বিষয়ে কথা বলতে চাইবেন না! তাই বাধ্য হয়ে…”

‘বাধ্য হয়ে এখানে নিয়ে এসেছ? এটা কথা বলার মতো জায়গা?’

‘সরি স্যার। দেখতে একটু টর্চার সেলের মতো হয়ে গেছে, তাই না? আনফরচুনেটলি এর চেয়ে বেটার কিছু এফোর্ড করতে পারলাম না। চা-কফির ব্যবস্থা আছে স্যার! খাবেন?’

প্রফেসর একটু শান্ত হয়ে এসেছেন। বললেন, “পানি খাবো”।

জেনি বিনা বাক্যব্যয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। প্রফেসরের মুখের সামনে ধরলো। প্রফেসর ঢক ঢক করে পানি খেলেন। তারপর জেনির দিকে তাকিয়ে বললেন, “হু আর ইউ? হোয়াই ইউ আর হেল্পিং হিম?”

জেনি পরিষ্কার বাংলায় বললো, ‘স্যার, আমি জেনি। শুভ্রর ওয়াইফ’।

‘আমার ক্রাইম পার্টনার স্যার!’ আমি যোগ করলাম জেনির সাথে। ‘আমি যা-ই করতে চাই, তাতেই রাজি হয়ে যায়! কি অদ্ভুত! এমন ভালোবাসা বর্তমান সময়ে বিরল, তাই না স্যার?’

‘ওহ! আই এম সিক অফ ইউ!’ আবার চিৎকার করলেন প্রফেসর। ‘কাম টু দ্যা পয়েন্ট! বলো, কি বলতে চাও?’

‘বলছি স্যার। আপনি একটু রিল্যাক্সড হোন’। জেনির দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘জেনি, স্যারের দুই হাতের বাঁধন খুলে দাও তো’।

জেনি প্রফেসর আলমগীরের হাতের বাঁধন খুলে দিলো। প্রফেসর বললেন, ‘পায়ের বাঁধনও খুলে দাও। পালানোর চেষ্টা করবো না। আই প্রমিজ!’

জেনি প্রফেসরের কথা অনুযায়ী কাজ করলো। আমি একটা সিগারেট ধরালাম। কয়েকবার টান দিলাম আয়েশি ভঙ্গীতে। মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছি।

‘কই? শুরু করো?’ প্রফেসর তাগাদা দিলেন।

‘করছি স্যার।’ আমি বলতে শুরু করলাম-

‘স্যার, আপনি সব জায়গায় একটা ভুল তথ্য দেন। যত কনফারেন্সে যান, যত বক্তৃতা দেন- সব জায়গায় ভুলটা বলেন। আপনার উইকিপিডিয়া পেইজেও এই ভুলটা আছে। এমনকি আপনার লেখা অটোবায়োগ্রাফি বইটিতেই এই ভুল তথ্যটি দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে- আপনি অক্সফোর্ডে পড়াশুনা শুরু করেন ১৯৭০ সালে। কিন্তু অক্সফোর্ডের অফিসিয়াল ডাটাবেজের রেকর্ড অনুযায়ী আপনি সেখানে ভর্তি হয়েছেন ১৯৭১ সালে। এত বড় একটা ভুল তো হওয়ার কথা না!’

“দেখো, আমার বয়স হয়েছে। অনেক কিছুই এখন আর মনে রাখতে পারি না। ৭১ এর যায়গায় ৭০ হতেই পারে। প্রায় ৫০ বছর আগের কথা!”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “স্যার, আপনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে লন্ডনে গিয়েছেন ১৯৭১ এর নভেম্বরে। অর্থাৎ দীর্ঘ ৮ মাস আপনি মুক্তিযুদ্ধে ভয়াবহতা নিজের চোখে দেখেছেন! এত বছর হলো বাংলা ভাষাটা মনে রেখেছেন, আর মুক্তিযুদ্ধ দেখার কথা ভুলে গেছেন, তাই কি হয়?
কিছুক্ষণ নীরবতা। প্রফেসর কিছু বলবেন এই আশায় আমি অপেক্ষা করছি। অবশেষে তিনি মুখ খুললেন, ‘হ্যাঁ। আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে ছিলাম… আর যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই লন্ডনে চলে যাই। কিন্তু আমি চাইনা বিষয়টা পাবলিকলি জানাতে। লোকে আমাকে কাপুরুষ ভাবুক, স্বার্থপর ভাবুক… আমি সেটা চাই না! আরও কিছু ব্যক্তিগত কারণ আছে। আই হোপ ইউ গেট দ্যা পয়েন্ট?’

আমি বুঝতে পারার ভঙ্গীতে মাথা ঝাঁকালাম।

‘ক্যান আই গো নাও?’ প্রফেসর বললেন।

‘আর একটু কথা আছে স্যার’। আমি মাথা নেড়ে বললাম। ‘প্রফেসর সুবিমল রায়ের ব্যাপারে।’

প্রফেসর আলমগীর নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বসে আছেন।

‘আমি আপনার অটোবায়োগ্রাফি বইটি পুরো পড়েছি। বইয়ের নাম দ্য কেমিস্ট, আপনার কেমিস্ট হওয়ার জার্নি! বইতে ছোটোবেলার অনেক স্ট্রাগলের কথা আছে। বাবা ছিলো না, মা পরের বাসায় কাজ করতো, চার ভাই-বোন। এন্ট্রান্স পরীক্ষার পর আপনার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। আপনি একটা ফ্যাক্টরিতে ক্যাশিয়ারের চাকরী নেন। এরপর এক যায়গায় লিখেছেন…’ আমি পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলাম। কাগজের লেখাটা হুবুহু পড়লাম, “প্রফেসর সুবিমল রায়ের সহযোগিতায় আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হই এবং পুনরায় লেখাপড়া শুরু করি”। কাগজটা আবার রেখে দিলাম পকেটে। ‘ব্যাস! এইটুকুই! কিন্তু প্রফেসর সুবিমল রায়ের ভূমিকা কি আপনার জীবনে এইটুকুই ছিলো? ছিলো না! তিনি আপনাকে ক্যাশিয়ারের চাকরী থেকে নিয়ে আসেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সাহায্য করেন। ভার্সিটিতে একটা দাপ্তরিক কাজের ব্যবস্থা করে দেন। আপনার থাকার যায়গা ছিলো না বলে থাকার যায়গা করে দেন। সন্তানের মতো বুকে আগলে রেখেছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এসবের কিছুই আপনি বইতে লেখেননি। আজকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বক্তৃতা দিলেন, প্রফেসর সুবিমল রায়ের নামটি একবারের জন্যেও উচ্চারণ করলেন না! কেন স্যার?’

প্রফেসর আলমগীর নিরুত্তর। চেহারায় কোন অভিব্যক্তি নেই কিন্তু চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছে যেন ফিরে গেছেন অতীতে!

‘কই বলুন?’ আমি তাগাদা দিলাম।

উত্তরে প্রফেসর বললেন, ‘আর একটু পানি খাওয়ানো যাবে?’

জেনি আর এক গ্লাস পানি নিয়ে এগিয়ে এলো। প্রফেসর পানির গ্লাসটা হাতে নিলেন। ঢক ঢক করে গিলে ফেললেন। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছলেন। তারপর বললেন, “এতক্ষনে বুঝতে পারছি কেন তোমাকে এতো চেনা চেনা লাগছে! তুমি সম্ভবত স্যারের গ্রান্ডচাইল্ড, তাই না?”

আমি হাসলাম। হ্যাঁ বা না কিছুই বললাম না।

দেখো তোমার দুইটা প্রশ্ন পরস্পরের সাথে রিলেটেড। এবং দুই চার কথায় এর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। আমি বরং তোমাকে একটা গল্প বলি, মুক্তিযুদ্ধের এক অজানা অধ্যায়ের গল্প। তাহলে তুমি তোমার প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়ে যাবে…

***

প্রফেসর সুবিমল রায়ের স্ত্রী সুলতা দেবী, আইমিন তোমার দাদী- চাকরি করতেন একটা বিদেশী কোম্পানিতে। ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে প্রমোশন হয়ে ঐ কোম্পানির নিউইয়র্ক শাখায় তাঁর পোস্টিং হয়। সুলতা দেবী চেয়েছিলেন স্বামী-সন্তান নিয়ে একবারের জন্য নিউইয়র্কে চলে যেতে। কিন্তু তোমার দাদা রাজি হননি। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে খুব দ্বন্দ্ব হয়। তোমার বাবার বয়স তখন ১৪-১৫ হবে। তাকে নিয়ে দাদী চলে গেলেন আমেরিকায়। আর দাদা থেকে গেলেন এখানেই।

প্রফেসর সুবিমল রায়ের বয়স তখন ৫০ এর আশে পাশে। এই বয়সী একজন মানুষের পক্ষে একা বাস করা খুব কঠিন। সে সময় এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। আমি পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে টপ রেজাল্ট করি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের জন্য আমার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। তখন এগিয়ে আসেন প্রফেসর সুবিমল রায়। তিনি আমাকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি করেন, একটা খন্ডকালীন চাকরির ব্যবস্থা করেন, আমার থাকার যায়গা ছিলো না বলে নিজের কাছে রাখেন।

প্রফেসর সুবিমল রায়কে আমি বাবার মতোই ভক্তি-শ্রদ্ধা করতাম। তাঁর সেবা যত্ন করতাম। সকালে নাস্তা বানিয়ে খাওয়াতাম, বিকেলে চা। ফুট ফরমাশ খাটতাম। উনিও আমাকে সন্তানের মতো স্নেহ করতেন। লেখাপড়ায় খুব উৎসাহ দিতে। বলতেন- আমি একদিন নামকরা কেমিস্ট হবো।

সে সময় পাকিস্তান সরকারের একটা বৃত্তি প্রচলিত ছিল। সরকারি খরচে প্রতিবছর বেশ কিছু ভালো ছাত্রকে অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজসহ বিশ্বের বড় বড় ইনস্টিটিউটগুলোতে পড়তে পাঠানো হতো। বলা বাহূল্য এই লিস্টে শতকরা ৯৫ ভাগ থাকতো পশ্চিম পাকিস্তানী, হাতে গোণা কয়েকজন বাঙালি ছাত্র সুযোগ পেতো। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতে ঐ বছর বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের নামের তালিকে প্রকাশ করা হয়। সেই তালিকায় আমার নাম আসে, অক্সফোর্ডে পড়তে যাওয়ার জন্য সিলেক্টেড হয়েছিলাম। কি পরিমাণ খুশি লাগছিল তা বলে বোঝাতে পারবো না! অনেক স্বপ্ন ছিলো বিলেতে গিয়ে পরাশুনা করার। প্রফেসর সুবিমল রায়ও খুব খুশি হন।

আমাদের যাওয়ার কথা ছিল জুন মাসে। ধীরে ধীরে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এই সময় আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের আভাস। ২৫ শে মার্চের কালরাত্রির পর শুরু হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেশিরভাগই ভারতসহ অন্যান্য দেশে চলে গেলেন। কিন্তু প্রফেসর সুবিমল রায় গেলেন না। মরলে এই দেশেই মরবেন বলে পণ করেন।

এদিকে পাকিস্তান সরকার বাঙালি ছাত্রদের বৃত্তি বাতিল করে দিলো। খবরটা শুনে আমি প্রচন্ড শকড হলাম। ততদিনে আমি অক্সফোর্ডে আমার ভবিষ্যতের দিনগুলো নিয়ে রঙিন স্বপ্ন সাজাতে শুরু করেছি। হঠাৎ স্বপ্নভঙ্গের কষ্টটা সহ্য করতে না পেরে ভেঙে পড়লাম পুরোপুরি। তখন স্যার আমাকে আশা-ভরসা দিলেন। বললেন বিলেতে পড়তে যাওয়ার আরো উপায় আছে। কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবেন।

মাস দুয়েক কেটে গেলো। আমি আস্তে আস্তে নিজেকে সামলে নিলাম। যা হওয়ার নয়, তা নিয়ে মিছে আশা করে কি লাভ? সময়টা তখন খুব অস্থির। চারিদিকে গুলির শব্দ, আগুন আর কান্না! স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দলটা প্রায়ই স্যারের সাথে দেখা করতে আসতো। স্যারের অনেক ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলো। স্যার তাদের নানারকম তথ্য-পরামর্শ দিতেন। আমারও খুব ইচ্ছে হতো যুদ্ধে যেতে, কিন্তু আমি ছোট বেলা থেকেই একটু ভীতু ছিলাম। তাই সাহস করতে পারেনি। আসলে সবাইকে দিয়ে যুদ্ধ হয় না!

আগস্ট মাসের দিকে একদিন স্যরের প্রাক্তন ছাত্র নবিউল হক এলেন। ভদ্রলোকের চেহারা দেখে মনে হলো খুব ভয় পেয়েছেন। বললেন যে স্যারের নাকি বিপদ। চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর উইং এর কাছে একটা লিস্ট এসেছে, তাতে স্যারের নাম আছে। লিস্টের সবাইকে ধরে ধরে মেরে ফেলা হবে! স্যার খুব অবাক হলেন। বুঝলেন না তার মতো এমন নিরীহ লোককে মেরে কী লাভ?

নবিউল হক আমাদের নিয়ে গেলো তার বাসায়। তার মেয়ে নুসরাত আমাদের আপ্যায়ন করলো। পরবর্তী কয়েকদিন আমরা সেখানেই থাকলাম। নবিউল হক জানালেন তার বাসা আমাদের জন্য নিরাপদ। কিন্তু এক সন্ধ্যায় আবার তিনি ছুটে এসে জানালেন পাক সেনারা কীভাবে যেন খবর পেয়ে গেছে যে স্যার এখানে আছেন! আমি জিজ্ঞেস করলাম- “তাহলে উপায় কি?”

নবিউলই সিদ্ধান্ত দিলেন, বললেন, “সামান্য দূরে পাহাড়ে আমাদের একটি পুরোনো বাগান আছে। জায়গাটা অতি দূর্গম। কিছুদিন লুকিয়ে থাকার জন্য খুব ভাল আদর্শ স্থান। আমি আপনাদের সেখানে রাত গভীর না হওয়া পর্যন্ত লুকিয়ে রাখবো। তারপর মানুষজন ঘুমিয়ে গেলে নৌকা করে পাশের গ্রামে আমার মামার বাড়ি পদুয়াতে রেখে আসবো।”

আমরা রাতের বেলা সেই পাহাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম। চারিদিকে ঘন জঙ্গলে। কোনো আশ্রয় নেই। খোলা আকাশের নিচেই অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের রেখে নবিউল হক আবার বাড়ির পথ ধরলেন। স্যার আমাকে বললেন, নবিউলের সাথে গিয়ে যাওয়া-আসার পথটা ভালো করে চিনে নাও। আমি স্যারকে রেখে নবিউলের সাথে বেরিয়ে এলাম। তাকে নৌকা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসতে যাবো, এমন সময় দূর থেকে পাক সেনাদের জিপগাড়ির আওয়াজ পেলাম। একটা নয়! অনেকগুলো জিপ! এখানেও কীভাবে যেন খবর পেয়ে গেছে!

আমি দ্রুত স্যারের যেখানে আছে, সেদিকে রওনা দিলাম। ভয়ে আমার পা ঠিক মতো চলছিলো না। বেশ কিছুদূর আসার পর দেখলাম ওরা স্যারের কাছে পৌঁছে গেছে। স্যার একটা ঝোপের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করছিলো, কিন্তু লাভ হয়নি। ওরা টর্চ লাইটের আলোয় দেখে ফেললো। তারপর মাথার চুল ধরে তাকে টেনে বের করে আনলো।

আমার ইচ্ছে করছিলো এক দৌড়ে গিয়ে স্যারের সামনে দাঁড়াই। কিন্তু আমি সাহস করতে পারছিলাম না। আমি মানুষটা খুবই ভীরু, কাপুরুষ! ওরা স্যারকে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেললো। মারার পর স্যারের মৃত্যুদেহের উপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করছিলো! আমি শুধু দূর থেকে দেখে চোখের পানি ফেলছিলাম! কিচ্ছু করার সাহস হয়নি!

এরপর আমি সেখান থেকে পালিয়ে যাই। কিছুদিন এখানে সেখানে ঘুরলাম। এর মধ্যে একদিন জানতে পারলাম পাকিস্তানী সরকার আমার বৃত্তি পুনর্বহাল করেছে। এর পেছনে একটা কূটনৈতিক কারণ ছিলো। আসলে ততদিকে বহিঃর্বিশ্বে বাঙালিদের উপর পাক হানাদার বাহিনীর আগ্রাসনের খবর পৌঁছে গেছে। চারিদিক থেকে চাপ আসছিলো ভুট্টোর উপর। তাই সে আন্তর্জাতিক মহলকে সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর জন্য কিছু চাল চালে। তারই অংশ ছিলো বাঙালি ছাত্রদের সরকারি বৃত্তিতে অক্সফোর্ডে পড়তে পাঠানো।

আমি তখন আর দেশে থেকে কি করবো? নিজের প্রতি ঘৃনা জন্মে গিয়েছিলো! এই কাপুরুষের জীবন নিয়ে আমি আর বাংলার মাটিতে থাকতে পারছিলাম না। তাই সুযোগটা নিলাম। চিরতরে চলে গেলাম বাংলার মাটি ছেড়ে। যে মাটিতে বীরের রক্ত মিশে আছে, সেখানে কি আর আমার মতো কাপুরুষকে জায়গা হবে?

***

প্রসের আলমগীরের দুচোখ বেয়ে অঝোরধারায় অশ্রু নামছে। গাল বেয়ে টপ টপ করে পড়ছে স্যুটের ওপর। ভিজে গেছে বুকের অনেকখানি। তার দিকে মায়াময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার স্ত্রী জেনি। তার চোখদুটোও ছলছল করছে।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাড়ালাম। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম। নিজের ঠোঁটে একটা লাগিয়ে প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরলাম প্রফেসর আলমগীরের দিকে, “চলবে স্যার?”

বিনা বাক্যব্যয়ে প্রফেসর একটা সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে লাগালেন। আমি লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে দিলাম। দুজনে বুক ভরে ধোঁয়া টানতে শুরু করলাম। যেন বুকের ভেতর জমাট বাধা পাথর গলিয়ে দিতে চাইছি!

আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “স্যার, সব কিছু ঠিক ছিলো। শুধু দুই-একটা জায়গা আপনি একটু ঘুরিয়ে বলেছেন।”

প্রফেসর সিগারেটে বড় একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন, “যেমন?”

“যেমন ধরেন- নবিউল হক যখন আপনাদের কাছে এসে জানালো পাক সেনাদের কাছে একটা হিটলিস্ট এসেছে, সেখানে দাদার নাম আছে, তখন সে এটাও বলেছিলো যে লিস্টের লোকগুলোকে ধরিয়ে দিলে পাকিস্তান সরকার থেকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হবে।”

কাঁধ ঝাঁকালেন প্রফেসর আলমগীর, “হতে পারে! এতো ডিটেইলস তো এখন আর মনে নেইরে বাবা!”

“মনে আছে স্যার!” আমি মৃদু হাসলাম। “অবশ্যই মনে আছে আপনার। কারণ আপনি নিজে সেই পুরস্কার জিতেছিলেন!”

প্রফেসর আলমগীর ঠোঁটে সিগারেটে আরেকটা টান দিতে গিয়েও থেমে গেলেন, হাত নামিয়ে নিলেন, পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে, “কি বলতে চাও?”

আমি সাথে সাথেই উত্তর দিলাম না। আয়েশ করে আরো দুটো টান দিলাম সিগারেটের ফিল্টারে। এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলতে শুরু করলাম, “পুরস্কারের কথা শুনে আপনার মনের নিভে যাওয়া আশা আবার জেগে উঠলো। নবিউল হকের বাড়িতে যাওয়ার পর আপনি এক সুযোগে গিয়ে পাক সেনাদের সাথে যোগাযোগ করলেন। বললেন আপনি প্রফেসর সুবিমন রায়ের খোঁজ দেবেন, বিনিময়ে আপনার অক্সফোর্ডের বৃত্তি পুনর্বহাল করার ব্যবস্থা করতে হবে। তারা রাজি হয়ে গেলো। ব্যাস! আপনি খবর দিয়ে দিলেন। কিন্তু নবিউল হক সেই খবর পেয়ে গেলো। আপনাদের নিয়ে গেলো এক দূর্গম পাহাড়ে। প্রফেসর সুবিমল আপনাকে পথ চিনে আসতে বলেননি। আপনি নিজেই পথ চেনার নাম করে বেরিয়ে এলেন। তারপর আবার খবর দিলেন পাক সেনাদের। ওরা পেয়ে গেলো সুবিমল রায়কে আর আপনি পেয়ে গেলেন আপনার পুরস্কার! নভেম্বর মাসে ঢাকা থেকে পাকিস্তানগামী শেষ প্লেনটি আকাশে ওড়ে। সেই প্লেনে করে আপনি প্রথমে করাচি, তারপর চলে গেলেন লন্ডনে। এরপর বাকিটা আপনার অটোবায়োগ্রাফি বইতে একদম ঠিক ঠাক লেখা আছে!”

“বেশ করেছি!”

রাগে দাঁতে দাঁত পিষে কথাটা বললো প্রফেসর আলমগীরের। তার চেহারার অভিব্যক্তি একেবারে বদলে গেছে। একটু আগের গোবেচারা সাধারণ একজন বয়স্ক মানুষের মুখোশ খুলে বেরিয়ে এসেছে এক স্বার্থের কারণে অন্ধ ব্যক্তির রূপ। সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে বললো, “কি লাভ হতো ঐ বুড়ো ভাম বেঁচে থাকলে? তার বদলে আমি বড় কেমিস্ট হয়েছি। পৃথিবীর উপকার হয় এমন অনেক কিছুই করেছি! ঐ বুড়ো ছিলো এক নম্বরের স্বার্থপর! সে আমাকে নিজের কাছে রেখেছিলো স্বার্থের জন্য! তার বাসায় রান্না থেকে শুরু করে সব ফুট-ফরমাশ খাটতাম আমি। আমার বৃত্তি বাতিল হয়ে যাওয়ায় সে খুশিই হয়েছিলো! আমি থাকলে তার বুড়ো বয়সে অনেক উপকার হয়। আরে! সে তো চাইলে কথা বলতে পারতো পাকিস্তান সরকারের সাথে? বলেছে? বলেনি! সে বলেছিলো বিলেতে যাওয়ার আরো অনেক ব্যবস্থা আছে। কই? সে কিছু করেছে? করেনি…”

“করেছিলো!” আমি হ্যাঁ-বোধক মাথা নেড়ে বললাম, “সবই করেছিলো দাদা। কিন্তু আপনাকে জানিয়ে করেনি। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো।”

প্রফেসর নির্বাক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

“নোবেল বিজয়ী কেমিস্ট আলেক্সান্ডার টডের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? একাত্তরে তিনি কেমব্রিজের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের হেড ছিলেন। দাদা আপনার ব্যাপারে রিকমেন্ডেশন করে চিঠি লিখেছিলেন তার কাছে। ভদ্রলোক এক মাস পরেই চিঠির উত্তর পাঠান। উত্তরে জানান আপনাকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব খরচায় বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন।”

আমি পকেট থেকে সেই লোহার ট্রাংকে পাওয়া চিঠিটা বের করলাম। ৪৯ বছরে ক্ষয়ে গেছে অনেকটা, কিন্তু এখনও স্পষ্ট পড়া যায়! চিঠিটা বাড়িয়ে ধরলাম প্রফেসর আলমগীরের দিকে। “চিঠিটা দাদা আপনাকে দেখানোর সময় পাননি, তার আগেই আপনি নিজের পথ খুঁজে নিয়েছেন…”

প্রফেসর আলমগীর কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠিটা ধরলো। ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করলো।

জেনি এসে আমার হাত ধরলো। “চলো, আমাদের কাজ শেষ।”

আমি হ্যাঁ-বোধক মাথা ঝাঁকালাম।

দুজনে হেঁটে বেরিয়ে যাচ্ছি ঘর থেকে। একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলাম- প্রফেসর আলমগীরের দুচোখ বেয়ে অশ্রু নামছে আবার। এবার অভিনয় নয়, উপলব্ধির অশ্রু।

(সমাপ্ত)

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৫১
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×