যেদিন প্রকাশকের কাছে আমার প্রথম বই “গোধূলীর স্বপ্নছায়া”র পান্ডুলিপিটা ইমেল করে পাঠালাম, সেদিন থেকে মনে হচ্ছিল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, আমার দায়িত্ব শেষ হলো। অপেক্ষায় থাকলাম, প্রকাশক কী বলেন, তা শোনার জন্য। কিন্তু তখন পীক টাইম, তাই প্রকাশক কেন, কর্মচারী কিংবা সাহায্যকারীদেরও কথা বলার সময় নেই। তাই দিন গুনতে লাগলাম। একদিন প্রচ্ছদ শিল্পী প্রচ্ছদ ডিজাইনটা মেল করে পাঠালেন। প্রথম দেখাতে ভালোই লাগলো, তবে কিছুটা খুঁতখুঁতের বিষয়ও থেকে গেল। একে একে পরিবারের সবাইকে দেখালাম, মেজ বৌমা বিদেশে উচ্চতর পড়াশোনা করছেন, তাকেও ই-মেল করে মতামত চাইলাম। তাদের সবার মতামত আমারটার সাথে মিলে গেল। আমাদের মন্তব্যটা প্রচ্ছদ শিল্পীকে জানালাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে, তিনি আমার সাজেশনমত কিছুটা সংশোধন করে আরেকটা প্রচ্ছদ করে পাঠাবেন। আবার অপেক্ষার পালা।
আরো কয়েকদিন পর যখন পরের প্রচ্ছদটা পেলাম, তখন পরিবারের সবাই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে পরেরটাকেই গ্রহণ করলো, যদিও পরেরটার ব্যাপারেও আমার একটু খুঁতখুঁতে মনোভাব ছিলো। প্রথমটায় ছিল রঙের একটু অভাব, পরেরটায় আধিক্য। আমার মনে হলো, পরেরটা শিল্পী যেন গা ছাড়া ভাবে আমাকে খুশী করার জন্যই করেছেন। প্রথমটাতে তার মন ছিল, পরেরটাতে লেখকের আদেশ। আদেশ দিয়ে শিল্প হয় না। আমি শিল্পীর মন বোঝার জন্য তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কী ভেবে প্রথম প্রচ্ছদটা করেছেন। তিনি উত্তরে যা বল্লেন, তা শুনে বুঝলাম, তিনি কয়েকটা হলেও আমার কবিতা পড়েছেন এবং যেগুলো পড়েছেন, সেগুলোর প্রতিফলনই প্রচ্ছদে এনেছেন। তার উত্তর শুনে আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট হলাম এবং মনে মনে তার পক্ষ নিয়ে ফেললাম। পরে বাসার সবাইকে শিল্পীর ব্যাখ্যার কথাটি বুঝিয়ে বললাম এবং কেন আমাদের সামান্য আপত্তি সত্ত্বেও প্রথম প্রচ্ছদটাই রাখা উচিত, তার স্বপক্ষে যুক্তি দিলাম। সবাই মেনে নিলো, তাই আমি আর দেরী না করে প্রথম প্রচ্ছদটার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়ে দিলাম।
প্রথমে কথা ছিল, পহেলা ফেব্রুয়ারী থেকেই বইটা স্টলে আসবে, যদিও সে ব্যাপারে প্রথম থেকেই আমার একটা সন্দেহ থেকে গিয়েছিলো। আমি বইটা ০৫ তারিখে পেলেও সন্তুষ্ট থাকবো বলে মনে মনে ভেবেছিলাম। কিন্তু ৫ তারিখেও যখন চারিদিক নীরব, তখন একটা অস্থিরতা বোধ করতে থাকলাম। এ ব্যাপারে ফোন, টেক্সট কিংবা ই-মেল, কোনটাই করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। যাহোক, অনিচ্ছা নিয়েই প্রকাশককে ই-মেল করলাম। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে তার কিছু অপারগতার কথা টেক্সট করে জানালেন, যা আমি খুব সহজেই বুঝে ফেললাম। তাই আবার অপেক্ষা, তবে বেশী দিনের জন্য নয়। অবশেষে আমার প্রথম বইটি অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৬ তে ৮ই ফেব্রুয়ারী বিকেলে প্রকাশকের স্টলে আবির্ভূত হয়। এ খবর পাওয়ার পর স্ত্রীকে নিয়ে চটজলদি ছুটলাম বইমেলার উদ্দেশ্যে, নিজের জন্য কয়েকটা কপি সংগ্রহের জন্য। তীব্র যানজট পেরিয়ে অবশেষে সময় শেষ হবার মাত্র দশ মিনিট আগে স্টলে পৌঁছলাম,
৮ই ফেব্রুয়ারী, তখনো মেলা তেমন জমে উঠতে শুরু করেনি। আর আমি যখন মেলায় গিয়েছি, শেষ সময় বলে তখন ভিড় অনেকটা হাল্কা হয়ে গিয়েছিলো। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে যখন প্রকাশকের সাথে টুকটাক আলাপ করছিলাম, তখন একজন ভদ্রমহিলা এলেন। প্রকাশকের সাথে তাঁর পূর্ব পরিচয় ছিল। তিনি উদীচীর সাথে জড়িত এবং পেশায় একজন ব্যাঙ্কার বলে জানালেন। তিনি আমাদের আলাপচারিতা কিছুটা শুনলেন, প্রকাশকও তাকে আমার প্রথম বই প্রকাশের কথা জানালেন। তিনি তা শুনে কোন ইতস্ততঃ না করে সাথে সাথে আমার বইটির প্রথম কপিটা কিনে ফেললেন। আমার কাছে একটা শুভেচ্ছা স্বাক্ষরও চাইলেন, আমি প্রীত ও পুলকিত হয়ে আলো আঁধারিতে স্বাক্ষর করে দিলাম। আলো আঁধারিতে, কেননা স্টলের বাইরের আলোগুলো ততক্ষণে নিভিয়ে দেয়া হয়েছিলো। প্রথম দিনের বিক্রয়ের পরিসংখ্যানটি শূন্য থাকলো না বলে খুব ভালো একটা অনুভূতি নিয়ে বাড়ী ফিরলাম, সামান্য প্রাপ্তিতেই চিরসন্তুষ্ট এই আমি।
উদীচীর বীথি, আপনি সেদিন আমাকে এক শুভক্ষণ উপহার দিয়ে গেছেন এবং সেই সাথে আমার একটা সুখের স্মৃতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছেন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
ঢাকা
১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:৪১