গত শতাব্দীর '৫০ এর দশক অবধি কুয়েত ছিল একটা অতি দরিদ্র দেশ। জনগণের প্রধান পেশা ছিল, মৎস্য শিকার। মূলতঃ কুয়েতিদের পূর্ব পুরুষরা জেলে ছিলো এবং পারস্য সাগরের তীর ঘেষেঁ কুয়েত জনপদ গড়া ওঠাই এর প্রধান কারণ নয়। অন্য কোন পেশা না থাকার ফলে নিতান্ত জীবন - জীবিকার খাঁতিরে তাদের এ পেশা বেছে নেয়া। ১৯৩৮ সালে যখন জানা গেল, কুয়েত তেলের ভেসে আছে, তখনও তারা তৎকালীন গ্রেটব্রিটেনের অংশ। অতঃপর, জুন ১৯৬১ তে কুয়েত স্বাধীনতা অর্জন করলো এবং ১৯৬০-৮০ এ সময়ে একমাত্র ভূ-গর্ভস্ত তেলের উপর নির্ভর করে ব্যাপক সমৃদ্ধি অর্জন করে। এরপরে কুয়েতকে আর কখনোই পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
এবার, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। স্বাধীনতার পরপরই রেকর্ড ৫৭% প্রবৃদ্ধি অর্জন আশা জাগানিয়া হলেও তা পরবর্তীতে ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। সোনালী অাশঁ পাটের সময় যা নেমে দাঁড়ায় ২৯% এবং পাটের পতনের সাথে নব্বইয়ের দশকে নেমে দাঁড়ায় ২৪%। সীমাহীন দূর্নীতি এবং শক্ত কাঠামোহীন শিল্প না থাকার ফলে ১৯৯৫-৯৬ সালে বৈদেশিক রিজার্ভ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। বিভিন্ন উৎস থেকে ত্রিশ বিলিয়নেরও অধিক ঋণ গ্রহন এবং সর্বস্তর দূর্নীতির ফলে তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে না পেরে দেশ প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলো। ৪-৫ টাকা চালের সের হওয়ার পরেও জনসংখ্যার সিংহভাগই তিনবেলা অন্নের সংস্থান করতে পারতো না।
এরপরের গল্প সকলেরই জানা। মধ্য প্রাচ্যমুখী জনস্রোত এবং পলিপ্রোপিলিন পণ্যের আগমনের ফলে প্রায় হারিয়ে যাওয়া পাট শিল্পের স্থলে পোশাক শিল্পের জয়জয়কার দিয়েছে রিজার্ভের উর্ধ্ব গতি, ৩৫-৪০ টাকা সের সত্যেও অন্ততঃ ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করার সামর্থ্য। ২০০৬ সালেও যে রিজার্ভ ৩.১ বিলিয়নের বেশী ছিলো না, তা এখন ২৭.৪১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী। যাদের জন্য এ সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে, চলুন এবার তাদের কথা বলা যাক।
তৈরী পোশাক শিল্পে অব্যস্থাপনার চাল-চিত্র নাজরীন ফ্যাশন, রানা প্লাজা কল্যাপ্সের মতো ঘটনায় ফুটে উঠলেও বিদেশে কর্মরত প্রায় দুই কোটি বাঙালীর প্রতি আমাদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আমরা ক'জনই বা জানি। দূতাবাসগুলোর অদক্ষতা, অপেশাদার মানসিকতা এবং দূর্নীতির ফলে বিদেশ-বিভূয়ে কর্মরত শ্রমিকদেরকে প্রায়ই নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কুয়েত দাঁড়িয়েছে তেলের তেলেসমাতির উপর, আমরা দাঁড়াতে চাচ্ছি ঘামে অর্জিত শক্ত অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর। এ সত্যিটা ভুলে আমাদের দূতাবাস কর্তাদের হানিমূন করার মানসিকতা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যেকে বাধাঁগ্রস্থ করছে।
এতো গেল, উচ্চশিক্ষিত দায়িত্বশীল সমাজের মানুষের কথা। এবার আসা যাক, আবাসী বাঙালীদের কুলীন মানসিকতার প্রসঙ্গে। ওনাদের নাক ছিঁটকানোর ইতিহাস সকলেরই জানা। একটা সত্যি ঘটনা বর্ণনা দিচ্ছি। আমার এক নিকটাত্মীয় প্রবাসী বিয়ে করবেন বলে ছ'মাসের ছুটিতে এসেছেন। তার এ ছুটি পাওয়াও অনায়াসে হয়নি। তিনি আসলেন, পাত্রী খুজছেঁন, সম্বন্ধের কথাবার্তাও চলে কিন্তু কাজের কাজ বিয়েটা হয় না। অতঃপর, এ মাসের প্রথম দিকে উনি জরুরী তলব করে আমাকে নিলেন। ওনার ভাষ্যমতে প্রায় সেটেল এক পাত্রীকে দেখতে আমাকে তলব করা। পাত্রী দেখলাম, হ্যাঁ-না পছন্দও করলাম। কাজী ঢাকবো ঢাকবো, এমন সময় পাত্রীর বাবা বেঁকে বসলেন। অপরাধ, পাত্র প্রবাসী। প্রবাসী পাত্রে উনি কন্যাদান করলে সমাজে নাকি ওনার নসিঁকার দৈর্ঘ্য সংকুচিত হবে। অতএব, ভাঙো বিয়ে। আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্য, ওনার একমাত্র পুত্র সন্তানটিও উল্লেখিত পাত্র যে দেশে চাকরী করেন, তিনিও ঔ একই দেশে চাকরী করেন। আমি চারদিনের ছুটি নিয়েছিলাম। উদয়-অস্ত পাত্রী সন্ধান করেও শেষ অবধি পাত্রী পেলাম না। যা পাওয়া যায়, তা মিলানো যায় না। ছুটি শেষ করে চলে এলাম। পাত্রের ছুটিও শেষের দিকে, উনি চলে যাবেন। আজ আমাকে জানালেন, হয়ত আর এদেশে নাও আসা হতে পারে। দেশের মানুষের প্রতি ওনার ভালবাসায় নাকি ভাঁটা পড়েছে। দেশকে ঠিকই ভালবাসবেন। উনি আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ী, বাড়ী-এয়ারপোর্টের একটা বর্ণনা দিলেন। যা বললেন, তা যদি সত্যি হয় তবে দেশের সূর্য্য সন্তান প্রবাসীদের কাছে আমাদের আজই ক্ষমা চেয়ে সমস্যার উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ।
আমরা, প্রায়ই শুনে থাকি প্রবাসীর স্ত্রী নিয়ে পাড়ার ছেলের উদাও হওয়ার ঘটনা। বিচ্ছিন্ন বলে হয়ত গূরুত্বারোপ করা হয় না। যার জন্য একটা বিয়ে করা প্রান ওষ্ঠাগত ব্যাপার তার জন্য এমন প্রোফাইল কতটা কঠিন একবার ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।