হ্যালো বলতেই ফোনের ওপাশে নিঃশব্দ হাসি। “আশ্চর্য!!! ফোন ধরে হ্যালো বলিস না কেন?”
- রেডিও অন করে কেউ হ্যালো বলে?
- মানে কি? থাপ্পড় খাবি কিন্তু!!
- তুই হচ্ছিস রেডিও বাংলাদেশ, হেমায়েতপুর…হা হা হা!!!
- রেখে দিচ্ছি…রেডিও বন্ধ…শুনতে হবে না…
- আরে গুল্লু!!! রাগিস না রে প্লিজ!! কেমন আছিস? অনেকদিন পরে ফোন করলি…
বহ্নির রাগ লাগলেও এখন ফোন রাখা সম্ভব না। বন্ধুদের মধ্যে এই মানুষটাই শুধু ওকে ‘গুল্লু’ বলে ডাকে; নিজেকে সেইসময়ে ওর বেনী দোলানো আল্লাদী কিশোরী মনে হয়।
- ফোন তো তুইও করতে পারিস। আর এখন তোর বউ আছে…যখন তখন রাতে বিরাতে ইচ্ছে হলেই ফোন করা যায় না!!!
- তা ঠিক…বউ আছে বলেই একটু ব্যস্ত। বৃদ্ধের তরুণী ভার্্যা...হা হা!!
- আচ্ছা তুই কি চাইনিজে কথা বলতে শিখে গেছিস?
ফোনের ওপাশে হাসির শব্দ “পাগলী…আমি চাইনিজ শিখতে যাবো কোন দুক্ষে?”
- তাহলে জুলিকে বাংলা শিখাচ্ছিস?
- তুই না আসলেই গুল্লু!!! আমরা ইংলিশে কথা বলি। আর দরকার কি তার বাংলা শেখার? তখন তাহলে তোর সাথে ফোনের সব গুটুর গুটুর বুঝে ফেলবে…
- ভারী তো গুটুর গুটুর…বকবকতো সব আমি করি…
- তা ঠিক…আমি নীরব শ্রোতা!!! তোর হাবুর ওপরে চাপ কমাই…বেচারা!!
- আবার!!! তোকে না বলেছি রাহাতকে হাবু বলবি না…
- বাহ…হাবির বাংলা হাবু করলাম…তোর ক্যান যে পছন্দ না বুঝি না…হা হা!!! তা ভদ্রলোক কেমন আছেন? তোর ছেলেরা?
- সবাই ভালো আছে…
- তুই খুব ভাগ্যবান একজন মানুষ। সারাজীবন চেয়েছিস যে ছেলেরা তোকে খুব ভালোবাসুক…দ্যাখ এখন তোকে তিন তিনটা ছেলে কি ভালোবাসে!!
- তোকে না চড়ানো দরকার…এমন কবে চেয়েছি রে?
- এতো চড় মারিস…লিখে রাখিস…একবার এসে দিয়ে যাস…
- আঠারো বছর হলো…একবার বেড়াতে আয় না…তোরতো একটা ফেসবুক একাউন্টও নেই…রাস্তায় দেখলে চিনতে পারবো তো?
- ছবি নাই দেখলি!! আমি সেই ঝাকড়া চুলের তরুন আর আমার কাছে তুই সেই হরিণ চোখের মেয়েটা থাকলিই না হয়!
বহ্নি হেসে দিলো “সেই হরিন চোখ…আমাকে তার আগে এতো সুন্দর কথা কেউ বলেনি…” একটু বিষন্ন শোনালো কি ওর কন্ঠ!!!
- আর তুই গাধী সেটা হি হি করতে করতে দেখালি তোর মা আর খালাকে…শালী…পুরাই বেইজ্জতি!!!
- বাহ…তুই জন্মদিনের কার্ড এতো গদগদে কবিতা লিখে মেইল করবি কি ভাবে বুঝবো? নাম দিসনি…তোর সাথেতো আমার প্রতিদিনই বুয়েটে দেখা হয়…এতো নাটকীয়তা…আমিতো খুব খুশী ভেবে যে কোন গোপন ভালোবাসার মানুষ বুঝি পাঠাল!!!
- আমি বুঝি না তুই মাকে কেন দেখাবি? আবার আমাকে ফোন করে হি হি করে আমার কার্ড পড়ে শোনাস? ইচ্ছে করছিলো থাপড়াতে…
- হি হি হি…তোরও রাগ হয়? তোর মতো নির্বিকার মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। আমারতো মনে হয় তোকে যদি ফোন করে বলি যে ‘শোন আমি না একজনকে খুন করে ফেলেছি’ তুই হাই চাপতে চাপতে বলবি ‘কি ভাবে মারলি…চাক্কু নাকি পিস্তল?’
- আমি আর কি নির্বিকার!! তোর নির্বিকার ভাবের জন্য বুয়েটে একটা প্রেম পর্যন্ত করতে পারলাম না…
- আমি কি তোকে মানা করেছিলাম প্রেম করতে?
- ঠিক তা না…তোকে যখনি কেউ ঠারেঠুরে বলেছে যে আমরা কাপল কিনা তুই একটা রহস্যময় হাসি দিয়েছিস…আমার জীবনটা পুরাই শেষ!!! By the way তোর হাসিটা কিন্তু সুন্দর!!
- হি হি!!! সবচেয়ে রাগ লাগতো যখন কেউ ন্যাকা ন্যাকা ভাবে বলতো ‘বহ্নি তুমি মাহীনকে তুই করে বলো কেন? তুমি করে বলা উচিত।‘ তখন হাসিতো দেবই…আমার যাপিত জীবনের জবাবদিহিতা আমি নিজেকে ছাড়া আর কারো কাছে দেই না…এখনও না।
- তা আর বলতে? তোর কালাম ভাইয়ের কথা মনে আছে?
ফোনের দুপাশেই উচ্ছসিত হাসির শব্দ। বহ্নির তখন পাশ করে বুয়েটে পড়াচ্ছে; রাহাতের সাথে মাত্র বিয়ে হয়েছে। বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে মাহীন ওর অফিসে এলে দুজনে মিলে হাঁটতে হাঁটতে বুয়েট শহীদ মিনারের কাছে গিয়ে ঝালমুড়ি খায়; কখনো কখনো রিক্সা করে টিএসসিতে ঘুরতে যায়। একদিন মাহীনের সাথে অফিস থেকে বের হয়ে নামতেই সিভিল বিল্ডিংয়ের লবিয়ে কালাম ভাইয়ের সাথে দেখা; উনিও পুরকৌশলের লেকচারার; দু’বছরের সিনিয়র।
- বহ্নি বাসায় যাচ্ছো? আজকের মতো কাজ শেষ?
- জী ভাইয়া কাজ শেষ। তবে এক্ষুনি বাসায় যাব না। মাহীনের সাথে আড্ডার পরে বাসায়।
- বহ্নি একটা কথা বলি? কিছু যদি মনে না করো…
- ভাইয়া একটু তাড়া ছিলো…কাল শুনবো।
লবির বাইরে পা রাখতেই কালাম ভাই বললেন “আমি তোমাদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলি…”
- শোন তুমি এখন বুয়েটের শিক্ষক। এভাবে বন্ধু বান্ধবের সাথে ঘুরাঘুরি করা ঠিক না। ছাত্ররা দেখলে কি ভাববে? এই যে তুমি ছেলেবন্ধুদের সাথে এখানে সেখানে ঝালমুড়ি চটপটি খাও…রিক্সায় ঘুরতে যাও…টিএসসিতে যদি কোন ছাত্র তোমাকে তোমার জামাই ছাড়া অন্য লোকের সাথে দেখে কি মনে করবে বলতো? তুমি হচ্ছো এখন রোল মডেল…ঠিক মতো চলাফেরা করা উচিত।
কালাম ভাইয়ের জ্ঞানগর্ভ কথা শুনতে শুনতে ওরা তিনজন মেকানিকাল বিল্ডিং পেরিয়ে বেশ কিছুদূর; একটা রিক্সা দেখে বহ্নি থামালো “এই শুনুন টিএসসি যাবেন?” রিক্সাওয়ালা রাজী হতেই বহ্নি নির্বিকার মুখে বললো “কালাম ভাই চলেন টিএসসি যাই…আপনি পাশে বসবেন নাকি ওপরে?”
কালাম ভাইয়ের মুখের অবস্থা দেখার মতো…বেচারা পুরাই বাকরুদ্ধ। “আপনার কথা কিন্তু ফেলে দেবার মতো না…একজনের সাথে ঘুরলে খারাপ দেখায় কিন্তু আপনি থাকলে নো প্রব্লেম!!! আপনার সাথে কোথাও দেখলেও ছাত্ররা কিছু ভাববে না…আপনার রেপুটেশন স্পটলেস!!” কালাম ভাই কথা খুঁজে পাচ্ছেন না “না না মানে…” “আচ্ছা যাবেন না…ঠিক আছে। তবে মনে রেখেন কেউ কিছু বললে আপনিও কিছুটা দায়ী!!! ওই মাহীন…রিক্সায় উঠ!!”
হতবাক কালাম ভাইকে পেছনে রেখে রিক্সা আগাতেই ওদের দু’জনের আটকে রাখা হাসি বাধ ভাংলো; রিক্সাওয়ালা অবাক হয়ে বার বার পেছনে ফিরে দেখছে। এতো বছর পরেও কালাম ভাইয়ের মুখ মনে করলে ওরা হাসি বন্ধ করতে পারে না।
- কালাম ভুল ক'রে পড়েছে ভুল বই,
পড়েনি ব্যাকরণ, পড়েনি মূল বই!
কালাম জানে না তো সময় প্রতিকূল…
কালাম ভুল ক'রে নেমেছে ভুল জলে!
- খবরদার ওই ব্যাটাকে নিয়ে আমার পছন্দের কবিতাগুলো নষ্ট করবি না!!!
- ঠিক আছে…তো গুল্লু মন খারাপ করে আছিস কেন?
বহ্নির মনে হলো হঠাৎ করেই অন্ধকারে কেউ মোমবাতি জ্বালাল; কি কোমল কি মায়াবী সেই আলো!!! কি ভাবে বুঝে ফেলে মানুষটা!!
- বলবো না…বলতে ইচ্ছা করছে না!!!
- আজব…তোর কাছে আমি কখনো জানতে চেয়েছি কিছু…আমি শুধু চাই তুই ভালো থাকিস…
এটা ঠিক যে মাহীন কখনওই কিছু জানতে চায় না; তারপরেও মাহীন বহ্নির “যা ইচ্ছে তাই লেখার খাতা… যখন তখন খুলে লিখে রাখে গতকালপরশুর কিছু পাগলামি!” বহ্নি চুপ করে আছে।
- শোন পাগলী!!! মন ভালো কর...মনে আছে বলেছিলাম...
“পাগলী, তোর সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোর সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
পাগলী, তোর সঙ্গে কথাশিল্প জীবন কাটাব
পাগলী, তোর সঙ্গে বকবকম কাটাব জীবন।“
- তোর আমার বকবক কথাশিল্প মনে হয়?
- আহারে...কি খুশী!!! তোর সাথেতো আর পাপবিদ্ধ বা ধর্মমতে জীবন কাটাতে পারবো না...কি আর করা!!!
- থাপ্পড় খাবি!! আবারো ফাজলামি...
- শোন অফিসে কাজ আছে...এক কলিগ দু’বার ঘুরে গেলো...
- কি আশ্চর্য!! আগে বলবি না!!! রাখি তাহলে...
- গুল্লুর মন খারাপ হলে সব বাদ...
“আকাশে যখন মেঘ, ছায়াচ্ছন্ন গুমোট নগরে খুব দুঃখ বোধ...
রেস্তোরাঁয় পথে পথে মানুষের মুখ কালো,
বিরক্ত মুখোস
সমস্ত শহর জুড়ে ক্রোধ...
যে-যার নিজস্ব হৃৎস্পন্দনেও হরতাল জানাবে–
আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, আমি জানি,
আমি তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই, গিয়ে বলি,
গুল্লু, তুমি মন খারাপ করে আছো?
লক্ষ্মী মেয়ে, একবার চোখে দাও,
আয়না দেখার মতো দেখাও ও-মুখের মঞ্জরী
নবীন জনের মতো কলহাস্যে একবার
বলো দেখি ধাঁধার উত্তর!
অমনি আড়াল সরে, বৃষ্টি নামে,
মানুষেরা সিনেমা ও খেলা দেখতে
চলে যায় স্বস্তিময় মুখে
ট্রাফিকের গিঁট খোলে...
মিলেমিশে বাড়ি ফেরে যা-যার
রাস্তায়
সিগারেট ঠোঁটে চেপে কেউ কেউ
বলে ওঠে,
বেঁচে থাকা নেহাৎ মন্দ না!”
- গেলি!!! আবার কবিতা নষ্ট করছিস!!!
- শোন এরপরে ঠান্ডা লাগলে ফোন দিসতো...
- মানে কি? সর্দিকাশি হলে অসুস্থ অবস্থায় ফোন করবো কেন?
- তোর গলাটা ঠান্ডা লাগলে ভালো শোনায়। অন্য সময়ে যেমন আজ তোর বাকবাকুম শুনতে কষ্ট হয়েছে...হা হা হা!!
- তুই না একটা যা তা!!! রাখি। ভালো থাকিস...
- তুইও ভালো থাকিস গুল্লু!!
ফোন রেখে বহ্নি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো “সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে...অথচ সময়ই জানে, কথা আছে, ঢের কথা আছে।“ কখনো কি সেই কথাগুলো বলা হবে? অথবা কে জানে হয়তো বলার হয়তো দরকার নেই; ওরা দুজনেই সেই কথাগুলো জানে।
(০৪/৩০/২০১৬)
বিঃ দ্রঃ সুনীলকে ছাড়া আমার একপাও চলার উপায় নেই। কারো কারো কাছে ঋনী হতে দারুন ভালো লাগে। জয় গোস্বামীর কবিতার নামে নাম তবে সব কবিতাই গল্পের প্রয়োজনে একটু বদলেছি। ‘নীরা’ বদলে গেছে ‘গুল্লু’তে বা রফিক আজাদের কবিতায় ‘বালক’এর জায়গায় ‘কালাম’। আর জয় গোস্বামী ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ বললেও আমার চরিত্ররা তুই সম্বোধন করেছে। পাঠকেরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে কবিতার পরিবর্তন মেনে নেবেন আশা করছি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:২৯