রাতটা কিছুতেই কাটতে চাচ্ছেনা । কতক্ষণ আগে দেখলো বারোটা । এখন কেবল একটা । এক ঘন্টাও এমন দীর্ঘ সময় হয়! আজ রাতটাই রোশনি ঘুমাতে পারবে বলে মনে হয় না । কাল বিকেল পাঁচটায় হিমেলের সাথে ওর প্রথম দেখা হওয়ার কথা । দেখা হবে একটা কফি শপে । ঘন্টাখানেক আগেই ফোন দিয়ে কানফার্ম করেছে হিমেল । আয়োজন করে সাক্ষাতে এই প্রথম কারো সাথে একটা মনোরোম অনুভূতির ভাগাভাগি করতে চলেছে রোশনি । এভাবনাতেই তার হৃদপিণ্ডে রক্তের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ । শিরা-ধমনিতে অবাধ্য গতি । কী করে ঘুমাবে রোশনি!
রোশনি ও হিমেলের প্রথম পরিচয়টা হয়েছে ফেসবুকে । শান্ত শান্ত চেহারায় হিমেলের প্রোফাইলের ছবিটা । বেশ আকর্ষণ আছে । About-এ, Studied at BBA তারপর একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির নাম । রোশনির প্রোফাইলে একটা বারবি ডলের ছবি । কিউট । রোশনি হয়তো জানে না এসব ডল-ফলের চেয়ে তার সৌন্দর্য আরো বেশি নিখুঁত । প্রথম ফ্রেন্ড রিকোএস্টটা হিমেলই পাঠিয়েছিল । রোশনি দেখলো এই ছেলেটা ও তার বান্ধবী ডিজনি মিউচুআল্ ফ্রেন্ড । সে হিমেলের রিকোএস্টটা একসেপ্ট করলো । হাই... হ্যালো... তারপর আরেকটু গভীরে... আরেকটু ব্যক্তিগত । বর্ণমালার পরিবর্তে ওরা এখন শব্দের বেশ ব্যবহার করে––মোবাইলে কথা বলে ।
রোশনি এইচ. এস. সি. সেকন্ড ইয়ারে । একমাত্র বড় ভাই ও আম্মু তার খুব কাছের বন্ধু । হেন বিষয় নেই যা ভাইয়া আর আম্মু জানে না । কোথাও হয়তো চামচিকা বা তেলাপোকা দেখে ভয় পেয়েছে তা অন্তত ভাইয়াকে না বললে ঘুম আসবে না ওর । তবে হিমেলের বিষয়টা গোপন করে চলেছে রোশনি । ভাইয়া কিছুটা টের পেয়েছে কিন্তু রোশনিকে কিছুই বলছে না । ভাইয়া জানে, মানুষ বড় হতে থাকলে অনেক কিছু লুকাতে শিখে, লুকাতে হয় ।
রোশনিকে প্রায় সারাদিনই বাইরে বাইরে থাকতে হয় । ক্লাশ, প্রাইভেট, কোচিং––বেশ ব্যস্ততা ! কালকেও বিকেল পাঁচটায় কেমিস্ট্রি প্রাইভেট আছে । এই প্রাইভেটটা মিস দিয়েই হিমেলের সাথে দেখা করতে যাবে রোশনি । কেউ জানবে না ।
আজ রোশনি কলেজে গেলো না । আম্মুকে বলল, তেমন ইম্পরট্যান্ট ক্লাস নাই; বিকেলে কেমিস্ট্রি প্রাইভেট পড়তে গেলেই হবে । দুপুরের ঘুমের অজুহাতে বেডরুমের দরজা বন্ধ করে দুইটা থেকে সাজতে বসেছে রোশনি । একে একে তার সমস্থ ড্রেস পরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে ট্রাইআল দিচ্ছে । অবশেষে একটা নীল ড্রেস পছন্দ করলো ও । ম্যাচ করে কানের দুল, ব্রেইসলিট, হাত-পায়ের নখে নেইল পলিশ; লোমহীন ধবধবে ডান পায়ে একটা পায়েল । একদম বাংলাদেশী ক্লিওপেট্রা ! এর আগেই কাজের ছেলেটাকে দিয়ে গোপনে একটা গোলাপ আনিয়ে রেখেছে । একটু খটকা লাগে রোশনির মনে, হিমেল কোন ফুল বেশি পছন্দ করে, গোলাপ নাকি অন্য কিছু । আহারে, এটা জিজ্ঞেস করা হয়নি ! রোশনি অবশ্য গল্পের বই পড়ে জেনেছে, প্রেমের সমার্থক হলো গোলাপ । ছেলেটা বেশকিছুদিন থেকেই ভালোবাসি ভালোবাসি বলে ঘ্যান-ঘ্যান করছে । আজ রোশনি এই ঘ্যান-ঘ্যানির অবসান ঘটাবে গোলাপ দিয়ে । ফেসবুকের ছবিগুলোতে হিমেলের আভিজাত্যই রোশনিকে এমন সাজতে উৎসাহ যুগিয়েছে । ছেলেটা কী দারুণ, কী অস্থির সব ছবি পোস্ট করে––আজ চকচকে কোন ফাস্টফুডে, কাল দানবীয় একটা মোটর বাইকের পিঠে বসে, পরশু প্রাডো গাড়ির স্টেয়ারিং-এ হাত দিয়ে নানা কিসিমের ছবি । এ যেনতেন ছেলে নয়; তাই যেনতেন সাজে যাওয়া ঠিক হবে না ।
ভ্যানিটি ব্যাগের এককোনায় গোলাপটা যত্নে রেখে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হলো রোশনি । বুকের মধ্যে ভীষণ ধকধক । আম্মু যদি বলে বসে এত সেজেগুজে কই যাস ? না, আম্মু তেমন লক্ষ্য করলোনা, বেসিনে হাত ধুচ্ছিলো । আসি আম্মু বলেই খুব দ্রুত মেইন গেইট পার হলো রোশনি । পড়লে হাত-পা ভেঙ্গে যেতে পারতো !
রিক্সা নিয়ে কফি শপের দিকে রওনা দিলো রোশনি । ঠিকানাটা আগেই জেনে নিয়েছিলো হিমেলের কাছ থেকে । রিক্সা থেকে নামতেই এগিয়ে এলো হিমেল । ছবির চেয়েও হ্যান্ডসাম ছেলে । রোশনির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো । রোশনি ইতস্তত, বুকের মধ্যে কাঁপন । এত মানুষের ভিড়ে কী করে অন্য ছেলের হাত ছোঁয় । না দেখার ভান করলো । বলল, চলুন ভিতরে যাই । হিমেল তৎক্ষণাৎ তার হাতটা সরিয়ে নিলো, যেন সে হাত বাড়ায়নি । কফি শপটার ভিতরে গিয়ে খুব অবাক হলো রোশনি । ডিমলাইট জ্বলা অন্ধকার । তারা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই । রোশনির চোখে একটা আসন্ন ভয়–– আঁচ করতে পারলো হিমেল । বলল, তোমার জন্য এটা সারপ্রাইজ, লজ্জা পাবে তো তাই পুরোটাই দুই ঘণ্টার জন্য রিজার্ভ নিয়েছি । এবার রোশনির চোখে একটু স্বস্তির ভাব–– ছেলেটা আমার জন্য এত কিছু করেছে ! হিমেল একটা চেয়ার টেনে রোশনিকে বসতে দিলো । ছেলেটা বেশ ভদ্রতা জানে । তারা দুজনে মুখোমুখি বসলো । রোশনি ভাবছে গোলাপটা এখোনি দেবে কিনা । ইতোমধ্যেই হিমেল উঠে দাড়ালো, বলল, ওয়েট দুকাপ কফি নিয়ে আসি । মৃদু হেসে সম্মতি জানালো রোশনি । কফি খেতে খেতে বেশকয়েকবার আলতো করে রোশনির হাত ছুঁয়ে দিয়েছে হিমেল । প্রতিবারই রোশনির বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠা অথচ ভালো লাগা কাজ করেছে । উফঃ কী রোমাঞ্চিত সুখ!
কিছুক্ষণ পরে দরজায় নক হলো । হিমেলের দুজন বন্ধু এসেছে । দাঁড়িয়ে সালাম দিলো রোশনি । সালামের উত্তর না দিয়েই ফ্রেঞ্চকাটিং দাড়িওলা নাদুসনুদুস ছেলেটি বলল, মামা, দারুণ মাল পটিয়েছিতো । গাঁজাখোর মত দেখতে আরেকজন বলল, যা করার তাড়াতাড়ি কর একঘন্টা সময় তো মাগনা মাগনা খেয়ে ফেলছোস । পরবর্তী ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটে গেলো । ঘণ্টাখানেক ধরে এই তিনটা জীব... । রোশনির কানের দুল, পায়েল ছিড়ে কোথায় ছিটকে পড়েছে । আর রোশনির তীব্র চিৎকার কফি শপটার দেয়ালে আটকে গেছে; কংক্রিট আর কাচ ভেদ করে মানুষের কানে পৌঁছেনি ।
রোশনি অবসন্ন দেহে রিক্সায় ফিরতে ফিরতে ভাবে, মেয়েদের প্রথম ভালবাসা ভুল প্রেম হয় । এই ভুলই রোশনিকে আজ বিধ্বস্ত মনে বাসায় নিয়ে যাছে । দরজায় পা দিতেই আম্মু বলল, কিরে আজ মনে হচ্ছে একটু দেরি হলো । আর তোকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে । কিছু হয়েছে । না আম্মু কিছু হয়নি । রোশনি কাউকেই বলবে না, না আম্মুকে, না ভাইয়াকে, আজ তার কী হয়েছে? রোশনি আজ ঘরের দরজা বন্ধ করে সারা রাত কাঁদবে... ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:০০