somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাদল ' ১৯৭১

৩০ শে অক্টোবর, ২০১১ সকাল ৮:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাদল সারাটাদিন এদিক সেদিক উদভ্রান্তের মত ঘোরাঘুরি করে। ওর বয়স বেশি না। দশ বা বার। কিন্তু আজকাল ওর নিজেকে কেমন যেন অনেক দায়িত্বশীল বলে মনে হয়। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে বয়স বেড়ে গেছে। অল্প কয়েকটা দিনের মধ্যে এ গ্রামে অনেক কিছু ঘটে গেছে। মাঝে মাঝে গ্রামে মিলিটারী হানা দিচ্ছে। পরিচিত একে ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কাউকে মেরে ফেলছে, কাউকে ল্যাংড়া করে ছেড়ে দিচ্ছে। গ্রামের যুবকেরা, মধ্যবয়স্করা সব পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মেয়েরা গ্রাম থেকে পালিয়ে আরো গ্রামের দিকে চলে গেছে। শুধু পড়ে আছে বুড়ো বুড়ির দল আর যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কেউ কেউ অবশ্য সাহস করে থেকে গেছে।


বাদলেরাও সাহস করে থেকে গেছে। বাদলের বাবা বৈরাগী মানুষ। কেউ পালিয়ে যাওয়ার কথা বললে বাদলের বাবা ভাবের কথা বলে। স্ত্রী পুত্রের নিরাপত্তা সে মুর্শিদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে।


বাদল এখন যাচ্ছে তিন গ্রাম পরের গ্রাম, ইন্দ্রুকুলে কামালকে খুঁজতে। কেউ তাকে খুঁজতে পাঠায় নি। সেই নিজ দায়িত্বে খুঁজতে যাচ্ছে। অবশ্য কেউ কামালের কোন খোঁজ খবর জানেও না। ইন্দ্রুকুল গেলে যে কামালকে পাওয়া যাবে এমন কোন নিশ্চয়তাও নেই। তবু একবার চেষ্টা করে দেখা। শেষবারের মত যদি চোখের দেখাটা অন্তত হয়। গত রাতে কামালের মা মারা গেছে। হঠাৎ বুকের বেদনা।


কামাল একজন গেড়িলা। ইন্দ্রুকুলে তার বন্ধুরা থাকে।যদি কারো কাছে খোঁজ পাওয়া যায়, কোথায় আছে কামাল। মাথার উপর তপ্ত রোদ। কাদার রাস্তায় ঠিকমত হাঁটা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে বাদল এগিয়ে যাচ্ছে। দৌড় আর হাঁটার মাঝামাঝি অবস্থা। বিকেলের মধ্যে ফিরতে হবে। সন্ধায় বাদ মাগরিব কামালের মায়ের দাফন। বাদলের হাঁটার তালে তালে ঝনঝন করে কোমড়ে কালো সুতোর সাথে বাঁধা চাবির গোছাগুলো বাজছে। বাড়ির যুবতি ও মধ্যবয়সী মেয়েদের বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রাখতে হচ্ছে। কখন শুয়োরের বাচ্চা মিলিটারীরা হানা দেয়, কে জানে।


আর একটু আগে রওয়ানা দিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু দেওয়া সম্ভব হয় নি। সকালে বাদলেরা কয়েকজন মিলে সাইলোতে ঘাস কাটতে গেছে। সাইলোতে মিলিটারীরা ক্যাম্প বসিয়েছে। ছোটছোট পোলাপান দিয়ে ওরা নানারকম কাজকর্ম করায়। কাপড়চোপড় ধোঁয়ায়, থালাবাসন মাজায়, হাত-পা টিপায়। বিশাল দেহী এক সিপাহী অনেকক্ষন ধরে ওকে দিয়ে হাত পা টিপিয়েছে। এতে অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে। হাত পা টিপিয়ে বাদলকে সিপাহীটা কয়েকটা বিস্কুট খেতে দিয়েছে। বাদল খায়নি, ফেলে দিয়েছে। মিলিটারীর হাত পা টিপার পরে গা ঘিন ঘিন করছে । বাড়ি ফিরে বাদল অনেকক্ষন সময় নিয়ে পুকুরে গোসল করেছে। তবু ঘিন্না লাগছে। কিছু না খেয়েই সে ই›দ্রুকুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে।


ইদ্রুকুল পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। শরীরে তেমন বল পাচ্ছে না বাদল। তবে কামালের খোঁজ পাওয়া গেছে। কামাল আছে তার বন্ধু নাসিরের বাড়ি। বাদলকে বারান্দায় একটা চৌকিতে বসতে দেয়া হয়েছে। কামাল ঘুমাচ্ছে। গত দুদিন সে অন্য কোথাও ছিল। শেষ রাতে ফিরেছে। সাথে আরো পনের ষোলজনের দল। সবাই ঘুমাচ্ছে। দুই একজন ভীষণ নাক ডাকছে। নাসিরের দাদী বাদলকে বড় কাঁসার গ্লাস ভর্তি করে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দিয়েছে। বাদল খালি পেটে ঢকঢক করে শরবতটা খেল। কেউ কামালের ঘুম ভাঙাচ্ছে না। ওর অনেক ঘুমের দরকার।


কামাল বাদলের সাত আট বছরের বড়। অথচ কামালকে বাদল তুই তুই করে, নাম ধরে ডাকে। পুরানো অভ্যাস, ছাড়তে পারছে না। কামালের হাতে এর জন্য মাইরও খেতে হয়েছে অনেক। তবু বাদলের অভ্যাস বদলায় না। অভ্যাস বদলাতে লজ্জ্বা লাগে।


মাগরিবের আজানের সময় বাদলের ঘুম ভাঙানো হল। অন্যরা তখনও ঘুমাচ্ছে। কামালের ঘুম যেন ভাঙতে চায়না। নাসির বলল, ওঠ জরুরী কাজ আছে তোর সাথে। এক জায়গায় যেতে হবে।

কামালকে এক প্লেট গরম খিঁচুরি খেতে দেয়া হয়েছে। বাদলের পেটেও দারুন ক্ষুধা তবু বলার উপায় নেই। কামাল তখনও বাদলের দেখা পায় নি। খাওয়া শেষে নাসির কামালকে বলল, তুই একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আয়। বাদল এসেছে। তোর মায়ের খুব অসুখ।


কামালের মায়ের খুব অসুখ এটা কোন নতুন ঘটনা না। বাদলকে দেখে সব কিছু পরিস্কার হয়ে গেছে।


অন্ধকার পথ ধরে কামাল আর বাদল দৌঁড়াচ্ছে। কামালের চেহারা দাড়িমোজে বীভৎস হয়ে গেছে। এ যেন সেই আগের কামাল না ,অন্য কেউ । মাঝে মাঝে কামাল ডুকরে কেঁদে উঠছে। বাদলেরও খুব কান্না আসছে। আজ কামালকে খুব ভাইয়া বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে। ভাইয়াকে কী বলবে বাদল, তার মাথায় কিছু আসছে না। বাদল কাঁদতে কাঁদতে কামালের পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে।


কামালের মায়ের জানাযা হয়ে গেছে। কামাল মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদল। বাদলের বাড়ি যাওয়া দরকার তার কাছে ঘরের চাবি। বাড়িতে সবাই বন্দী হয়ে আছে। কিন্তু তার পা নড়ছে না।


সবাই ধরাধরি করে লাশ তুলল। অনেক দেরী হয়ে গেছে। দাফন শেষ হতে না হতেই তিন চারটি জীপে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জনের একটি মিলিটরী দল গ্রামে ঢুকেছে। গোলগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সবাই দিগি¦দিক দৌড়াচ্ছে। কামাল তার মায়ের কবরের পাশে নিথর বসে আছে।


বাদল দৌড় শুরু করল। বাতাসের আগে যাওয়া দরকার। গেরিলাদের খবর দিতে হবে। যদি গ্রামটা বাঁচানো যায়। নিস্তব্ধ রাত। মিলিটারীর ভয়ে একটা ঝিঁঝিঁ পোকাও ডাকছে না। শুধু মাঝে মাঝে বাদলের কোমড়ে কালো সুতোয় বাঁধা চাবির গোছাটা ঝনঝন করে বাজছে।

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১১ সকাল ৮:১৪
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×