অনুবাদঃ ফ্রিডম ফ্রম ওয়ান্ট - লিজ মুরি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
( “ লিজ মুরি ১৯৮০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের ব্রুনক্সে এক দরিদ্র এবং মাদকাসক্ত বাবা – মায়ের ঘরে জন্মান । শৈশবেই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন এবং অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টে নিঃস্ব অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় বড় হন । কিন্তু লিজ মুরি হারিয়ে যাননি । অক্লান্ত পরিশ্রম, সংগ্রাম, দৃঢ় মনোবল আর মানুষের সাহায্য নিয়ে তিনি জীবনে ঠিকই সফল হয়েছেন ।
২০০৩ সালে তার জীবন নিয়ে তৈরি হয় “ Homeless to Harvard: The Liz Murray Story “ নামের এক প্রামাণ্য চিত্র । ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে তার লেখা নিজের আত্মজীবনী “ The Breaking Night “ চলে আসে New York Times (US) এবং Sunday Times (UK) এর বেস্ট সেলারের তালিকায় । ১৯ মে ২০১৩ তে তাকে দুঃস্থ মানুষের কল্যাণে অপরিসীম ভূমিকা রেখে চলার জন্য ডক্টরেট ডিগ্রিতে ভূষিত করা হয় । তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক বই এবং ফিচার ।
বর্তমানে তিনি একনিষ্ঠ ভাবে সহায় সম্বলহীন মানুষদের পাশে দাড়িয়ে তাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন । “ - ভাষান্তরকারী )
১৯৯৭ সালে, আমি নিজেকে এমন একটা অবস্থায় দেখলাম যাতে কখনও দেখবো বলে কল্পনাও করি নি ; একা এবং নিউ ইয়র্কে টাকার জন্য ভিক্ষা করছি । আমি বয়স তখন ১৬ , থাকার মতো কোন জায়গা নেই এবং মরিয়া হয়ে এমনএকটা হাই স্কুল খুঁজছি যা আমাকে বছরের পর বছর ভবঘুরে হয়ে রাস্তায় রাস্তায় দিন কাটানোর পর ক্লাসে ভর্তি করবে ।
বাবা তখন আমাদের পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং যদিও আমি জানতাম তিনি কাছেই একটা পুরুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন , তিনি আমাকে কোনরকম সাহায্য করার মতো অবস্থায় ছিলেন না । মা কয়েক বছর আগে AIDS থেকে হওয়া নানা জটিলতায় মারা গিয়েছিলেন এবং আমি তার পরের কিছু মাস ঘুমিয়েছি বন্ধু – বান্ধবীদের বাসায় বা ব্রুনক্সের নানা বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির নিচে ।
ঠাণ্ডা মার্বেলের মেঝেতে নিজের ব্যাকপ্যাকটাকে কোলবালিশ বানিয়ে কাটানো ওইসব রাতগুলোর যা আমার সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে তা হল, উজ্জ্বল হয়ে জ্বলা ফ্লুরসেন্ট বাল্বের আলো থেকে চোখ কে বাঁচাতে আমার ন্যাকড়া হয়ে যাওয়া ফ্লানেল কাপড়ের গেঞ্জিটা একটু উপরের দিকে তুলে চোখ ঢেকে রাখতাম । হয়তো বাড়ির ভেতরের পরিবারটার থেকে সিঁড়ির নিচে আমার কানে ভেসে আসা নানা শব্দ শুনতাম – বাচ্চারা বাবা – মা কে ডাকছে , টিভিতে কার্টুন চলছে , খাবারের বাসনের টুং টাং শব্দ - সহ আরও নানান শব্দ যেটা একটা খালি এপার্টমেন্টকে একটা বাড়ি বানিয়ে দেয় ।
নিঃসঙ্গতার মধ্যে টিকে থাকতে আমি দিবাস্বপ্নে ডুবে যেতাম । চোখ বন্ধ করে আমি আমার পরিবারের সবাইকেও একসাথে কল্পনা করে গেছি ; যে কল্পনায় মা জীবিত আছেন; আগের মতোই ,খুব বেশী হাসলে তার চোখের চারপাশের চামড়া যেমন একটু কুঁচকে যেতো , তেমন ; আমরা চারজন – মা , বাবা , আমার বড় বোন লিসা এবং আমি - আবারও একই ছাদের নিচে নিরাপদে । তবে সবচেয়ে বেশী উজ্জ্বল দিবাস্বপ্নগুলো ছিল নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ।
কল্পনায় দেখতাম আমি কোন এক স্কুলের ক্লাসে বসে আছি , খুব মনোযোগের সাথে নোট নিচ্ছি । দেখতাম শরৎকালের গাছের পাতার ফাঁকে ঝকঝক করতে থাকা উঁচু উঁচু পাথরের বিল্ডিংয়ের এক ক্যাম্পাসে আমি হাঁটছি , ক্লাসের দিকে খুব আনন্দের সাথে । এসব নিরাপদে থাকার অনুভূতি , ছন্নছাড়া হয়ে স্রোতে ভেসে হারিয়ে না যাওয়া এবং বড় হওয়ার আশা আমাকে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়ে দিত ।
আমার এখনকার জীবন সেই সময়কার জীবনের সাথে কোন মিলই বহন করে না । আমি শুধু যে হাই স্কুল থেকেই গ্র্যাজুয়েট করেছি এমন না , আমি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকেও গ্রাজুয়েট করেছি । আমাকে এখন আর ছেঁড়া কাপড় পড়তে হয় না বা হলওয়েতে ঘুমাতে হয় না । তার বদলে আমি এখন প্রতি রাতেই ম্যানহাটনে নিজের এপার্টমেন্টে নিরাপদ । গত ১১ বছর ধরে আমার প্যাশন সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে মানুষকে তাদের নিজেদের জীবন বদলাতে সাহায্য করা । সংক্ষেপে বললে , এখন আগের " আমি " থেকে বর্তমানের " আমাকে " চেনা যাবে না ।
জীবনে যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, সেসবের পর শুনতে অদ্ভুত শোনালেও – আমি বিশ্বাস করি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ চাওয়াই আসলে জীবনে কাম্য । আমি এমনটা ভাবি সম্ভবত জীবনে পাওয়া নিজের অভিজ্ঞতার কারণেই । প্রকৃতপক্ষে “ জীবনের সব অভাব মিটিয়ে ফেলা “ কখনোই আমার লক্ষ্য ছিল না । অভাব আসলে আমার স্বপ্নগুলো পূরণে সাহায্যই। করেছে, বাঁধা হয়ে দাড়ায় নি এবং আমার স্বপ্ন সবসময় তাই ছিল যা আমাকে উৎসাহিত করতো ।
আমি যখন ঐ বাড়িঘর ছাড়া তরুণী ছিলাম , যে কিনা তার জীবনে পরিবর্তন আনতে দিন-রাত কষ্ট করে যাচ্ছিল , তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিউ ইয়র্কের ফুটপাথ ধরে ভর্তি হওয়ার মতো স্কুল খুঁজতে হাঁটতাম – যে কোন স্কুল , যেটা আমাকে ভর্তি করাবে । নিজের সে সময়ের কষ্টটা আমার কাছে তখন বড় লাগতো না । বড় লাগতো সিঁড়ির নিচের অন্ধকার খুপরিতে শুয়ে শুয়ে আমি যেসব স্বপ্ন দেখেছি সেগুলোকে বাস্তব করতে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি , কিন্তু পারছি না ।
ঐ সব মুহূর্তগুলোর আলাদা আলাদা গানও আছে । পকেটে একটা পুরানো , লক্কড় মার্কা সিডি প্লেয়ার থাকতো যেটাতে হতাশা দূর করার মতো গান বাজাতাম - Paula Cole এর গাওয়া “Me” , বা Cake এর “The Distance” । নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতাম এবং আমি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলাম যে তাতে আমি একদিন পা রাখবোই ।
যদিও আমি আমার পরিবারকে হারিয়েছিলাম; সাথে কিছু গান, মায়ের একটা ছবি, জামা কাপড়ের উপর কিছু আর্টিকেল এবং দোকানের উচ্ছিষ্ট কিছু খাবার সহ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা এবং সে অনুযায়ী চেষ্টা করাটা ছিল হার্ভার্ডে চান্স পাওয়ার অনুভূতির মতোই ভালো লাগার । নাবিক যেমন আকাশের তারার দিকে চোখ রেখে জাহাজ চালিয়ে যায় , তেমনি আমি জানতাম জীবনে আমার কোথায় পৌছতে হবে এবং আমার লক্ষ্যগুলোই প্রতিদিন কি করবো তা ঠিক করে দিত ।
জীবনের মোড় ঘুরানোর জন্য প্রতিটা দিনের ভাবনাটা যেমন জরুরী ছিল, তেমনি জরুরী তাদের অবদান, যারা আমাকে পথ চলতে সাহায্য করে গেছেন । Humanities Preparatory Academy; আমার “ না “ –এ ভরা পৃথিবীতে ঐ জায়গাটা থেকে আমি “ হ্যাঁ “ শুনতাম । Door নামের অলাভজনক আরেকটা স্বর্গের মতো প্রতিষ্ঠান ছিল আমার মতো ভবঘুরে কিশোর – কিশোরীদের জন্য, যারা আমাকে মানসিকভাবে শক্ত রেখেছে, খাবার , চিকিৎসা দিয়েছে । এসব সাহায্যের জন্যই আমি রেল স্টেশনের বা হলওয়ের আলোয় হোমওয়ার্ক করে বেঁচে থেকেছি । জীবনে সফল হওয়ার জন্য আমার মানুষের সাহায্যর খুব বেশী দরকার ছিল এবং যখন আমি সাহায্যর জন্য কাউকে খুঁজেছি – আমি পেয়েছিও ।
যে সাহায্যটা আসলে আমি কখনও পাবো কল্পনাও করি নি , সেটা কে আমার খুঁজতে হয় নি , সাহায্যটা নিজেই আমাকে খুঁজে পেয়েছিল । দুই বছর রাস্তায় রস্তায় ভবঘুরে থেকে পড়াশুনা করে যাওয়ার পর একদিন নিউ ইয়র্ক টাইমস আমার গল্প সবাইকে বললো ।
পরের সপ্তাহে সারা আমেরিকার নানা প্রান্ত থেকে কয়েক ডজন অচেনা মানুষ আমাকে খুঁজে বের করেছিল । হাই স্কুলে আমাকে উৎসাহ দিয়ে নানা মানুষের হাতে লেখা চিঠি পেতাম । অপরিচিত মানুষরা খাবার , জামা, বই নিয়ে আসতো , কেউ বা আমাকে আপনজনের মতো আদরও করতো । খবরের কাগজের আর্টিকেলটাতে আমি হার্ভার্ডে ভর্তির জন্য চেষ্টা করবো লেখা দেখে এক মহিলা আমার জন্য একটা কম্বল বুনেছিলেন , যে বক্সে করে তিনি সেটা আমাকে পাঠিয়েছিলেন সেখানে ছোট্ট একটা চিরকুটে লেখা ছিল – “ ওখানকার হোস্টেলের রুমগুলোতে খুব ঠাণ্ডা পড়ে । তুমি এই ভেবে নিজেকে উষ্ণ রেখো যে আমরা সবাই তোমার ভালোর জন্য ভাবি “ ।
এসব মানুষদের দেখার আগে , যাদের অনেকেরই নাম আমার অজানা, আমি কখনোই বুঝতে পারি নি মানুষ কতখানি ভালো হতে পারে । এখন আমি তা বুঝি , এবং সে জন্য আমি বলতে পারি যারা আমাকে সাহায্য করেছেন তারা আমাকে সবসময়ের জন্য বদলেও দিয়েছেন । তারাই আমার “Door “ পরিচালনা বোর্ডে যোগ দেওয়ার কারণ । তাদের কারণেই আমি ছোট্ট একটা দলের অংশ হয়ে আশ্রয়হীন কিশোর – কিশোরীদের জন্য স্কুল খুলতে পেরেছি । তারাই সে কারণ যার জন্য আমি নিজের জীবনকে অন্যের জীবনের রাস্তা তৈরি করার কাজে উৎসর্গ করেছি ।
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
অনির্বাণ শিখা
রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।
আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=
©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....
মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।
ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন
অণু থ্রিলারঃ পরিচয়
ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত
১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন
শিরোনামহীন দুটি গল্প
গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন
এশিয়ান র্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!
যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন