১
মাটির ঘরে ছনের মাদুর পেতে খাবারগুলো হাতড়ে মুখ ব্যাদান করে বললো সুরহাব, "ঐ মাগী! আইজ কি কিচ্ছু রান্ধস নাই?"
-সাজনার শাক দিয়া ইঁচা মাছ রানছি। মুরগীর সালুনও আছে, লন।
-আর কিছু নাই? দুইদিন আগের সালুন। তুই খায়া কবরে যা। আছে তো বস্তার লাহান শইল। সারাদিন করস কি?
কথার ভঙ্গীতে ইদানিং সখিনার আর রাগ হয়না। সুরহাব অনেক বদলে গেছে। সব কিছুতেই বিরক্ত। পাতের শাকটাকে আঙুল দিয়ে নেড়ে সুরহাব আবারও বললো,
-মৈজুদ্দিনরে কইছিলাম গজার মাছ দিয়া যাইতে। দেয় নাই?
-দিসে, সইন্ধার আগে শইলডা খারাপ আছিলো, কাইল রান্ধুম নে
টিনের থালিতে রাখা হাতটা কাঁপতে কাঁপতে স্বামী উচ্চস্বরে বলতে থাকে
-বাঞ্জা মাগী ভাত খাওনের কুন্দি। ভালা বুড়া দুইডা জিনিস রানলে নবাবজাদীর হাত ক্ষয় অয়? মির্জা বাড়ির জাত যায়?
অভিযোগটা সম্পুর্ণ ভুল। গাছ থেকে সাজনা পাতা রান্না করেছে। গতকাল মাচা থেকে নামিয়ে একটা লাউ রান্না করেছে।
সখিনার বাড়িতে রাঁধতে হতো না। আর এই বাড়িতে ঢুকেই কালিমাখা ফুকনী দিয়ে তুষের চুলা জ্বালতে হয়েছে। গালে বিয়ের সাজ যখন মুছে যায়নি, চোখ জ্বলে গেছে ধুয়াতে।
সুরহাবদের জন্মের সময় কি মুখে মধু দেয়ার রেওয়াজ ছিল না? না হলে এমন শক্ত করে কথা বলে কী করে? সখিনাও খুব শক্ত মেয়ে ছিল। বিয়ের আগে তার জেদী স্বভাবের জন্য সবাই তাকে সমীহ করতো।
সখিনার এখন আর সেই সখিনা নেই। শুধু মাঝে মাঝে ভাবে এই সংসারে থেকে সে পেলো টা কি? সে কেন সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যায় না। সুরহাবের মুখের উপর তর্ক করে আজ সে বলবে, আমারে কন পুরুষ মানুষ কয়ডা কাম করে? দোকানে গিয়া কী করেন? বিড়ি টানেন, মৌজ মারেন, চা খান, খবরের কাগজে সিনেমার গপ্প দেখেন। একবার ভাবছেন কী শইল লইয়া ঘর সামলায় আপনের বউডা? কোন বান্দী কইতর খাওয়ায়, হাস মুরগীর নজরদারী করে, উঠান লেপে, গোবরের মুঠ্যারা বানায়? ভাতের চাউল গুলা সিদ্ধ করে? উঠানে ধান লাড়ে?
পুরুষেরা বউয়ের তর্ক পছন্দ করে না। দুর্বলদের অস্ত্র তালাক। দিলে দেক বাইন তালাক। এই সংসারে থুতু দিলেও সখিনার আর কষ্ট নাই।
কিন্তু সে কোন এক অজানা শঙ্কা সখিনার মুখ বন্ধ করে দেয় । ভীষণ ভয়। অনুতাপ। কিছুদিন আগে মারা যাওয়া বৃদ্ধা শাশুড়ীর মুখ ভেসে আসে চোখের সামনে। মুখ শুকিয়ে যায়। একটা হত্যার ছবি ভাসে। মাঝে মাঝে সে স্বপ্নে দেখে অন্ধকারে লোহার বড় হাতকড়া চকচক করছে।
২
পেটে ভাত পরার পর সবারই রাগ কমে। সুরহাব আদতে ভাল মানুষ। হয়তো খিদেতে মাথা বিগড়ে গিয়েছিল। মুরগীর কষানো ঝোলে পেঁয়াজটা কচলে একটু সোহাগী সুরে বলে, "বিয়া তো হৈছে দুই বছর আর কতদিন পটের বিবি সাইজ্যা থাকবি।, শুনি? গেরামের মানুষতো কত কথা কয়। পুলাপান নাই। বেবাকে আমারে কয় লেঞ্জাকাটা সুরহাব।
সখিনা এসব শুনে অভ্যস্ত। এর চেয়ে খারাপ কথা সে শোনে। পিত্তি জ্বলে যায়। চোখে পানি আসে। কলিজা এখন এঁটেল মাটির মতো শক্ত হয়ে গেছে। মাথা ব্যথা করে, রাগ পড়ে আসে। কুপির আলোয় সুরহাবের দৈত্যাকার ছায়াকে কাঁপতে দেখে। তারপর বলে
-আপনে বুঝেন না, আমার শইলডা খারাপ
মাথা নিচু করে পেঁয়াজে শব্দ করে কামড় দিতে দিতে উত্তর দেয় সুরহাব,
-হ, তোর হইছেডা কি? মন ধরে শইল খারাপের মেশিন অইছস! যেদিন জিগাই খালি মাথার বেদনা, চোখ্যের বিষ, কমরে কামড়ায়। হুজুরের পড়া পানি খাইসস?
-খাইছি
-তয় অসুখ সারেনা ক্যা? হুজুর কইছে এই সব গজবের ফসল। বউয়ের নিয়ত খারাপ। গোপন পাপ পেটে চাক্বা বানছে। শুন, তাহাজ্জুজের নমাজ পইরা এই অষুধ খাবি।
বাটির মসুরির ডালটা ক্ষেত সেচার মতো করে পুরোটা নিজের পাতে ঢেলে দেয় সুরহাব। মরিচে দাঁতালো কামড় বসায়। সখিনা জন্য আর ডাল অবশিষ্ট থাকে না। সখিনারও খাওয়ার রুচি নেই। তার গোপন পাপের জন্য সে নামাজ পড়বে। মাফ চাবে। যদিও সে শুনেছে নামাজ পড়লেও খুনীর কোন মাফ নাই।
৩
পাশের কামরাটা ঘুট ঘুটে অন্ধকার। প্রজাপতি ম্যাচের কাঠিটা দপ করে জ্বালতে চোখে পড়ে লাল সুতায় সেলাই করা বাণী -
যেই নারী গড়িয়াছে সুখের ঘর,
সেই নারীই করিল ভাইয়েরে পর
শুরমা বিবির নিজের হাতে কাজ। তার সুতার কাজ ভাল। শক্ত সমর্থ মহিলা ছিলেন। বিয়ের পর হাতপাখা বানাতেন, কাঁথা সিলাই করতেন। সেই সুরহাবের মা আজ কবরে। ছোট কামরায় শুরমা বিবি আগলে রাখতেন একটা কালো ট্রাঙ্ক। পিতলের বাটা ভর্তি পান, সুপারী আর ঝুলানো শিকাতে তসবী, নরুণ সহ নানান টুকিটাকি জিনিস। তার কিছু সখের জিনিসও ছিল। স্বামীর স্মৃতিও। সেগুলো এই ট্রাঙ্কে থাকতো সব সময়।
ছেলের বিয়ের পর ঘরের সিন্দুকটা ছেড়ে দিয়েছে শুরমা। বাড়ির পুরনো খাটেই ঘুমায়। সুরহাবের ঘরের বড় পালঙ্কটা যৌতুক হিসেবে প্রাপ্ত । যৌতুক আরো পাওয়ার কথা ছিল। মির্জা বাড়ি কিপ্টার গোষ্ঠী। যা যা দেয়ার কথা সব দেয় নাই। মির্জার সেই দিনও নাই। একমাত্র ছেলে যাত্রা জুয়ায় পয়সা উড়ায়ে বাপকে শেষ করেছে। আর তার মেয়ে যে কয়টা মির্জা নিজেও জানেনা। সখিনার বিয়ে দিয়ে যেন বাঁচার বাঁচা বাঁচছে। খোঁজ খবর নেয় না বললেই চলে।
শুরমা বিবির চলে যাওয়ার পর বাড়িটা চুপ চাপই পড়ে থাকে। সুরহাবের ঘরের এক কোণায় পুর্বপুরুষের আলমারী আর দেয়ালে ঝুলানো টিনের আয়না। ঘরটাতে সব সময়ই একটা আঁষটে গন্ধ থাকে। কারণ, লাগালাগি গোলা ঘরের নিচে ছাগল বেঁধে রাখা হয়। সখিনা এই সব সাংসারিক বিষয়ে একসময় কিছুই জানতো না।
শুরমা বিবির যৌতুকের আক্ষেপটা দীর্ঘদিনের। বিয়ের বিষয়ে সুরহাবের দিওয়ানা ভাবের কারণে যৌতুকের মুলামুলি ভাল হয় নাই।
সখিনা মির্জা বাড়ির সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। গাওগেরামে চেহারা ফর্সা হলেই সুন্দরী বলে কিন্তু তার চুল ছিল ঘন আর লম্বা, চোখগুলো ডাগর। হাটে ছোকরারা গল্প করতো মেয়েটার রূপ নিয়ে। ১২ বছর থেকে তাকে বিয়ের জন্য পয়গাম নিয়ে এসেছে কতজন। সখিনার বাবার অবস্থা তখনও ভাল ছিল। সে বলে দিয়েছিল বড় তিন মেয়ে রেখে ছোট মেয়ের বিয়ে দেবে না। বড় মেয়ের চেহারাছবি ভাল কিন্তু চাপা রং।
কলিমঘটকের কথাতেই শেষে বিয়েটা হয়। সে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে বলেছিল, "মির্জা সাব, এই প্রস্তাব পায়ে ঠেললে পস্তাইবেন। পাত্রের জমি জমা আছে, মাইকের দোকান আছে, পুকুর ভরা মাছ আর ওয়ারিশে একটা মাত্র বইন। পোলাডার মাও অসুখ্যা, বিছানায় পরা, বেশী দিন দম নাই"
(চলবে... )
---------------------------
ড্রাফট ১.০/
পাঠের সুবিধার্থে ৩ পর্বে প্রকাশিত হবে
বানান ও বিন্যাসের ত্রুটি সহ প্রকাশিত
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১০ রাত ১১:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



