চকবাজারের এদিকটায় এলে, আমি বরাবরই সাদা পান্জাবী পায়জামাই পরি। পুরানো ঢাকার মহাজনরা এখনো সাদা প্রীতি ছাড়তে পারেনি। চালের আড়তদাররাতো অবশ্যই পরবেন।
গত তিন চারদিন ধরে লক্ষ্য রাখছিলাম এই আড়তটা। ছোটখাট গড়নের পৌঢ় মহাজন, জোহরের ঠিক আগে আগে নামাজে যায়, ছোট ছেলেকে ক্যাশে বসিয়ে। ফিরে এসেই ব্যাংকে টাকা পাঠিয়ে দেয় ম্যানেজারকে দিয়ে। মাঝখানে কাটে প্রায় আধা ঘন্টা!
অনেকখানি সময়!
আজকেও সেটাই হলো; আজানের পর পর মহাজন বের হয়ে আসলো।
হায় হায়! ব্যাটা দেখি আজকে সাদা লুঙ্গি পরেছে।
যাকগে, এখন আর কাপড় বদলের সময়-সুযোগ নেই। লোকটা মসজিদের গলির মুখে- আড়ালে চলে যেতেই, আমি বদলে গেলাম। কানা গলির কোনাটা নির্জন; তাই কারো চোখে পড়ার সম্ভাবনাটাও ছিল ক্ষীণ। কিন্তু সাবধানের মার নেই। কিছুটা ছায়ায় ছায়ায় থেকে, বেরিয়ে আসলাম চারদিক দেখেই।
ছেলেটা বাপকে এতো তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে বেশ উদ্বিগ্ম সূরেই জানতে চাইলো-
"ফিরা আইলেন যে?!"
কিছুটা বিকৃত মুখ করে একটু কাশতে কাশতে জবাব দিলাম;
"ট্যাকা লওন লাগবো কিছু।"
সে ক্যাশ ছেড়ে সরে দাড়ালো। আমি ক্যাশে আলগোছে যা পেলাম রুমালে প্যাঁচিয়ে নিলাম। ভাবনার সময় কম। দ্রুত সটকে পড়তে হবে।
কালক্ষেপণ না করে বেড়িয়ে পরার সময়, চোখের কোনায় লক্ষ্য করলাম ছেলেটা আমার পাজামার দিকে তাকিয়ে কি যেন জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও থমকে গেলো।
এক নিশ্বাসে গলির মোড়টা পেরুতেই অপর পাশ থেকে দ্রুত ছুটে আসা লোকটার সাথে মুখোমুখি ধাক্কা লেগেই গেলো।
" আবে হালায় আন্ধা নি!! চোক্খে দেহেন না...." ব্যাথা পেয়ে গর্জে উঠে লোকটা।
কিন্তু কথা শেষ করতে পারলো না, তার আগেই আমার দিকে তাকিয়ে তার চোয়াল ঝুলে পড়লো বিস্ময়ে !
আর ঝুলবেই বা না কেন বলেন? কটা মানুষ ভর দুপুরে, পূর্ণ জাগ্রত অবস্থায় নিজের মুখোমুখি হয়? মহাজন যখন চোখ কচলে আবার আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকানোর চেষ্টা করছিলো, আমি ততোক্ষণে মাটি থেকে উঠে জামা কাপড় ঝেড়ে ঝুড়ে পগাড় পার। খুব বাঁচা বেঁচে গেছি। ধরা খেলে হাড্ডি একটাও আস্ত থাকতো না।
ধ্যাৎ, শালার জীবন। আর ভালো লাগে না এভাবে ধাওয়া খেয়ে বেড়ানো।
আপনারা মনে হয় একটু বিভ্রান্তিতে আছেন? বুঝতে পারেন নি পুরো ব্যাপারটা? আচ্ছা খোলাসা করেই বলছি।
আমি গিট্টু বহুরূপী।
গিট্টু মানে তো জানেনই? নাকি?
আমার হাইট ঠিক বামনাকার নয় তবে, ব্যাটাছেলের উচ্চতা ৫ ফিটও যদি না ছোঁয়; তাহলে কি আর লোকে ছেড়ে কথা বলে? আমার নামের সাথেও তাই গিট্টু শব্দটা জুড়ে গিয়েছিল, আর পরে পাকাপাকি ভাবে বাপ দাদার দেয়া নাম বাদ পড়ে গিয়ে গিট্টুটাই পার্মানেন্ট হয়ে গেলো!
ছোটবেলা থেকেই আমি সার্কাসে বহুরূপীর কাজ করতাম। মেকাপ নিয়ে, নকল দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে ভোল পাল্টে, দিব্যি হয়ে যেতে পারতাম অন্য কেউ! তবে সেবার যখন বিশ্রী টাইফয়েডটা জেঁকে বসলো; দিন পনের পরে সার্কাসের সবাই আমাকে গন্জের এক নটির জিম্মায় ফেলে রেখে চলে গেলো অন্য শহরে। সেরে উঠে টের পেলাম, আমার ভেতরে নতুন একটা ক্ষমতা জন্ম নিয়েছে!
আমি এখন চাইলেই বদলে ফেলতে পারি চেহারা। কোনরকম মেকাপ ছাড়াই আমার নাক মুখ চোখ পাল্টে নিয়ে যে কারো রূপ হুবহু নিতে পারি।
ভাবছেন আমাকে আর পায় কে, তাই না?
নাহ, ভাগ্যের কিছুই বদলাতে পারলাম না। আমার উচ্চতার কথা ভুলে যান নি নিশ্চই? পাত্তিওয়ালা কয়টা লোক গিট্টু সাইজের, বলতে পারেন? ভোল পাল্টে ব্যাংক, দোকানে ঢু মেরে টাকা বাগানো তো দূরে থাক, হোটেলে গিয়ে দুবেলা মুফতে খাওয়ার সুযোগটাও নিয়মিত পেতাম না।
হায়রে শালার গিট্টু কপাল! তাই দেখেশুনে টুকটাক এদিক সেদিক করে, কোনমতে চলছিলো জীবনটা।
চকবাজারের আড়তের পয়সায় দিন কতক ভালোই গেলো।
তারপর আবারও সেই ঘুরাঘুরি নতুন শিকারের সন্ধানে।
সেদিন রেকি করছিলাম গুলশানের ডিসিসি মার্কেটের হীরার দোকানের আশে পাশে। একটা মক্কেলকে টার্গেট করেছি গত দুই সপ্তাহ ধরে। সে হীরার দুই নম্বুরি কারবার করে। সপ্তাহের একদিন সব দোকান থেকে পাওনা টাকা তুলে নেয়। আমিও মওকার অপেক্ষায় আছি। মোটা দাও মারার সুযোগ আছে। পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে ধুঁয়া ছাড়ছিলাম আর লোকটার সব চালচলন মনে মনে গেঁথে নেয়ার চেষ্টা চলছিল।
মক্কেল দেনা পাওনা মিটিয়ে তার গাড়িতে উঠে পড়তেই আমিও ঘুরে দাড়ালাম ডেরায় ফেরার জন্যে।
ঘুরতেই লোকটার সাথে প্রায় ধাক্কা খাবার উপক্রম হলো। তাল সামলিয়ে খিস্তি করতে যাবো; চোখের সামনে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনটা ঝুলতে দেখে থমকে গেলাম।
আমার ছবি!! চকবাজারের সেই আড়তদারের ক্যাশ বাক্সের সামনে!
ছবি বদলে গেল নিমেষেই; এবার আড়তদারের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা খাবার মুহুর্তের ছবি। তারপর চেহারা বদলে ফেলার ছবি।
ছবি বেশ দ্রুত পালটে যাচ্ছিল; কিন্তু আমি আতংকের জন্য আর বুঝতে পারছিলাম না কিছু।
চোখ তুলে লোকটার চেহারার দিকে তাকালাম। দীর্ঘদেহী, মিশমিশে কালো, পাথর চেহারার এক লোক!
কে এই লোক?!
একে তো জীবনে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়লো না!
কোন প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম না। আমাকে ইঁদুরের মতো ঘাড় ধরে টেনে তুলে প্রায় ছুঁড়ে নিয়ে ফেললো একটা কালো কাঁচ লাগানো মাইক্রোবাসের ভেতরে, টু শব্দটি করার সুযোগ পেলাম না।
ভাগ্যিস তখন হাউকাউ করিনি; করলে হয়তো আজকে আপনাদেরকে আয়েস করে শুয়ে বসে এই গল্প কখনোই করা হতো না। বদরুল ভাই, অর্থাৎ মুর্তিমান আতংক চেহারার সেই লোকটা খুব অল্প কথায় সব খুলে বল্লো।
সে, আমাকে অনেক দিন ধরেই ফলো করছে; আমার নাড়ী নক্ষত্র সব তার জানা। সে আমার জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, যেটা আমার ভাগ্য খুলে দেবে। আপনাদের মধ্যে যারা, আমার মতো ভাগ্যের তালা খোলার চেষ্টা করছেন; তারা নিশ্চই বুঝতে পারছেন, এ কথাটা কতোটা উৎসাহ বয়ে আনতে পারে একজন হতভাগার জীবনে! আমি আরেকটু স্বস্তি নিয়ে নড়েচড়ে বসলাম।
আমাকে একজনের জায়গা নিতে হবে, কিছুদিনের জন্য। বিনিময়ে বাকী জীবন আমাকে আর কিছু করে খেতে হবে না; সব দায় দায়িত্ব তাদের। প্রথমটায় আজগুবি গুল মনে হলেও সেই একজনের ছবি দেখে নিমেষেই বুঝে গেলাম মোটেও চাপা মারছে না লোকটা! কোন রকম দ্বিধা ছাড়াই রাজী হয়ে গেলাম।
কার নির্দেশে সে এসব করছে, আমার এ প্রশ্নটা অবশ্য সে, না শোনার ভান করেই এড়িয়ে গেল। তবে যা আঁচ করলাম, একদম সর্বোচ্চ রাঘব বোয়াল ছাড়া আর কারো পক্ষে এমনটা ভাবা সম্ভব নয়!
পরের ঘটনাগুলির দীর্ঘ বর্ণনা দিয়ে আপনাদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটাবো না আর। সংক্ষেপেই বলি।
আমি এখন খুব ভালো আছি।
বদরুল ভাই এর কথা মতো সেই লোকের চেহারা নিয়ে দিব্যি দুবেলা অফিস করে যাচ্ছি। ভাবছেন, আমার মতো বকলম কী করে অফিস করছে, কিংবা এমন ধোকা চালিয়ে যাচ্ছে?!
আচ্ছা তাহলে খুলেই বলি।
একটু ভেবে দেখুন তো, ওয়ান ইলেভেনে ক্ষমতায় আসার পর পর দেশ প্রধান কতটুকু তেজী ছিলেন?
একে মারেন, তো ওকে ধরেন। চারদিকে জিহাদ জিহাদ রব! দেশ থেকে দূর্নীতি-ফিতি রাতারাতি উঠে যায় যায় অবস্থা!
মনে পড়ছে?
আর তার মাস তিনেক পরেই হঠাৎ কেমন যেন মিইয়ে গেলেন ?
সব আবার আগের মতো! যেইকার সেই! তাই না?
এখনো বুঝতে পারেনি নি?!!
দুর, দূর!!
আরে আমি গিট্টু মিয়াই তো এখন দেশপ্রধানের সীটে বসা!
আসল লোককে তো কবেই বদরুল ভাই এর দলবল খাল্লাস করে দিয়েছে!!
ও হ্যাঁ, আরো একটা কথা বলে রাখা ভালো; সাবধানের মার নেই।
নেতাদের মতিগতি তো বোঝা ভার। তাই সময় সুযোগ তৈরী হতেই আর দেরী করিনি।
গতকাল সেভেন মার্ডারের অভিযোগে কানা বদরুল নামের যে সন্ত্রাসীর ফাঁসি হল, তার মার্সি পিটিশন নাকচ হয়েছে আমার হাত দিয়েই।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১০ রাত ১২:৩৭