somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের গ্রাম

১৭ ই এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের গ্রামটি অনেক সুন্দর।
‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ আমার জন্মভূমিকে মায়ের মতো মনে হয়। দূর বিভূঁইয়ে আমার মাকে খুব মনে পড়ে, আমার গ্রামকে খুব মনে পড়ে। শৈশবের বন্ধু, অকৃত্রিম বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা মনে পড়ে।

আমাদের গ্রামের উত্তরে কেলাগাইছ্যা আর সিন্দুরকোটা চক। এই দুই চকের মাঝখান দিয়ে পশ্চিম থেকে পুবদিকে বয়ে গেছে দোহারের খাল, এরপর মিশে গেছে আড়িয়াল বিলে। সিন্দুরকোটা চকের উত্তরে বানাঘাটা ও নিকড়া গ্রাম। আমাদের গ্রামের পূর্বদিকে বিরাণ গাংকুলা চক, তারও পুবে গেলে আমার কৈশোরের ধাত্রীমাতা আড়িয়াল বিল। কখনো উছা, কখনো পোলো, কখনো ঠেলাজাল, কখনো টানাজাল, আবার ঝাঁকিজাল দিয়ে মাছ ধরেছি। বর্ষায় নাও ভরে গরুর জন্য কস্তুরি (কচুরিপানা) এনেছি। বোরো মৌসুমে ঘাস কেটেছি। ধাপারি খালের মুখে আমাদের বোরো জমি ছিল- ছোটোবেলায় বাবার সাথে সেই ক্ষেতে গেছি। দোহারের খাল আর ধাপারি খাল যেখানে আড়িয়াল বিলে পড়েছে, সেখানে আশ্বিন-কার্তিকে প্রচুর মাছ গাবাতো। সারাদিন সূর্যের তীব্রতাপে পিঠ পুড়িয়ে কতো মাছ ধরেছি, তার ইয়ত্তা নেই।

হ্যাঁ, ধাপারি খাল। ধাপারি খাল আমাদের গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে গেছে। ধাপারি খাল আর দোহারের খাল- দুটোরই উৎসমুখ পদ্মা নদী। আমাদের দক্ষিণে ঘাড়মোড়া ও মুন্সিকান্দা গ্রাম। পশ্চিমে পশ্চিম মুড়া চক, চকের পশ্চিমে সুতারপাড়া, গাজীর টেক ও কাজীর চর। উত্তর-পশ্চিমে সুবিস্তৃত লাঙ্গলভাঙ্গা চকের পর দোহার। আরো দুটি চকের নাম হলো নাওঘাটা ও বোয়ালিয়া। সিন্দুরকোটা থেকে পুবদিকে যেতে প্রথমে নাওঘাটা। আড়িয়াল বিলের পশ্চিমে বোয়ালিয়া চক।

আমাদের গ্রামের মাঝখানে একটা মাঠ আছে। গল্প শুনেছি, আগে এটা মাঠ ছিল না, কুম ছিল।

‘কুম’ একটা আঞ্চলিক শব্দ যার মানে হলো বিশাল ডোবা, গর্ত, যাতে সারা মাস পানি থাকে। গ্রীষ্মে সব খাল আর পুকুর-ডোবা শুকিয়ে গেলেও আমাদের গ্রামের কুমটিতে সারা মাস ধরে পানি থাকতো। আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ আসতো এই কুমে গোসল করতে। ‘ডাইয়া’ শব্দটার অর্থ হলো শক্ত-সামর্থ, বলিষ্ঠ, আবার আরেক অর্থে পিঁপড়াও। আমাদের গ্রামের মানুষগুলো খুব শক্ত, বলিষ্ঠ, তরতাজা, সাহসী। ওরা এতই একতাবদ্ধ যে ও-গাঁয়ের কারো গতরে ভিন গ্রামের কেউ একটা টোকা দিলে ওরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে একত্রে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদেরকে ঘায়েল করতো। এজন্য ওদেরকে আশেপাশের গ্রামের মানুষ খুব সমীহ করতো, বলতো- ‘তোরা হইলি ডাইয়া’। সেই থেকে গ্রামটার নাম হয়ে গেল ‘ডাইয়ারকুম’।

আমাদের গ্রামের স্কুলটির নাম মারুয়াপোতা প্রাইমারি স্কুল। আমি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি, তখন এটি একটা চৌচালা টিনের ঘরের মতো ছিল, যার সামনে আর পেছনে ভাঙা দুটি বেড়া ছিল, বাকি অংশ ছিল ফাঁকা। মাঝখানে কিছু বেঞ্চি ছিল, শিক্ষকদের জন্য দুটি টেবিল ও দুটি চেয়ার ছিল। পঞ্চম শ্রেণিতে আমি, জসিম, নূরু ও সাইফুল- এ ৪জন। চতুর্থ শ্রেণিতে সম্ভবত ৭জন এবং তৃতীয় শ্রেণিতে ১০-১২ জন ছাত্রছাত্রী ছিল (স্মৃতি হাতড়ে লিখছি)। নিচের ক্লাসগুলোতে ২৫-৩০ জনের বেশি ছিল না। সারা গাঁয়ে শিক্ষার অবস্থা এমনই ছিল। ঝনকীর শরাফ উদ্দিন স্যার আমাদের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, আর গাজীরটেকের সিরাজুল হক স্যার ছিলেন সহকারী শিক্ষক। শিক্ষকদের চেয়ে বড় কেউ নেই, তাঁদের চেয়ে মহান, কিংবা ক্ষমতাবানও কেউ নেই, ছোটোবেলায় আমার এমন ধারণা ছিল। স্যারেরা আমাদের খুব আদর করতেন। শরাফ উদ্দিন স্যার কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। স্যারের কথা মনে পড়লে চোখ ফেটে কান্না আসে। আল্লাহ যেন তাঁকে বেহেশ্ত নসীব করেন- এই দোয়া করি।

আমাদের গ্রামের ক্লাবটির নাম ‘সবুজ অঙ্গন’। শৈশবে এ নামটির অর্থ বুঝতাম না। এ ক্লাবের পক্ষে আমরা একটা সাহিত্যপত্রিকা বের করছি ২০০২ সাল থেকে; ক্লাবের নামানুসারে পত্রিকার নামকরণ করা হয়েছে ‘সবুজ অঙ্গন’। এটি কোনো বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকা নয়; তবে ‘সবুজ অঙ্গন’ নামের পত্রিকা, পত্রিকার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং এর ভিতরকার লেখালেখি পড়ে অনেকেই প্রশংসা করে জানিয়েছেন যে, একটা সাহিত্যপত্রিকার এতো সুন্দর নাম খুব কমই হয় (‘সবুজ অঙ্গন’ নবীনদের পত্রিকা)। আমি ‘সবুজ অঙ্গন’ পত্রিকার লেখক ও পাঠকদের কাছে কৃতজ্ঞ। আরো কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছি আমাদের গ্রামের অগ্রজগণকে, যাঁরা আমাদের ক্লাবের এতো চমৎকার একটা নাম রেখেছিলেন।

আমাদের মাঠে ফুটবল, হাডুডু, দাঁড়িয়াবাঁধা, ভলিবল ও ব্যাডমিন্টন খেলাই সবচেয়ে বেশি হতো আমাদের সময়ে। নূরুল ইসলাম বাবুল, আনোয়ার ও আজাহার মামা আমাদের গ্রামের সেরা ফুটবলার। সূতারপাড়া থেকে রাজাভাই, বায়েজীদ, জাহিদ, ফরহাদ আর রতন ভাই খুব ভালো ফুটবল খেলতেন। আশপাশের কয়েকটা গ্রামের মধ্যে আর কোনো মাঠ না থাকায় আমাদের মাঠেই সবাইকে খেলতে হতো। হাডুডু খেলায় দুর্দান্ত ছিলেন তৈয়বুর চাচা ও আজাহার মামা। ঘাড়মোড়ার খোকা ভাই, বাশার ভাই, খায়ের আর ওর ছোটোভাই- এক বাড়ির ৪ ভাই ছিল হাডুডুতে অপ্রতিরোধ্য। রাজাভাইও হাডুডুতে দুর্দান্ত ছিলেন। আমাদের গ্রামে এখন হাডুডু আর দাঁড়িয়াবাঁধা খেলা কেউ খেলে না। ভলিবল আর ক্রিকেট খেলা হয় প্রচুর। ভলিবল খেলায় আমাদের সাফল্য অনেক বেশি। হায়দর বেপারি ভলিবলে অসাধারণ নৈপুণ্য অর্জন করেছে। পুরো দোহার উপজেলায় কেবল ওর দক্ষতায়ই আমাদের গ্রাম ভলিবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল।

আমাদের ছোটোবেলায় ভাদ্রমাসের ১২ তারিখে আড়িয়াল বিলে, আর ১৩ তারিখে মেঘুলায় ধাপারি খালের উৎসে পদ্মানদীতে নৌকা বাইচ হতো। নৌকা বাইচে চানাচুর, মুরলি, আমিত্তি আর রসগোল্লা ছিল সবচেয়ে মজার খাবার। ‘বাইয়ালির নাচ’ (সং বা নর্তকী) আমার খুব ভালো লাগতো। বাইচের নৌকা ‘টাডডুম টাডডুম’ শব্দে ঢোল বাজিয়ে শরীরে এক অভূতপূর্ব উত্তেজনা সৃষ্টি করতো। একঝাঁক বৈঠা টেনে যখন বাইচের নৌকা সামনে দিয়ে শেষপ্রান্তের দিকে ছুটে যেতো, আমার শিশুমন সেই নৌকার সাথে সাথে টিয়েপাখির মতো উড়তো।

আমাদের প্রাইমারি স্কুল নিয়ে আমার অনেক মধুর একটা স্মৃতি আছে। এটা নিয়ে আমি অনেক গর্বও করি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমাদের প্রাইমারি স্কুল থেকে কোনো ছাত্র বৃত্তি পায় নি। আমি এবং জসিম ১৯৭৮ সালে এ স্কুল থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আমার পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছিল। কিন্তু আমাদের স্কুলের কোনো সুনাম ছিল না, খ্যাতি ছিল না। বৃত্তি পাওয়া মুখের কথাও নয়। দুই মাস পার হয়ে যায়। আমি মালিকান্দা হাইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়েছি ততদিনে। বৃত্তির রেজাল্ট কবে বের হয়ে গেছে! আমি ওসব ভুলে গেছি। আমার বাবা অবশ্য মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করেন, আমি বৃত্তি পেলে তো ‘সারা দেশে খবর হয়ে যেতো’ বলে প্রসঙ্গ পালটে ফেলি। কিন্তু বাবা আশা ছাড়েন না। জয়পাড়া গেলে খোঁজখবর করেন। এপ্রিলের একদিন বাবা জয়পাড়া থেকে বাড়ি ফিরে এসে বলেন, ‘বিত্তির রেজাল্ট অহনতুরি বাইর অয় নাই। তুমি আশা ছাইড়ো না।’ ধূর! আমার বিরক্ত লাগে। আমাদের মতো এত নিঃস্ব স্কুল থেকে কি বৃত্তি পাওয়া সম্ভব? আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধবও এ নিয়ে খোঁচা দেয় মাঝে মাঝে।

আমাদের স্কুল থেকে দ্বিতীয় বৃত্তিটি পেয়েছিল আমার ছোটোবোন আসমা। এরপর মাজেদ ভাইয়ের ছোটোভাই বৃত্তি পেয়েছিল, এবং চতুর্থ বৃত্তিটি পেয়েছিল আমার ছোটোভাই কামরুল।

প্রাইমারি বৃত্তি আজকাল আহামরি কিছু না। কিন্তু ঐ সময়ে এটা আমাদের জন্য সোনার হরিণ ছিল। মে মাসের কোনো একদিন যখন আমাদের বাড়িতে খবর এলো- আমি বৃত্তি পেয়েছি, আমার মা আর বাবা আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। আর আমার তিনজন শিক্ষক বাড়িতে ছুটে এসেছিলেন। যেদিন সকালে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য বাবার সাথে জয়পাড়া গিয়েছিলাম, সেদিনই আমার অবুঝ মা একটা মানত করেছিলেন- আমি যদি বৃত্তি পাই আমাকে গলায় মালা পরিয়ে বাদ্যবাজনাসহ সাত গ্রাম ঘুরিয়ে আনা হবে। মায়ের ইচ্ছে আল্লাহ পূরণ করেছেন। আমি বৃত্তি পেয়েছি। এ উপলক্ষে বাড়িতে উৎসবের আয়োজন করা হলো। শিক্ষকসহ আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত করা হলো। দুপুরের দিকে মেঘুলা থেকে ব্যান্ড (বাদক দল) আসলো। ঢোলের তালে তালে সারা বাড়ি আনন্দে নাচতে থাকলো। আমি মনে মনে খুব লজ্জা পাচ্ছিলাম- গলায় মালা পরে বাদকদলের সাথে কীভাবে আমি সাতগ্রাম ঘুরবো! যদি আমাকে না যেতে হতো! যদি না যেতে হতো- কত ভালো হতো! কিন্তু আমার শেষরক্ষা হয় নি। আমি জেদ করে দাঁড়িয়েছিলাম- যাবো না। অবশেষে মায়ের মানত পালন করতে বাদকদলের সাথে ঘুরতে হয়েছিল। তবে গলা থেকে মালা খুলে হাতে পেচিয়ে রাখি, সাতগ্রামের বদলে কেবল একগ্রাম ঘুরি, আর বাদকদলের সাথে এমনভাবে হাঁটতে থাকি যে, এ আয়োজন আমার জন্য নয়, আমি আর কাউকে সঙ্গ দিচ্ছি। এটা বোঝানোর জন্য একসময় আমার হাতের মালা আমার সমবয়সী মামার গলায় পরিয়ে দিই। আমার বৃত্তি পাওয়া উপলক্ষে শিক্ষকদের অভিনন্দন আর আবেগঘন স্নেহাশীষ আমাকে আজও উদ্বেলিত করে, এবং সামনে যেতে নিরন্তর উদ্বুদ্ধ করে।

আমাদের মারুয়াপোতা স্কুলের চিত্র এখন আমূল পালটে গেছে। ছোটো তিনটি বিল্ডিং আছে। এ বছর সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে, সামনে বছর অষ্টম শ্রেণি। এরপর এটাকে এসএসসি লেভেল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি আমরা। এ স্কুল থেকে বৃত্তি পাওয়া এখন খুব সাধারণ ঘটনা- বৃত্তি না পাওয়াটাই একটা খবর হয়ে ওঠে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুস সামাদ খুব আন্তরিক। ৫-৬জন শিক্ষক রয়েছেন। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রচুর। এ স্কুল আমাদের গর্ব।



আমাদের গ্রামে একটা বাজার আছে। বাজারটি গ্রামের দক্ষিণে ধাপারি খালের উত্তর পাড়ে। এ বাজারের নাম আমিন বাজার। সামাদ মাদবর এ বাজার প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। বাজারটি অবশ্য এখন বেশ বিস্তৃত হয়েছে- ঘাড়মোড়া গ্রামের একটা অংশ পর্যন্ত।

ডাইয়ারকুম গ্রামে জসিম আর নূরু আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ও ক্লাসমেট ছিল। কিছুদিন পর যুক্ত হয় আবুল। ফজলু আমার চেয়ে বয়সে বড় হলেও এক ক্লাস নিচে ছিল। এ্যাথলেটিকসে ফজলু ছিল দুর্দান্ত। মুন্সিকান্দার খবিরুদ্দিন, ঘাড়মোড়ার স্বপন আর খায়ের আমার হাইস্কুলের ক্লাসমেট। সুতারপাড়ায় ছিল বায়েজিদ, জাহিদ, শেরখান, মাসুদ, আজাদ মোল্লা, আজাদ, জাহাঙ্গীর, ফারুক১, ফারুক২, জামাল, রাজ্জাক, পনির, শাহজাহান ১, ২, ৩, আরও অনেকে। দোহারে আমজাদ, শ্যামল, কামাল। মেয়েদের মধ্যে নার্গিস (ঘাড়মোড়া), নাজনীন, প্রমীলা, ঝিনুক, (আর নাম মনে পড়ছে না)।

আমাদের পাশের গ্রাম সুতারপাড়ায় এক মরমী কবির জন্ম হয়েছিল। তাঁর নাম মিজানুর রহমান শমশেরী। আমরা ছোটোবেলায় তাঁকে মালেক ভাই বলে ডাকতাম। কবি মিজানুর রহমান শমশেরী ৮ই কার্তিক ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে (১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে) জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৯ আষাঢ় ১৩৮৮ বঙ্গাব্দে (১৪ জুলাই ১৯৮১) বিয়ের পূর্বরাতে হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে অকালে প্রয়াত হোন । তবে এ-ও জনশ্রুতি আছে যে, আরাধ্য মানবীকে না পেয়ে বিয়ের আগের রাতে তিনি আত্মহত্যা করেন। তাঁর পিতার নাম শমশের উদ্দিন। সর্বজ্যেষ্ঠা এক বোন ও পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শমশেরী ছিলেন পঞ্চম।

একান্ত কৈশোর থেকেই লেখালেখির প্রতি শমশেরীর আগ্রহ গড়ে উঠেছিল। সাহিত্যসাধনা ও সাহিত্যচর্চা ছিল তাঁর প্রাণ। স্কুল-কলেজের বন্ধু-বান্ধবী ও এলাকার তরুণ-কিশোরদের নিয়ে গড়ে তোলেন সাহিত্যচর্চা বিষয়ক আসর ‘পদ্মাপার খেলাঘর’। এর পূর্বে আদমদজী নগরের ‘অগ্নিকন্যা খেলাঘর’ আসরের সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে তিনি তাঁর খেলাঘর জীবন শুরু করেন।

শমশেরী ৭০ দশকের কবি। ধূমকেতু, দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সমাচার সহ তদানীন্তন গুটিকতক জাতীয় দৈনিকের সবকটাতেই এবং অন্যান্য লিটল ম্যাগাজিন ও সাময়িকীতে তিনি নিয়মিত লিখতেন। দৈনিক বাংলার বাণীতে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে লিখতেন উপ-সম্পাদকীয়।

তাঁর জীবদ্দশায় একটিমাত্র কাহিনীকাব্য ‘অশ্রুমালা’ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির আয়তন সুবিশাল।

তাঁর একটি পাণ্ডুলিপি আমার কাছে রক্ষিত আছে। এই পাণ্ডুলিপিতে যে বইগুলোর নাম উল্লেখ আছে তা হলো : জীবন যন্ত্রণা, বসন্ত পরাগ, একাত্তরের চিঠি, শিকল ভাঙ্গার গান (গান) ও হিজলফুলের মালা (কাহিনীকাব্য)। এখানে রয়েছে সর্বমোট ১৩৭টি কবিতা, ৪০টি ছড়া ও ৫২টি গান।

আমাদের ক্লাসমেট জাহিদ মালেক ভাইয়ের একটা কবিতা অনেক বলতো- ‘তুমি কি আমার কথা ভাবো?’ সারাজীবনে আমার ভালোলাগা কবিতাগুলোর মধ্যে এটি একটি।

আমাদের গ্রামের কথা বলতে গিয়ে অনেক কথাই বলে ফেলেছি। নিজের গ্রাম, নিজের জন্মভূমি একটা আবেগ। হারানো অতীতের কথা যখন মনে পড়ে, সব স্মৃতি দাও দাও করে জ্বলে ওঠে। আবেগ থামিয়ে রাখা খুব দুরূহ। যা কিছু লিখলাম, তা আবেগ ছাড়া আর কী!

শেষ করছি মিজানুর রহমান শমশেরীর কবিতা দিয়ে।


***

তুমি কি আমার কথা ভাবো?


তুমি কি আমার কথা ভাবো?
কঠিন প্রাচীরে কান পেতে শুনি
মুক্তির দিন একদিন আসবেই
সেইদিন তোমাকে আবারো কাছে পাবো।

যেখানে সূর্যের সোনালি বিচ্ছুরণ
এখনো হোঁচট খায়
পড়ন্ত বিকেলের বসন্ত যৌবনে
যেখানে ধ্বনিত পাখির কাকলি
প্রাচীরের বাঁধ ভেঙ্গে চলে যাবো
তুমি আর আমি পায় পায়
সেই নির্জনতায়।

রাত্রির নিঃসঙ্গতায় একা জেগে আছি
আমার চোখে নেই ঘুম,
চোখের সামনে প্রাচীরের গায়
স্বপ্নের পাখিগুলো ডানা ঝাঁপটায়
মুক্তির অন্বেষা খুঁজিতেছে পথ
সুপুষ্ট মৌসুম।

এখনো আমার চোখে নেমে আসে
সন্ধ্যার পশ্চিম আকাশ,
পলাশের লাল রঙে রঙিন পদ্মাপার
পারভাঙ্গা তীরে নব কিশলয়ে
পালতোলা নায়ে স্বচ্ছ সলিলে
গোধূলির সুস্পষ্ট প্রকাশ।

এই নির্জনতায় বসে বসে ভাবি
আবারো তোমায় কাছে পাবো
গানে আর কবিতায় কাটাবো প্রহর
মধুরাত এনে দিবে চাঁদের সুষমা
তারার মালিকা গেঁথে কবরী সাজাবো।
তুমি কি আমার কথা ভাবো?
আমার কথা কি ভাবো?
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৩
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×