আমার সব ‘প্রথমে’র রেফারেন্স পয়েন্ট হলো ১৯৭১। তখন বয়স কত ছিল জানার উপায় নেই, কারণ কৃষকের ছেলের জন্মতারিখ লিখিত থাকে না, ধাইমার হাতে সে ভূমিষ্ঠ হয়; মা-চাচি-দাদি-নানিরা ঘোর বৃষ্টির দিনে, তুমুল তুফানের রাতে বাংলা মাসের ‘অমুক তারিখে’ বা ‘অততম’ চাঁদের দিন জন্ম হয়েছিল- এভাবে দিনতারিখ মনে রাখেন। তারপর নবম শ্রেণীতে রেজিস্ট্রেশনের সময় গড়পড়তা একটা জন্মতারিখ, যা চাকরিক্ষেত্রে সুবিধা দিতে পারবে অনুমান করে লেখা হয়ে থাকে, যাতে প্রায়শ প্রকৃত জন্মতারিখ থেকে বিস্তর ব্যবধান থাকে।
আমি বড্ড নিরীহ প্রাণী সেই ছোটোকাল থেকে- কেবল ঘরের বাইরে; এজন্য কত পিটুনি খেয়েছি পরের হাতে তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু ঘরের ভেতর আমার দুরন্তপনায় সবাই সবসময় ভীষণ অতিষ্ঠ থাকত; বাইরে পরের হাতে মার, ঘরের ভেতর মায়ের পিটুনি খেতে খেতে আমার দফারফা অবস্থা।
সে পর্যন্ত দুবার খেজুর গাছ থেকে পড়ে মরতে মরতে বেঁচে উঠেছি। গাবগাছ থেকেও পড়েছি বেশ কয়েকবার। আর বাড়ির পাশে খালের ধারে একটা দইল্লা গাছ ছিল, উন্নার দিনে ওটাতে রসি দিয়ে পিঁড়ির দোলনা বানাতাম; আর বর্ষাকালে এ গাছটা ছিল আমাদের সবচেয়ে মজার জায়গা- করতাম কী, দল বেঁধে গাছের ডগায় উঠতাম, আর ঝাঁকে ঝাঁকে গাছের ডগা থেকে লাফিয়ে পানিতে পড়তাম। ডুব দিয়ে যে যত বেশি দূরে গিয়ে উঠতে পারতাম, সে তত সেয়ানা। আমি এ কাজটায় বড্ড সেয়ানা হয়ে গিয়েছিলাম। মা মানা করতেন, কিন্তু আমি কি আর মায়ের হাতের পুতুল?
একদিন আমার এমনি এক বিটকেলির শাস্তি স্বরূপ আমাকে বাম হাতে ধরে ডান হাতে পিঠের উপর দমাদম কিল ঝাড়তে ঝাড়তে মা মুখ দিয়ে আগুন বের করতে লাগলেন- তোর মতো পুলা আমি দুনিয়াতে রাহুম না- আমার কইলজ্যা খাইয়া হালাইলি তুই- পুলার পুলা, ক, গাছে গনে আরো লাফ দিবি? আরো লাফ দিবি? আর আমার ছিল কইমাছের প্রাণ বা গণ্ডারের শরীর- মায়ের কিলে আমার কোনো ব্যথা হত না, যদিও পিটুনি খাওয়ার সময় গলা ফাটিয়ে বাবা-বাবা বলে চিল্লানি দিতাম।
একটু বিরতি দিয়ে মা বললেন, তুই জানস তোর মত পুলারা আইজকাল ইস্কুলে যায়? তোর সুরুজ মামু পরশু দিন গনে ইস্কুলে যাইবার লাগছে। কত বদ্র অইয়া গেছে সুরুজ!
সুরুজ মোল্লা আমার একমাত্র মামা, আমার থেকে তিন-চার মাসের বড়। মামা আমাদের বাড়ি আসে, তার সাথে কিছুক্ষণ ত্যাঁদরামি করি, সে ত্যক্ত হয়ে কান্নাকাটি করে বাড়ি চলে যায়। মামাও বেশ গোবেচারা বটে, আমার সামনে। সেই মামা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে শুনে আমার কোনো ভাবান্তর হলো না; কেননা ‘বদ্র’ই বা কী জিনিস, আর স্কুলে যাওয়ার মাহাত্ম্যই বা কী, গাছে গাছে বাস করার চেয়ে তাতে অধিক আনন্দ আছে কিনা সে বিষয়ে কোনো জ্ঞান তো ছিলই না, জানারও কোনো আগ্রহ ছিল না।
মায়ের পিটুনিতে ব্যথা না পেলেও মা-ই ছিলেন সাক্ষাৎ ‘রাক্ষসী’, আর বাবা ছিলেন সকল বিপদের নিরাপদতম আশ্রয়স্থল; যতক্ষণ বাবা বাড়িতে, মা আমার টিকিটিও ছুঁতে পারতেন না, আর আমার থাকতো তখন সাত খুন মাফ।
মা একদিন সন্ধ্যায় বাবাকে মৃদু ক্ষোভের সাথে বলছেন, তোমার বান্দর পুলারে হয় তুমার সাতে ক্ষ্যাতে নিয়া যাইবা, নাইলে ইস্কুলে দিয়া দেও। ওর জ্বালায় আমার জানডা ত্যাজপাতা অইয়া গেল।
বাবা হাসতে হাসতে বলছেন, কও কী, ইস্কুলের বয়স বড় অইছে নি? বয়স অইলে আল্লায় নিলে ইস্কুলেই বর্তি কইরা দিমু। আমার মতন লাঙ্গল টানবো নি বড়ো আমার পুলা!
বয়স অইছে না! মা ঝামটা দিয়ে বলেন, সুরুজ ইস্কুলে যাইবার লাগছে কবে গনে। সুরুজ কত বদ্র অইয়া গেছে দ্যাকছাও না!
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসেন।
এরপরের কিছুদিনের কথা ও ঘটনা আর মনে নেই। মনে পড়ে শুধু কথাগুলো- বাড়িতে প্রস্তুতি চলছে আমাকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য। আজ না কাল, কাল না পরশু- এভাবে। বাবা বাড়িতে থাকলেই স্কুলে নিয়ে যাবেন একদিন, কিন্তু বাবার সেই সময় আর হয়ে ওঠে না।
বাবার সময় হল একদিন সকালে। আমার জন্য একটা বই কেনা হয়েছে- সবুজ সাথী। একটা শ্লেট আর মাটির পেন্সিলও। সেগুলো গত কয়দিন ধরে নাড়াচাড়া করেছি, আর কেবলই বিষণ্ণ হয়েছি- হায়, এ আপদগুলোর জন্যই আমাকে স্কুলে যেতে হবে! আমার পুরোনো হাফপ্যান্ট আর শার্টটা ৫৭০ সাবান দিয়ে ধুয়ে নতুনের মত করা হয়েছে। কিন্তু সকালবেলা থেকেই আমার খুব মন খারাপ- খুব কান্না পাচ্ছে। মায়ের ‘বদ্র’ কথাটার অর্থ আমি না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিলাম যে স্কুলে গেলে আমিও সুরুজ মামার মত ‘বদ্র’ হয়ে যাব- হায়রে, আমার দিনভর গাছগাছালি খেলা- এসব তো আর কিছুই করতে পারব না- আমি তবে কীসের লোভে স্কুলে যাব?
স্কুলে যাবার সময়টাতে পাড়াপড়শিরা ও বাড়ির সবাই জড়ো হলো আমাদের ঘরের সামনে, আর ঠিক তখনই ডুকরে কাঁদতে শুরু করলাম। যতই সময় ঘনিয়ে আসতে লাগলো বাড়ি হতে বের হবার, আমার কান্নার বেগ ততই বাড়তে থাকলো, একসময় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম- আমি ইস্কুলে যামু না। ইস্কুলে যামু না। আর আমার কান্না তখন এতই করুণ হয়ে উঠেছিল যে বাবা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজেও কেঁদে দিয়ে মাকে বললেন, তাইলে আইজক্যা বাদ দেই? কিন্তু মা শাসিয়ে উঠতেই বাবা আমার হাত ধরে বললেন, চলো বাজান- কাইন্দো না- ইস্কুল অনেক বালো জাগা।
আহারে কী কান্নাই না করেছিলাম সেদিন- আমি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছি আর আমাকে বাড়িভর্তি মানুষজন দেখছে- আমি আমার সোনার দিনগুলো ফেলে চলে যাচ্ছি অন্যদিনের দিকে...
স্কুলে আমি ভালো করছিলাম। কয়েক বছরের মধ্যে পাড়াপড়শি ছাড়িয়ে পুরো গ্রামে আমার মেধার কথা ছড়িয়ে পড়লো। লোকে বলতে লাগলো- গোবরে পদ্মফুল।
আমার অজপাড়াগাঁয়ের স্কুলটাতে আমিই প্রথম প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেছিলাম- এই বৃত্তির খবর নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ তিনজন শিক্ষক ও কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি যখন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন- আমার মা হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছিলেন।
আমার মা মারা গেছেন আমি যখন ৭ম শ্রেণীতে পড়ি। প্রাইমারি স্কুল থেকে হাইস্কুলে যেয়েও আমি স্কুলে খুব ভালো করতে থাকি- আমার মা এ খবরে অতি আপ্লুত হয়ে বলতেন- তর মনে আছে, ইস্কুলে যাইবার দিন তুই কত কানছিলি?
ফেলে আসা দিনের অবিস্মৃত অনেক কিছুর মধ্যে স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিনটির কথা এভাবেই আমার ভেতর সতত ঝলমল করে আলো দেয়...
৮ মে ২০০৯