somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তুমি শান্তিতে ঘুমাও গল্পের জাদুকর!

১৯ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম হুমায়ূন আহমেদের বই সম্ভবত পড়েছিলাম ১৯৯৯ সালে,ক্লাস ফোরে থাকতে। বইয়ের নাম এখন আর মনে নেই।ততদিনে লুকিয়ে লুকিয়ে “আউট বই” পড়তে শিখে ফেলেছি। সামনে যা পেতাম তাই গোগ্রাসে গিলতাম,তার সবগুলাই যে ভালো মানের ছিল তা না,তবে পড়ার অভ্যাসটা ছিল। প্রথমদিকে হুমায়ূন আহমেদের বইগুলা পড়ার পর একটা জিনিস অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এই লেখকের একটা বই শুরু করার পরে শেষ না করে উঠা যায় না। আমার কোমল মনে লেখকের প্রতি এক ধরনের ভালোবাসার জন্ম হলো। সেই থেকে শুরু।

এরপর কত রাত জেগে কাটিয়েছি হুমায়ূনের বই পড়ে পড়ে। একবার একটা বই পেলেই হল।খাওয়া-নাওয়া,ঘুম সব বাদ দিয়ে শুধু ওই বই নিয়ে পড়ে থাকা। একবার পড়েও মন ভরতো না,কয়েকবার পড়েই তবে ক্ষান্ত দিতাম। গ্রামে থাকতাম বলে সবসময় বই মিলতো না,অনেক কষ্ট করে সংগ্রহ করে পড়তে হত। কারো কাছে হুমায়ূনের একটা বই আছে খোজ পেলে কয়েক মাইল হেটেও সেটা নিয়ে আসতাম। কারো হাতে একটা হুমায়ূনের বই দেখলে সেটা না দেওয়া পযর্ন্ত শান্তি দিতাম না, জোকের মত পিছু লেগে থাকতাম। পড়তে বসলে একেবারে শেষ করেই তবে উঠতাম। পড়া শেষ করেও মনে হত যেন শেষ হয় নি,মনে হত কি যেন বাকি রয়ে গেছে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসগুলো ছিল এমনই।

তখন বই কিনে পড়ার মতো সাধ্য ছিল না। কারো সংগ্রহেও খুব বেশি বই থাকত না। আর তাই স্কুল লাইফে পড়া হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের সংখ্যা খুব বেশি নয়,সবমিলিয়ে ৫০/৬০টা হবে।

প্রথম হিমু পড়েছিলাম ক্লাস নাইনে থাকতে,বইয়ের নাম “দরজার ওপাশে”। সেই সময় হিমুর পাগলামি আমাকে চরমভাবে অভিভুত করল। নিজেকে তখন হিমু কল্পনা করতাম,অসম্ভব ভালো লাগত। জীবনে অনেক পাগলামি করেছি,তার পেছনে হিমু চরিত্রের প্রভাব প্রচন্ড। হলুদ হিমু কালো র‍্যাব উপন্যাসের একটা জায়গায় হিমু পার্কে ফ্লাস্কে করে চা বেচে,পড়ে আমারো খুব ইচ্ছা হতো যেন আমিও ফ্লাস্কে করে চা বেচি,ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াই। এস.এস.সির পর একমাস বাড়ি থেকে পালিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই এর পেছনে মুল উৎসাহটা পেয়েছিলাম হিমু নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলো থেকে।

তখন এস.এস.সি পরীক্ষা চলছে। আমি খালাতো বোনের বাসায় থেকে পরীক্ষা দিচ্ছি। উনার বাড়িতে আরেক ঘরে পেলাম “আমার আছে জল” উপন্যাসটা। পরীক্ষার আগের রাতে আমি পড়া বাদ দিয়ে বইটা নিয়ে বসলাম। আপা এসে আমাকে বকতে লাগল,কান দিলাম না। বই শেষ না করে কি উঠা যায়? বইটা পড়ে মন খুব খারাপ হল,আর পড়ায় মন বসাতে পারলাম না। ফলাফল পরদিন ম্যাথ পরীক্ষা খারাপ হল। তবুও নিজের কাছে আমার এতটুকু খারাপ লাগেনি,এতোটাই হুমায়ূনের বইয়ের পাগল ছিলাম আমি।

এস.এস.সি পাশ করে যখন সিলেট শহরে পড়তে এলাম তখন হাতের কাছে বই না পাওয়ার যন্ত্রনা ঘুচলো। হুমায়ূনের বেশিরভাগ বই পড়েছি ইন্টার আর ভার্সিটি লাইফে। আহা কত মধুরই না ছিল সেই মুহুর্তগুলো! আমাদের কলেজ লাইব্রেরিতে তখন খুব বেশি বই ছিল না,গল্প উপন্যাস ছিল আরো কম। এর মাঝেই আমি খুজে বের করলাম হুমায়ূন আহমেদের “এইসব দিনরাত্রি” উপন্যাসটি। কিন্তু ঝামেলা বাধলো অন্য জায়গায়। বইটি পড়ার সময় পেতাম খুবই কম। আমাদের মধ্যাহ্ন বিরতি ছিল ৩০ মিনিটের। এই ৩০ মিনিটে আমি যতটুকু পারতাম পড়তাম,পরদিন এসে পরবর্তী অংশ পড়তাম। এইভাবে বই পড়ার কি যে কষ্ট সেটা কি করে বুঝাই। যেখানে আমার এক সিটিং এ শেষ করে ফেলার অভ্যাস সেখানে একটু একটু করে এই বই পুরো ২ সপ্তাহে শেষ করি। প্রতিদিন একটু একটু করে পড়তাম আর সারাদিন ওই অংশটুকুর কাহিনী মাথার মাঝে ঘুরতো। উপন্যাসটি যেদিন শেষ করি সেদিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন,কাহিনিটা আমার হৃদয় ছুয়ে গিয়েছিল। এর প্রতিটি চরিত্রের মাঝে আমি মিশে গিয়েছিলাম।

ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর কম্পিউটার নামক জাদুর বাক্সের সাথে মিতালি হলো। অবাক হয়ে দেখলাম কাগজের মলাটে বাধাই করা বই ছাড়াও বই আছে,পিডিএফ ফরম্যাটে। নেটে হুমায়ূনের পড়া না পড়া প্রায় সব বইয়ের সন্ধান পেলাম। ততোদিনে বই কিনে পড়ার সামর্থ্যও হয়ে গেছে। একের পর এক না পড়া বই তখন গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম,রাতের পর রাত ঘুমহীন কাটতে লাগলো,পাল্লা দিয়ে নিদ্রাহীন মুখে ব্রন আর শালের পরিমান বাড়তে লাগলো। একই সাথে কমতে লাগলো হুমায়ূনের লেখা আমার না পড়া বইয়ের সংখ্যা। তবে এখনো উনার লেখা অনেকগুলো বই পড়া বাকি।
বই পড়া ইদানিং আরো সহজ হয়ে গেছে। চলতে ফিরতে আমার এন্ড্রয়েড মোবাইলেই বই পড়তে পারি। তবে কাগুজে বইয়ের স্বাদ ল্যাপি কিংবা মোবাইলে কখনোই পাই নি। নতুন বইয়ের প্রতিটি পাতায় যে মন মাতানো গন্ধ সেটা তো শুধু কাগুজে বইয়েই পাওয়া যায়,ল্যাপি কিংবা মোবাইলে না। বই পড়তে গিয়ে সেই পরিচিত ঘ্রানই যদি নিতে না পারি তবে বই পড়ে লাভ কি?

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলাম ফেসবুকে,২০শে জুলাই ২০১২ তারিখে সকালে ঘুম থেকে উঠে। তখনো মেনে নিতে পারি নি আমার প্রিয় লেখক আর পৃথিবীতে নেই। অনুভুতিগুলো সব ভোতা হয়ে গিয়েছিল,স্তব্ধ হয়ে থেকেছিলাম সারা দিন। খুব মনে পড়ছিল স্যারের বই নিয়ে কত স্মৃতি! খুব ইচ্ছা ছিলো একদিন দেখা করে অটোগ্রাফ আর পায়ের ধুলা নেব,তা আর হলো না। এই দুঃখ আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।

হুমায়ূন স্যারের মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের কতটুকু ক্ষতি হয়েছে জানিনা,তবে আমার জীবনের একটি অংশ শূন্য হয়ে গেছে। খুব কষ্ট হয় যখন চিন্তা করি স্যার আর কখনোই আমাদের জন্য লিখবেন না। হিমু আর খালি পায়ে রাস্তায় হাটবে না। জানালায় দাড়ানো রুপার প্রতীক্ষা কখনোই শেষ হবে না। মিসির আলী আর কোন নতুন রহস্যের পেছনে ছুটবেন না। শুভ্র তার হারানো চশমা আর খুজে পাবে না। মাজেদা খালা,বাদল,রানু,আনিস,বাকের ভাই,মতি মিয়া,ধানমন্ডি থানার ওসি,আগামসি লেনের কুকুরটা...ওরা সব হারিয়ে গেছে,আর কখনোই ফিরে আসবে না,কোনদিন না।

এখনো আমি জোছনা দেখি,গৃহত্যাগী জোছনায় আমার পৃথিবী হারিয়ে যায়। এখনো আমি বৃষ্টিতে ভিজি,ভেজা সন্ধ্যায় শ্রাবনের প্রথম কদম ফুল নিয়ে একাকী হাটি। শুধু যেই মানুষটি জোছনা,বর্ষা কিংবা কদম ফুল চিনিয়ে গেলেন সেই মানুষটি আর নেই!

আজ সেই মানুষটির তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এই মানুষটি তিন বছর থেকে আমাদের মাঝে নেই,কি অদ্ভুত! এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়!
যেখানেই থাকুন প্রার্থনা করি স্যার আপনি ভালো থাকুন,শান্তিতে থাকুন।

“তুমি শান্তিতে ঘুমাও গল্পের জাদুকর”!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:২১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×