নদীর মধ্যে সুন্দর একটা নৌকা। নৌকায় কোন মাঝি নেই। নৌকায় পুলক আর রীতা বসা। অল্প দুলছে নৌকাটা। সন্ধ্যা হবে হবে করছে। একা মানুষদের কাছে সময়টা খুবই বিষাদের, হাহাকারের। কিন্তু সঙ্গে প্রিয় মানুষ থাকলে অন্য কথা। পুলকের তাই মন খুব তরল। হঠাৎ করে নৌকাটা খুব জোরে জোরে দুলে উঠল। পুলক নৌকা থেকে নদীতে পড়ে গেল। পুলক সাঁতার পারে না। একবার ডুবছে আর ভাসছে। যতবার ভেসে উঠছে ততবার বলছে ‘রীতা আমাকে ধর’ , ‘রীতা আমাকে ধর রীতা’। রীতা চুপচাপ বসে আছে। একটুও নড়ছে না। পুলক ডুবে যাচ্ছে। ডুবে যেতে যেতে পুলক দেখছে রীতার চেহারা ভাবলেশহীন। সে একদৃষ্টিতে পুলকের ডুবে যাওয়া দেখছে। পুলকের খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। পানির নিচ থেকে পুলক রীতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। নৌকার মুখ ঘুরে যাচ্ছে। রীতার চেহারাটা দূরে সরে যাচ্ছে। ডুবে যেতে যেতে সে শেষবারের মত ডাকল, ‘রীতা!!! রীতা!!!’।
ধড়মড় করে বিছানায় লাফিয়ে উঠল পুলক। ফোন বাজছে। প্রিয়াঙ্কার ফোন।
- পুল!!! কখন থেকে তোমাকে কল করছি।
- কে? (পুলকের ঘোর এখনো কাটেনি)
- কে মানে? আমি প্রিয়াঙ্কা। were u sleeping, পুল?
- হুম!!
- Anyways!! আজকে মিট করতে পারছি না। সরি। সান্ডির বাসায় যেতে হবে।
- হুম।
- কি হুম হুম করছ!! ধুর!! রাখলাম। বাই।
- হুম! বাই।
স্বপ্নটা থেকে এখনো বের হতে পারেনি পুলক। বুকটার মধ্যে এখনো চিনচিনে ব্যাথা। এই ব্যাথা এরকম হঠাৎ হঠাৎ হয়। তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। এই এক বছর ধরে সে ব্যাথাটার জন্য অপেক্ষা করে আছে। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মত ব্যাথাটা আসে। কিন্তু থাকে না। চলে যায়। ব্যথা বা কষ্টের জন্য অপেক্ষা করাটা গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়ার মত। বোঝা যায় না ঠিক কী করা উচিৎ! পুলকও এতটা সময় গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী বিশাল শুন্যতা পুলকের অস্তিত্ব জুড়ে। কষ্ট ছাড়া শূন্যতা ভোঁতা যন্ত্রণার মত। এই শূন্যতা কিছুতেই ভরাট হয় না।
সারাদিনে আমাদের জীবনে অগুরুত্বপূর্ণ কত কিছু ঘটে। জ্যামে আটকে আছি। অফিসে ঢুকতে লেইট হয়ে গেছে। বাসের কন্ডাক্টরের সাথে আজকে খুব ঝগড়া হয়েছে। টেম্পোতে পাশে বসা লোকটার গা থেকে বিটকেলে গন্ধ বের হয়েছিল। মা আজকে এই বলেছিল। পুরোনো এক বন্ধুর সাথে হঠাৎ দেখা। ভার্সিটি এর কাছ দিয়ে যেতে মনটা খুব স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছিল। আজকে প্যান্টটা টাইট টাইট লেগেছে। মনে হয় খুব খেয়ে ফেলছি। আমার ওই যে খুব প্রিয় একটা শার্ট ছিল নীল রঙের। ওইটা খুঁজে পাচ্ছি না। এরকম কত কথা আমাদের এই মনে জমে। এই আপাতদৃষ্টিতে অগুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো আমরা আমাদের প্রিয় মানুষকে বলি। সবাইকে এসব কথা বলা যায় না। সবার কাছে এসব কথার গুরুত্বও থাকে না। পছন্দের মানুষ, ভালোবাসার মানুষেরাই এসব গুরুত্বহীন কথার মাঝেও গুরুত্ব খুঁজে পায়। আর মানুষেরা পায় না।
রীতা যখন ছিল তখন পুলক এরকম ৫ মিনিটের জন্য কল করে কথা বলে নিত। গুরুত্বপূর্ণ অগুরুত্বপূর্ণ সব কথা। না বললে যেন ঠিক শান্তি হত না। বেশ কয়েক মাস আগে। পুলকের একটা প্রেজেন্টেশান ছিল অফিসে। এই প্রেজেন্টেশানটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রেজেন্টেশানটা ভালো হলে কিছুদিনের জন্য বসদের নজরদারি থেকে মুক্তি। প্রেজেন্টেশান যতটুকু ভালো হওয়ার কথা ছিল। তাঁর চেয়েও ভালো হল। সবাই তাঁকে কনগ্রাচুলেট করল। তাঁর বসের বস বিবেক রয় তাঁর খুব প্রশংসা করল। এই সেই বিবেক রয় যে কয়েক মাস আগে তাঁর ডাইরেক্ট বসের কাছে তাঁর নামে কমপ্লেইন করেছিল। আজ সে তাঁকে ভালো বলছে। পুলকের মনটা খুশিতে ভরে উঠল। সে কনফারেন্স রুম থেকে বের হয়ে অভ্যাসবশত ফোনটা বের করল। রীতার নাম্বার এ ডায়াল যেই করতে যাবে অমনি তাঁর মনে পড়ে গেল যে রীতাকে তো আর সে কোনোদিন কল করতে পারবে না। পুলক পকেটে ফোন রেখে দিল। তাঁর আর কাউকে কল করার নেই।
যাদের মধ্যে বিশাল শূন্যতা কাজ করে তাঁরা অর্থহীন কাজ করে। অর্থহীন কাজগুলো তাঁদের করতে হয় শূন্যতা ভরার জন্য। কিন্তু যে বিশাল গর্ত তৈরি হয় তা ভরাট করার ক্ষমতা মনে হয় ঈশ্বর মানুষকে দেননি। মানুষ তাও বৃথা চেষ্টা করে। মেনে নিলেই কিন্তু হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ মেনে নেয় না।
পুলক সারাজীবন দেবদাস কিসিম এর পাবলিকদের নিয়ে কৌতুক করে এসেছে। একটা মেয়ের জন্যে কি অবস্থা করছে ছেলেগুলা। ছিঃ!! এ মদ খায়। আবার একটু পর পর কাঁদে। উদাসীন হয়। সারাদিন ঘুমায়। কী অবস্থা!!! এইগুলা কিছু হইল!!!!
সেই পুলকের কাছেই এই সময় মনে হল জীবনের আসলে কোন অর্থ নেই। এইরকম বোধ থেকেই যে মানুষ অর্থহীন কাজে লিপ্ত হয় এটাও সে উপলব্ধি করল।
অসামাজিক মানুষেরা প্রবল রকমের নীতিবান হয়। কারণ তাঁদেরকে সমাজের বাকি মানুষদের সাথে না মিশলেও চলে। কারণ তাঁরা অসামাজিক। পুলকের মত রাগী মানুষেরা তাই প্রবল রকমের নীতি মেনে চলতে চেষ্টা করে। পুলক সারাজীবন যে কোন ধরনের নেশা করা অপছন্দ করেছে। এর পিছনে অবশ্য তাঁর বাবার নেশা করার ব্যাপারটা ছিল। তাঁর বাবা নেশা করত এবং বাসায় এসে হই চই করত। যাক সে কথা!! মেয়েদের পিছনে ঘোরা, এদের অতিরিক্ত পাত্তা দেয়া। এসবও পুলক সারাজীবন অপছন্দ করেছে। সেই পুলককে দেখা গেল সিগারেট খেতে। অনেক রকম মেয়ের সাথে তাঁর আলাপ হয়ে গেল। সে আজকাল তেলতেলে কণ্ঠে প্রয়োজন হলে হাসতে পারে। তবে খুব একটা চেষ্টা করার প্রয়োজন তাঁর হয় না। সে সুদর্শন। এটা সে আগে জানত না। এখন জানে। তাই এটা সে ব্যবহার করে। মেয়ে মানুষ যে প্রথম পদক্ষেপ কখনো নেয় না। এটাও সে জানে। তাই প্রথম পদক্ষেপ নেয়ার কাজটা আজকাল সেই করে। মাঝে মাঝে নতুন পুলকের সাথে পুরাতন পুলকের তুলনা করে সে। নাঃ!! তাঁর কোন লজ্জা হয় না। নীতি ফীতি সব বাজে কথা মনে হয় তাঁর। সবই অর্থহীন লাগে। এই অর্থহীন জগতে নীতির কোন জায়গা আদৌ আছে কি? এভাবেই প্রিয়াঙ্কার সাথে পরিচয়। সময় কাটানোর জন্য উদাসীন হাঁটাহাঁটি, সিগারেট খাওয়া আর কয়েক ঘণ্টা মেয়েদের অর্থহীন আলাপ শোনার চেয়ে ভালো কিছু হয় না।
কিন্তু এত কিছুর পরেও শূন্যতা ভরে না। হাহাকার দূর হয় না। খালি মনে হয় কি যেন নেই!!! কি যেন নেই!!! মেঘলা দিনটা আজকাল পুলকের সহ্যই হয় না। কি এক আজব মন খারাপ পেয়ে বসে পুলককে মেঘলা দিনে। সেই মন খারাপের উৎসস্থল যে রীতা এটা সে বুঝতে পারলেও মানতে চায় না। এইদিন সে শুধু হাঁটে অফিস এর পর। কারো সাথে দেখা করে না। কারো ফোন ধরে না। একটার পর একটা সিগারেট। আর হাঁটা। এখনো সিগারেটে অভ্যস্ত হতে পারেনি সে। খালি ধোঁয়া ছাড়ে। দুয়েক বার ভিতরে নিয়ে দেখেছে। দারুন জ্বলে।
পুলকের পরিবর্তন কেউ খুব একটা ধরতে পারে না। খালি তাঁর কিছুটা স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে এটা চোখে পড়ে। মুখটা শুকনো থাকে। কিন্তু আজকাল যেন আরো বেশি হাসে সে। কথাও বেশি বলে। কোথাও বেশিক্ষন বসে থাকে না সে। অফিস এও আজকাল হেঁটে হেঁটে কাজ করে।
রীতার এসএমএস এ একটু চমকালেও খুব বেশী আলোড়িত হয়নি পুলক। হঠাৎ হয়তো পুলকের জন্য রীতার guilt হচ্ছে, খারাপ লাগছে। পুলকের তো রীতার উপর কোন রাগ নেই। মানুষের মন পরিবর্তন হয়। রীতারও হয়েছে। হতেই পারে। এতে সে রীতাকে দোষ কখনোই দেয় না। তবে এটা সে জানে এখন যে রীতা আছে, সে তাঁর রীতা নয়। সে কোথাও হারিয়ে গেছে। এইভাবে যদি কেউ হারিয়ে যায় তাঁকে কেউ কখনো ফিরে পায় না।
পুলক অপেক্ষা করছে কষ্টটার জন্য। একটা কষ্ট হওয়ার কথা। খুব কষ্ট। কষ্টটা হচ্ছে না। সে জানে কষ্টটা আছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকের মত কষ্টটা আসে। এই যে সেদিন তাঁর বসের বস বিবেক তাঁকে তাঁর রুমে ডাকলেন।
- কেমন আছ পুলক?
- জি স্যার। ভালো।
- আমি তোমার কাজে খুব খুশি।
পুলক হাসিমুখে বিবেকের দিকে তাকিয়ে রইল। এই লোকের মুখের কথার কোন দাম তাঁর কাছে নেই।
- পুলক সামনের বছর তোমাকে জার্মানিতে ট্রান্সফার করে দিব বছর দুয়েকের জন্যে। ওইখানের ব্রাঞ্চে তোমার মত কিছু লোক দরকার। তুমি মানসিকভাবে তৈরি থাক।
কথাটা শোনামাত্রই পুলকের বুকের ভিতর কি যেন একটা খামচে ধরল। তাঁকে বাইরে যেতে হবে!!! সে রীতাকে ছেড়ে কেমনে কই যাবে!!! তাঁর তখন মনে হলো না যে সে রীতাকে ছাড়াই ৬ মাস কাটিয়ে দিয়েছে। চোখটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। বিবেক তাঁর সামনে বসে জার্মানির অফিস এর কথা বলে যাচ্ছে। পুলক অনেক চেষ্টা করছে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করার।
রুম থেকে বের হয়ে সে অফিস এর বাইরে চলে গেল। গ্যারেজের যে দিকে অন্ধকার ওখানে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ল পুলক। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। বসা মাত্রই কি প্রবল বর্ষণে চোখ দিয়ে পানি পড়ল!! কেন কাঁদছে! কি হয়েছে! কিছুই বুঝতে পারল না পুলক। বুকের কোন জায়গা থেকে এত ব্যথা হচ্ছে কেঁদে কেঁদে হাজার হাতরিয়েও খুঁজে পায়নি সে।
সেদিনের কান্নার পর কষ্টটা আবার চলে যায়। কিন্তু জানান দিয়ে যায় সে আছে। এবং তাঁর তীব্রতা প্রবল। এই কষ্ট সে কিভাবে সামলাবে!!! একা কিভাবে সামলাবে যখন এটা পুরোপুরি আসবে!!!!
পর্ব-১ Click This Link পর্ব-২ Click This Link পর্ব-৩ Click This Link পর্ব-৪ Click This Link পর্ব-৫ Click This Link পর্ব-৬ Click This Link পর্ব-৭ Click This Link পর্ব-৮ Click This Link পর্ব-৯ Click This Link পর্ব-১০ Click This Link পর্ব-১১ Click This Link পর্ব-১২ Click This Link পর্ব-১৩ Click This Link পর্ব-১৪ Click This Link পর্ব-১৫ Click This Link পর্ব-১৬ Click This Link পর্ব-১৭ Click This Link পর্ব-১৮ Click This Link পর্ব-১৯ Click This Link পর্ব-২০ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:৩২