প্রশ্নটা ঠিক উড়োভাবে করা হলেও মনোবিজ্ঞান এর একটা সুন্দর উত্তর দেয়। আবেগের সাথে ভালবাসা ও ঘৃণার সম্পর্ক ব্যাপক। সম সাময়িক বিভিন্ন পরিস্থিতির বিবেচনায় দুটো বিষয় ই প্রাসঙ্গিক ভাবে মূল্যায়ন করা যায়।
প্রথমেই গ্রীকের মহান দার্শনিক সক্রেটিসের একটি পর্যবেক্ষণ দেখা যাক।
সক্রেটিস বলেন, পরিমাপ করা যায় এমন বিষয় আমরা সহজেই মেপে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি। এক্ষেত্রে তর্কের প্রশ্ন ওঠে না । যেমনঃ কোন বস্তুর মাপ। কিন্তু যেসব ব্যাপার পরিমাপ করা যায় না বা যা পরিমাপের সর্বজন সিদ্ধ একক কোন আদর্শ নেই; যেমনঃ ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ প্রভৃতির নির্ণায়নে আমরা তর্কে জড়াই। পক্ষে বিপক্ষে বিভক্ত হই।
খুব সহজ ও সাধারণ বাস্তব কথা। বক্তব্যের যথাযথতা মূল্যায়নে স্বাভাবিক ভাবে বিশ্বাস ও যুক্তির কোন সংঘাত নেই।
দ্বিতীয় বিষয়গুলো অর্থাৎ ন্যায়-অন্যায়বোধ সাধারণত আমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস , ভালবাসা- ঘৃণার দ্বারা সর্বপরি দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা পক্ষে বিপক্ষে অভীষ্ট হই।
এই প্রসঙ্গে মনোবিজ্ঞানের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের একটি পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভাবে এসে পড়ে।
ফ্রয়েড বলেন, মানুষ সাধারণত অপ্রিয় বিষয়গুলোকে অসত্য বলে মনে করে। বিধায় সহজেই এর বিপক্ষে কিছু যুক্তি দাঁড় করায়।
পর্যবেক্ষণটার সত্যতা আমরা নিজেরাই নিজেদের চিন্তা দিয়ে যাচাই করতে পারি। বিষয় টাকে কিছুটা যুক্তিতে সাজানোর চেষ্টা করলে এরকম দাঁড়ায়-
যে কোন বিষয়ের পক্ষে বিপক্ষে আমাদের মস্তিস্কে কিছু তথ্য থাকে।
সুত্র ১- প্রিয় বিষয় গুলোর পক্ষে সব সময়ই আমারা ভাল বা পজিটিভ দিক গুলো তুলে আনি।
সুত্র ২- অপ্রিয় বিষয়গুলোর খারাপ বা নেগেটিভ দিক গুলো তুলে আনি।
মানুষের মানসিক প্রক্রিয়ার এই ব্যাপার গুলো ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন। যথেষ্ট ভিত্তি ও নেই। বিধায় বাস্তবতার সাথে তুলনা করেই সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করতে হবে।
সুত্র ৩- উপরের সুত্র ধরে বলা যায়, আমরা যে কোন বিষয়ের পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণে সাধারণত প্রিয় দিক গুলোকে পক্ষ হিসেবে বেছে নিয়ে অপ্রিয় দিক গুলোকে বিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করি। তারপর পক্ষের ভাল ও পজিটিভ দিকের সাথে বিপক্ষের খারাপ ও নেগেটিভ দিক তুলনা করি।
এমনকি পক্ষ-বিপক্ষের তর্করত অবস্থায় ও বিপক্ষ নিজ ভাল দিক গুলো তুলে ধরলে আমরা তার খারাপ দিক গুলো তুলে ধরতে আপ্রাণ চেষ্টা করি।
আমাদের আবেগ আমাদের নিরপেক্ষ মূল্যায়নে বেশ বাধার সৃষ্টি করে।
সাধারণত এ ধরণের পরিস্থিতিতে আমাদের তীক্ষ্ণ আবেগিয় জ্বালানি; অন্ধত্ব, গোঁড়ামি ও সেচ্ছাচারিতার সৃষ্টি করে।
নিজেকে সঠিক প্রমাণের চেয়ে অন্য কে ভুল প্রমাণের চেষ্টাতেই হরহামেশাই ঝগড়া, বিবাদ, হানাহানির সৃষ্টি হয়।
এই অনিবার্য সংঘাত এড়াতে সমাজ বা রাষ্ট্র টিকে থাকার স্বার্থে ও শান্তি- শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ নির্দিষ্ট করে দেয়। এই মানদণ্ডের বিবেচনায় সমাজ-রাষ্ট্রের মানুষের প্রশংসা-নিন্দা, পুরষ্কার-শাস্তি জোটে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রচার করা হয়ে থাকে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতেই এই মানদণ্ড নির্ধারণ হয়। যা সময় পরিস্থিতির বিবেচনায় সংযোজন, বিয়োজন ও সংস্কারের নিয়ম রাখা হয়।
এক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয় দুটি কারণে-
সমস্যা- ১) যখন সুদূরপ্রসারি ফল বিবেচনা না করে আবেগের ভিত্তিতে এই মানদণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হয় বা পরিবর্তনের দাবি ওঠে,
আবার ঠিক তেমনি,
সমস্যা- ২) যখন ন্যায়-অন্যায় প্রয়োগের দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিতরা ব্যক্তিস্বার্থে যথেষ্ট সচ্ছতা না দেখিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগের বিপক্ষে মানদণ্ড দেখিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেন।
সমস্যা-৩) এই দুটি কারন একক ভাবে ও ঘটতে পারে অথবা যুগপৎ ভাবে ও ঘটতে পারে।
সামাজিক মানদণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ হউয়ার ক্ষেত্রে দুটি কারণের কোনটি দায়ী নাকি দুটোই দায়ী, তা সঠিক ভাবে নিরূপণ করতে না পারলে এবং সিদ্ধান্ত অটল রাখলে; সমাজকে অদুর ভবিষ্যতে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়।
এই উত্তর খোঁজায় আবেগের নিয়ন্ত্রণের দিকটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবেগের সাথে আবেগ বহির্ভূত সাধারণ যুক্তি-বুদ্ধি না মেলালে পরিস্থিতি অত্যন্ত শোচনীয় পর্যায়ে যেতে পারে।
উদাহরণ স্বরূপ- আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা ধরা যাক।
আমাদের সোনার সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা নিজ জীবনের মায়া ত্যাগ করে নয় মাস যুদ্ধ করেছেন, দেশের জন্য একনিষ্ঠ আবেগিয় ভালবাসার দ্বারা। এখানে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন, তারা শুধু আবেগের বশে যখন তখন মনের ইচ্ছানুযায়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন নি। সুনিয়ন্ত্রিত পরিকল্পনার মাধ্যমে লক্ষ্য ঠিক করে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। যুদ্ধ কালীন সুদূর ভবিষ্যৎে পরিকল্পনার কল্যাণ-অকল্যাণ মিলিয়ে দেখেছেন। জয় ছিনিয়ে এনেছেন বীরদর্পে।
আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, যে কোন উদ্ভুত পরিস্থিতির পক্ষ বিপক্ষ তথা ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণে আবেগের সাথে যুক্তি মিলিয়ে সুদূরপ্রসারি কল্যাণ-অকল্যাণের বিবেচনা অত্যন্ত জরুরী।
দীর্ঘ আলোচনা ধৈর্য নিয়ে পড়ার জন্য প্রথমেই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
এবার আমরা সরাসরি ব্যবহারিক প্রয়োগের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করি সম-সাময়িক ঘটনাগুলোর একটি নিয়ে।
ধরা যাক, বিশ্ব সেরা অল রাউন্ডার বাংলাদেশের সাকিব আল হাসানকে বিসিবির ছয় মাসের জন্য ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করার- ঘটনা টা।
আমরা কোন গভীর বা তথ্য মুলক আলোচনায় যাব না। সাধারণ কিছু বিষয় তুলে ধরে এ পর্যন্ত করা আলোচনার সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করব।
সাকিব আল হাসান
নিজের অসাধারণ পারফর্মেন্স ও যোগ্যতা দিয়ে দেশের অনেক ক্রীড়াভক্তের মন জয় করে নিয়েছেন, ভালবাসা অর্জন করেছেন।
অন্যদিকে,
বিভিন্ন সময়ে নিজের অসংযত আচরণের কারণে অনেকের অপ্রিয় পাত্র হয়েছেন।
( কার কাছে কেন প্রিয় বা অপ্রিয়- এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। )
সাকিব কে নিষিদ্ধ করায় সমালোচনার কেন্দ্রে আছেন, বিসিবির শীর্ষস্থানীয় কিছু কর্মকর্তা।
এখন স্বভাবতই সাকিবের খেলাকে পছন্দকারিরা বিসিবির ঐ কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সাকিবের পক্ষে যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করবেন। ( যথাক্রমে সুত্র ২, ১ ও ৩ )
অন্যদিকে,
সাকিবের অসংযত আচরণে তাকে অপছন্দকারিরা বিসিবির পক্ষে অবস্থান নিয়ে যুক্তি দেখিয়ে সাকিবের বিপক্ষে যুক্তি দেখাবেন। ( যথাক্রমে সুত্র ১, ২ ও ৩)
এখানে পার্থক্য এটুকুই যে, বিসিবি কে চরম তম সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দেওয়ার বিধান আছে। তাই প্রথমে নিজেদের পক্ষে কথা বলতে হবে।
এটা গেল সাকিবের পক্ষ- বিপক্ষ বিবেচনায় বিসিবির মূল্যায়ন।
বিসিবির পক্ষ বিপক্ষ বিবেচনায় সাকিব কে মূল্যায়নে উল্টো হবে। এখানে রাজনৈতিক বিবেচনা আসবে কিছুটা।
বিসিবির শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তা
উনাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের আনুগত্তের কারণে অনেকে তাদের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সাকিবের বিপক্ষে যুক্তি দেখাতে চাইবেন। ( সুত্র ১, ২ ও ৩)
আবার উনাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রতি বৈরাগ্যের কারণে অথবা উনাদের বিরুদ্ধে থাকা পূর্বের নানা অভিযোগের ( কাগজে কলমে প্রমানিত নয় ) কারণে উনাদের বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে সাকিবের পক্ষে যুক্তি দেখাবেন। ( সুত্র ২, ১ ও ৩)
যে ভিত্তিতেই হোক, এভাবে গড়ে ওঠা পক্ষ বিপক্ষ যেটাই বলুক, সামাজিক মানদণ্ড প্রশ্ন বিদ্ধ হউয়ার কারণ তিনটি অনুযায়ী তিনটি অনুসিদ্ধান্তে আসা যায় –
১) সাকিবের অহংকার পুরো বিসিবি কে তার আনুগত্যে প্রভাবিত করছে। তার ভবিষ্যতে ভাল পারফর্মেন্সে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনার সম্ভাবনা থাকলে ও টিমের অন্যান্য খেলোয়াড়দের হীনমন্যতার কারণ হউয়ার সম্ভাবনা আছে। ফলে বিসিবির সিদ্ধান্ত যৌক্তিক। ( সমস্যা- ১)
২) সাকিব কে শাস্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত বিসিবির শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত আক্রোশ অথবা ব্যক্তিগত লাভের জন্য তৃতীয় পক্ষের দ্বারা প্রভাবিত। ( সমস্যা- ২)
৩) বিসিবির কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং সাকিবের অসংযত আচরণে নিয়ম ভঙ্গ- দুটোই সাকিব কে নিষিদ্ধের কারণ হতে পারে। তবে এক্ষেত্রে শাস্তি বেশি হয়ে গেছে কিনা সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
খুব প্রমানিত ভাবে কিছু বলা অসম্ভব। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি আমরা পক্ষে বিপক্ষে আবেগের যুদ্ধে তর্ক-বিতর্ক করতে থাকি, তবে তা ভবিষ্যতে ভাল ফল বয়ে আনবে না। তাই কিছু বলার আগে আমাদের সব কিছু আরও ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করা উচিত।
এমনিতেই জাতিগত ভাবে আমাদের কিছু সমস্যা আছে। ব্লগার অন্যমনস্ক শরৎ দা এ নিয়ে চমৎকার একটি পোস্ট দিয়েছেন।
"হাইপারবাইপোলারসহাবস্থান" সিনড্রোম
পোস্টটি পরার পর ব্লগার রেজা সিদ্দিক ভাই এর এই পোস্ট টা পড়লে সম্ভবত আমাদের ই লাভ হবে।
চাই মানবিক হয়ে ওঠার অনুশীলন- চাই মানবিক হয়ে ওঠার অনুশীলন-
সমস্যা জানার পর ইতিবাচক বক্তব্য অনেক ভাল মানসিকতা গঠনে সহায়তা করতে পারে।
পোষ্টের শেষে এটুকু বলতে চাই, সাকিব কে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আরও বেশি স্পষ্টতা প্রয়োজন। তিনি বাঙালির গর্ব, বাঙালির সম্পদ। তাই বলে ভুল- শাস্তির উরধে নন।
উপযুক্ত, স্পষ্ট ও প্রমানিত কারণ না থাকলে বিসিবিকে অবশ্যই তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে।
তবে, উপযুক্ত, স্পষ্ট ও প্রমানিত কারণ পেলে সাকিবের নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত শুধু আবেগিয় কারণে বিরোধিতা করলে তা অদুর ভবিষ্যতে ভাল ফল বয়ে আনবে না।
এক্ষেত্রে শুধু বলব, বিসিবি স্পষ্ট জবাব চাই।
অনেক কষ্ট করে পোস্ট টি পড়ার জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা।
মনোবিজ্ঞানের বিষয় গুলো বিভিন্ন বইয়ে পড়া, সাথে নিজস্ব চিন্তার মিশ্রণ আছে। বিপক্ষ যুক্তি থাকলে সাদরে গ্রহণযোগ্য।
সবার জন্য জানাই ভাল থাকার মন্ত্রণা।