মৃত্যু শোক উদযাপন নাকি পালন করা হয় সেটা পৃথক করা যায় পালনের মধ্যে আড়ম্বর ও অনাড়ম্বর প্রজ্ঞাপন ঠুকে দিয়ে। শতাব্দীর শেষ দশকগুলোতে শোক একধরনের শক্তিতে পরিণত হয়েছে - পালন বা উদযাপন সংক্রান্তিযোগে।
আমাদের আদিবাসী পূর্বসূরিদের শোক মন্থন একধরনের দহন উৎপন্ন করতো, সংস্কৃতিতে তেমন রেশ এখনও দেখা যায় পাহাড়িদের মাঝে। তবে বাঙালি সংস্কৃতিতে শোক একধরনের নির্লিপ্ত-মুহ্যমান চর্চা আবহমানকাল থেকেই। পশ্চিমে শোকাবহ তৈরীর জন্য কৃষ্ণবর্ণ আর ভারতে শুভ্র পরিধেয় খুব বেশী পুরানো আমলের সূচনা নয়। তবে বাঙালির আবেগ-উচ্ছ্বাসের সাথে শোক সবসময় একধরনের ম্লান-বিধুর গ্রন্থনা।
সাহিত্য ও দর্শনে শোকের রূপকীয় ও যৌক্তিক বিশ্লেষণ রয়েছে, আর প্রকাশ্যে আছে সরব আহাজারি, মূলত যা মধ্য ও নিম্নবিত্তদের মধ্যে দৃশ্যমান। তবে উচ্চমধ্যবিত্ত বাঙালীর বিকাশমান ধারায় মৃত্যুশোক সর্বদাই নীরব প্রার্থনায় অবগাহন করেছে।
তবে বিদেহী লেখক বা কীর্তিমাদের জন্য গোষ্ঠীবদ্ধ শোক পালন একটা নৈয়মিক স্মরণ - এবং ব্যক্তিক ও অব্যক্তিক সম্পর্কহেতু শ্রদ্ধা প্রদর্শন। আনুষ্ঠানিক তবে মূলত মূল্যায়ন একটা উদ্দেশ্য থাকে এমন চর্চায়। কখনও সংস্কৃতির এক নতুন উদযাপন-বোধের সংযোগ ঘটিয়ে উৎসব হিসাবেও ব্যাপকভাবে প্রচারিত, পারস্পরিক যোগাযোগ বিনির্মাণের ক্রিয়াশীল অবলম্বন। একজন লেখকের সাথে রক্তমাংস-আত্মীয়তার বাইরে সম্পৃক্তজনরা লেখকের সৃষ্টিজগতের কল্পলোক ও বাস্তবতার চরিত্রগুলো নিয়ে উপস্থিত হয়। ক্রমশ শোক উদযাপনে শক্তিমত্তা ও আধিপত্য প্রদর্শনীর নানা অনুষঙ্গ বর্ণীল হয়ে ওঠে। একধরনের আচার-আচরণও বিকশিত ও অলঙ্ঘনীয় হয়ে ওঠে এবং এর অন্যথাকারীদের জন্য সম্মিলিত অসদাচারও প্রকাশ পায় - যাকে কোনভাবেই শোকের রাজনীতিগ্রস্থতা ছাড়া অন্যকিছু ভাবা যায় না।
গোষ্ঠীবদ্ধ শোক উদযাপনে রক্তমাংশচ্ছেদ্য উত্তরসূরিদের স্মৃতিসৌধের মত অঞ্জলী অর্পণের আতিশয্য থাকতে পারে, কিন্তু তার লেখায় নিবিষ্ট পাঠক বিষয়-বিস্তার ও বিশ্লেষণে - বিদেহী লেখকের চিন্তার নতুন দেশ আবিষ্কারে সক্ষম হন। যারা লিখে যান এবং নির্মাণে অভিনবত্বের মশলা যোগান দিয়ে বিমুগ্ধতার উপাদান রেখে যান তাদের স্মরণ করে যায় নতুন নতুন পাঠককুল ধারাবাহিকভাবে, স্বতস্ফূর্ত ক্রান্তিকাল পর্যন্ত। লেখক পরিচিত হয়ে উঠতে পারেন অসামান্য উজ্জ্বলতায়।
সুমন রহমান তুলে ধরেছিলেন বিদেহী ব্লগার জুবায়ের ভাইয়ের মৃত্যুশোককে কেন্দ্র করে নির্মীয়মাণ সংস্কৃতির স্বরূপ, ভাবনার জগতে নতুন প্রসঙ্গটি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তখন শোকের রাজনীতি কিভাবে হাত পা ছড়িয়ে বসে সেটা স্পষ্টভাবে প্রকাশ্য হয়নি। শোক ক্ষমতায় কেন্দ্রীভূত হয়ে গোষ্ঠীর প্রবর্তিত আচার-আচরণের ভিন্নতাকারীদের বিরুদ্ধে কেমন নির্মম হয়ে ওঠে সেটা বোঝা না গেলেও এখন বোঝা যায়। সুমন রহমান শোকপালনে রাজনীতির যে অন্তর্ভুক্তি চিহ্নিত করেছিলেন তার মধ্যে জুবায়ের ভাই কোন লক্ষ্য বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়নের (আদৌ যদি থেকে থাকতো!) অংশ ছিলেন না, বেশ ভালোভাবেই বোঝা যায়। বরঞ্চ তা ছিল এক সামগ্রিক শোক-চিত্রের উৎস, অবস্থান ও বিরাজিত পরিস্থিতির দলিল। কিন্তু শোকের রাজনীতি যে ভয়ালভাবে বিস্তার করেছে এর মধ্যে প্রমাণ মেলে দেড় বছর পরে একদল শোক-সংস্কৃতিসেবী যখন সুমন রহমানকে নির্মমভাবে আক্রমণ করলো। সুমন রহমানকে ব্যবচ্ছেদের মাঝে শোকের প্রকরণ আর খুঁজে পাওয়া যায় না – কেবল শোকের রাজনীতিই চোখে পড়ে, যা সুমন বেশ আগেই শনাক্ত করেছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১০ সকাল ১০:৩২