কম্পিউটারের সাথে পরিচয় ঘটেছিল ২০০৬ সালে । ও হ্যাঁ কম্পিউটারের সাথে দেখা হয়েছিল ২০০৩ এর দিকে । বলে রাখা ভাল আমাদের পরিবারে মোবাইল আসে ২০০১ সালে । তখন মোবাইল এর আইএসডি কলটা এত সহজলভ্য ছিল না । আমার চাচা লন্ডনে থাকেন । তার সাথে কথা বলার জন্য একটা নির্দিষ্ট দিনে গাড়ি রিজার্ভ করে সবাইকে নিয়ে সিলেট শহরে যাওয়া হত । তখন মোটামুটি কথা কম্পিউটার বাক্সটা চিনি । সেটা শুধু নামেই চিনি । আর তার কাজ বলতে শুধুই বিদেশে ফোন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাম ।
২০০৬ সালে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম । সেখানেই দেখা হল সেই কম্পিউটারের সাথে । তবে এবার আমার জ্ঞান কিছুটা উন্নত হয়েছে এর সম্বন্ধে । ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার জন্য স্কুলের হ্যাড ম্যাম কোথা হতে যেন কম্পিউটার সম্পর্কে রচনা নিয়ে এলেন আমার জন্য । ক্লাসের ফার্স্টবয় আর জিনিয়াস ( ! ) স্টুডেন্ট হিসাবে ‘ কম্পিউটার ‘ রচনাটা তোলে দেয়া হল আমার হাতে । সেখান থেকেই জানতে পাড়লাম এই যন্ত্র শুধুই ফোন করায় সীমাবদ্ধ নয়, আরও নানা কাজে লাগে । তন্মধ্যে হিসাব-নিকাশ , ছাপার কাজ , ইমেল প্রেরণ করা অন্যতম । যদিও সেই সময় ইমেল কি সেই জিনিসটা জানতাম না । যখন সিক্সে ভর্তি হলাম তখন এই টুকটাক জ্ঞান আমাকে বিশাল জ্ঞানী করে দিল । আমাদের স্কুলে দুইট কম্পিউটার ছিল । তাও ভীষণ সিকিউরিটি দিয়ে রাখা ছিল । আমাদের স্কুলের অফিস রুমের পাশে । নিতান্ত দুর্বল ছাত্র যারা ছিল তারা সেই রুমের পাশেই ঘেঁষত না । তাদের জন্য আমিই ছিলাম ভরসা ! কি সেই জিনিস এত সিকিউরিটি দিয়ে রাখা , দেখতে কেমন , এটা দিয়ে কি হয় এই সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য আমি স্পেশালিষ্ট ছিলাম আমাদের গ্রুপে । আমাদের গ্রুপ বলতে আমাদের গ্রুপ , আমাদের গ্রামের গ্রুপ । যারা একসাথে প্রতিদিন প্রায় দেড় কিলোমিটার পায়ে হেটে স্কুলে যেতাম , আর এক সাথে গ্রামে ফিরতাম । যখন তাদের সাথে কম্পিউটারের গল্প করতাম তখন আমি মোটামুটি স্টার এর মত ভাব নিতাম । সবাই আমাকে ঘিরে হাঁটত । সবার মাঝখানে থাকতাম আমি , আর তারা আমার দুই পাশ দিয়ে হাঁটত । ২০০৬ সালের শেষের দিকে আমার কম্পিউটার জ্ঞান আরও কিছু বৃদ্ধি পেল অনেকটা নিজের ইচ্ছাশক্তির বলে । একি গল্প কতবার বলা যায় মানুষদের ! সেই ইচ্ছা থেকেই শুরু করলাম কম্পিউটার সম্বন্ধীয় লিখা সংগ্রহ করা । আবারও ধরনা দিলাম প্রাইমারী স্কুলের হ্যাড ম্যামের কাছে । ম্যাম আমার সব কথার মূল্যায়নই ক্লাস টু থেকেই দিতেন । কি জানি কি দেখেছিলেন আমার ভেতর । ম্যাম নিজ পরিশ্রমে আমাকে কিছু লিখা কালেক্ট করে দিলেন । আর কালেক্ট করার পদ্ধতিও বলে দিলেন । জানতে পাড়লাম বিল গ্যাটস এর নাম । তখন আমি সিক্সের বার্ষিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি মাত্র । মাইক্রোসফট এর নামও জানা হল সেদিন । জানার খুদা বেড়ে গেল । মাইক্রোসফট জিনিসটা কি আসলেই , বা এই বিল গ্যাটস ই বা কে । বেশী বেগ পেতে হয়নি আমার । বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করেই নানা বাড়ি পাড়ি জমালাম । সেইদিন রাতই আমার ছোট মামাকে জিনিসটা জানালাম । জানালাম বিল গ্যাটস আর মাইক্রোসফট এর কথাও । পরের দিন দুপুর বেলা মামা আমার জ্ঞানের পরিধিটা শুধু বাড়িয়ে দিলেনই না আমার ক্ষুধা আরও বাড়িয়ে দিলেন । জানলাম বিল গ্যাটস আর মাইক্রোসফট এর সম্পর্কে । শুরু হলও মাইক্রোসফট নিয়ে গবেষণা । ক্লাস সেভেনে ভর্তি যেদিন হলাম সেদিন বাড়ি ফিরেই আব্বা বললেন – ‘ এত টাকা পয়সা খরচ করছি শুধুই তোমাদের ভবিষ্যতের জন্য । কি হতে চাও জীবনে ? ‘ আব্বাকে সেদিন উত্তর দিলাম ডাক্তার । জানতাম এটা শোনে আব্বা খুশী হবেন । কিন্তু সেদিন প্রথমবারের মত আমি খুশী হতে পাড়লাম না । এই উত্তরের পর আমার প্রশান্তি ছিল না সারা দিন । সেদিন রাত আম্মার পাশে শোয়েই ইনিয়ে বিনিয়ে বিল গ্যাটস আর মাইক্রোসফট এর গল্প বললাম , কম্পিউটারের গল্প বললাম । সেদিন প্রথমবারের মতো আম্মুর কাছে অন্যায় আবদার করলাম যে আমি ডাক্তার হতে চাই না । আম্মা আবাক কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করলেন কেন , সেইদিন প্রথমবারের মত উচ্চারণ করলাম আমিও বিল গ্যাটস এর মত হব । মাইক্রোসফট বানাব । সেই অন্যায় আবদারটা আমার আম্মা হয়তো ততোটা সিরিয়াসলি নিলেন না । মাথা নেড়ে সায় দিয়ে দিলেন যে আমি বিলগ্যাটস হয়ে যাব । তারপর আবার তাঁরা সেই ডাক্তারীর পিছনেই পড়ে রইলেন । আর আমি ? আমি প্রিপারেশন নিলাম কিভাবে বিল গ্যাটস হওয়া যায় । তখন হাতে পেলাম কিশোরকন্ঠ নামে একটা ইসলামিক সঙ্ঘটন এর মাসিক পত্রিকা যার প্রতিটা সংখ্যায় থাকতো কম্পিউটার সম্পর্কীয় ফিচার । আর কম্পিউটার এর বিজ্ঞাপন তো আছেই ! আমি সেই পত্রিকার নিয়মিত সদস্য হয়ে উঠলাম । এই পত্রিকার পুরনো সংখ্যাগুলোও সংগ্রহ করতে লাগলাম । অবশ্য পড়ে এই সঙ্ঘটন সম্পর্কে জানতে পেড়ে আর কখনোই কিনি নাই ।
২০০৮ এর কথা । আমি মাত্র ক্লাস এইটে । বৃত্তির জন্য চাপ শুরু । কম্পিউটার নিয়ে ভাবার টাইম নাই । সকালে স্যার আসেন , তারপর স্কুল । বিকালে বাড়ির কাজ , রাতে আবার স্যার ! এরকম একদিন আমার ছোট মামা আবার ফোন দিলেন আমাদের বাড়িতে । তখন আমি স্কুলে , আম্মুকে জানিয়ে দিলেন আমি স্কুল থেকে ফিরেই যেন উনাকে ফোন দেই । আর্জেন্ট কল ! জানিয়ে রাখি ছোট থেকেই সবার জীবনে একজন সুপার হিরো থাকে । আমার জীবনে দুইজন ছিলেন ; আমার চাচা , আর আমার ছোট মামা । বাড়িতে ফিরেই খবরটা পেলাম , সাথে সাথেই দিলাম ফোন । মামা সেই খবরটা জানালেন , লন্ডন থেকে উনার জন্য একটা কম্পিউটার এসেছে । এর নাম ল্যাপটপ । তখন অবশ্য ল্যাপটপ সম্পর্কে মোটামুটি জানা হয়ে গেছে । তখন শুরু হলও আমার প্রশ্ন দেখতে কেমন , রঙ কি , বাটন কতটা :p ! আবারো প্রতীক্ষা শুরু হলও কখন নানা বাড়ি যাব । সেই দিন এলো এক মাস পড় । গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে নানা বাড়ি গেলাম । তারপর ? হাতেখড়ি হল কম্পিউটারে , নতুন করে পুরনো স্বপ্ন চাড়া দিল । মাইক্রোসফট ওয়ার্ড এর হাতে খড়ি হলও প্রায় পনেরো দিনের ট্রেনিং এ । এছাড়াও ছিল প্যাইন্ট টুল শেখা । মোটামুটি উস্তাদ তখন । অন্যদের সাথে এ নিয়ে গল্প করা প্রায় ছেড়ে দিলাম । নিজেকে শুধুই মোটিভেট করতাম কম্পিউটার এর জন্য । ২০০৯ সালের দিকে GOOGLE সম্পর্কে জানলাম এবং শিখলাম । জানলাম ল্যারি প্যাজ সম্পর্কে । দ্বিধান্বিত হলাম আমি কে হতে চাচ্ছি ! বিল গ্যাটস , নাকি ল্যারি প্যাজ ! তখন একদিন আম্মাকে জানিয়ে দিলাম আমি ল্যারি প্যাজই হতে চাই । ক্লাস নাইনের একটা ছেলে যখন তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বেশ কনফিডেন্সের সাথেই অভিভাবকদের জানায় তখন তাদের মনে একটু দাগই কাটে । আমার আম্মারও কাটল । তাঁদের ডাক্তার বানানোর স্বপ্নের প্রতিবন্ধকতা অনুমান করতে পাড়লেন । মামাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন আমাকে কম্পিউটারের দিকে না টানার জন্য । আম্মা আসলেই অনেক লেট করে ফেলেছিলেন । তখন অনেক লেট হয়ে গেছে । আমি প্রায় নেশাগ্রস্ত আমার স্বপ্ন নিয়ে । শারীরিক অসুস্থতা আর মানুষিক দুর্বলতার ফলেই পরীক্ষার ফলাফল ভাল হল না । ডাক্তারি স্বপ্ন মাটি চাপা দিলেন আম্মা-আব্বা । এসএসসি পড়েই আমার আরেক মামা আমাকে ভর্তি করালেন কম্পিউটারের অফিস এপ্লিকেশন কোর্সে । সেই কোর্সে যা পড়ায় আমি তার থেকে একটু এডভান্স , শুধুই টাইপিং আর এক্সেল এ একটু দুর্বল । তার জন্য মিলল সেই ইন্সটিটিউট এর মালিক এর সহযোগিতা । এগিয়ে গেলাম রকেটের বেগে । তার সাথে শিক্ষক এর কাজও ! সেম ব্যাচ এর ছাত্রছাত্রীদের জন্য ব্যবস্থা করা হল আরেকটা স্পেশাল কোর্স । যা পূর্বের ক্লাসের রিভিউ ক্লাস , যা আমি এবং ইন্সটিটিউট এর মালিক মিলে নিই । কি সাফল্য আর ইন্সপিরেশন । নিজের বয়সের সাতটা ছেলে আর এগারটা মেয়ে আমার সামনেই স্টুডেন্ট এর জায়গায় বসে আছে , এর থেকে বেশী কি হতে পারে যখন আমার বয়স পনেরো পেরিয়ে মাত্র ষোল ? পরিবার থেকে তখন এই সাফল্য দেখে ভর্তি করানো হল আরও এডভান্স কোর্সে । ২০১০ সালেই ভর্তি হলাম গ্রাফিক ডিজাইন এর বেসিক কোর্সে । সেখানেই পেলাম আরেকটা অধ্যায় । কালার জিনিসটা ছোটবেলা থেকেই টানে আমাকে । আর ফটোশপ আর ইলাস্ট্রেটরে তো এর কোন অভাব নেই ! শুরু হলও সব বাদ দিয়ে শুধুই গ্রাফিক শিখার কাজ । নিজের জন্য কম্পিউটারও এলো তখন । ১৪ ইঞ্চির ভেতর পড়ে থাকতাম সারাদিন ।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পড় আমার লাগাম টেনে ধরা হল । হঠাথ করে যেন নতুন পরিবেশে এসে পড়লাম । সারাদিন কম্পিউটারের বাহিরে কিছুই ভাবতে পাড়লাম না । তখন আবার নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়া , ভাল গ্রেড আনা , মেডিকেলে চান্স পাওয়া এগুলো নিয়ে পারিবারিক ম্যালোড্রামা শুরু হলও । মায়ের চুপসে যাওয়া মুখ দেখতে কার বা ভাল লাগে ? মায়ের জন্য বেঁছে নিলাম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা । আম্মা-আব্বা চাইলেন না আমি কম্পিউটার নিয়ে ভাবি । এটা নষ্ট হওয়ার একটা মাধ্যম হিসাবে আখ্যা পেল । এছাড়াও গ্রামের মানুষ হিসাবে আমার আব্বা মনে করলেন কম্পিউটার শিখে শুধু টাইপ রাইটার এর কাজ ছাড়া আর কোন কাজ পাওয়া সম্ভব না । আমার প্রতিবন্ধকতার পর প্রতিবন্ধকতা এলো । উদাহরণ এলো অমুকের ছেলে কম্পিউটার শিখে নষ্ট হয়েছে , তমুকের ছেলে কম্পিউটারের কাজ শিখে কোন কাজে লাগতে পারেনি । পড়ে গেলাম মানুষিক যন্ত্রণায় । আবারও আম্মা সদয় হলেন । অবশেষে দেড় বছরের পর আবার কাজ শিখা শুরু করলাম । এবার ইউটিউবও সঙ্গী । তবে আমি কখনোই ডাক্তারের উপযোগী হতে পারি নাই । আমার কারণেই আমার আব্বা আমাদের ফেমিলির আর কারো কম্পিউটার শিক্ষা এলাও করেন নি ।
২০১০ এর পর তৃতীয় এবং শেষবারের মত ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বদল করলাম । এখন একজন বড় মাপের গ্রাফিক ডিজাইনার হওয়ার ইচ্ছে । আর এর জন্য কাজ করছি বা শিখছি গত পাঁচ বছর ধরে । সেই সময়টা আর বেশী দূরে নাই হয়তো । তবে এখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য বেঁছে নিয়েছি বিদেশের মাটিকে । আল্লাহ যদি আমার শিক্ষার পথে আর কোন প্রতিবন্ধকতা না রাখেন তবে আশা আছে এই বছরই বিদেশের কোন গ্রাফিক ইন্সটিটিউট এর মাল্টিমিডিয়া ক্লাসে বসার থ্যাম ডেভেলপার গ্রুপ এ আছি UI Designer হিসাবে । আমি নিজের কাজের প্রতি অনেক সিকিউরিটি প্রধান করি তাই কখনো তা খুলাসা ভাবে বলিনা ,বা শো অফ করি না । মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে দুএকটা পোস্ট দেই ফেসবুকে , তবে সেগুলোও বিশেষ সিকিউরিটি বোর্ডিং পাস করে আসে । :p :v
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৫ সকাল ১১:২২