মিডিয়ার লোকদের সংসার টিকে না কেন?
আমি কলেজ লাইফে থিয়েটারে জয়েন করি। “লোকনাট্যদলে” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে চলত আমাদের গ্রুপের রিহার্সেল। ছোটবেলা থেকেই মিডিয়ায় কাজ করার স্বপ্ন। কিন্তু ফ্যামিলি অনেক কনজারভেটিভ, দিবে না। আর যদি জানে তাহলে ত খবর আছে।
তাও কিভাবে যেন আমার বড় ভাই জেনে যায়। তখন আমাকে একটা হতাসা নিয়েই বলেছিল
“ভাই,মিডিয়ার লোকেদের লাইফ কেমন যেন,সুখের হয় না”
ভাই আমার সালমান শাহ্ ভক্ত। তিনি যখন আমাকে কথাটা বলেন কেমন যেন মনে হয়েছিল। চিন্তায় ফেলেদিল। আশেপাশের কিছু ঘটনা দেখলাম, মিডিয়ার পারসনদের লাইফও দেখলাম,পড়লাম,জানলাম।
ছোটবেলায় শুক্রবারের সিনেমা দেখার পর স্কুল ফেরার পথে সারা সপ্তাহ ধরে চলত ছোটদের মত সিনেমা নিয়ে বিশ্লেষণ। যে দেখে নাই,তাকে সেই গল্প শোনানো।
সালমান শাহ্ মৃত্যু নিয়ে আমাদের মাঝে নানান ধরনের গল্প চলতে থাকত,কখনো বলতাম ডন মারছে কখনো মিশা সওদাগরকেও সন্দেহ করতাম। তবে ঘুরে ফিরে দোষ সেই সালমানের বউকেই দেয়া হত।
তখনি জানলাম শাবনূর আসলে সালমান শাহ্ র বউ না। তার সাথে ছবি করে শুধু। তার বউ আরেকজন। সে সালমান শাহ্কে শাবনূরের সাথে ছবি করতে না করে কিন্তু সালমান শাহ্ শুনে না,ছবি করে। তাই সালমান শাহ্র বউ ডনের সাথে মিলে সালমানকে খুন করে। (সালমান শাহর অনেক সিনেমায় ডন ভিলেন তাই এই ভাবনা) ত শাবনূর কেন প্রতিশোধ নেয় না,শাবনূর অন্য বেটার সাথে এখন ছবি করে। আসলেই এরা ভালো না। তখনকার ছোট মনে এই সব চিন্তাই হত।
কিছুদিন পর জানলাম আলমগির বিয়ে করেছে রুনা লায়লাকে। প্রমাণ হিসাবে পত্রিকাও দেখালো। তাদের নাকি দ্বিতীয় বিয়ে। শুনে একটু খারাপ লাগল। আলমগির শাবানাকে ছেড়ে দিল! লোকটা ত অনেক খারাপ। আর রুনা লায়লার বর না এড্রো কিশোর? দূর এড্রো কিশোর ত কনকচাঁপার সাথে। কিছুদিন পর দেখলাম জসিম শাবানা। আলমগির আরও কত কি! আস্তে আস্তে বড় হলাম আর ব্যপারটাও বুঝলাম এরা এক সাথে কাজ করলেও বউ-জামাই না।
যতই বড় হচ্ছি,পত্রিকা পড়ছি,দেশের টিভি চ্যানেল বাড়তেছে,আসলো এফএম যুগ। রেডিও টুডে,পরে ফুর্তি। এবার সব খবর আমার কাছে। কোন তারকার বাসায় কি রান্না হচ্ছে থেকে শুরু করে আজকে কোথায় যাচ্ছে,আড্ডা মাস্তি সব আমার হাতের মুঠোয়, সব তথ্য।
আরজে কিবরিয়া,আরজে তানিয়া,আরজে নওশিন,আরজে নীরব,প্রত্যয়,আরজে রুবি,রাসেল,সায়েম,রাজু,মারিয়া,লুবানা সহ আরও হাবিজাবি……. যাদের নাম বললাম এরা ছিল আমার আমার কাছে তখন এক একজন সেই টাইপের। তাদের দেখি নাই তাও কল্পনায় সাজিয়ে নিতাম। যে মানুষগুলো এত সুন্দর করে কথা বলে না জানি তারা কত দুন্দর।
এফএমের আরজেরা যখন হিট,তখন তারা টিভিতেও আসা শুরু করল। তাদের চেহারাও দেখার একটা সুযোগ হলো।
“আরজে রাজুরে টিভিতে দেখে মনে মনে কত না বকা দিছি,বেটা কাইল্লা,তুই এত সুন্দর কথা বলস কিভাবে? আরজে নীরবরে যখন বাংলা ভিশনে ফোনে এক মেয়ে ন্যান্সির সামনে বকা দিছে তখন মনে হয়েছিল,শালায় আসলেই একটা লুইচ্চা,চেহারাটাও কেমন যেন। ন্যান্সির সাথে এমন এমন করে কথা বলে কেন””
আরজে প্রত্যয় সুইসাইড করেছে..
বাংলাদেশের রুপ তিব্বত বিউটিকেয়ার সোপ,তিন্নি শুনলাম হিল্লোল নামের ছেলের সাথে প্রেম পরে ছাড়াছাড়ি, আরজে নওশিন আরজেগিরি ছেড়ে হিল্লোলের সাথে। তারপর জানেনই।
হাইস্কুল লাইফে
“ভেজা হাওয়া,ভিজে যাওয়া….. টাওয়েল মাথায় প্রভা,ভালই লাগত মেয়েটাকে”
কলেজ লাইফে বুঝলাম ভালই লাগে,কয়েক মাস যেতেই জানতে পারলাম তার স্ক্যান্ডেল বের হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম কোন সেলিব্রেটির স্ক্যান্ডেল। দেশের তরুনরা যে কতটা পর্নগ্রাফিতে আসক্ত তা সেই ভিডিওই প্রমান করেছিল।
অনেক অনেক মন খারাপ হয়েছিল সেদিন। এর পর থেকে অপুর্বর নাটক খুব একটা দেখা হয় না।সেও নাকি বাসায় মেয়ে,মদ কি কি করে…..
মিডিয়ায় নতুন নতুন কিছু মেয়ে আসতে থাকল। সারিকা,শখ,মোনালিসা,নিলয়,নীরব, ইমন। বাংলালিংক বিজ্ঞাপনে এদের ভালই লাগত। যে বাংলালিংকের এড করে সে ই হিট।
এর কিছুদিন পর জানলাম ন্যান্সি বিবাহিত,প্রেম করেই বিয়ে করেছে। ক্লোজআপের সালমার বিয়ে হলো,গাইকা মমতাজের পরিকায় করে,মানিকগঞ্জ র কোন এক ডাক্তারের সাথে, পত্রিকায় পড়লাম।
আস্তে আস্তে ভালো লাগা সব মেয়েগুলোর বিয়ে হয়েগেল। যেভাবে তাদের একটার পর একটার বিয়ে হয়েছে তাদের সংসারও ভাঙ্গা শুরু হলো একটা একটা করে।
সারিকা,শখ,মোনালিসা,সালমা,ন্যান্সির সংসার ভেঙ্গেগেল।
আর আগে আমার পছন্দের শিল্পী “দুই বধু এক স্বামী, নাম তার আরিফিন রুমি” সেই লঙ্কা কান্ড। এখন লোকে তার নাম বলার আগে লুইচ্চা কথাটা যোগ করে। বিয়ে নিয়ে, সংসার নিয়ে ত কম করল না। সিনিয়ররা বলতে শুরু করল “গুরু জেমসের”ও নাকি একই দোষ ছিল,নারীদের প্রতি সেই আকর্ষণ। শাফিন আহমেদ,হুমায়ুন ফরিদি-সুবর্না কত কি জানলাম। হাবিব ওয়াহিদেরও বিয়ে ভেঙ্গেগেলো দায়ি মিডিয়ারই কোন এক নারী।
বিশ্বাস হতে শুরু করল মিডিয়ার লোকেদের সংসার লাইফ আসলেই সুখের না। এরা আসলে বিয়ে করেই ক্যান? ছাড়েই কেন?
হ্যাপি-রুবেলের স্ক্যান্ডেল নিয়ে ত কম হলো না। মিডিয়ার মেয়েই খারাপ,সবার সাথেই এরা শুইতে পারে। এই অপবাদ দেয়া শুরু হলো,ক্রিকেটার আরাফাত সানী তার সর্বশেষ শিকার।
প্রথম যখন পরিচালক হিসাবে একটা শর্টফিল্মের ডিরেকশন দিলাম,অনেকেই জেনেগেল আমি মিডিয়ায় কাজ করি। এত দিন মঞ্চে চুপচাপ থাকলেও এবার ক্যামেরার সামনে।
শুরু হয়েগেল আমাকে নিয়ে কাছে বন্ধুদের ফিসফাস, স্কুলের বান্ধবী কল দিয়ে বলল
”তর সাথে ত এখন খুব বেশি কথা বলা যাবে না,মিডিয়ার লোকত ভালো না”
ছোট ভাইয়ের বন্ধু বলল “আমার লিখা একটা স্ক্রিপ্ট ডিরকশন দিবেন? আমি কিন্তু কিছু করতে,পারব না!”
- করতে পারবা না, মানে কি?
--মিডিয়ার লোকেরা ত ভালো না,কোন কাজ করলেই নাকি তারা কি কি করে……
দেশ টিভিতে আমার একটা প্রোগ্রাম আসবে,পাশের বাসার ভাবিকে বলছিলাম,ভাবি বলল পাশের আন্টিকে। আন্টি এবং আন্টির মেয়ে এখন আমাকে উল্টাপাল্টা ভাবে। আন্টির মেয়ে ত আমার ফেসবুক টাইমলাইন রিতিমত স্কেন করে। কোন মেয়ে আমার লিষ্টে আছে,কারে আমি লাইক দিয়েছি,কোথায় কমেন্ট করলাম। স্ক্রিনশট সহ ম্যাসেজ দিবে। “মিডিয়ার মানুষ যে খারাপ আগেই বলছিলাম,মেয়েদের সাথে ছবি তুলেন,এমন মেয়ে আপনার লিষ্টে, এই মেয়ে আপনার পিকে লাভ রিএক্ট দেয়”
বন্ধুরা ভাবে নাইকা নিয়া উল্টাপাল্টা কাজ করা আমার কাছে কোন ব্যপারই না,প্রবাসী এক বড় ভাই বলল মিডিয়া খারাপ,কেন মিডিয়ায় আসছ?
তাকে জানালাম মিডিয়ায় খারাপ কিছু হয়,আর আমি এই খারাপ তাড়ানোর জন্যই মিডিয়ায়,দেখি কতটুকু পারি। আল্লাহ জানে কতটুকু পরব।
আজ যদি আমার গায়ে মিডিয়ার তকমা না থাকত তাহলে আমার স্বাভাবিক কাজগুলাও তাদের কাছে সন্দেহজনক বা অস্বাভাবিক মনে হত না! আর আমি যে কাজগুলো করেছি সেটা সমাজের কিছু অসঙ্গতি নিয়ে,সমাজ সচেতনতামুলুক। তাও এত সমস্যা।
সবারই ধারণা মিডিয়া মানেই খারাপ,যারা মিডিয়ায় কাজ করে তারা খারাপ। বনানী ঘটনা,ইয়াব ডন কার্লোস সহ সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা এই ধারনা আরও জোড়ালো হলো।
মিডিয়ার ভালো কাপল এবং সবাই যে উদাহরণ দিতো তাহসান-মিথিলার। সেটাও ভেঙেগেলো!
এবার আসলেই প্রশ্ন জাগালো সবার মনে? এরা বিয়ে করেই কেন আবার বিয়ে ভাঙ্গেই বা কেন? মিডিয়ার লোকেরা আসলেই সংসারী হয় না? এদের দিয়ে সংসার,ঘর হয় না।
বর্তমানে ঘটনাটা সত্যিই মনে হচ্ছে আপাদ দৃষ্টিতে। কারন?
“”আমাদের দেশে শুধু মিডিয়া না যাদের একটু নাম ডাক আছে, বিশেষ করে খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদ তাদের সবার দিকেই আমাদের নজর থাকে। পত্রিকা, টিভি,ফেসবুক, অনলাইন অফলাইন সবখানেই আমরা তাদের খোঁজখবর রাখি। আমাদের পারসোনালিটি বা পছন্দ হিসাবে এক একজনে সেলিব্রেটি বা নিজের পছন্দের তারকা করে নেই। বাংলাদেশে এমন তারকা খুব কমই,গুটি কয়েকজন, যাদের দিকে সবার দৃষ্টি থাকে। আর তারা ত মানুষ, আমাদের যেমন দোষত্রুটি থাকে তাদেরও আছে। আজকে আমি আপনি রাস্তায় কলার খোসা ফেললে এটা কেউ নটিচ করবে না কিন্তু আজকে শাকিব খান বা সাকিব আল-হাসান যদি একই কাজ করে,পত্রিকায় নিউজ হবে। চারদিকে ছিঃ ছিঃ ছিঃ শুরু হয়েযাবে।””ভালো মন্দ সবখানেই আছে কিন্তু সেলিব্রেটিদের দোষটা আমাদের চোখে বেশি পরে। এটা হলো একটা কারণ।
আরেকটা কারণ আছে…..
“”আপনি যদি সারাদিন বাহিরে থাকেন কাজের জন্য,মাসের পর মাস। আপনার পাশের ছেলে বা মেয়ে কলিগের সাথে। কাজের জন্যই আপনাদের হাত ধরা,নাচা বা অভিনয় করতে হয়। আপনার মাঝে কিছু উইকনেস তৈরি হবেই,এটাই স্বাভাবিক।
আপনার ওয়াইফ/স্বামী যদি আপনার বন্ধুর সাথেই একটু বেশি মিশে আপনার একটু খারাপ লাগবেই। আপনি পৃথিবী সবচে খারাপ লোক হলেও কিছু জিনিশ একান্তই আপনার,যা কাউকে ভাগ দেয়া যায়না,কেউ দিতে চায় না। তৈরি হতে পারে সন্দেহ বা মানুষিক একটা যন্ত্রণা। এর এটা বেশি পরিমানে হলে তখনই সাজানো সংসার ভেঙ্গে যায়। মিডিয়ার লোকদের এটা বেশি হয়,তৃতীয় ব্যক্তির কারনে সংসার নষ্ট””
অনেকে আছে নিজের অবস্থান পরিবর্তন হলে আগের সম্পর্কটা বাদ দিয়ে সমাজের উঁচু শ্রেণীতে নতুন সম্পর্ক করতে চায়। ক্রিকেটার শহীদের স্ত্রী তার বিরুদ্ধে এমন অভিযগই করেছে।
আমাদের সমাজে স্বামী, স্ত্রী দুজনেই জব করে বা স্বাধীনচেতাদের ভিতর ডিভোর্সের পরিমান বেশি। হয়ত তা খবরে আসে নয়ত না। কিন্তু দোষ সেই মিডিয়ার ২/৩ শ লোকের উপরেই পরে।
তবে একটা সংসার বা রিলেশনশিপ টিকিয়ে রাখার জন্য দুজনের মধ্যে বিশ্বাস সহ ভালো বুঝাপড়া, পরস্পরকে ছাড় দেয়ার মানুষিকতা,সম্মান করা প্রয়োজন। না হয় কোন রিলেশনশিপই টিকবে না! টিকতে পারেনা।
ভালো থাকুক সব ভালো সম্পর্কগুলো!