নুহা
নুহা-২
নুহা-৩
নুহা-৪
নুহা-৫
অন্যদিন তেমন খিদে পায় না আমার কিন্তু আজ সকাল আর দুপুরের মাঝামাঝি সময়ে একটা স্যান্ডউইচ খেয়েছিলাম ,তারপর বাসায় ফেরার পথেই তো শবনমদের সাথে আবার অস্টিয়া চলে আসতে হলো। এই ফাঁকে এক কাপ কাপুচিনো ছাড়া আর কিছু খাওয়া হয়নি। তারচেয়েও ঘরে ফিরে ঘুমাবার প্ল্যান করেও ঘুমাতে পারিনি বলেই কিনা জানি না বেশ জোরেশোরে খিদেটা উঁকি দিচ্ছে থেকে থেকে।
সূর্যের তেজ এখন আর নেই-ই ধরতে গেলে। সেই ব্রীজের ওখান থেকে উঠে আমি আর শবনম এমনিতেই লক্ষ্যহীনভাবে হাঁটছিলাম ঠিকই কিন্তু আমার চোখ এপাশ ওপাশে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো কোনো টার্কিশ রেস্টুরেন্ট পাওয়া যায় কিনা। ওদের বানানো শর্মা খেতে খুবই মজার ! শবনের কথার সাথে তাই তাল মেলাতে পারছিলাম না আমি। আমার মাথায় ভন ভন করে ঐ একটা ব্যাপারই ঘুরপাক খাচ্ছে যে আমার খিধে লেগেছে, তাই বিকল্প কিছু ভাবা সম্ভব হচ্ছিলো না আমার পক্ষে।
- কিরে নুহা, ঐখানে কই যাস ?
- শর্মা খাবো, খিধে লাগছে।
- ক্যান , দুপুরে খাস নাই তুই ?
- আয় তো , আগে রাস্তা পার হয়ে নেই ! হলুদ বাতি কিন্তু এখনি লাল হয়ে জ্বলে উঠবে
শবনমের জিজ্ঞাসার সাথে পাল্লা দিয়ে পথ পারাপারের বাতিটা লাল হয়ে যাওয়াতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন মিনিট এখন দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কেমন রাগ রাগ লাগছে একটু ! কি আজব ব্যাপার , মাথা থেকে খিদের ব্যাপারটা সরাতেই পারছি না । আর খিধে বেশী লাগলেই আমার পেট ব্যথা করতে থাকে।
- কিরে আজকে দুপুরে খাস নাই তুই ?
- সেজন্যই তো বাসায় যাচ্ছিলাম তখন ! খেয়ে ঘুমাবো ভেবেছিলাম ! আয় তাড়াতাড়ি , আবার দেরী হলে আরেকটা সিগন্যালে পড়তে হবে। বলে আমি আর ও তাড়াতাড়ি রাস্তাটা পার হই।
- আমি কিন্তু খামু না , আমার জন্য অর্ডার দিস না। তুই খা।
- আলী ভাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস কর উনি খাবে কিনা তাহলে যাবার সময়ে নিয়ে যাওয়া যাবে।
আমি নিজের জন্য একটা শর্মা আর একটা ফানটার অর্ডার দেই, সাথে আলী ভাইয়ের জন্যও একটা চিকেন শর্মার অর্ডার দেই পার্সেল করে নেবো বলে। শবনম যতই বলুক ও খাবে না কিন্তু আমি জানি আমার কাছ থেকে একটু শর্মা ওকে খেতে দিলে ও ঠিকই খাবে। খাবে আর খেয়ে বলবে - ইশশ কত্ত মোটা হয়ে যাচ্ছি রে ! আর খাবো না ! ও অবশ্য মোটা শব্দের চেয়ে ধুমসী শব্দটা বলে নিজের আকার দেখাতেই বেশী মজা পায়। এতো এতো সমস্যার মাঝে থেকেও ও যে কী করে হাসে , ফূর্তির মাঝে থাকে ! শর্মা খেতে খেতে ফাঁকে ফানটার ক্যানেও আমি ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছিলাম।
- কিরে খাবি নাকি একটু ? বলে শবনমের দিকে শর্মার এক কোণা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেই।
ও হাসতে হাসতেই শর্মার টুকরোটা নেয়। এ দোকানটা তেমন একটা বড় না। আর এখানে বেশীরভাগ ক্রেতাই খাবার নিয়ে বাইরে চলে যায়, ভেতরে বসে খাবার মতো তেমন একটা জায়গা নেই ছোট একটা টেবিল ছাড়া । তবে সন্ধ্যার পর এসব দোকান বেশ ভালো চলে , একেবারে গভীর রাত পর্যন্ত। এই মুহূর্তে দোকানে তেমন ভিড় ছিলো না বলে আমি আর শবনম টেবিল ফাঁকা পেয়ে বসে বসেই খাচ্ছিলাম। আলী ভাই ইতিমধ্যেই তার মালের গাড়ি গোছাতে শুরু করেছেন হয়ত। কারণ শবনমের কাছেই শুনেছি সব গুছিয়ে নিয়ে কার্টনে প্যাকেট করতেও নাকি ঘণ্টাদেড়েক সময় লাগে। দোকানের বিল মিটিয়ে আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এবার হাঁটতে লাগলাম আলী ভাইয়ের ব্যবসা আজ যে স্পটে বসেছে সেখানের উদ্দেশ্যে। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁই ছুঁই করলেও সন্ধ্যা তার আলো ছড়ায়নি পুরোপুরি এখনো। বেশ ঠাণ্ডা একটা হাওয়া দিচ্ছে। তবে শর্মার দোকানে গরম চুল্লির কারণে আগুনের তাপ বেশী লাগতে পারে এমনটার কারনেও বাইরের বাতাস ঠাণ্ডা লাগছিল হয়তোবা।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বাজতে পারে এমনটাই বলেছিলো আলী ভাই । সন্ধ্যায় রেজা ফোন দিবে বললেও ফোন দেয়নি আর ওর বিরক্তিতে ভরা কণ্ঠস্বরটা এখনো আমার কানে বাজছিলো বলে আমিও আর ইচ্ছে করে ফোন দেইনি। এটা আমিও মানি কাজ শেষ করে ঘরে ন আফিরে অন্যান্য কাজ সেরে ঘরে ফিরতে কিংবা ঘরে ফিরে ঠিকমত চাবি খুঁজে না পেলে বা গেট খুলতে দেরী হলে মেজাজ আমারও খারাপ হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে রুটিনের বাইরে চলতেও যে রেজার এতো অনীহা এটাই আমার রাগ লাগে ! রোজ তো আমি একা একাই সময় কাটাই ঘরে ঘুমিয়ে , মুভি দেখে বা বাইরে হেঁটে হেঁটে। একটা সন্ধ্যা বা একটা মুহূর্ত তার কাছে আমি চাইতেই পারি --- এটাই যেন সে বোঝে না বা এটা ভাবার মতো একটা মন তার নেই , ব্যাপারটাই অদ্ভুত ! এসব ভাবতে ভাবতেই আমি আর শবনম টুকটাক কথার ফাঁকে ফাঁকে আলী ভাইয়ের এখানে পৌঁছে গেলাম। আলী ভাই তার জরুরী কয়েকটা ফোন সেরেই আমাদের নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন বাসার উদ্দেশ্যে।
- দুই বান্ধবী নিশ্চয়ই আজ অনেক গল্প করেছেন ! পেট ভরেছে তো কথা বলে !
আলী ভাই আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেও শবনমই উত্তর দেয়।
- ভরলো আর কই !
- সেটা তো বুঝতেই পারছি। বাসায় ফিরাও তো আবার ফোনে তোমাদের আধা ঘণ্টার নিচে গল্প না করলে হয় না ! ঠিকঠাক মতো বাসায় তোমরা পৌঁছলা কিনা এই খবর বলতে বলতেই পনেরো মিনিট পার হয়ে যায় তোমাদের। বলে উনি হাসতে থাকেন। ড্রাইভিং এর ফাঁকে ফাঁকে উনি অবশ্য উনার জন্য কিনে আনা শর্মাও খান আর বলেন - আমারও অনেক খিদে লাগছিলো আজকে ! এতো ভিড় ছিলো দোকানে, একটা সিগারেট পর্যন্ত খেতে পারি নাই।
- এখন আবার সিগারেট ধরাইবা না চিংকু , খবরদার ! গাড়ি থিক্যা নাইম্যা যামু কিন্তু ! শবনম আর চিঙ্কুর মানে আলী ভাইয়ের খুনসুটি চলতেই থাকে। আমি গাড়ির সিটে মাথাটা হেলান দিয়ে একটু সময়ের জন্য চোখ বন্ধ করি।
- নুহা , রেজা ভাই কি আপনাকে নিতে আসবে , কিছু বলছে ?
- আমার সাথে সন্ধ্যার পর ওর আসলে কথা হয়নি। ওর মোবাইলটাও বন্ধ পাচ্ছি , মনে হয় ও যে ফ্লোরে কাজ করে নেটওয়ার্ক নেই ।
- সমস্যা নাই , আমিই নামাইয়া দিয়া আসবো।
গাড়িতে কিছুক্ষনের নীরবতা নেমে আসে। আমার কেমন জানি ঘুম ঘুম পাচ্ছিলো। বাসায় ফিরেই যদি কোনোদিকে না তাকিয়ে ফ্রেশ হয়ে সোজা বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারতাম ! যা ভাবি সেটা সবসময় হবার নয়। রাতের জমাখরচ বুঝিয়ে দিয়ে তবেই না ঘুমাতে হবে আমাকে!
শবনমরা আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাবার পর ঘরে ঢুকেই দেখলাম রেজা বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা প্রোগ্রাম দেখছে। তার হাসি হাসি মুখ দেখে অনুমান করে নেই বাসায় সে অন্তত ঘণ্টাখানেক আগে ফিরেছে। এখন ঘড়ির কাঁটায় সময় রাত এগারোটা। সে চাইলেই পারতো আমাকে শবনমদের বাসা থেকে নিয়ে আসতো কিংবা নিদেনপক্ষে একটা ফোনও দিতে পারতো।ব্যাপারটা ভেবেই মনটা কেমন বিরক্তিতে ভরে যায়। কিন্তু তাকে কিছু বলা হয় না।
- কি আজ খুব ঘুরলা নাকি ?
- নাহ তেমন একটা না। সমুদ্রের ওখানে যে ব্রীজটা ছিল ওখানে বসে ছিলাম।
- সমুদ্র তো তোমার প্রিয় জায়গা ! ওখানে গেলে তো আমাকেও ভুলে যাও ! হাহাহহা
- তোমাকে কবে কবে মনে রাখি এটাও আসলে একটা কথা ! খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা ! আমার কথার ধরণে রেজা হয়ত কোনো পোড়া গন্ধ টের পায়। আর তাতেই সে প্রসঙ্গ বদলে জানতে চায় আজ কি আলী ভাইয়ের অস্টিয়াতে ব্যবসার পোস্ট পড়েছিল নাকি ?
আমি ব্যাগ আলমারিতে রেখে ওয়ারড্রব থেকে জামাকাপড় বের করতে থাকি পড়নের পোশাক বদলে নেবো বলে। রেজার কথার উত্তর দিতে ক্লান্তি লাগছে আর উত্তর দিলেই আমি হয়তো ঝগড়া করে ফেলবো বলে চুপ থাকি।
- জামা বদলাইতে আবার ফ্রেশরুমে যাইতাছ ক্যান ? এই রুমেই বদলাইয়া ফালাও।
রেজার মুখে কেমন খুশী খুশী এক আভা। আজ শেভও করেছে দেখা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই এখন ইনিয়ে বিনিয়ে আমার প্রশংসা শুরু করবে। আর ওর এই লক্ষণের সাথে আমি বেশ পরিচিত। বাইরে থেকে ঘুরে আসলে আমার খুব ক্লান্ত লাগে । তখন আর রেজার শারীরিক কোনো আহ্বানে সাড়া দিতে ইচ্ছে করে না। আমি ফ্রেশরুমের দিকেই পা বাড়াই। বাইরে থেকে এসে শাওয়ার নেয়া আমার অভ্যাস হলেও এই মুহূর্তে আর ইচ্ছে করে না শাওয়ার নিতে। কারণ রেজার সাথে বিছানায় সময় কাটাবার পর আবারো আমাকে শাওয়ার নিতেই হবে ভেবে চোখে মুখ এপানি দিয়ে ঝটপট বেরিয়ে আসি। রান্নাঘরে ঢুকে বুঝতে পারি রেজা বাসায় এসে খায়নি। অবশ্য আমি রোজ রান্না করিও না কারণ আমাদের রাতের খাওয়াটাই শুধু একসাথে হয় । তাই নিজের জন্য নতুন করে রান্না করতে ইচ্ছে করে না ।
- রেজা , খাবার গরম করতে দিয়েছি। খাবে এসো !
- আমি অফিসেই খাইয়া নিছি। তুমি খাও। পারলে এক কাপ কফি দিও। এমন বৃষ্টির দিনে চা- কফি না হইলে চলে !
- এতো রাতে কফি খেতে চাচ্ছো যে , পরে তো ঘুম আসবে না !
- তোমার সাথে কফি খেতে খেতে গল্পগুজব করবো ভাবলাম , তাই কফি খাইতে চাইলাম
- আচ্ছা , এনে দিচ্ছি ।
বলে আমি রুম থেকে বের হতে হতে শুনলাম - তোমার লাইগ্যাও কফি আইনো।
মেজাজ খারাপ হলেও আমার মাথা ব্যথার কাঁটা মনে হয় সর্বচ্চো গতিতে বাড়তে থাকে। সে হিসাবে কফি খেলে মন্দ হয় না। বাসায় নেসক্যাফে গোল্ডটাই রাখি সবসময়। খুব একটা কড়া না এর স্বাদ।
- নুহা, আমার মোবাইলটা চার্জে দাও তো ! মোবাইলে চার্জই নাই !
- ওহ এজন্য ফোন করতে পারো নি বুঝি ! ওর অজুহাত শুনে মনে মনে বিদ্রুপের একটা হাসি খেলা করে যায় আমার মাঝে নীরবে।
- রাগ করলা নাকি নুহা বিবি ? ব্যস্ত হইয়া গেছিলাম তাই পরে আর ফোন করতে পারি নাই।
- নাহ রাগ করবো কেন ! তুমি তো আমার মতো ভবঘুরে না !
- হইছে আর গাল ফুলাইতে হইব না , এখন কাছে আসো তো ! লাইট টা নিভাইয়া দিও ।
আহ ! এই কাছে আসার মানে একেকজনের কাছে একেক রকম ! কাছে আসার পরেও কেন যেন সবাই কাছে আসতে পারে না ! প্রত্যেকটা সম্পর্কের মাঝে একটা সম্মানজনক ফাঁকা জায়গা থাকা দরকার ! এটা অনেকেই বোঝে না ! রেজার কাছে " কাছে আসার " মানে আর আমার কাছে " কাছে আসার মানে " এর মাঝে বিস্তর ব্যবধান কাজ করে বলেই আমি রেজার ঠোঁটে ঠোঁট রাখার পরেও ও আমাকে ভীষণ করে ওর গায়ের সাথে মিশিয়ে দিতে চায় আর বলতে থাকে ' আরও কাছে আসো নুহা , আরও কাছে ! ' সে সময়ে আমি কী করে যেন বধির হয়ে যাই , সৃষ্টিকর্তার কাছে সেই মুহূর্তের বধিরতার জন্য কৃতজ্ঞতা অনুভব করি।
চলবে