নুহা
নুহা-২
নুহা-৩
দানিয়েলের দোকান থেকে বেরিয়ে আমার কোথাও যাওয়ার তেমন তাড়া ছিলো না। দুপুর প্রায় একটা বাজতে চললো। তবে এই এলাকায় মাস তিনেক হলো নতুন একটা অর্নামেন্টস এর দোকান হয়েছে হোয়াইট গোল্ডের। ওখানে গত সপ্তাহে এক জোড়া কানের দুল দেখেছিলাম। ওখানে দামী এবং মধ্যম বাজেটের সব ধরণের অর্নামেন্টসই পাওয়া যায় । তবে আমি শেষের শ্রেণীর ক্রেতা তাই ঐ দোকানের সামনে দিয়ে গেলে দামী গয়নার দিকে পারতোপক্ষে নজর দেই না। আজকে ব্যাগে টাকা আছে বলে চিন্তা করলাম সেখানে একবার ঢুঁ মারব যদি এর মধ্যেই ঐ সাদা পাথরের কানের দুলটা কেউ না কিনে থাকে। কারণ রেজা আমাকে যা হাত খরচ দেয় তাতে প্রতি মাসেই আমার কাছে একশো থেকে দেড়শো ইউরো বেঁচে যায় অন্যান্য খরচ মেটাবার পরেও।
আজ বৃষ্টির দিন কিনা বলেই কে জানে অন্যান্য দিনের তুলনায় রাস্তায় পায়ে হাঁটা মানুষের সংখ্যা একটু কম। আর যারা দৈনন্দিন কাজে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে বা কাজের জায়গায় যায় তাদের কথা আলাদা। এই মার্কনির রাস্তায়ই অনেক বাঙালি তাদের পসরা সাজিয়ে বসে যেখানে ঘরের দৈনন্দিন তৈজসপত্র থেকে শুরু করে কসমেটিকস , গানের / মুভির সিডি , স্টোনের অর্নামেন্টস , ফুল অনেক কিছুই পাওয়া যায়। কিন্তু তারা বেশির ভাগই অবৈধ পথে আসে বলে তাদের এভাবে ফুটপাতের ব্যবসাটা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায়ই পুলিশ এসে তাদের জিনিসপত্র নিয়ে যায় , ক্ষেত্রবিশেষে জরিমানার টিকিট, জেল অনেক কিছুর মুখেই পড়তে হয়। প্রথম প্রথম এখানে এসে তো আমি দূর থেকে কোনও বাঙালি ভাইকে দেখলেই অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতাম বা তাদের সামনে দিয়ে যেতাম না। কারণ স্বদেশীদের সামনে তারা এভাবে ব্যবসা করতে লজ্জা পেলেও বিদেশীদের কাছে ছিলো বেশ স্বচ্ছন্দ। অবশ্য এখন সময়ে অনেক কিছুই সয়ে গেছে বলে রাস্তায় বসে এভাবে ব্যবসা করা আসা-যাওয়ার পথে পরিচিত কয়েকটা মুখের সাথে পরিচয় হয়ে গিয়েছিলো। আজ বৃষ্টির জন্য তারা বসতে পারেনি বুঝলাম। তাদের কাছে বৃষ্টিটা একটা অভিশাপের মতো । লাখ লাখ টাকা খরচ করে এসে পরিবারকে স্বাচ্ছন্দ্যের পরশ দিতেই তারা কতই না কষ্ট করছে , কতটা মানবেতর জীবনযাপন করছে , গাদাগাদি করে এক বাসায় থাকা, খাওয়া- দাওয়া হিসেব করে করা , মাঝে মাঝে পুলিশ বাসায় এসে তল্লাসি চালালে সারাদিন রাত্রির জন্য বাসার বাইরে থাকা সহ কতই না যন্ত্রণা! শুধু এটা যে বাঙালিদেরই সহ্য করতে হতো সেটা না , চাইনিজ, রোমানিয়ান , সুদানি, রাশিয়ান যারা অবৈধ ভাবে স্টে পারমিশান ছাড়া আছে তাদের সবার জন্যই প্রযোজ্য।
আগে এসব দেখে বা শুনে খুব কষ্টে আমার দিন যেতো , এরকম কত কত দিন তাদের খাওয়া হয়নি শুনে আমিও না খেয়ে থেকেছি , পরিচিত কিছু বাঙালির মুখে চোরা পথে তাদের ইউরোপে পৌঁছানোর কথা শুনে, পথে কারো কারো মারা যাবার ঘটনা শুনে শিউরে উঠতাম, দুঃস্বপ্ন দেখতাম বলে রেজা আমাকে এসব ঘটনা আর জানাতে চাইতো না । এখন আর আগের মতো এসব ঘটনা শুনে বা দেখে কাতর না হলেও বাংলাদেশে ফোনে কারো সাথে গল্প হলে এগুলোর কিছু জানাতে ভালো লাগে না । আর দেশে ফোন করতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করি। রোজ মা'কে ফোন দেয়া আমার অভ্যাস থাকলেও এখন সপ্তাহে দু/ তিনদিন ফোন দেই । দেশে সবাই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত। কেউ কথা শুনতে চায় না আর ফোন দিলে খালি বলতেই চায় নিজেদের দুঃখের কথা, অপ্রাপ্তির কথা। মায়ের সাথে কথা বললেও দেখি সেও কেমন হাই তুলে তুলে কথা বলে। তাই আর কাউকে মনে চায় না বিরক্ত করি ফোন করে। বাবাকে অবশ্য রোজ দিন পাই না ফোনে। বাবার ইউরোপ নিয়ে অগাধ কৌতূহল। কী ধরনের খাবার খাই , রাস্তা কতটা পরিষ্কার , বাসের রঙ কী, বাসগুলো দেখতে কেমন, সবাই গাড়ি নিয়ে চলে কিনা , রাস্তায় একা বের হতে ভয় পাই কিনা কত হাজারো প্রশ্ন বাবার ! কয়েকদিন আগে ফোনে বাবা জানতে চাচ্ছিলো -
- কি রে নুহা , তুই কি এখানে এসে জিন্স পড়িস নাকি ?
- আহা , এটা আবার কেমন প্রশ্ন তোমার, আমি লজ্জিত হয়ে বলি বাবাকে।
- না বিদেশে বাঙালিরা কেমন পোশাক পরে জানার জন্য আর কি !
- হুম , শীতের মাঝে জিন্স পড়ি তো !
- আচ্ছা তুই একটা চিঠিতে লিখেছিলি , বৃষ্টির সাথে নাকি কাদা পড়ে এখানে , আসলেই কি পড়ে ? নাকি আমাকে বোকা বানাচ্ছিস ?
আরে মেয়েটা এত দূর থেকে ফোন করছে জরুরী কথা বলতে আর তোমার খালি পোলাপাইনের মতো প্রশ্ন - দাও দেখি ফোনটা , বলে মা বাবার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নেয় ।
নাহ , মায়ের জ্বালায় বাবার সাথে মন ভরে কথা কখনোই বলতে পারি না । বাবাকে একটা মোবাইল কিনে দিতে হবে দেখা যায় । অবশ্য বাবাকে কিনে দিলে আবার মা রাগ করে গাল ফোলাবে। কোনও লোক বাংলাদেশে গেলে তাদের হাতেই পাঠিয়ে দিতে হবে মোবাইল , রেজাকে বলে রেখেছিলাম আগেই ।
হোয়াইট গোল্ডের কানের দুলটা কিনে ভাবছিলাম এরকম প্যাচপ্যাচে বৃষ্টির মাঝে এলোমেলো হাঁটাহাঁটি না করে বরং বাসায় গিয়ে একটা ঘুম দিবো। সকালে ঐ বদমেজাজি মহিলা দোনাতেল্লার কারণে ঘুমটা ভালো হয়নি। বাসায় ফেরার উদ্দেশ্যে এদিক সেদিক দেখতে দেখতে রাস্তায় ধীর পায়ে হাঁটতে থাকি। দুপুরে খাবারের এই সময়টায় রেজা ফোন দেয় প্রতিদিন , নিজে যখন খেতে বসে। এটা আমার কখনোই কেন যেন মনে হয়নি মন থেকেই সে এই কাজগুলো করে। বরং সময়ের কারণে এক সাথে থাকতে গেলে কিছু কিছু কাজ একটা সময় দায়িত্বের পর্যায়ে চলে আসে, একটা অভ্যাসে পরিনত হয়। রোজ একটা কাজ করতে করতে অবচেতনে হলেও মানুষ সেই নির্দিষ্ট সময় এসে মস্তিষ্কের নির্দেশ নিয়মমাফিক কাজটা করে। রেজার আমাকে ফোন দেবার ব্যাপারটাও ঠিক এমনই , যেমন করে আমার ভেতরেও একটা প্রতীক্ষার ব্যাপার কাজ করে - এই বুঝি ওর ফোন আসবে এখন ! ফোন আসেও কিন্তু ওর অদ্ভুত কথার ধরনে আমার ভেতরে ওর জন্য যে প্রতীক্ষার বলয়টা তৈরি হয় শেষ পর্যন্ত সে বলয়টা ভেঙেও যায়। একজন মানুষের মাথায় কী করে শুধু শারীরিক ব্যাপারের চিন্তাই সারাক্ষণ ঘুরপাক খেতে থাকে সেটা রেজাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। ওর সাথে ঝগড়া , ভালো কথা - মন্দ কথা সবকিছুই শেষ হয় এক তথাকথিত বোরিং বিষয় - যৌনতায় গিয়ে ! যেমন মাঝে মাঝে আমি কোনও কাজ না পেলে ওর অফিসে ফোন দিলে কিছুটা সময় অপেক্ষার পর যখন ওর এক্সটেনশন নাম্বারে ফোনটা যায় সে তো রীতিমত গদগদ হয়ে যায় আমার ফোন পেয়ে ।
- আরে , কী ব্যাপার তুমি ফোন দিছ !!! অ্যা ,তুমি ফোন দিছ আমারে ! অ্যা ?
তার অ্যা অ্যা করা আর অবাক ভাব কমলে আমি একটা পর্যায়ে কথা বলার সুযোগ পাই।
- ক্যান , আমি মনে হয় তোমাকে ফোন দেই না !
- না , দ্যাও ! কিন্তু এত কম ফোন দ্যাও তাই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি কি বাসায় তুমি না বাইরে বাইরে হাঁটতাছ ?
- বাসাতেই ! আজকে গা ম্যাজম্যাজ করছে , তাই বের হই নাই । বলে আমি একটু আড়মোড়া ভাঙার মতো শব্দ করি । কিন্তু গা ম্যাজম্যাজের কথা বলেই বুঝতে পারি রেজার ভেতরের আরেক রেজাকে একটা খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে দিলাম। কথা বলে সেটা আবার ফেরত নেবার সুযোগ থাকলে তাই করতাম।
- একটা পেইন কিলার খাও নাইলে ডাক্তারের কাছে যাও। ফোন কইরা দেখো আজকে এলিজার চেম্বার খোলা কি না ! আর আমি তো আছিই । রাইতে বাসায় আইসা গা ম্যাসাজ কইরা দিমুনে। শরীর এক্কেবারে ঝরঝরা হইয়া যাইবো । বলে ও কেমন হে হে করে বোকাদের মতো হাসতে থাকে। ও যদিও বোকা না কিন্তু ওর অনেক কাজই আমার আজব লাগে ! আমার এত প্রেম প্রেম ভাব আর শরীর বিষয়ক কথাবার্তা কেন যেন ভালো লাগে না ! সেই বিয়ের রাত থেকেই রেজাকে দেখছি ... চেনা নেই জানা নেই কেমন করে একজন পুরুষ মানুষ পারে একজন নারীর শরীর নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করতে ভালমতো মানসিক ব্যাপারগুলোর সাথে পরিচয় হবার আগেই ! উফ ভাবতেই কেমন কাঁটা দেয় আমার গায়ে। মাঝে মাঝে আমার কিছু কাজে রেজা আমাকে বলে আমি নাকি গর্ধভ টাইপ মেয়ে। খুব দ্রুতই রিএক্ট করি , ইমোশনাল হয়ে কান্নাকাটি করে যুক্তি ভুলে চিল্লাফাল্লা করি। রেজার মতো মানুষের কাছে আমি অবশ্য গর্ধভই । এটা নিয়ে আমার এখন আর অবাক হবার কিছু নেই।
ছাতা হাতে এই হালকা বৃষ্টির মাঝে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করাটা ঝামেলা লাগছে বলে দু'বার ফোন বেজে থেমে গেলেও আমার আর ফোনটা রিসিভ করতে ইচ্ছে করে না। নিশ্চয়ই রেজা ফোন করেছে। বৃষ্টি নিয়ে তার কমন রোমান্টিসিজমের সাথে আমার পরিচয় আছে বলেই আমার এখন ওর ফোনটা ধরতে তীব্র এক অনীহা কাজ করছে। কিন্তু ক্রমাগত মোবাইলের রিঙের যন্ত্রণায় স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখা সম্ভব হয় না বলেই ফোন রিসিভ করেই বলি -
- হুম বলো !
- কিরে , সারাক্ষণই কি তোর জামাই তোরে ফোন দেয় নাকি যে আমার নাম্বারটাও চিনিস না ?
-ওহ শবনম ভাবী ! কি করিস ?
- এই বৃষ্টির মধ্যেও তোর বের হইতে হইব ! তুই পারসও রে ! কই আছস এখন বল দেখি ?
- এই তো বাসার দিকে যাই। ঘুমাবো
- বাইত্তে যাইতে হইবো না । যেখানে আছস ঐখানেই দাঁড়া দুই মিনিটের মধ্যেই আইতাছি আমি চিংকুরে নিয়া ।
আমাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শবনম ভাবী ফোনের লাইন কাটতে কাটতে অপর প্রান্তে আলী ভাইয়ের গলার আওয়াজ পাই -
- তুমি সবার সামনে আমারে চিংকু কইয়া ডাকো কেন বুঝি না
- না খাইয়া খাইয়া সারাদিন কাজ করবেন , আপ্নারে চিংকু ডাকুম না তো কি করুম !
এই এক চমৎকার দম্পতি আলী ভাই আর শবনম ভাবী। কিন্তু যতক্ষণ এরা এক সাথে থাকে সারাটাক্ষন এদের ঝগড়া লেগেই থাকে। ঠিক খুনসুটিও না , সিরিয়াস টাইপের ঝগড়া যাকে বলে। এরকম কতদিন হয়েছে শবনম রাগ করে আমার বাসায় চলে এসে বলেছে - মনে কর এইটা আমার বাপের বাড়ি। আমি আর ওর সংসারে ফেরত যামু না। চিংকু , ঐ খবিসটা ফোন দিলে বলবি আমি তোর বাসায় আসি নাই । খুইজ্যা মরুক আমারে সারা রোম শহরে ! তার সাথে আমার যতটা না সম্পর্ক ভাবীর মতো তারচেয়েও বেশী বোনের মতো। এই প্রবাসে সেই আমার একমাত্র মানুষ যার কাছে গেলে আমার মনটা নির্মল আনন্দে ভরে যায় ! দুই মিনিটের মাঝে না হলেও মিনিট পাঁচেকের মাঝে দেখি ভিয়া মানচিনির রাস্তায় আলী ভাইয়ের গাড়ি পৌঁছে গেছে শবনম ভাবীকে নিয়ে।
( চলবে )
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৫৯