সভ্যতার বিবর্তনের সঠিক নিয়ম উদঘাটনের প্রশ্নে লক্ষ লক্ষ বছরের নিরন্তর ধারার কঠিনতম বাস্তবতা হলো ‘অসাম্য’ যেখানে সাম্য, ন্যায্যতার উল্টোপিঠে এ বিবর্তনের পথে গড়ে উঠেছে বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষের অভ্যন্তরীন শ্রেনীবীভাজন। আদর্শ পৃথিবীর বসতভূমি’র অপ্তবাক্যের আড়ালে “মানুষ” নামের উবে যাওয়া সত্ত্বায় অবদমিত শ্রেনী ‘নারীকুল’, যাতে দিগভ্রান্ত শতাব্দীর আরোপিত আত্নপরিচয় ‘শোষিত’ আর ‘পশ্চাদপদ’ লেপ্টে আছে । ডারউইন না হয় কাঠখড় পুরিয়ে মানুষের প্রাকৃতিক বিবর্তনের বিজ্ঞানভিত্তিক রহস্য তুলে এনেছেন কিন্তু অতীব সরল সমাজজীবী মানুষের প্রাকৃতিক লৈঙ্গিক পার্থক্যের রুপায়ন তো রহস্যে ঘেরা নয় তবে সেটি কিভাবে বৈষম্যে গিয়ে ঠেকেছে এবং প্রাকৃতিকতাকে অতিক্রম করে রূঢ় বাস্তবতায় এসে দাড়িয়েছে ?? কিভাবে এসেছে সেটি বিতর্কিত তবে কারা তা করেছে তা পরিষ্কার।
এই পুরুষই সমাজ নির্মাণ করেছে,এই পুরুষই ধর্মের অপবিধান ঝুলিয়েছে,এই পুরুষই অর্থনীতি লুন্ঠন করেছে এবং নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যেখানে শক্তি’ই সভ্যতার নিয়ামক ‘মানবিক সহাবস্থান’ নয় । সাধারনভাবে এই আরোপিত বিভাজনের নিগূঢ় ভিত্তি উন্মোচন করতে গিয়ে পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ ‘অবধারিত আলোচনা’ র বিষয়বস্তু যেটিতেই নারী নিগ্রহের প্রামাণ্য দলিল দেশকালের ,জাতির, সাহিত্যের,আধুনিকতার খেরোখাতায় হাজির । শতাব্দী তার আলকোজ্জলতার আবেদনকে ধারন করতে গিয়ে মানবতা আর সাম্যের পথে নারীবাদ নামের যে আন্দোলনধর্মী বিপ্লববাদ উচ্চারন করেছে সেটা ধর্ম কর্তৃক আক্রান্ত,সমাজ কর্তৃক আক্রান্ত সর্বোপরি এই জটিল চক্রের পুরুষতন্ত্র কর্তৃক আক্রান্ত । নিজের বৈবাহিক জীবন টিকিয়ে রাখার চিন্তা, সমাজ কর্তৃক কলঙ্কিত হবার চিন্তা, সতীত্ব টিকিয়ে রাখার চিন্তা সাধারনত একটি মেয়েকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এখন প্রশ্নটি হলো…অধিকার আদায়ের এই বিপ্লববাদ কি দিয়েছে এযাবতকালে???
প্রথাগত ,শাস্ত্রীয় নারীবাদের বিষয়বস্তু নারীর চিন্তার পরিধিকে একাডেমিক অবয়বে দাড় করিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র এবং চিন্তা করার পদ্ধতি বাতলে দিয়েছে কিন্তু এই তত্ত্বীয় দিকটি অনেক বিভ্রান্তিও ছড়িয়েছে। যেমন-
পশ্চিমা ধাচে পোষাকি খোলামেলাকে অধিকার বলে অনুবাদ করা ,সিনেমা নাটকের মতো করে নারীর নিজস্ব অবয়ব চিন্তা করা ব্যতীত শতাব্দীর এ কালে এসেও নারী বস্ত্রহীনতার মাঝে অধিকার খুজে ভ্রান্তিবিলাসে আচ্ছন্ন। অধিকারের জন্য যে বিপ্লববাদের উচ্চারন নারীকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো সেটাও পুরুষতান্ত্রিক শিনাজুড়িতে আক্রান্ত। তবে সভ্যতার কাছে মানবিকতার দায় মেটাতে গেলে মানুষকে মানুষ বলেই বিবেচিত হবার যে বাস্তবিক সত্যতা তা এখনো প্রকৃত চর্চায় এসেছে কি না সেটি বড় প্রশ্ন। প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া , বলিউডি অনুকরনে সিগারেট ফুঁকা নিশ্চিত অর্থেই নারীসত্ত্বার বিকাশকে নির্দেশ করা বুঝায় না বরং পুরুষবাদী যৌনকামনার উৎকট ছকে নারীসত্ত্বার বিসর্জনকে বুঝায়।
যেমন- সেকেলে শেকলসম হেরেমকন্যা আর আজকের রমরমা কর্পোরেট দুনিয়ায় নারীর সম্ভ্রমের মূল্য ঐ মনোরঞ্জনেই সীমাবদ্ধ। হেরেমের গোসল আর লাক্সের বিজ্ঞাপনের গোসলে যে অন্তত নারীবাদী লাভের অংক শূন্য সে কথা বিনাদ্বিধায় বলা যায়। অধিকারের ভ্রমাত্নক জারিজুরি শুধু পোষাক খুলে স্বল্পবসনা হওয়াতেই সীমাবদ্ধ ,পাশ্চাত্য ধাঁচে নিজেদের উপস্থাপনও সে বিভ্রান্তিরই অংশবিশেষ । কর্পোরেট গোষ্ঠীর পণ্যদূত হয়ে আবেদনময়ী চিত্রায়ন নারীদেহ উন্মোচন করে ভোগ্যবস্তুতে পরিণত করা ছাড়া কি দিতে পেরছে? না , কিছুই পারে নি বরং নারীর মানবিকতার সত্ত্বায় নেতিবাচকতা ভিন্ন কিছু ঘটে নি।
সমাজ তাঁর বিবর্তনের পথে যে অনিবার্য নিয়ম সৃষ্টি করেছে ‘সতীত্ব-সম্ভ্রম’ সেরকমই কিছু । আদতে সেই সম্ভ্রমচিন্তার প্রকটরূপটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে যেখানে পুরুষের সম্ভ্রম শরীরে সেটে দেয়া হয় না কিন্তু নারীর সম্ভ্রম শরীরে সাটানো থাকে এক জোড়া স্তনের মাঝে আর মাংশল যোণীর মাঝে কখনো সমগ্র দেহেই লোলুপ দৃষ্টি ফেলে যেনো জিঘাংসায় রত কোন বাঘ। ঈশ্বর যেমন তার একক মহীমায় বিশ্বাসী ,পুরুষ ঠিক তেমনি তুঘলকি কায়দায় এক নারীর সম্ভ্রম একা ভক্ষনের আয়োজন দাড় করিয়েছে ধর্ম দিয়ে অথবা তার একত্ব দিয়ে । সম্ভ্রমের আক্ষেপে সিনেমায় নায়িকার আত্নহনন তারই তো বহিঃপ্রকাশ কারন নারীই সমাজ থেকে ভাবতে শিখেছে তার সম্ভ্রমের খাদক কোন এক পুরুষ । নারীর সমস্ত চিন্তা শুধু তার বুকজোড়া নিয়ে সেখানে কখন কে হাত দিলো, কখনো তাঁর পশ্চাৎদেশ নিয়ে কখন কে হাত দিলো। এই চিন্তা করতে গিয়ে এক ভিন্নদেহগঠন নিয়ে যেনো অবর্ণনীয় সতীত্ব রক্ষার সংগ্রাম। এ এক পুরুষতন্ত্র বটে......। এই সতীত্ব রাখতে গিয়ে নারী কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ ছেড়ে দেয়,এই সংগ্রাম করতে গিয়ে নারী ঘরনী হতে শেখে । অন্ধকার রুপালী রাতে মানুষের স্তনদুটি নারীর স্তন হয়ে তখন লেতিয়ে পরে , নারীর জরায়ু সম্ভ্রম লুটেপুটে খাওয়ার হিংসাত্নক পশুবৃত্তি জরায়ুকে বানায় যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে নারীইচ্ছাকে থোড়াই কেয়ার। পুরুষতন্ত্রের সমাজ নারীকে শিখিয়েছে কিভাবে বুকে ওড়না রাখতে হয় ,পুরুষই তাকে বুঝিয়েছে সতীত্বের লুন্ঠন কিভাবে হয়,সমাজের আরোপিত এক বহুকালের প্রথা যেনো নারীর জন্য অকাট্য । পুরুষতোষনের এই সংগ্রাম করতে গিয়েই নারী পুরুষতন্ত্রের সমাজশৃঙ্খলের কাছে অসহায় আত্নসমর্পণ করে।
দুনিয়ায় যেদিন ব্যাক্তিগত মালিকানার ধারণা জন্মেছে সেদিন প্রকৃতির মাঝ হতে শ্বাপদশংকুলের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বশ করেছে সবকিছুকে, অন্যদিকে এই শিশ্নধারী একগুচ্ছ মানুষ সেই মালিকানা হস্তগত করেছে। আবার লড়াই এর প্রতিপক্ষ পরাভূত হবার সাথে সাথেই শিশ্নহীনদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে শৃঙ্খলিত করতেই মাতৃত্ব ,সতীত্ব আর কুসংস্কার আবির্ভূত হয়েছে অচ্ছেদ্য উপাদান হয়ে যেখানে নারী তাঁর সম্পদের ঐ ব্যাক্তিবাদীতায় ভাগ বসাতে পারে নি। ।
মার্ক্সীয় নারীবাদীরা বলে পুজিবাদি সভ্যতার অগ্রগামীতাই এই বৈষম্যের নেপথ্যে …। মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণে সমাজের বিকাশের নিয়ামক হিসাবে চিহ্নিত হলো দ্বান্দিকতার সূত্র এবং যেখানে উঠে এসেছে বুর্জোয়া প্রলেত দ্বন্দ। মানববিকাশের ইতিহাসও যে তেমন দ্বিধারার দ্বান্দিকতায় শাসক পুরুষ আর শোষিত নারী সৃষ্টি করেছে যেটির প্রামাণ্য দলিল হলো বিরাজিত সমাজ ,ধর্মে নারীর প্রতি বৈষম্য, যেখানে কি না সম্পত্ত্বির অধিকার নেই কিন্তু সম্ভ্রম রক্ষার দায়বদ্ধতা ঠিকই আছে। এখন পর্যন্ত পুজিবাদী ব্যাবস্থা টিকে আছে নারীর অর্থনৈতিক অধিকারও কুক্ষিগত । সাম্রাজ্য,জমিদারি আর হালের রাষ্ট্র পর্যন্ত কিছুতেই নারী তাঁর সমানে সমান পায় নি। এ কথাটি অনেকাংশেই সত্য যে বৈষম্যের মূলে অর্থনীতি কাজেই ধর্ম আর বিভ্রান্তির ফাঁকফোকরে স্বামীর কাছে সকল সমর্পণ পুরুষতন্ত্রেরই জয়জয়কার ঘোষণা করে।
পিতৃতান্ত্রিকতার দোহায় দিয়ে নারীকে সন্তান লালন পালন আর বংশের বাতি জালানোর মেশিন ভেবে যে পুরুষশ্রেনী তাঁর আধিপত্য জারি রেখেছে তাকে অতীত এবং আজকের সমাজবাস্তবতায় তাকে সহবাস বলা অন্যায়মাত্র। নিজের জরায়ুর অধিকার প্রতিষ্ঠা, কর্মক্ষেত্র অনুপ্রবেশ এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রন আদায়ের মাপকাঠিতে সভ্যতার কোন কালেই প্রেক্ষাপট যেখানে নারীবান্ধব ছিলো না সেখানে পিতৃতন্ত্রের অনিবার্য নিয়ম আরো যেন ষোলআনা হয়ে দাঁড়িয়েছে আবহমান কাল ধরে । shula mittle fierstone এই পিতৃতন্ত্রে যৌনলালসের বিক্ষুব্ধমানসে নারীবাদী আন্দোলনে একটি নতুন ধারা সংযোজন করেন এই আদিপত্যবাদী যৌনসম্পর্কের বাইরে লেজবিয়ানিজম এবং সিঙ্গেল মাদার কনসেপ্টকে অস্ত্র হিসাবে ধারন করে। সে জিনিসটার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কি সেটা আলচনার থেকে মুখ্য হলো প্রকৃতঅর্থে নারীর যৌনজীবন নারীর উপভোগের চাইতে পুরুষের লিঙ্গচাহিদার খোড়াকই মেটায় না বেশী ? অবিরত সেক্সুয়াল অপ্রেশন এর নিয়ত জীবনেও যেমন ঘটে আবার বিবাহোত্তর কালেও ঘটে। বিবাহ যেনো ধর্ষণ করার স্থায়ী লাইসেন্স ।
এই সমস্ত শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে উচ্চারিত আওয়াজে গনমাধ্যম কিংবা সাহিত্যের মতো প্রগতির মাধ্যমগুলো কি অন্য কিছু তুলে এনেছে?? মোটেই না।বরং চিত্র ভিন্ন
ঢালিউডি সিনেমার পোশাক আশাক অবয়ব কিংবা নারী চরিত্রের নির্মাণে দেখা যায় যেখানে নায়িকার মিনি স্কারট পরা নায়িকার দেহের অংশ বের হয়ে আসছে যেটি নিষ্প্রয়োজন । আবার নায়িকাকে আশ্রিতা ,একেবারে ভেঙেপড়া সহজ সাবলীল করে উপস্থাপন যেনো এ যুগের মোঘল হেরেমের কথায় মনে করিয়ে দেয়। রামায়নের রামের সীতা বিসর্জন, স্বামীর পদতলে ঠায়প্রার্থনা শুধুমাত্র লাইট ক্যামেরা একশনে আধুনিকায়িত হয় যেখানে নির্মাতার চিন্তা ঐ পুরুষতান্ত্রিকতার বাহিরে আসতে পারে না। যুদ্ধে ধর্ষণের ছবিকে অবশ্যধারনীয় করে উপস্থাপন নারীভোগ দৃশ্যের বাণিজ্যিকীকরণ ;যে দৃশ্য দেখে নারী লজ্জায় লাল হয় সে দৃশ্য পুরুষ আগ্রহভরে দেখে আর নারীভোগের ছক কষে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রগুলোতে নারী চরিত্র নির্মাণ করার চালচিত্র হলো-
# কখনো অতীব সাধারন পতিব্রতী
# ধর্ষিত নারীসত্ত্বা যেনো একেবারে সস্তা বাণিজ্যিকীকরন
# পুরুষনির্ভর কোন এক প্রাণী
আবার দর্শনগত জায়গা থেকে বিচার করলে অধিকাংশ চলচ্চিত্রের মান যেমন নিচে তেমনি নারীকে উপস্থাপনে বলিউডি অনুকরন আর যুগ যুগ কালের মান্ধাতার বাস্তবায়নই যেনো মূল কথা । নারী কখনো গাড়ী চালানোর দৃশ্যে দেখা যায় না, নারীকে পুলিশ চরিত্রে দেখা দায়, নারীকে শিক্ষিকার চরিত্রে দেখানোর অবিরত প্রয়াস, নারীকে বিপদ হতে উদ্ধার করতে নায়কের আবির্ভাব প্রভৃতি পুরুষ নির্ভরতার মরচেপড়া ধারনার বহিঃপ্রকাশ। বলিউডি,ঢালিউডি শুধু নয় দুনিয়াজুড়ে এমন উদ্ভ্রান্ত বানিজ্যিক সংস্কৃতির আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে নারীর অস্তিত্ত্ব। কর্পোরেট দুনিয়ায় নারীর সম্ভ্রম আর দেহ এমনই এক ‘ ভোগ্য –ট্যাবু’ বিষয় যে তা টাকায় বিকোয় আর সুন্দরী প্রতিযোগীতার আসর জমায়। জগতের অকাট্য বিধানকে আকড়ে ধরতে গিয়ে নারী চরিত্র রূপায়নে যেনো রন্ধনশৈলী, মায়াময়তা,সন্তানধারন তাঁর অর্জিত একপ্রকার অপগুণ যেটা কি না তাকে পশ্চাদপদ আত্নপরিচয় এনে দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:২৬