আমার আব্বাকে যখন পাকিস্তানী মিলিটারিরা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল মারার জন্য, তখন আম্মা আব্বাকে "লাকাদ জা'আকুম" আর "আয়াতুল কুর্সি" এই দোয়া দুইটা পড়তে বলেছিলেন। নেয়ামুল কোরানে লেখা আছে যে কেউ যদি এই দুই দোয়া পড়ে তাহলে তার বরকতে সেই দিন আল্লাহ তাকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবেন । যখন মৃত্যু নিশ্চিত তখন আব্বার কাছে এক মাত্র আল্লাহই ভরসা ছিল, তিনি ছাড়া আর কেউ নাই সাহায্য করার।
এর পরের ঘটনাগুলি আমার শোনা কাহিনী, নিজের চোখে দেখা নয়। যখন আব্বা, খন্দকার আংকেল আর বোরহানকে জীপে করে মারার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল মিলিটারিরা, তখন তারা আশে পাশে বহু গুলি করে মারা মানুষের লাশ দেখতে পায়। আমার আব্বা, খন্দকার আংকেল আর আমাদের আর্দালি বোরহানকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা মারার জন্য ধরে কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের বধ্যভুমিতে নিয়ে যায়। কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের বধ্যভুমিটা ছিল ইস্পাহানী স্কুলের পিছনের টিলার উপরে। সেখানে তারা সব সেনাবাহিনীর সব বাঙালি সদস্যদের নিয়ে গিয়ে সারি সারি লাইন দিয়ে দাড় করিয়ে সাব মেশিনগান বা এস এল আর দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলছিল।
সেখানে এই নৃশংস হত্যাকান্ডের দায়িত্তে ছিল পাকিস্তানি লেঃ কর্নেল মালিক ইয়াকুব। আব্বাদেরকে সেই বধ্যভুমিতে নেওয়ার পরে এই ব্যক্তি পাকিস্তানি সৈন্যদের জিজ্ঞাসা করে যে এদেরকে কেন মারার জন্য আনা হয়েছে, এদেরকে এখান থেকে নিয়ে যাও। এই ভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান আমার আব্বা, খন্দকার আংকেল আর আমাদের আর্দালি বোরহান। মিলিটারিরা তখন আব্বাসহ বাকিদেরকে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে বন্দী করে রাখে প্রায় তিন মাস।
ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে সেই ২৫শে মার্চের ভয়াল দিনগুলিতে আরও তিন জন ডাক্তার - তাহের আংকেল, হসেইন আংকেল আর তালুকদার আংকেল, বেচে যান সি এম এইচের একজন কাশ্মীরি ক্যাপ্টেনের কল্যাণে। আব্বাদের সবার জুনিয়ার ডাক্তার ছিলেন তিনি, তার নামটা মনে নাই আমার । সেই কাশ্মীরি ক্যাপ্টেন পাকিস্তানী মিলিটারিদের দ্বারা সব বাঙ্গালী অফিসার আর সৈনিকদের হত্যার বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু তার অধীনে শুধু মাত্র এ এম সি (আর্মি মেডিকেল কোর) এর সৈনিকরা কাজ করত, যাদের মারার অর্ডার দেওয়া হয়েছিল সেই সব পাকিস্তানী সৈন্যরা না। কিন্তু তিনি বাঙালি ডাক্তারদের ওদের হাতে তুলে দিতে রাজী ছিলেন না।
সেই কাশ্মীরি ক্যাপ্টেন তিন বা চারজন বাঙ্গালী ডাক্তারকে সি এম এইচের ওটি তে (অপারেশান থিয়েটারে) লুকিয়ে রেখেছিলেন তিন দিন, ২৫শে মার্চ থেকে ২৮শে মার্চ পর্যন্ত । তাহের আংকেল আর তালুকদার আংকেল ছিলেন আই স্পেশালিস্ট, আর তরফদার আংকেল আর হোসেন আংকেল ছিলেন সার্জন । পাকিস্তানী সৈন্যরা তিন দিনে যতবার এসেছিল এদের ধরে নিয়ে যেতে, তিনি বলে দিয়েছিলেন ওরা এখন ওটি তে ব্যস্ত, ওদের এখন নেয়া যাবে না। তিন দিন পরে যখন গোলাগুলি মারা মারি শেষ হয়, তার পরে তিনি এদেরকে ওটি থেকে বের করেছিলেন।
তাহের আংকেল, তরফদার আংকেল আর হসেইন আংকেল্ কে ধরে মিলিটারিরা তখন কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যায়, যেখানে আমার আব্বা, খন্দকার আংকেল, বোরহান অন্যান্য আরো কিছু বাঙ্গালী বন্দী ছিল। তালুকদার আংকেলকে ওরা আমাদের সাথে ইস্পাহানী স্কুলে বন্দী করে রেখেছিল। আর ঐ কাশ্মীরি ক্যাপ্টেনকে নাকি তার পরে কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানে বদলি করে দেয়া হয়।
তিন মাস পরে যখন পাকিস্তানী মিলিটারিরা ঠিক করল যে এই ডাক্তারগুলিকে তারা কোয়ার্টার গার্ড থেকে ছেড়ে দিবে, তখন আব্বা বলেছিলেন যে আমার সাথে আমার আর্দালিও আছে এখানে, তাকে আমার দরকার। তখন ওরা বোরহানকে ছেড়ে দেয় আব্বার সাথে সাথে। সেই সাথে আরেক বাঙ্গালী বন্দীকেও ছেড়ে দেয়, যাকে আমি খালি বুড়া মিয়া বলে জানি, তার সাদা দাড়ির জন্য। ওরা বুড়া মিয়াকে খন্দকার আংকেলের আর্দালি মনে করেছিল, তবে ওনার আর্দালি আর ছোট ভাই মার্চ মাসের শুরুর দিকেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের পরে এই বুড়া মিয়া আমার আম্মাকে তার বাচার কাহিনী বলেছিল, কিভাবে আব্বার জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে আর যেই তিন জন বাঙ্গালী অফিসার বেচে গিয়েছিলেন, তাদের একজন বাহার আংকেল, আর বাকি দুই জনের নাম ভুলে গিয়েছিলাম, খোজ করে জানতে পেরেছি এখন। তারা হচ্ছেন গফফার আংকেল আর আইনুদ্দিন আংকেল। এই দুই জন যেভাবেই হোক আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে পাকিস্তানী আর্মি সব বাঙ্গালীদেরকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে এবং এরা ২৫শে মার্চের ঠিক আগেই ইন্ডিয়া পালিয়ে যান।
বাহার আংকেল পালিয়ে গিয়েছিলেন ২৫শে মার্চে গোলাগুলি শুরু হওয়ার পরে। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের বাসার সামনে পাহারা দিচ্ছিল। তখন বাহার আন্টি তার ছোট চেলে শ্যামলকে কোলে নিয়ে বাসার সামনে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে গিয়ে কান্না কাটি করছিলেন এই বলে যে "আমার বাচ্চার খুব অসুখ, এক্ষণই ডাক্তার দেখাতে হবে, সি এম এইচ নিতে হবে"। এই ভাবে তিনি তাদের ব্যস্ত রেখেছিলেন । আর বাহার আংকেল তখন বাসার পিছনের দিকে জানালা কেটে ধান ক্ষেত আর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে লুঙ্গি পড়ে ক্রলিং করে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পালিয়ে যাওয়ার আগে বাহার আন্টি দেড় হাজার টাকা ওনার জামায় সেলাই করে দিয়েছিলেন। তার পরে যখন পাকিস্তানী সৈন্যরা বাহার আংকেলকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাসায় ঢুকে, তখন বাহার আন্টি তাদের বলেছিলেন যে তোমাদের সৈন্যরা এর আগেই তাকে ধরে নিয়ে গেছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা যখন বাসা সার্চ করে বাহার আংকেলকে খুজে পেল না, তখন বাহার আন্টি ও তার চার ছেলে মেয়েকে (মিনি, বেবী, ইতি আর শ্যামল) বাসা থেকে বের করে সারা বাসায় ডিনামাইট বসিয়ে তাদের চোখের সামনেই বাসাটাকে ধূলিসাৎ করে দেয়।
তার পরে আর সবার মত বাহার আন্টিদেরকে আমাদের সাথে ইস্পাহানী স্কুলে বন্দী করে রাখে। আমার আম্মা আর বাহার আন্টির ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয় আমরা যখন ইস্পাহানী স্কুলে আটকা ছিলাম, এবং বাহার আন্টি যখন আমার আম্মাকে এই সব ঘটনা বলেছিলেন, তখন আমি শুনেছিলাম।
গফফার আংকেল ইন্ডিয়া পালিয়ে গিয়েছিলেন তার সদ্য বিবাহিত বউ আর শালীকে ফেলে, সেই আন্টিও আমাদের সাথে বন্দী ছিলেন। গফফার আংকেলের শালীর নাম ছিল সমাপ্তি। সে আমাদের বয়সী ছিল আর আমাদের সাথে খেলত তখন। কিন্তু গফফার আন্টিকে সারাদিন খালি নামাজ পড়তেই দেখতাম, কারো সাথে বেশী গল্প করতেন না। সুতরাং গফফার আংকেল কিভাবে পালিয়েছিলেন সেই কাহিনী আমি শুনি নাই। আর আইনুদ্দিন আংকেল কিভাবে ইন্ডিয়া পালিয়ে গিয়েছিলেন সেটাও আমি জানিনা।
(To be continued)
প্রথম খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
দ্বিতীয় খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
৪র্থ খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
৫ম খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ৯:০৫