১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরতেই ইস্পাহানী স্কুল খালি হয়ে গিয়েছিল। সারা দেশে আন্দোলন চলছে তখন, স্কুলের হোস্টেলের ছেলেদের গার্জিয়ানরা তাদের বাড়ি ফেরত নিয়ে গেছে। শেষের দিকে আমাদের ক্লাসে ৪-৫জন স্থানীয় ছাত্র ছাত্রী ছাড়া কেউ আসতো না। স্কুলের বেশীরভাগ শিক্ষকরা তখনো ছিলেন সেখানে। সবাই তাদের পরিবার পরিজনদের দেশের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, খালি একজন ছাড়া। ২৫শে মার্চের পর থেকে স্কুল বন্ধ ছিল। ৩০শে মার্চে পাকিস্তানী মিলিটারিরা স্কুলের ১১ জন শিক্ষককে এবং একজন শিক্ষককের পরিবারসহ সবাইকে মেরে ফেলে। ঐ এগার জন শিক্ষকের নাম হচ্ছে - জনাব আবুল কাশেম, এম এ, জনাব আজিজুল হক, এমএ এমএড, জনাব আব্দুল জব্বার, বিএ এমএড, জনাব তাযুল ইসলাম, বিএ এমএড, জনাব শরফুদ্দিন আহমেদ , বিএস সি, বিএড, জনাব মসলেহ উদ্দিন, এমএ এমেড, জনাব আমির হোসেন, বিএ বিএড, জনাব আব্দুল মালেক, বিএসসি বিএড, জনাব মফিজ উদ্দিন ভুইয়ান, বিএসসি বিএড, জনাব খাইরুল বাশার এবং জনাব আব্দুল মান্নান।
ছবিঃ ইস্পাহানী স্কুলে ১৯৭১ সালের শহীদ শিক্ষকদের স্মরণে দেয়াল ফলক। ফটো ক্রেডিট - আনোয়ার হোসেন, ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০১২।
ইস্পাহানী স্কুলের দুইজন শিক্ষক বেঁচে গিয়েছিলেন সেই সময়। তারা হচ্ছেন পিটি (শারিরীক শিক্ষা) শিক্ষক জনাব মিয়া এবং সশ্যাল স্টাডিজ (ইতিহাস, ভূগোল, পউরনীতি) শিক্ষক জনাব ওয়ালি উল্লাহ। এরা দুই জন ২৫শে মার্চের পরে যুদ্ধের মধ্যে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
এছাড়াও তখন আমাদের স্কুলে একজন এংগলো মেডাম ছিলেন, মিস মারটিন। বেশ কড়া মেডাম ছিলেন তিনি। বিশুদ্ধ ইংরেজী উচ্চারন, রীতি নীতি শেখানোর জন্য তাকে রাখা হয়েছিল। আর মেয়েদের গার্হস্থ্য বিজ্ঞ্যান শিক্ষাও তার কাজ ছিল। রুমাল হেম করা আর সুই সুতা দিয়ে এম্ব্রইয়ডারী করা তার কাছেই শিখেছিলাম। তার দুই ছেলে মেয়ে ছিল, খুব সুন্দর দেখতে, খয়েরি সোনালী চুল। ওরা বেশ বড় ছিল, মানে ক্লাস এইট বা নাইনে পড়ত মনে হয়। তারা আমাদের স্কুলে পড়ত না, খালি ছুটিতে মায়ের কাছে বেড়াতে আসত। একবার মিস মারটিনের ছেলে আমাদের স্কুলের এক ফাংশানে গিটার বাজিয়ে "সামার ওয়াইন" বলে একটা গান গেয়েছিল। আমরা সব হাঁ করে শুনেছিলাম। মিস মারটিন ২৫শে মার্চের বেশ আগেই স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সুতরাং উনিও বেচে গিয়েছিলেন মনে হয়।
সারাদিন ঘুরাঘুরি করলেও সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে খাওয়া শেষ করেই রাত্রি বেলা আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়তে হত সবাইকে। বাইরে থেকে যেন আলো না দেখা যায়। সেটা কি বম্বিং এর ভয়ে করেছিল কিনা পাকিস্তান আর্মিরা ঠিক জানি না। তখন বাহার আন্টিরা আর আমরা এক জায়গায় মাটিতে বিছানা করে শুতাম বিরাট এক হল ঘরে। আর বাহার আন্টির একটা রেডিও ছিল, ব্যাটারি দিয়ে চলত। সেটাকে উনি কাপড় পেচিয়ে খব আস্তে আস্তে বাজাতেন, বিবিসি আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার শুনতাম আমরা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম , এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম" তখন বারে বারে প্রচারিত হত। শেখ মুজিবুর রহমানের ঐ ঐতিহাসিক ভাষণটা তখনই আমি প্রথমবার শুনেছিলাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আরও প্রচারিত হত চরম পত্র। সেটা আমাদের সবার খুব প্রিয় ছিল।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এছাড়া দেশের কোথায় কি হচ্ছে সেই খবর কিছু পাওয়া যেত কিনা আমার মনে নাই। তারপরে খবর শেষ হয়ে গেলে রেডিও বন্ধ করে সবাই ঘুমিয়ে যেতাম। তখন ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট আর আশে পাশের গ্রামগুলি সম্পূর্ণ জন শুন্য ছিল, খালি পাকিস্তানী মিলিটারি ছাড়া কেউ ছিল না সেখানে। দোকান পাট, হাট বাজার, স্কুল কলেজ সব বন্ধ ছিল। জন কোলাহল মুক্ত একটা জায়গা কিরকম নীরব নিস্তব্ধ হয় সেটা টের পাওয়া যেত ঘুমানোর আগে । রাত্রি বেলা খালি দূর থেকে শেয়ালের হুক্কা হুয়া আর কুকুরের ডাক শোনা যেত কান্নার আওয়াজের মত। আমার আম্মা বলতেন যে যখন কুকুরের কান্না শোনা যায়, সেটা খুব অশুভ সময়ের লক্ষন। পাকিস্তানী মিলিটারি যেসব বাঙ্গালীদের মেরে ছিল তাদের অনেকের লাশ ভাল মত কবর দেয় নাই। এই শেয়াল কুকুর সেই লাশগুলি খেত বলে আমার ধারনা হয় এখন।
স্কুল বন্ধ থাকাতে তখন আমার দিন তারিখের কোন হিসাব ছিল না যে আজকে স্কুলের দিন বা ছুটির দিন, কোনটা কাজের দিন বা বন্ধের দিন। মনে হয় এইভাবে ২-৩ মাস যাওয়ার পরে হঠাত একদিন পাকিস্তানী মিলিটারিরা আমার আব্বা, খন্দকার আংকেল, তাহের আংকেল আর হোসেন আংকেল কে ফেরত দিয়ে যায় ইস্পাহানী স্কুলে আমাদের কাছে। যাদের আব্বা ফেরত এসেছে তাদের কি খুশী! কিন্তু বাহার আংকেল ফিরে আসেন নাই বলে তার মেঝ মেয়ে ইতি খালি আন্টিকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো যে তার আব্বা কখন ফেরত আসবে। ভাগ্যক্রমে বাহার আংকেল তখন ইন্ডিয়া পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন আর যুদ্ধের পরে ফেরত এসেছিলেন। তবে সেটা অনেক পরের কথা।
আব্বা আর খন্দকার আংকেল ফেরত আসার পরে আমাদের হল রুম থেকে হোস্টেলের একটা রুমে স্থানাতরিত করা হয়। তখন থেকে খাওয়া দাওয়ার কিছুটা উন্নতি হয়। আমার মনে আছে খন্দকার আংকেলের বউ খুব ভাল মুসুরি ডাল দোপেয়াজা ধরনের রান্না করতেন সেই রুমের মধ্যেই কেরসিনের চুলায়। তখন সেখানে আব্বা বেশীর ভাগ সময় নামাজ আর কোরান শরীফ পড়েঈ কাটাতেন । এতদিন কোথায় ছিলেন বা কিভাবে ছিলেন, কি দেখেছেন সেই কথা কক্ষনো বলতে শুনি নাই আব্বাকে বা খন্দকার আংকেলকে। বড় কেউ বলে না দিলেও ছোটরা সবাই জানতো যে চারিদিকে পাকিস্তানী স্পাইরা আছে, আমরা কি করছি বা বলছি সেটা লক্ষ করছে। এক মাত্র লুকিয়ে লুকিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনা ছাড়া কোন দুঃসাহসিক কাজ কাউকে করতে দেখি নাই।
আমাদেরকে যখন ইস্পাহানী স্কুলের দোতালায় বন্দী করে রেখেছিল পাকিস্তানী মিলিটারিরা তখন প্রথম দিকে সেখানে পানির কানেকশান ছিল না। পানির ট্রাক আসলে নীচে গিয়ে বালতিতে করে পানি আনতে হত। তবে কিছু দিনের মধ্যে দোতালায় পানির বেবস্থা ঠিক করা হয়। সেখানে সবাই হোস্টেলের বাথরুম ব্যাবহার করত। বিরাট একটা রুমে বাম দিকে টয়লেটের সারি আর ডান দিকে গোসলের জন্য শাওারের সারি সারি ঘর ছিল। একটা টিম টিমে বাল্বের আলো ভিতরে বেশী দূর যেত না। কোন কোন শাওার থেকে সারাক্ষন টিপ টিপ করে পানি পড়ত। আর কোন কোন বাথরুম দিয়ে পানি যেত না। এই সব ঠিক করার জন্য মিলিটারিরা স্থানীয় মিস্ত্রী মজুর ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল। কিভাবে যেন আমাদের গ্রামের লোকেরা খবর পেয়েছিল যে আমরা ইস্পাহানী স্কুলে বন্দী আছি। তারা সেই পানির মিস্ত্রীদের হাতে চিঠি পাঠিয়েছিল আমাদের খোঁজ নিতে, সেটা মিস্ত্রীরা বাথরুমে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল। এভাবে পাকিস্তানীদের চোখের সামনে দিয়ে লোকে আমাদের খোঁজ নিয়েছে সেই সময়।
আমরা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে থাকতে আমাদের বাসায় ফুলের বাগান ছাড়াও শাক সব্জীর বাগান ছিল। আমাদের বাসার আশে পাশে অনেক কাঁঠাল গাছ ছিল। আর বাসার সামনের রাস্তার ধারে লম্বা লম্বা তাল গাছ ছিল। সেই তাল গাছে বাবুই পাখির বাসা ছিল। ঝড় হলে মাঝে মধ্যে দুই একটা বাবুই পাখির বাসা নীচে পড়ে যেত, আমি সেগুলি কুড়িয়ে নিয়ে আসতাম। তাল গাছে বাবুই পাখি ছাড়াও এক রকম বড় বড় টিকটিকি থাকতো । আমরা তাদের টোট ঠ্যেং বলতাম, কারন সন্ধ্যা হলেই সেগুলি জোরে জোরে টোট ঠ্যেং বলে শব্দ করত। তখন আমাদের দুইটা গরু আর দুইটা বাছুরও ছিল। গরু দুইটা আমরা পালতাম দুধের গাভী হিসাবে, অনেক আদরের ছিল, আম্মা ওদের নামও দিয়েছিলেন। তাদের প্রত্যেকদিন বড় গামলা ভরে খৈলের ভুষি, ভাতের মাড়, কাঁঠালের খোসা ইত্যাদি খওয়ানো হত আর রাত্রি বেলা ওরা সারভেন্ট কোয়ার্টারের বারান্দায় ঘুমাত।
২৫শে মার্চের আগেই আব্বা বোরহানকে তাদের ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। তার পরে যখন আব্বাদের ধরে নিয়ে গেল, আর আমাদের ইস্পাহানী স্কুলে বন্দী করে রেখেছিল মিলিটারিরা তখন তারা আমাদের গরু-বাছুরগুলি ধরে এনে স্খুলের মাঠে জবাই করে খেয়েছিল। সেটা আমরা দোতালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেয়েছিলাম। আর আমার ছোট বোন শাহীন আর কয়েকজন ছোট বাচ্চা উপর থেকে চিৎকার করে বলেছিল, "মিলিট, মিলিট, গোস্ত দে", সম্পূর্ণ মিলিটারি শব্দ উচ্চারন করতে পারত না তখন। আর আশ্চর্যের বিষয় যে তাদের ডাক শুনে মিলিটারিরা দোতালায় গোস্ত পাঠিয়ে দিয়েছিল। অনেক দিন পরে আমরা গোস্ত রান্না খেয়েছিলাম।
(To be continued)
প্রথম খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
দ্বিতীয় খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
তৃতীয় খন্ডের লিঙ্ক Click This Link
৪র্থ খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৫ রাত ৯:১৩