somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বাধীনতা যুদ্ধে বেঁচে থাকার কাহিনী: ১ম খণ্ড

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৯:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্বাধীনতা যুদ্ধের কাহিনী:

১৯৭১ সালের মার্চ মাস। আমরা তখন কুমিল্লা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে থাকি। আমার আব্বার নাম মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন। জন্ম ১লা মার্চ, ১৯৩০ সালে। তিনি ডাক্তার, তখন আর্মির মেজর ছিলেন, কুমিল্লা সি এম এইচের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড (2-i-C)। সি এম এইচের সিও ছিলেন লে: কর্নেল জাহাঙ্গীর আঙ্কেল, উনিও বাঙালি ছিলেন। আর কাজ করতেন একজন কাশ্মীরি ক্যাপ্টেন, আব্বাদের সবার জুনিয়ার ডাক্তার, তার নামটা মনে নাই আমার।

সারা দেশে তখন আন্দোলনের বন্যা চলছে। ইলেকশানে শেখ মুজিবুর রহমান জিতেছেন কিন্তু পাকিস্তান সরকার তাকে প্রধান মন্ত্রী হতে দিবে না। ৭ই মার্চ শেখ মুজিব ঘোষণা দিলেন, "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম "। তারপর হঠাৎ সব চুপচাপ। সারা ক্যান্টনমেন্ট খালি হয়ে যেতে লাগল । ইস্পাহানী স্কুলের ছাত্র বেশীর ভাগ হোস্টেলে থাকতো , তারা সব বাড়ী চলে গেল। আমাদের বাসায় কাজ করত দুই বোন , নুরজাহান আর আনোয়ারা , পাশের গ্রামে থাকতো । ওরা কাজে আসা বন্ধ করে দিল। চারিদিকে থম্ থমে আবহাওয়া ।

তারপর আসলো ২৫শে মার্চ । আমাদের স্কুল বন্ধ, আব্বার অফিস যাওয়া বন্ধ, কিন্তু ঘরে ইউনিফর্ম পড়ে বসে আছেন। আব্বা সারাদিন কোরান শরীফ পড়ছেন , আর আম্মা খালি দোয়া দরুদ পড়ছেন। আর বাইরে খালি মেশিন গানের গুলির শব্দ। ঠা-ঠা ঠা-ঠা ঠা ... এক টানা তিন দিন তিন রাত এই শব্দ চলতেই থাকল। অনবরত গুলি করে ১,২০০ মানুষ মারতে কিছু সময় লাগে। (পাকিস্তানী মিলিটারীরা দুই শত বাঙ্গালী অফিসার আর এক হাজার বাঙ্গালী সৈনিককে গুলি করে মেরেছিল সে সময়)

আমাদের আর খন্দকার আংকেলের বাসা ছিল পাশাপাশি। মেজর খন্দকার আঙ্কেলও ডাক্তার ছিলেন। আমরা দুই বাসার লোক এক বাসায় জড়ো হয়ে থাকলাম। আব্বা আর খন্দকার আংকেল এক সাথে বসে থাকলেন ইউনিফর্ম পড়ে। আম্মা আমাকে বাসার বাইরে যেতে নিষেধ করে দিলেন, কিন্তু আমি সব সময় কথা শুনতাম না। অবস্থা যে কত গুরুতর সেটা তখনো বুঝি নাই । তখন বসন্ত কাল ছিল। গাছে গাছে আমের মুকুল ফুটেছিল, মৌমাছি উড়ে বেরাচ্ছিল। আর কিছুক্ষণ পরে পরেই আসে কাল বৈশাখী ঝড়। ছোটবেলায় শোনা সেই গানটার মতইঃ

ঝড় এল, এল ঝড়
আম পড়, আম পড়
কাঁচা আম, পাকা আম, টক টক মিষ্টি
এই যাহ, এল বুঝি বৃষ্টি

কাল বৈশাখী ঝড়ে গাছের নীচে আম পড়েছিল। আমি গিয়ে সেই বৃষ্টি ভেজা আম কুড়িয়ে নিয়ে এসেছি। আম্মা মনে হয় সেদিন আমাকে বকাও দেন নাই সেই জন্য।

আমাদের বাসা থেকে পাশের গ্রামগুলি দেখা যেত । সেদিন বিকেলে হঠাত দেখি পাকিস্তানী মিলিটারিরা সেই গ্রামের বাড়ীগুলি ঘেরাও করে বাড়ীতে কেরসিন ঢেলে আগুন জালাচ্ছে । দাউ দাউ করে আগুন জলছে। বাঁশ ঝাড়ের চেয়েও বেশী উঁচু আগুনের শিখা। আমারা জানালার পর্দা ফাঁক করে দেখছি, আর খন্দকার আংকেলের মা সমানে আগুন নেভার দোয়া পড়তে আরম্ভ করলেন। ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামলো । কিন্তু সেই আগুন নিভল না যতক্ষণ পর্যন্ত ঐ বাড়ী গুলি পুড়ে ছাই না হয়ে গেল। আমি এখন পর্যন্ত ভাবি যে ঐ বাড়ীর লোক গুলি আগেই পালিয়ে গিয়েছিল, কেউ সেই আগুনে পুড়ে মরে নাই। নয়ত এই বিভীষিকাময় স্মৃতি সহ্য করার মত না।

তিন দিনের দিন সকাল বেলা দেখলাম আব্বা স্টীলের আলমারি থেকে টাকা বের করে আম্মার হাতে দিচ্ছেন, আর আম্মা সেই টাকা প্যাকেট করে শাড়ীর কোমরে গুঁজে রাখলেন । তার কিছুক্ষন পরে আমাদের ঘরে পাকিস্তানী মিলিটারী সৈন্যরা আসলো, হাতে বন্দুক তাক করে। লম্বা রাইফেল, সেটার আগায় ধারালো বেয়োনেট চকচক করছে। পাকিস্তানী মিলিটারীরা আব্বাকে দুই হাত হ্যান্ডস আপ করে ঘর থেকে নিয়ে গেল । আমি তখন আম্মার সাথে বাসার বারান্দায় দাঁড়ানো, আম্মার কোলে আমার দুই বছরের বোন শাহীন আর আমার ছোট বোন শামীম আম্মার শাড়ীর আঁচল ধরে আরেক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দেখছি আব্বাকে ধরে নিয়ে বাসার সামনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে পাকিস্তানী মিলিটারীরা।

আব্বাকে আর খন্দকার আংকেলকে এক সাথে হ্যান্ডস আপ করে একটা জীপে তুলে নিয়ে গেল এক দল মিলিটারী, আর আরেক দল আমাদের বাসা সার্চ করতে লাগলো । ধরে আনল আব্বার আর্দালি বোরহানকে তার থাকার রুম থেকে। তারপর আমাদের বাসার সামনের বাগানে বেল গাছের নীচে হ্যান্ডস আপ করে পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে দাঁড় করালো তাকে। তক্ষুনি গুলি করে মেরে ফেলত মনে হয় বোরহানকে । কিন্তু আমার আম্মা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন , "মাত মারো , মাত মারো " বলে। কি যেন দয়া হল সেই মিলিটারীর , সে তখন বোরহানকে সেখানে আমাদের চোখের সামনে মারল না, আব্বাদের সাথে জীপে তুলে নিয়ে গেল।



(To be continued)

দ্বিতীয় খন্ডের লিঙ্ক Click This Link

তৃতীয় খন্ডের লিঙ্ক Click This Link

৪র্থ খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link

৫ম খন্ডের লিঙ্ক - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ৭:৫২
১৪টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×