somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায়

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গল্পের ভূমিকায় ছিল একটি চিঠি:

সকালে ঘুম থেকে উঠে হাসিব অনেকক্ষণ ধরে চিঠিটা পড়লো। চিঠিটা সে গতকাল হাতে পেয়েছিল। সারাদিন খুব তাড়াহুড়ায় ছিল বলে পড়ার সময় হয়নি। তাছাড়া রাতে সম্ভবত ওর হালকা জ্বর এসেছিল। গা টা এখনো গরম আছে। সারা শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল।
চিঠিতে লেখা : -

বাবা হাসিব,
কেমন আছিস বাবা? দু’এক দিনের ভেতর কোন একটা ব্যবস্থা করে পাঁচ হাজার টাকা পাঠাতে পারবি? খুব দরকার।
আমরা ভালো আছি। নিজের যত্ন নিস।
ইতি,
তোর মা

ছোট্ট একটা চিঠি। কয়েকটা মাত্র লাইন। অথচ অনেক কিছু যেন বলা হয়ে গেছে। চিঠিটার ভেতর থেকে যেন একটা আকুতি ফুটে উঠছে। অনেকটা কবিতার মতো। কবিতার নাম পাঁচ হাজার টাকা। হা হা হা। হাসিব মনে মনে তিক্ত একটা হাসি হেসে নেয়।
টাকাটার ব্যবস্থা করতে হবে।

গতকাল সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল:

হাসিব সেই গতকাল দুপুর থেকে একটা কবিতা মাথায় নিয়ে ঘুরছে। রাতে খাওয়ার পর চেষ্টা করেছিল। লাভ হয়নি। যদিও রাতের খাওয়াটা হয়েছিল চমৎকার। মেসে গতকাল ফিস্ট ছিল। প্রতি মাসেই ফিস্ট হয়। এবারে ফিস্টে অবশ্য মেনুতে ভাত রাখা হয়েছিল সাথে শুঁটকি মাছ, ঘন ডাল দিয়ে মুড়িঘণ্ট আর রুই মাছের দোপেয়াজা। সালাদ।
প্রচণ্ড গরম পড়েছে। সেটাই ফজলু ভাইয়ের মেন্যুর নির্ধারণি বিষয় হয়ে দাঁড়ালো।
“বুঝলেন ভাই! এই গরমে পোলাও কোর্মা খেয়ে পোষাবে না।” ফজলু ভাইয়ের কথা। আর মেসে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে ফজলু ভাইয়ের কথাই শেষ কথা।
“গরম গরম ভাত। শুঁটকি মাছের ভর্তা আর ডাল। এই দিয়েই তো আমি দুই সের ভাত খেয়ে ফেলতে পারি! হা হা হা। ...ঝাল খাবেন আর ঘামবেন। ... ঘামবেন আর খাবেন... ঝালের গরমের সাথে কার্তিকের গরমে কাটাকাটি।”
ফজলু ভাইয়ের কথায় অনেকেই বেকে বসলো। সবচেয়ে বেশী উত্তেজিত হলেন ইলিয়াস ভাই। মজার ব্যাপার হল ইলিয়াস ভাই খেপে গেলেই আর স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারেন না। তিনি বসা থেকে উঠে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “এ...এ...এটা আপনার বাড়াবাড়ি ফজলু ভাই। আ...আ...আমি শুঁটকি খাই না। আর ফিস্টে কেউ শু...শুউউটকি খাআআয়?”
ইলিয়াস ভাইয়ের কথায় অনেকেই গুঞ্জন করে উঠলো। ফলে মেনুতে একটু পরিবর্তন আনতেই হল। ফিস্টে কি মেন্যু হবে সেটা ফজলু ভাই আগের দিন আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেন। মেসের ছাদে একটা মিটিং হয়। সেখানেই সবাই মাসে একটা দিন আড্ডা দ্যায় আর ফজলু ভাইয়ের খাওয়া দাওয়ার গল্প শোনে। মুড ভালো থাকলে পেশায় P.W.D. এর ইঞ্জিনিয়ার সেলিম ভাই মাঝে মাঝে গান গেয়ে শোনান। বড় দরাজ গলা সেলিম ভাইয়ের অথচ জীবনে কারো কাছ থেকে তালিম নেননি। এক পয়সা ঘুষ খান না। ফলে আর্থিক অবস্থাও তথৈবচ।
রাতের খাওয়ার পর কবিতা লেখার ডায়রিটা হাতে নিয়ে বসেছিল হাসিব। কিন্তু এমনিতেই সেদিন ভয়াবহ গরম পড়েছিল তার উপর লোড শেডিং এর যন্ত্রণায় কবিতা জানালা দিয়ে পালালো। এই ভ্যাপসা গরমে আর যাই হোক কবিতা হয় না।
“নাহ!” কলমটা ঢিল দিয়ে ফেলে দিয়ে বিছানায় জানালার পাশে গিয়ে বসেছিল হাসিব। একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরে অনেক দূরে নিজেকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করল সে। ছাদে সম্ভবত সেলিম ভাই গান গাইছিল

“বারে বার ডাকি তোমায়
ক্ষম ক্ষম অপরাধ……!
বড় সঙ্কটে পড়িয়া এবার
ওগো দয়াল
বারে বার ডাকি তোমায়
ক্ষম ক্ষম অপরাধ……!
দাসের পানে একবার চাও হে দয়াময়
ক্ষম অপরাধ।..."


গান শুনে আর ঘরে থাকতে পারেনি হাসিব। ছুটে ছাদে গিয়েছিল। গভীর রাত পর্যন্ত সেলিম ভাই গান গাইলেন। কিছু একটা হয়েছে ভদ্রলোকের। কিছুই বললেন না। গান গাইতে গাইতে দু’এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলেছেন। কেউ দেখেনি। কিন্তু ওই পর্যন্তই।
সে রাতে গান শুনে ঘরে এসে অনেকক্ষণ নিজের মানসিক অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করল হাসিব। এক সময় ডায়রি লেখার অভ্যাস ছিল ওর। সেটা এখন হিজিবিজি লেখালেখিতে পরিণত হয়েছে। তারপরও কিছু একটা লিখলে আজকাল মনটা একটু শান্ত হয়।
অন্ধকার ঘরের নিস্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ একটা কথা ওর মাথায় বিদ্যুতের ঝলকের মতো এপার থেকে ওপারে ছুটে যায় – “আর এক মাস বাদেই ঝর্নার বিয়ে।”
কথাটা মাথায় আসতেই হাসিব মাথা নাড়ে - এসব আমার মনের অশুভ কল্পনা। আর কিছু না। ঝর্নাকে সে কখনোই বন্ধুর চাইতে বেশী কিছু বলে ভেবে দেখেনি।
কিন্তু ঝর্না?
এই প্রশ্নটা হাসিবকে অদ্ভুত এক বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। আর এভাবেই হঠাৎ হঠাৎ ওর মনের মধ্যে যে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া জমে সেটা লেখার মাধ্যমে বের হয়ে আসে। গতকাল সে কিছু একটা লিখে নিজের কাছে স্পষ্ট হওয়ার চেষ্টা করেছিল। তাতেও ব্যর্থ হয়ে সব কিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়ে সে। মনের ভেতরের বিষাক্ত চিন্তা ভাবনাগুলো বের হওয়ার জন্য আকুলি-বিকুলি করছে কিন্তু বের হওয়ার পথ পাচ্ছে না। মহা যন্ত্রণা। জ্বর জ্বর ভাব নিয়ে এক সময় ঘুমিয়ে গেল হাসিব।

প্রলাপ:

"আমার দেখি কিছুই ভালো লাগে নারে ভাই। কি হইসে আমার?"
শুধু মনে হয় সাথে কাউকে নিবো না, একা একা কোন এক জায়গায় পালিয়ে যাই। কিন্তু কোথায় পালিয়ে যেতে চাই?
গভীর রাতে জ্যোৎস্নার আলোতে একাকী বাসার ছাদে?
-না
-গভীর বনে?
-নাহ!
-খোলা আকাশের নিচে?
-না
-দূরে কোথাও বেড়াতে?
-না!
-তাহলে?
-চুপ কর বেওকুফ!
আমার মনে হয় কোন একটা অন্ধকার কুয়ার ভিতরে লাফ দিয়ে পড়ে যাই। যেই কুয়ার কোন তল থাকবে না। একবার লাফ দিলেই হল। তারপর আমি কুয়ার অন্ধকার বেয়ে পড়তেই থাকবো... পড়তেই থাকবো...পড়তেই থাকবো...

অবেলার পথচারী:

বাইরে কাঠ ফাটা গরম। লু হাওয়া বইছে। কোন কোন গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছে ক্লান্ত পথচারী, তার খানিকটা দুরেই একটা ঘেয়ো কুকুর লালা ঝরাচ্ছে। গার্লস স্কুলের সামনে ডাব বিক্রি করছে খোকন। গরমে এটা তার সাইড বিজনেস।
গায়ে জ্বর নিয়েই মেস থেকে বের হল হাসিব। টাকাটার ব্যবস্থা করতে হবে। মা সাধারণত তার কাছে এভাবে টাকা চেয়ে পাঠায় না। কারণ প্রতি মাসে সে নিজেই যতখানি পারে বাড়িতে টাকা পয়সা পাঠায়। হঠাৎ করে যখন টাকাটার দরকার হয়েছে তার মানে কিছু একটা ঝামেলা লেগেছে। আর বাড়িতে ঝামেলা মানেই বাবার পাগলামিটা সম্ভবত আবার বেড়েছে।
রাস্তায় বের হয়েই হাসিবের মনে হল শরীরের এই অবস্থা নিয়ে ঘরের বাইরে বের হওয়াটা ঠিক হল না। তাছাড়া কোথায় যাবে, কার কাছ থেকে টাকা নেবে - সেটা ঠিক না করেই এই গরমে রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে শরীর খারাপ করার কোন মানে হয় না। সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা। ফাইনালের আগে শরীর বসে গেল বিপদ। মহা বিপদ।
রাস্তা দিয়ে বিড়বিড় করতে করতে হাঁটছিল হাসিব। হঠাৎ খোকনের ডাকে মুখ তুলে তাকায় সে।
“মামা, একটা ডাব খাইয়া জান। এক্কেরে ফেরেশ।”
“আরে ধুর! টাকা নাই।”
“আরে মামা, ট্যাকা চাইছি আপনার থন?” হাসতে হাসতে কচকচ করে একটা ডাব ছিলে হাসিবের হাতে ধরিয়ে দেয় খোকন।
ডাবটা মুখে দিয়ে তৃপ্তির একটা আভা হাসিবের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। যাক ছেলেটা আজকে ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ডাবটা খেতে ভালো লাগছে।
“মামার কি শইলডা খারাপ?”
“কেন?”
“আপনার চুক লাল হইয়া আছে।”
হাসিব ডাবের পানি স্ট্র দিয়ে খেতে খেতে ভুরু কুঁচকে খোকনের দিকে তাকায়।
“বেশী লাল?”
“হ”
“রাতে জ্বর এসেছিল। সেজন্য মনে হয়।”
হাসিবের কথা শুনে খোকন হাত দিয়ে হাসিবের হাতটা ধরে চমকে উঠে।
“বস, আপনার তো হেভি জ্বর উঠছে। বাড়িত যান। এই বেলা আর বাইরে বেড়ানির কাম নাই।”
ডাবটা খাওয়া শেষ করে সেটা একটা ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে হাসিব খোকনের দিকে একবার তাকায়। তার চোখে বিস্ময় মাখা হাসি। কত অল্প বয়সে সে এই ছেলেটাকে একটা দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়ে ছিল? আট? দশ? হতে পারে। সেই ছেলে এখন নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে। শুধু তাই না। হাসিবকেও সে দেখে রাখার চেষ্টা করছে এই বয়সেই। ছেলেটার মাথায় হাত দিয়ে আদর করে ডাবের টাকাটা দিয়ে বের সামনের দিকে হাঁটতে থাকে হাসিব। খোকন টাকাটা হাতে নিয়ে আর কিছু বলে না। হাসিব মামাকে কিছু বলে লাভ নেই। অদ্ভুত এই মানুষটা কোন মাটি না লোহা দিয়ে তৈরি কে জানে?

ভুল হিসাব:

হাঁটতে হাঁটতে হাসিব লাল রঙের দালানটার কাছে এসে পড়ে। এটা ঝর্নাদের বাড়ি। প্রতি সপ্তাহে সে ঝর্নার ছোট বোন স্বর্ণাকে টিউশনি পড়াতে আসে। স্বর্ণার এখন কলেজ ছুটি। সামনেই পরীক্ষা। এই টিউশনিটা ঝর্নাই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ঝর্না তাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। ক্লাসের প্রথম দিনেই ঘটনাক্রমে ঝর্নার সাথে হাসিবের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ঝর্নার সাথে দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্বের মধ্যে হাসিব অনেক পরিবর্তন টের পেয়েছে। কিন্তু তার সবই অস্পষ্ট। হাসিবও সেগুলো তার মনের অশুভ খেয়াল বলে উড়িয়ে দিয়েছে।
দরজায় কড়া নাড়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়ে হাসিবকে। দরজা খুলেই স্বর্ণা ঝলমল করে কথা বলে উঠে, “হাসিব ভাই! আজকে তো আপনার পড়াতে আসার কথা না। তার ওপর এতো সকালে!”
তৃষ্ণায় হাসিবের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। এই মেয়ে তো গেট ধরে বসে আছে। এখান থেকেই বিদায় দেয়ার ইচ্ছা বলে মনে হচ্ছে। হাসিব তার শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে কোন রকমে জিজ্ঞেস করে,
“ঝর্না আছে?”
“হ্যাঁ আছে। আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।“ বলে গেট ছেড়ে দিয়ে স্বর্ণা ঘরের ভেতরে এগিয়ে যায়।
স্বর্ণাদের বাসার ভেতরে ঢুকলে কারো আর বাইরে বের হতে ইচ্ছা করবে না। এই গরমেও ভেতরে এসির বাতাসে শীত শীত লাগছে।
“হাসিব ভাই, আপনার কি শরীর খারাপ?”
হাসিব একটু থমকে বলে, “নাহ!”
“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি অসুস্থ। শুধু অসুস্থ না ভয়াবহ অসুস্থ। কি হয়েছে আপনার?”
জবাবের আশায় স্বর্ণা হাসিবের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নিজের ছাত্রীর সামনে নিজেকে কেমন যেন চোর চোর লাগছে হাসিবের। সে একটু অস্বস্তি নিয়ে জবাব দেয়,
“বাইরে খুব গরম! খুব পিপাসা পেয়ে গেছে। আমাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাওয়াও তো! আর ঝর্নাকে একটু ডেকে দাও। একটা কাজ ছিল।”
স্বর্ণা ভুরু কুঁচকে হাসিবের কথাগুলো শুনে চিন্তিত মুখে কিছু না বলেই ঘরের ভেতর চলে গেল। খানিকক্ষণ পর একটা মেয়ে একটা ট্রেতে করে মিষ্টি, চানাচুর, ঠাণ্ডা পানির একটা জগ আর একটা গ্লাস রেখে গেল সেন্টার টেবিলটার ওপর। হাসিবের আসলেই তৃষ্ণা পেয়ে গিয়েছিল। তবে জ্বরটা মনে হয় বেড়েছে। অল্প একটু পানি খাওয়ার পরই আর ভালো লাগলো না।
গ্লাসটা টেবিলে রাখতেই স্বর্ণা আর ঝর্না দুই বোন এসে হাজির। দুই জনের চেহারাতেই সিরিয়াস ভাব যেন গুরুত্বর কিছু একটা ঘটে গেছে।
“তোমার নাকি শরীর খুব খারাপ? আর সেই খারাপ শরীর নিয়ে নাকি তুমি এই সকাল বেলা স্বর্ণাকে পড়াতে এসেছ?”
ঝর্না এগিয়ে এসে হাসিবের কপালে হাত দিয়ে চমকে ওঠে!
“কি সর্বনাশ! তোমার তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে!”
স্বর্ণা পেছন থেকে বলে ওঠে, “ দেখেছো বুবু, আমি ঠিকই ধরেছিলাম। হাসিব ভাই আমাকে মিথ্যা কথা বলেছেন।”
অনেকদিন হাসিব কোন মমতার স্পর্শ পায় না। ওদের ব্যস্ততা দেখে আমার শরীরটা যেন সত্যিই ভেঙ্গে পড়তে চায়। সে মরিয়া হয়ে ঝর্নার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, “ঝর্না, আমার কথা শোন। আমি ঠিক আছি। আমি একটু তোমার সাথে আলাদাভাবে একটা কথা বলতে চাই। খুব আর্জেন্ট।”
হাসিবের কথা শুনে ঝর্নার চোখে কিসের যেন একটা দ্যুতি বিদ্যুতের বেগে ছুটে হারিয়ে গেল। হাসিব অসুস্থ না হলে হয়তো সেটা দেখতে পেত। হয়তো এবারও সে এটাকে তার অশুভ ভাবনা বলে উড়িয়ে দিত।
ঝর্না এক মুহূর্ত হাসিবের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে পেছন ফিরে স্বর্ণার দিকে তাকায়। স্বর্ণা কিছু না বলে ভেতরের ঘরে চলে গেল।
হাসিব একটু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “তুমি আমাকে হাজার পাঁচেক টাকা জোগাড় করে দিতে পারবে?”
“এটা বলার জন্য তুমি এতদূর এসেছ?” ঝর্না আহত স্বরে বলে ওঠে। “একটা ফোন করে দিলেই পারতে। ড্রাইভার তোমার মেসে গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসতো।”
হাসিব মাথা নেড়ে বলে, “আমি আসলে এতো কিছু চিন্তা করিনি। হঠাৎ বাড়ি থেকে চিঠি এলো। সেটা পড়ে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তুমি ছাড়া এসব কথা তো আমি আর কাউকে বলতে পারিনা, এটা তো তুমি জানোই।”
হাসিব একটু দম নিয়ে ম্লান হেসে বলে, “ফোন করার কথা মনে ছিল না। এতো কিছু আসলে ভাবিনি। চিঠিটা পড়েই তোমার কথা মনে হল। তাছাড়া শরীরটাও ভালো লাগছে না।”
হাসিব কথা শেষ করে দেখে ঝর্নার দু’চোখে অশ্রু টলমল করছে। ঝর্না কিছু না বলেই ঝড়ের বেগে ড্রয়িং রুম থেকে বের হয়ে গেল। ফিরে এলো খানিক বাদেই। হাতে একটা খাম নিয়ে।
ঝর্না ওর দিকে না তাকিয়ে মুখটা কঠিন করে বলল, “এতে টাকাটা আছ। বাইরে ড্রাইভার অপেক্ষা করছে। তোমাকে মেসে পৌঁছে দিয়ে আসবে।”
হাসিব মাথা নাড়ে, “আরে নাহ! লাগবে না।”
ঝর্না হাসিবের চোখে চোখ রেখে শান্ত স্বরে বলে, “ হ্যাঁ লাগবে। আমি বলছি, তাই লাগবে!”
কথাগুলো বলতে গিয়ে ঝর্নার চোখে আবারো পানি চলে এলো।
হাসিব ঝর্নার চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। এই মেয়েটার চোখ দু’টো তো অসম্ভব সুন্দর! এই চোখের দিকে তাকিয়ে তো একটা জীবন অনায়াসে কাটিয়ে দেয়া যায়!
হাসিব মাথা নাড়ে। হাতের খামটার দিকে তাকিয়ে ওর চোখেও পানি চলে আসে - এসব আমার মনের অশুভ কল্পনা। আর কিছু না। আর কিছু না।

বিরতি:

ড্রাইভার মেসের সামনে দাঁড়িয়ে খোকনকে ডাক দেয়। ঝর্নাদের বাসা থেকে বাসায় আসার পথে প্রচণ্ড জ্বরে হাসিব বেহুশ হয়ে গেছে। খোকনের ডাকাডাকিতে মেসের ভেতর থেকে আরও কয়েকজন বের হয়ে এসে হাসিবকে ধরাধরি করে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়।
রাতে হাসিবের জ্বর আরও বাড়ে। মেসের লোকজন কাজ থেকে ফিরেই হাসিবকে নিয়ে হামলে পড়ে। ডাক্তার নিয়ে আসা হয়। ডাক্তার হাসিবকে দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে যায়। ভয়ের কিছু নেই। জ্বরটা একটু বেশী তবে ঠিক হয়ে যাবে। কিভাবে কিভাবে যেন সেই ঔষধ কেনা হয়ে যায়। হাসিব ঘুমের ঘোরে কেবল টের পায় সে এক অতল গহ্বরের ভেতর পড়ে যাচ্ছে। গভীর থেকে গভীরে সে নেমে যাচ্ছে সেই অতল গহ্বরে অন্ধকারে।
হাসিব ঘুমাচ্ছে দেখে সবাই একে একে রাতের খাবার খেতে চলে যায়।
“আপনারা যান, আমি আসছি” বলে সেলিম সাহেব হাসিবের পাশে বসে ওকে জলপট্টি দিতে থাকেন। হঠাৎ জ্বরের ঘোরের মধ্যেই হাসিব বিছানার উপর ধড়মড় করে উঠে বসে। সেলিম সাহেবের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই সে এলোপাথাড়ি কি যেন খুঁজতে থাকে।
“কি হয়েছে হাসিব? এইভাবে কি খুঁজছ তুমি? কিছু হারিয়েছে?”
হাসিব শূন্য দৃষ্টিতে একবার সেলিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলে, “সেলিম ভাই। আমার পকেটে একটা খাম ছিল। খামটা খুঁজে পাচ্ছি না সেলিম ভাই!”
সেলিম সাহেব ধীরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, “খামে কি টাকা ছিল?”
“হ্যাঁ।”
“পাঁচ হাজার। টাকাটা বাসায় পাঠানো দরকার। খুব জরুরি।”
সেলিম সাহেব হাসিবের হাত ধরে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে বলেন, “টাকার খামটা আমার কাছে আছে হাসিব। তোমাকে ধরাধরি করে ঘরে আনার সময় খামটা তোমার পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল।”
সেলিম সাহেবের কথা শুনে হাসিব একটু নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়ে।
“তুমি অসুস্থ। এখন বিশ্রাম নাও। সকালে অফিস যাবার পথে টাকাটা আমি তোমার বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দেব। এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর।”

বাস্তবতা,ঘোর অথবা বিভ্রান্তি:

হঠাৎ অনেক রাতে একটা গাড়ি ওদের মেসের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঠিক মেসের সামনে না একটু দূরে। যতটা দূরে গেলে কাছে থেকেও চোখের আড়ালে যাওয়া যায়। এক সময় গাড়িটা থেকে একটা মেয়ে নেমে আসে। অন্ধকারে দূর থেকেই মেয়েটা মেসের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। সেলিম সাহেব আজ ছাদে একাই আছেন। বাকিরা সবাই ঘুমে। তার ঘুম আসছে না। বাড়িতে তার পাঁচ বছর বয়সের মেয়েটার শরীর খুব খারাপ। মেয়েটাকে দেখতে যেতে অফিসে ছুটির আবেদন করেছিলেন। ছুটি মঞ্জুর হয়নি।
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা কে সেটা সেলিম সাহেব দেখতে না পেলেও বুঝতে পারেন। অনেক দিন ধরেই এঁকে তিনি দেখে আসছেন। তিনি জানেন এই মুহূর্তে যে মেয়েটার চোখ বেয়ে ভালোবাসার পবিত্র অশ্রু গড়িয়ে নামছে সেটা কেউ দেখতে পাবে না। পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে যা দেখা যায় না, কেবল বোঝা যায়। কিন্তু যার সেটা বোঝার কথা, সে-কি সেটা বোঝে
আমরা জানি না। কোন দিন জানতে পারবো কিনা তাও আমাদের জানা নেই। রহস্যময় এই প্রকৃতি অকারণেই তার সৃষ্টির সবচেয়ে সুন্দর জিনিষগুলো মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এরই বা কারণ কি?
আকাশে আজো চাঁদ আছে। একটু ঠাণ্ডা বাতাসও আছে।
সেলিম সাহেব গান ধরেন। মনের ভেতর পাওয়া না-পাওয়ার দুঃখ নিয়ে সেলিম সাহেব গান গাইবেন আজ। সেই গানে গলা মিলিয়ে মনের দুঃখ ভুলতে আকাশ বাতাস সবাই কাঁদবে। অনেক দুঃখ জমেছে এই পৃথিবীর দেখা অদেখা প্রান্তরে।
গত তিন চার দিন কিংবা সপ্তাহ খানিক আগের ঘটনা। একটা কাজের জন্য গুনে গুনে দশ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন তিনি। জীবনের এই দীনতা তিনি আর সহ্য করতে পারছিলেন না। হাসিবের জন্য পাঁচ হাজার টাকা একটা খামে ভরে তিনি আলাদা করে রেখেছেন। বাকি পাঁচ হাজার রেখেছেন নিজের পরিবার আর মেয়ের চিকিৎসার জন্য।
সেলিম সাহেব জানেন না তার মেয়ের মৃত্যু সংবাদ ভোর বেলাতেই তার কাছে এসে পৌঁছাবে। সেকারণেই হয়তো অনাগত বিষণ্ণতায় তার গাওয়া গানটার অন্যরকম একটা সৌন্দর্য ধরা পড়ে চন্দ্রালোকিত এই রাতে।

“নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে
ধর বন্ধু আমার কেহ নাই
তোল বন্ধু আমার কেহ নাই ।।”


হাসিবের ডায়রি থেকে:

এক সময় সব কিছু শান্ত হয়ে আসে। অস্থিরতাও! অনেক কিছু ভাবতে হয় আমাকে। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে পথে নামতে হয় আমাকে। কারণ এখন এই যন্ত্রণাই এখন আমার বেঁচে থাকার মন্ত্র। মনের ভেতর আমার আত্মাকে আরও কিছুদিন দগ্ধ হতে হবে সব কিছু শেষ হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত।

আরও কিছু দিন
আরও কিছু আগুনে পুড়ে
আরও কিছু অসহ্য কথা শুনতে শুনতে
আরও কিছু অসময়ের অযাচিত দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে
একদিন সময় ফুরিয়ে যাবে
একদিন হয়তো দেখব এসব কিছুই অর্থহীন ছিল
একদিন হয়তো বুঝবো এভাবে গল্পটা শেষ না হলেও পারতো।


আমার অন্যান্য লেখাঃ

১) একটি অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প
২) ফেরা
৩) জয়ানালের মধ্যরাতের কবিতা
৪) নিগূঢ় প্রতিবিম্ব
৫) পুনর্জাগরন
৬) একজন জাহেদা বেগম
৭)গল্পঃ আক্ষেপ
৮) পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রেমের গল্পটা
৯) শেষ পর্যন্ত
১০) কোন এক অনিয়ন্ত্রিত সকালে
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:৩৯
৫টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দাসত্বের শিকল ভাঙার স্বপ্ন দেখা এক ক্রান্তদর্শী ধূমকেতু ওসমান হাদী।

লিখেছেন মুঃ গোলাম মোর্শেদ (উজ্জ্বল), ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪২

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশে যে ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তাহলো বিদেশী প্রভুরদের দাসত্ব বরণ করে রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে দেশের মানুষের উপর প্রভুত্ব করা , আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×