somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রেমের গল্পটা

০৮ ই জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অল ইন্ডিয়া রেডিওর অফিসটা গোহাটি বাজারের কাছেই। বাজারের সাথে লাগোয়া ভিক্টোরিয়ান কায়দার যে বড় বাড়িটা আছে ওটাই অল ইন্ডিয়া রেডিওর অফিস। বাড়িটা শতায়ু এবং বেশ জীর্ণ হলেও এর আভিজাত্য এখনো টিকে আছে। এই মুহূর্তে অফিসের সামনের পোর্চে একটা মারুতি জিপ দাড়িয়ে আছে ষ্টেশন ডিরেক্টর মিসেস কিরণ দেব বর্মণের অপেক্ষায়।
এদিকে সন্ধ্যার পরপরই চারদিক সুনসান হয়ে যায়। রাত আটটা বাজলেই মনে হবে যেন গভীর রাত। ষ্টেশন ডিরেক্টর মিসেস কিরণ দেব বর্মণের আজ একটু দেরীই হয়ে গেল। তবে সমস্যা নেই, সাথে গাড়ি আছে। বাসায় পৌছাতে বেশী সময় লাগবে না। তবে বাসায় পৌঁছেই হুলুস্থুল শুরু হয়ে যাবে। তিনি বাসায় পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত তাঁর ছেলে দু’টো পড়ার টেবিলে বসবে না। এতো পাজি হয়েছে ওরা! অথচ কদিন আগেই এই এত্তটুকু ছিল! আহ! কিভাবে দিন পার হয়ে যায়! সময় যত যাচ্ছে দিককে দিন ছেলে দু’টো পাজির পাঝাড়া হয়ে উঠছে! এখনই ওদের শায়েস্তা না করলে পরে পশ্চাতে হবে।
এতো কিছুর পরও ছেলেদের নানান দুষ্টুমির কথা ভেবে মিসেস কিরণের ঠোঁটের কোণে প্রশ্রয়ের হাসি দেখা যায়। তবে পর মুহূর্তেই ক্ষীণ সেই হাসি সরে গিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ কাঠিন্য ফুটে ওঠে চেহারায়। নাহ! অনেক বাঁদরামি হয়েছে, আর না।
ওদের পড়তে বসিয়ে তিনি রান্না শুরু করবেন, সময় পেলে আগামী মাসের অন এয়ারে যাবে এমন কয়টা প্রোগ্রামের শিডিউলটা মিলিয়ে নিতে হবে। অনেক কাজ। অথচ অফিস থেকে বের হতেই দেরি হয়ে গেল।
খানিকটা বিরক্তি নিয়ে তিনি গজগজ করতে করতে অফিস থেকে বের হলেন।
গাড়িতে উঠতে যাবেন এমন সময় তাঁর চোখে পড়ল রিলে রুমের আলো জ্বলে আছে।
“অ্যাই সুবীর, রিলে রুমে আলো জ্বলছে কেন?”
সুবীর এই রেডিও ষ্টেশনের রেকর্ডারের কাজ করে। সময় সুযোগ মতো ম্যাডামের বাসার কিছু ফাই ফরমাশের কাজও করে দেয়। মিসেস কিরণের প্রশ্নের জবাবে সুবীর হাত কচলাতে কচলাতে চওড়া হাসি দিয়ে বলল,
“অমর দাদা আজ স্টেশন দখল করেছে ম্যাডাম! বলছিল, আজ কিছু অন্যরকম হবে।”
সুবীরের জবাব শুনে তিনি রিলে রুমের দিকে একবার তাকালের। মুখের হাসিটা আবার ফিরে এলো তার। অমর ভার্মা দিল্লী থেকে এসেছে। প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ। দারুণ উচ্ছল ছেলে। সারাক্ষণ হাসি ঠাট্টা করে চারপাশ মাতিয়ে রাখে। আজ আবার কোন পাগলামি মাথায় চেপেছে কে জানে? গাড়িতে উঠে মুখের হাসি নিয়ে বহুদিন পর কর্মস্থল ত্যাগ করলেন তিনি।

ওদিকে রিলে রুমের সাউন্ড প্রুফ রুমে অমর ভার্মা নাটকীয় ঢঙ্গে বলে চলেছে : -
“নিশুতি রাত। হাফলং ষ্টেশন। আমি ষ্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলাম। আধঘণ্টার মধ্য ট্রেন চলে আসার কথা কিন্তু চলে এলো ঝড়!
অমর মুখ দিয়ে ঝড়ের দমকা হাওয়া বয়ে যাওয়ার মতো একটা শব্দ করে শ্রোতাদের তুমুল ঝড়ের রাতের কথা মনে করিয়ে দিয়ে দ্রুত লয়ে বলতে থাকে-
“ঝড়টা এলো যেন শিশুদের মতো খেলতে খেলতে, বিদ্যুৎ শিখার তীব্র ফলায় আকাশের বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে চিড় ধরাতে ধরাতে! ঝড়ো হাওয়ায় গাছগুলো এমনভাবে ঝুঁকে যাচ্ছিলো যেন তার হুঁশ হারিয়ে ফেলবে!!...টিনের চালে গাছের ডালপালাগুলো চাবুকের মতো আছড়ে পড়ছিল। খানিক-বাদেই মুহুর্মুহু বজ্রপাতের সাথে মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হল। প্রকৃতি যেন আজ তৈরি হয়ে এসেছে - তীব্র রোষে পৃথিবীকে আজ ধ্বংস করে দেবে! বুম!”

প্রচণ্ড উত্তেজনায় টেবিলে ধাম করে একটা চাপড় দেয় অমর-

“আর এইসবের মধ্যে আমি প্লাটফর্মের অপর প্রান্তে অন্ধকারে যেন একটা অবয়ব দেখতে পেলাম। আমার হাতে একটা সিগারেট ছিল, কিন্তু ম্যাচ নেই। হাঁক দিয়ে আগন্তুকে জিজ্ঞেস করলাম-
“এই যে ভাই, আপনার কাছে ম্যাচ হবে?”
“হঠাৎ এক দমকা হাওয়া সেই আগন্তুকের গায়ে জড়িয়ে রাখা চাদরটা হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে দিল!”

অমরের গলার স্বর হঠাৎ করে খাদে নেমে যায়-

“ওহ! এ যে একটা মেয়ে!”
“ছোট ছোট চোখ দু’টোয় কি অদ্ভুত গভীরতা!”
“চিবুকের পাশ থেকে ওপরের দিকে, গালের কাছটায় একটু উঁচু হয়ে গেছে। বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে গালের ওপর।”
“ছোট্ট একটা নাক, যেন খুব তাড়াহুড়ায় নাকটা লাগানো হয়েছে।”
“সোনালী চুল...”

অমরের মুখে একটা লাজুক হাসি ফুটে ওঠে। একই সাথে ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন হুহু করে উঠছে! কথা বলতে বলতেই লজ্জিত ভঙ্গিমায় মাথা ভরা ঘন চুলে হাত চালিয়ে নেয় সে, যেন লুকিয়ে প্রেমিকাকে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। ক’দিন আগে হাফলং ষ্টেশনে দেখা হওয়া মেয়েটার মিষ্টি চেহারাটা মনে পড়ে যায় তার। মেয়েটাকে নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছে সে। সে কথা ভেবেই ওর চোখের তারায় খুশির দ্যুতি খেলা করতে থাকে।

তারপর একটুখানি বিরতি। অমরের গলার স্বর এবার দ্রুত হয়ে ওঠে-

“মেয়েটাকে দেখা মাত্র ছেলেটা সিদ্ধান্ত নেয় ওকে গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচিয়ে একটা সাদা ঘোড়ায় তুলে নিয়ে পালিয়ে যাবে সে অনেক দূরে...
টগবগ...টগবগ...টগবগ...”
নিজের সাথে রেডিওর শ্রোতাদেরকেও ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে অমর ভার্মা।
“কিন্তু সেখানে না ছিল গুণ্ডারা, না ছিল সাদা ঘোড়া!”

আবার নীরবতা!

“চারপাশে ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দ।”
“মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে আমি গলা চড়িয়ে ক্ষমা চাইলাম,
“মাফ করবেন! আমি অন্ধকারে আপনাকে ভালভাবে দেখতে পাইনি। আপনাকে ছেলে ভেবে ম্যাচ চেয়েছিলাম!!”
“মেয়েটার জবাব – কিছু না, এক রাশ নীরবতা! শান্ত দৃষ্টিতে শুধু একবার তাকিয়ে দ্যাখে। কি মোহনীয় আর জাদুময় সে দৃষ্টি!”
“আমি ভেতর ভেতর অস্থির হয়ে উঠি। মেয়েটা কথা বলে না কেন? একটু হাসে না কেন? কিছু জিজ্ঞেস করে না কেন? আমি আনমনেই বলে উঠি-
“সিগ্রেট?...ওহ! সরি!”
হঠাৎ ... যেন ... মালা ছিঁড়ে এক ঝাঁক মুক্তা ঝরে পড়লো... মেয়েটা মৃদু কণ্ঠে বলে উঠলো-
“এক কাপ চা!”
...
“ইয়েস!!!”
...
...
“ফুলের নকশা তোলা চায়ের কাপে গরম চা নিয়ে আমি প্লাটফর্মের দিকে পড়িমরি করে দৌড়ালাম। অন্যকোন দিকে আমার খেয়াল ছিল না শুধু এতটুকুই যেন চা পড়ে না যায়! প্লাটফর্মের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতেই আমি ট্রেনের হুইসেল শুনলাম।”
শঙ্কিত কণ্ঠে মাইকের সাথে মুখ লাগিয়ে অমর বলতে থাকে,
“দৌড়াতে দৌড়াতেই আমি ট্রেনটাকে প্লাটফর্মে প্রবেশ করতে দেখলাম। বুকটা ধ্বকধ্বক করে উঠলো অজানা আশংকায়। আমার জানা নেই ট্রেনটা কি আমার, না মেয়েটার? রেলের গার্ড লাল পতাকা দেখানোর সাথে সাথে সবুজ পতাকায় উড়িয়ে দিল।”
হুসসসস...হুসসসস...হুসসসস...
ট্রেনটা চলে গেল!
সে-ও চলে গেল!
...
“ফুলের নকশা তোলা কাচের গ্লাসে বৃষ্টির পানি জমতে থাকে। আমি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে অন্ধকারে অপস্রিয়মাণ ট্রেনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি।”
...
নিশুতি রাত। আকাশে আজ একটা ফ্যাকাসে চাঁদ উঠেছে। গোহাটির অল ইন্ডিয়া রেডিওর রিলে রুমের নির্জনতায় দিল্লীর উচ্ছল ছেলে অমর ভার্মার বুকের গভীর থেকে একটা হাহাকার উঠে আসে-
“এটা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট প্রেম কাহিনী।”
=============================================
Based on one of my faviorite movie: Dil se...
Starring Shahrukh Khan and Monisha Koirala

For those who haven't seen the movie:




আমার অন্যান্য লেখাঃ

১) একটি অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প
২) ফেরা
৩) জয়ানালের মধ্যরাতের কবিতা
৪) নিগূঢ় প্রতিবিম্ব
৫) পুনর্জাগরন
৬) একজন জাহেদা বেগম
৭) আক্ষেপ
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ৮:০২
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×