কোন কুক্ষণেই না জানি সামহোয়্যার ইন ব্লগের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম! দশটা বছর পার হয়ে গেল, ব্লগের ভুত ছাড়াতেই পারলাম না। কতবার ভেবেছি, অনেক তো হলো, এবার খ্যামা দিই। কিন্তু হয়নি। সাময়িক বিরতির পর ঠিকই আবার ফিরে এসেছি, অনেকটা পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের মত!
মনে পড়ে, ২০০৬ এর প্রথম দিকে বুয়েট পড়ুয়া এক ছোটভাই, রাইসুল কবির রুমন সামহোয়্যারইনের খোঁজ দিয়েছিল। রুমন নিজেই এই প্রজেক্ট এর সাথে ছিল বলে জানতাম। আর আমি প্রথম আটকে গিয়েছিলাম ব্রাত্য রাইসুর এক পোস্টে লুৎফর রহমান নির্ঝর’র কমেন্ট-পাল্টা কমেন্ট দেখে। সেই শুরু, এখনও আটকেই আছি, ছুটতে পারলাম না। ইতোমধ্যে পার হয়ে গেল দশটি বছর। সত্যিকারার্থে বারোটি বছর।
তখন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়বেলা। তরুণ মনে উতলা হাওয়াদের দুদ্দাড় দৌড়ানি। ধমাধম কয়েকটা আইডি খুলে ফেললাম। সবগুলো বেদখল হয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত এই ‘পদ্মপুকুর’ নিকটাই রয়ে গেছে আমার হয়ে। এই নিকটাতেই আমার বয়স হয়ে গেল দশ বছর।
বাপ্রে! দশ বছর! মুসা ইবরাহিমের মত এভারেস্ট জয়ী মনে হচ্ছে নিজেকে। এখন বুঝতে পারছি, বিখ্যাত মানুষরা কেন শেষ বয়সে আত্মজীবনী লিখতে চায়! আমি নিতান্তই অবিখ্যাত সাধারণ এক ব্লগার। দশ বছর ধরে লিখেও পোস্টের সংখ্যা একশ পার করতে পারিনি। তবুও আজ মনে হচ্ছে ‘আমার দেখা ব্লগের ১০ বছর’ টাইপ একটা কিছু লিখে ফেলি আজ।
সামহোয়্যারইন আর আমার ব্লগজীবন প্রায় একই সাথে শুরু হয়েছে। তাই সামহোয়্যারইনের পরপরই যে সব ব্লগসাইট এসেছে, যেমন প্রথম আলো ব্লগ, আমার ব্লগ, বৈঠকখানা, সোনারবাংলা ব্লগ, সচলায়তন, মুক্তমনা, সবগুলোকেই কেমন যেন শত্রুপক্ষ বলে মনে হয়েছে। লিখতে মন চায়নি ওখানে।
ব্লগের শুরুর দিকে এখানে লিখতেন সব সেলিব্রেটি লেখকরা। লুৎফর রহমান নির্ঝর, ব্রাত্য রাইসুর কথা আগেই এসেছে, ছিলেন মাসকাওয়াথ আহসান, মাসুদা ভাট্টি, আব্দুন নুর তুষার, আরিফ জেবতিক, মনজুরুল হক, অমি রহমান পিয়াল, মাহবুব মোর্শেদ, হাসান মাহমুব, ফাহমিদুল হক, তমিজউদ্দিন লোদি, মোস্তাকিম রাহী, রণদীপম বসু, অন্যমনষ্ক শরৎ, রাগিব, ফয়সল নোই, সরওয়ার চৌধুরী, কৌশিক, মানস চৌধুরী বা এ রকম আরো অনেকে, যাঁরা নিজস্ব পরিচিতি নিয়েই এই ব্লগে এসেছিলেন। বলতে চাইছি, ব্লগের বাইরেও তাঁদের সমান পরিচিতি ছিলো।
এছাড়াও ছিল হাসিন, ত্রিভুজ, অরিলের নিজের ব্লগ, চশমা পড়া নুরে আলম, আলেকজান্ডার ডেনড্রাইট, নুশেরা, যীশু, কালপুরুষ, বিবর্তনবাদী, বাফড়া, বিদ্রোহী ভৃগু, অক্ষর, বৃশ্চিক, হাল্ক, মিলটন, পারভেজ, রাতমজুর, অক্ষর, শেরিফ আল সায়ার, মুকুট, জেমসবন্ড, এক্সিমো, কনফুসিয়াস, আব্দুর রাজ্জাক শিপন, মানবী, সন্ধ্যাবাতি, বিবর্তনবাদী, রাশেদ, সোনারবাংলা, মেহরাব শাহরিয়ার, মাহবুবা আখতার, রিফাত হাসান, বিডি আইডল, ঘনাদা, আরিফুর রহমান, সুমন কর, .. .. .. অনেক অনেক নাম। এত ভালো লিখতো এরা সবাই! কিন্তু কি এক অজ্ঞাত কারণে একে একে সবাই হারিয়ে গেছে। এদের মধ্যে খুব অল্পজনই এখনও নিয়মিত লিখছেন। বেশিরভাগই অফলাইন অথবা অনলাইনে থেকে শুধু লেখাগুলো দেখেন, কোন পোস্ট বা কমেন্ট করেন না। তার মানে নেশাটা এখনও ছাড়তে পারেননি। সামহোয়্যার ইনের এই বিষয়টা ভেবে দেখা প্রয়োজন, কেন লেখকরা এমন শীতনিদ্রায় চলে যায়, অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
এখন ব্লগে যেমন ‘চাঁদগাজী’ সেলিব্রেটি ব্লগার হিসেব আবির্ভূত হয়েছেন, বিপুল পরিমাণ পোস্টের সাথে প্রায় সবার পোস্টেই প্রথম মন্তব্যকারী হিসেবে বিরতিহীনভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, ঠিক এমনই, প্রতিটা যুগেই এক দু’জন করে সেলিব্রেটি ব্লগার ছিল। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে দি এ টিম, নাফিস ইফতেখার, সাঁজবাতির রুপকথা, নোবেলজয়ী, ফিউশন ফাইভ, চিকনমিয়া, রাজামশায়, তাজুল ইসলাম মুন্না, সাম্প্রতিককালের কাল্পনিক ভালবাসা, এ ধরণের আরো অনেকের কথা, যারাও কালের বিবর্তনে হারিয়ে গিয়েছে। তাই খুব ভয় হয় চাঁদগাজীকে নিয়ে।
তবে, ব্লগাররা আসবে, ব্লগাররা যাবে, কিন্তু এই সামহ্যোয়ারইন থেকে যাবে চিরটাকাল। সেই সাথে অন্য সবার মত আমার লেখাগুলোও থেকে যাবে এই কালের আয়নায়। এটুকুই পাওনা।
এই দশ বছরে ভার্চুয়ালজগতের সীমানা পেরিয়ে বাস্তবজগতেও বেশ প্রভাব রেখেছে এই ব্লগ। শুরুটা সম্ভবত হয়েছিল ব্লগের একেবারে প্রথমদিকে একটা অসুস্থ মেয়ের প্রতি সাহায্য চেয়ে করা পোস্ট থেকে (আমার ঠিকমত পোস্টদাতা এবং শিরোনামটা মনে পড়ছে না, পুরোনো কেউ থাকলে মনে করিয়ে দিতে পারেন), যদিও পরে জানা গিয়েছিল যে আদৌ এ ধরণের কোন অসুস্থ মেয়ে এক্সিস্টই করেনি তখন। তখন অনেকেই খুবই আপসেট হয়েছিল, কারণ এটা ছিল এমন এক সময়ে, যখন ব্লগের প্রায় প্রত্যেকেই প্রত্যেককে চেনে, অন্তত লেখার মাধ্যমে। সে কারণে সকলেই বিষয়টা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিল। তাই এই ধরণের একটা ধাপ্পাবাজী সবাইকেই একটা ধাক্কা দিয়ে গিয়েছিল। তবুও এ ধরণের আবেদনময় পোস্ট থেমে থাকেনি।
আমার মতে সিআরপি’র ভেলরি টেইলরকে নিয়ে আরিফ জেবতিকের পোস্টটিইএই ঘরানার সেরা পোস্ট এখন পর্যন্ত। এই পোস্টটা একটা ব্লগীয় আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, যেটা পরবর্তীতে ভার্চুয়ালজগত ছেড়ে বাস্তবজীবনে এসে পড়ে এবং সফলও হয়। ভেলরি টেইলরের প্রতি যে অন্যায় হতে যাচ্ছিল, সেটা বন্ধ হয় এই আন্দোলনের ফলে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়েও সম্মিলিতভাবে এই ব্লগ ভুমিকা রেখেছে। এই ব্লগে লিখেই অনেকে বাস্তবজীবনে শক্তিশালী লেখক-কবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন, একুশের বইমেলায় বই প্রকাশ করেছেন।
এই ব্লগে পদ্মপুকুর 'নিক' এ আমার প্রথম পোস্ট এর শিরোনাম ছিল ”অস্পষ্ট কথামালা’। দীর্ঘদিন পর এই পোস্টে গুছিয়ে কিছু কথা লিখতে চেয়েছিলাম, শেষ মেষ হলো সেই অস্পষ্ট কথামালাই। এলোমেলো কথায় আমার দশ বছরের ব্লগজীবন এখানেই থামাচ্ছি। যেহেতু আমি প্রথম দিককার ব্লগার, সব প্রথমেরই একটা আলাদা মুগ্ধতা আছে, ওই যে গান আছে না- “প্রথম জীবনের ভালোবাসা-স্বপ্নের মতো লাগে...” ওই রকম আর কি! তাই যাঁদের কথা আমি বলছি, সবাই-ই প্রথম দিককার, এখনকার অনেকেই হয়তো চিনবেন না সবাইকে। তবে যাঁদের কথা আমার এই মূহুর্তে মনে হয়েছে, তাঁদের কথাই এখানে লিখেছি, এর বাইরেও অসংখ্য শক্তিশালী, জনপ্রিয় লেখকরা তখনও ছিলেন, এখনও আছেন।
২০০৮ এর নভেম্বরে আমার এক পোস্টে চোরকাঁটা বলেছিলেন “হিট ফিট বুঝিনা!! ব্লগ লিখবেন নিজের ভালো লাগে বলে!! হিট ধুইয়া কি পানি খাইবেন? আর যারা পড়তে পছন্দ করে তাদের জন্য ব্লগ জুশ!! খত কিছু আছে। সবাই ইচ্ছামতো লিখুক। কুনু প্রবলেম নাই। খালি গালাগালি বাদ। বাম, ডান, রাজাকার, আঁতেল, সুশীল, জীন, পরী, চোর, ছ্যাঁচোর, সুন্দরী, কুশ্রী, লুল, শিশু, বুড়া- যার যা ইচ্ছা। পড়লে পরবেন, না পড়লে নাই। এখন ১০০ জন অনলাইনে থাকে। সামনে ৫০০ এর উপরে যাবেই। ১ মিনিট পর পর পোস্ট পরতে থাকবো? কয়টা দেখবেন? তাই সা ইন জিন্দাবাদ।
এখন চোরকাঁটার সেই ‘সামনের সময়’ এসে গেছে। প্রতি মিনিটে পোস্ট পরছে। প্রথম পাতায় একটা লেখা খুব বেশি সময় থাকছে না। আগের মত প্রতিটা লেখা ৪ ডিজিটে পড়া হচ্ছে না, ৩ ডিজিটে মন্তব্য পড়ছে না। পুরোনো লেখকদের অদৃশ্য হওয়ার এটা একটা কারণ হলেও হতে পারে?
শরৎচন্দ্র চট্টপধ্যায় ‘বিলাসী’তে বলেছিলেন, “অতিকায় হস্তি লোপ পাইয়াছে, কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে”.. .. আমি তাই আজও টিকিয়া আছি। অবশ্য এটা এমন এক কলিযুগ, যেখানে টিকিয়া থাকাটাই স্বার্থকতা।
আমার দশ বছরপূর্তিতে নতুন পুরাতন সকল ব্লগারকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। আপনারা সবাই আমার পরিবারেরই অংশ। সবাই ভালো থাকবেন, নিরন্তর শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৯