ছাত্রজীবন শেষ হতে না হতেই বাবার মৃত্যু আর তার ফেলে যাওয়া সংসারের ভারে অল্পদিনের মধ্যেই আমার অর্জিত দর্শনের দেউলিয়াত্ব বুঝতে পারলাম। একদিন আবিষ্কার করলাম, আমার পরনের শার্টটা ময়লা, কোমরের বেল্টটা বহু ব্যবহৃত, জুতোয় সেলাই পড়েছে কয়েক জায়গায়; আর এগুলো পরেই মাসের পর মাস বাসে ঝুলতে ঝুলতে আমি অফিসে যাই, আসি, সংকীর্ণ ঘুপচি ঘরের আলো বাতাসহীন অন্ধকারে বসে সামান্য টাকায় পুরো মাস কিভাবে চলবে তার হিসাব করি।
- কি ভাই এখানে আছেন, নাকি নাই ?
বসে ছিলাম একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর রিসিপশনে, এসেছিলাম চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। আমার সাথে ইন্টারভিউ দিতে আসা সপ্রতিভ চাকরি প্রার্থীদের একজন পাশ থেকে ডাকছিলেন। নিজের ভাবনায় এত বেশী মগ্ন হয়ে ছিলাম যে তার কথা শুনতে পাইনি।
- ইন্টারভিউ দিতে এসে ঘুমায় গেলেন নাকি ভাই?
আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি। বেশ জোরে হেসে উঠল বাকি সবাই।
- কোথায় আছেন আপনি? জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা।
আমার কোম্পানির নাম বলায় কেউ চিনতে পারলো না। জানতে চাইল, পড়ালেখা করেছি কোথায়। ছেলেটার প্রশ্ন করার ধরন বেশ উদ্ধত, অন্য সময় হলে উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকতাম। কিন্তু আজ চাকুরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছি, আজ আমাকে বিনয়ী হতেই হবে। নম্রভাবে তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম। আমার সাথে কথা শেষ করে তারা নিজেদের আলাপে ফিরে গেলেন। পাশে মোটা মত, চ্যাপ্টা ফর্সা চেহারার একটা মেয়ে বসেছিলেন। তিনি নামজাদা বিজনেস স্কুল থেকে পাশ দিয়ে নামী ব্যাংকে চাকরি করেন। আলাপটা উঠেছিল তাকে নিয়ে- ভাল প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেও কেন তিনি এখানে ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন। মেয়েটি জানালো, কোম্পানি ভাল হলেই যে কেরিয়ার গ্রোথ ভাল হবে এমন নয়। তাদের আলোচনায় অংশ নেবার যোগ্যতা আমার ছিল না। কথা শুনে বুঝেছিলাম, মাশলো সাহেবের "হায়ারআর্কি অফ নিডের" উচ্চস্তরের মানুষ ছিলেন তারা, আর আমি ছিলাম একেবারে নিম্নস্তরে, শরীরবৃত্তি-অলাদের ঘরে।
কোন কারণে ইন্টারভিউ খুব ধীরে আগাচ্ছিল। এতক্ষণ বসিয়ে রাখা হয়েছে দেখে স্যুট পরা একটা ছেলে ঘন ঘন বিরক্তি প্রকাশ করছিল। এবার সে উঠে দাঁড়িয়ে রিসিপশনিস্ট মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে ইংরেজীতে বলল, ঘন্টার পর ঘন্টা তার বসে থাকার সময় নেই, তার ইন্টারভিউ কোন ভাবে আগে নেওয়া যাবে কিনা। মেয়েটি মিষ্টি হেসে জানালো, ব্যাপারটায় সে দুঃখিত, কিন্তু তার আসলে কিছু করার নেই। ছেলেটা আরও কিছু কড়া ইংরেজি বলে রাগ করে ইন্টারভিউ না দিয়েই চলে গেল। তার চলে যাওয়া দেখে বেশ অবাক হলাম। একটু দেরি হবে বলে এমন সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে। আমাকে শেষ রাত পর্যন্ত বসিয়ে রাখলেও ইন্টারভিউ না দিয়ে আমি যাচ্ছি না, ভাবলাম মনে মনে। ছেলেটা নামজাদা সিগারেট কোম্পানিতে চাকরি করে, এখানে ইন্টারভিউ দেয়াটা হয়ত তার জন্য তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
দুপুরের পরে ইন্টারভিউয়ে আমার ডাক পরলো। ইন্টারভিউ বোর্ডে তিন জন ছিলেন। তখনো ইন্টারভিউ দেবার কলাকৌশল শিখিনি, যতটা পারলাম সহজ সরল ভাবে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন বিষয়ে, প্রসঙ্গে প্রশ্ন করে করে তারা আমাকে নার্ভাস করে ফেললেন। আমার প্রকৃতি এমনিতে সরল, নার্ভাস অবস্থায় এই সরলতা অতি মাত্রায় বেড়ে গিয়ে নিরেট বোকামিতে পরিণত হয়। অতি সরলতা যে কর্পোরেট জগতে অচল এটা কিছুটা হলেও বুঝতাম। ওখান থেকে বের হয়ে মনে হল, বেশি সরলতার জন্যই হয়ত ইন্টারভিউটা ভাল হল না। পরের দিন রাতে মারুফ ভাইকে পড়াতে গিয়ে ইন্টারভিউয়ের কথা বললাম। সব শুনে তিনি বললেন, মনে হচ্ছে ভালই হয়েছে। বেশী দিন অপেক্ষা করতে হল না, সপ্তাহখানেক পরেই একদিন সেই অফিস থেকে ফোন এলো। পরের ধাপের ইন্টারভিউয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছি। ফাইন্যান্স চিফ এর সাথে কদিন পরে আমার ইন্টারভিউ।
মারুফ ভাই আমাকে বলেছিলেন, বিদেশী এই ফাইন্যান্স চিফ তুখোড় বুদ্ধিসম্পন্ন এবং দূর্দান্ত প্রফেশনাল। তুখোড় বুদ্ধির ব্যাপারটা কিছুটা বুঝলেও দূর্দান্ত প্রফেশনাল ব্যাপারটা যে ঠিক কেমন তা কিন্তু আমার মাথায় ধরলো না। ভাবলাম একাউন্টিংয়ের বিদ্যা আরেকটু ঝালাই করে নিলেই বোধহয় বুদ্ধি এবং প্রফেশনালিজম দুটোকেই কুপোকাত করতে পারবো। অনেক আশা নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। কিন্তু ইন্টারভিউয়ের অল্প সময়ের মধ্যে নিজেই কুপোকাত হয়ে গেলাম। প্রথমত, চিরকাল দেশী ইংরেজি শুনে শুনে বিদেশী সেই লোকের খাস আমেরিকান উচ্চারণ আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল। তিনি প্রশ্ন করছিলেন ঝড়ের বেগে। আমি কোন প্রশ্নই ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে বারবার তাকে পুনরাবৃত্তি করতে বলছিলাম। তার উপর ভদ্রলোক একাউন্টিং বিষয়ে কোন প্রশ্নই করছিলেন না। সেদিন ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত অর্থনীতির কি একটা খবর নিয়ে আমার সাথে আলোচনা শুরু করে দিলেন। এই ইন্টারভিউটা কিন্তু খুব বেশী দীর্ঘ হল না। প্রশ্ন করলেন অনেক, কিন্তু খুব মাপা সময়ের মধ্যে। বের হয়ে বুঝলাম, ইন্টারভিউটা ভালো হল না। সেদিন রাতেই মারুফ ভাইয়ের বাসায় গেলাম। ভেবেছিলাম সব শুনে মারুফ ভাই হয়ত আশার কথা কিছু বলতে পারেন। কিন্তু দেখলাম, তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, শুধু বললেন, "চেষ্টা করতে থাক, এখানে না হোক অন্য কোথাও হয়ত হবে।" তার কথা শুনে খুব আশাহত হলাম। সত্যি বলতে কি, আম্মাকেও বাসায় ফোন করে এই ইন্টারভিউয়ের কথা বলেছিলাম। যদিও জানতাম, যেটা এখনও পাইনি সেটা সম্পর্কে আম্মার মনে আশা জাগানো ভুল হবে, তবু কেমন করে যেন ঠিকই বলে ফেলেছিলাম। আমার মন থেকে কিন্তু আশা পুরোপুরি গেল না। মনে হল, যদি চাকরিটা হয়ে যায়।
এরপর থেকে প্রতিদিনই ভাবি আজ হয়ত ঐ অফিস থেকে ফোন আসবে। কিন্তু না, সপ্তাহ পার হয়ে গেল, ফোন এল না। মারুফ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করলাম, তিনি কোন খবর দিতে পারলেন না। বললেন, আর কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখতে। যতো দিন যায় আমার অস্থিরতা ততো বাড়ে। পরের সপ্তাহ শেষ হয়ে গেল, ফোন এল না। মারুফ ভাইয়ের সাথে আবার যোগাযোগ করলাম। বললেন, এইচআরে খোঁজ নিয়ে দেখবেন। পরের দিন বিকেল থেকেই মারুফ ভাইকে ফোন দেই, কিন্তু ফোন ধরেন না। বহুবার চেষ্টা করেও কিছুতেই তাকে ফোনে পেলাম না। বুঝলাম, খবর খারাপ, কিন্তু খবরটা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। রাত দশটার দিকে মারুফ ভাই নিজেই কল ব্যাক করলেন। জানলেন, আমার চাকরিটা হয়নি। দুই জন ফাইনালি সিলেক্ট হয়েছে, আমি তাদের মধ্যে নেই। দুই মাস ধরে লালন করা স্বপ্ন মুহূর্তেই ভেঙ্গে শেষ হয়ে গেল। এই দুটো মাস কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম, ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি মুরগির খামারের কর্মচারী। ভুলে ছিলাম যে, জীবন যাপনে আমি নিতান্ত ছাপোষা, বেঁচে থাকার জন্য তুমুল চেষ্টায় রত একা একটা মানুষ। আম্মাকে খবরটা জানানো কষ্টকর হল, কেননা ছোট বোনের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে সবাই মিলে ঢাকায় থাকার ইচ্ছাটা আমার মায়ের মনে তীব্র ভাবেই ছিল। আসলে আমাদের তিন ভাইবোনকে ঢাকায় রেখে মফস্বলের নির্জন বাসায় আম্মার পক্ষে একা থাকা সম্ভব ছিল না।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুরগীর খামারের পুরনো বাস্তবতায় আবার ফিরতে হল। একদিন কি একটা কাজের সূত্র ধরে আমাদের ছাত্র এমডি আমার সাথে খুব চোটপাট করলেন। মিয়া উদ্দিন চলে যাবার পর থেকেই আমার মধ্যে একটা উড়ু উড়ু ভাব তৈরি হয়েছিল, সেই কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দেবার সময় থেকে ভাবটা বেড়ে গিয়েছিল। আমাদের ছাত্র এমডি বিষয়টা লক্ষ করেছিলেন। ধমকা ধমকি সে কারণেই করলেন, কাজটা ছিল উপলক্ষ মাত্র। অনেক দিন চেষ্টা করেও নতুন কোন চাকরির ব্যাবস্থা করতে পারছিলাম না। সীমাহীন অযোগ্যতায় নিজের উপর ঘৃণাটা দিনের পর দিন বেড়ে যাচ্ছিল। যে ভাবে চেষ্টা করলে কাজ হতে পারে, মনে হচ্ছিল ঠিক সে কাজ গুলো আমি করছিলাম না। আসলে কি, তখন পর্যন্ত নিজের ভিতরেই গুটিয়ে থাকতাম। নিতান্ত ঠেলায় না পড়লে খোলস ছেড়ে বাইরে বের হতাম না। বাহিরের কুটিল, স্বার্থপর পৃথিবীর সাথে কিভাবে যে অভ্যস্থ হয়ে সামাজিক হয়ে ওঠা যায় তার উপায় জানা ছিল না। আমার পিঠ যেহেতু দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল, তাই কোন ভাবে ঘুষ দিয়ে হলেও এই নীতিবিহীন রুক্ষ পৃথিবীর সাথে আপোষ রফা করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু ঠিক কিভাবে, কোথায় কখন যে ঘুষটা দিতে হবে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। ঠিক করলাম, এখন থেকে বড় ভাইদের মধ্যে যারা ভাল জায়গায় আছে, তাদের সাথে দেখা করে চাকরির খোঁজ করব, সুযোগ মত সিভিও দিয়ে আসবো। কিন্তু ঐ ঠিক করা পর্যন্তই, চাকরির প্রয়োজনে কারো সাথে যোগাযোগ করার কথা ভাবতে গেলেই মনের মধ্যে কেমন একটা সংকোচ, মানুষকে বিরক্ত করার তীব্র অস্বস্তি দানা বাঁধতো। ফোন করবো করবো করেও কোন বড় ভাইকে আর ফোন করা হত না, দেখা করে সিভি দেওয়া তো দূরের কথা।
একদিন অনেক সাহস সঞ্চয় করে ভাল কোম্পানীতে ভাল চাকুরি করেন এমন এক বড় ভাইকে ফোন দিলাম এবং তার সাথে দেখা করার অনুমতি চাইলাম। তার কথা শুনে মনে হল তিনি অনেক ব্যস্ত আর ঝামেলার মধ্যে আছেন, কিন্তু তিনি আমাকে সময় দিতে রাজি হলেন এবং পরেরদিন বিকেলে গুলশানে তার অফিসে যেতে বললেন। পরদিন সেই বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য তৈরি হচ্ছি, অফিস থেকে সেদিন একটু আগে আগে বের হবার প্লান। অফিস থেকে বের হব এমন সময়ে আমার মোবাইলে টিএনটি নম্বর থেকে একটা ফোন এল। মাস খানেক আগেও টিএনটি নাম্বার থেকে ফোন এলে চমকে উঠতাম। যে অফিসে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম সেখান থেকে সবসময় টিএনটি নাম্বার থেকে ফোন আসতো, একটা নির্দিষ্ট নাম্বার নয়, একেকবার একেক নাম্বার। ততদিনে সেই চাকরিটা না পাবার দুঃখ প্রায় কাটিয়ে উঠেছি। ভাবলাম বোধহয় সেই বড় ভাইয়ের অফিস থেকে ফোন। কিন্তু ফোন এসেছে সেই কোম্পানি থেকেই। সুকণ্ঠী একটি মেয়ে বললো, তাদের এইচআর ম্যানেজার আমার সাথে কথা বলতে চান, কবে আমি তাদের অফিসে যেতে পারবো।ওখানে শেষ ইন্টারভিউয়ের দেবার পর থেকে এর মধ্যে প্রায় দুমাসের বেশী সময় পার হয়ে গেছে, আমার মনে সন্দেহ হল যে হয়ত তারা আবার নতুন করে ইন্টারভিউ নিতে চায়। জানালো, তা নয়, ইন্টারভিউয়ের পর্ব শেষ, এখন তারা আমাকে জব অফার করবে আর বেতন নিয়ে কথা বলবে। বললাম, আমি আজই ফ্রি আছি, যদি এইচআর ম্যানেজারের সময় হয়, তবে এখনই তাদের অফিসে গিয়ে দেখা করতে পারি। মেয়েটি আমাকে লাইনে রেখে কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে জানালো, তাদের অফিস পাঁচটা পর্যন্ত খোলা, যদি সাড়ে চারটার মধ্যেই আসতে পারি তাহলে যেন আসি।
তখন প্রায় চারটা বেজে গেছে। সেসময়ে ঢাকার রাস্তা এখনকার মতো এতটা দূর্বিষহ ছিলনা। কাওরান বাজার থেকে সিএনজি নিয়ে আধাঘন্টার মধ্যেই গুলশানে পৌঁছলাম। সেদিনও সেই পুতুল চেহারার মাখন শরীরের মেয়েটি রিসিপশন ডেস্কে বসে ছিল। একটু হাসি হেসে, কার সাথে দেখা করতে এসেছি জানতে চাইল। আজ কেন যেন তার হাসিটাকে তাচ্ছিল্যের বলে মনে হল না। এইচআর ম্যানেজারের সাথে তাড়াতাড়িই আমার কাজ শেষ হয়ে গেল। বেতন নিয়ে দরকষাকষি করার যোগ্যতা আমার ছিল না, শুধু কাগজ পত্রে চোখ বুলিয়ে সই করে দিলাম। আমার হাতে তিনি আরও কিছু কাগজ ধরিয়ে দিলেন, বললেন, কিছু কাজ এখনও বাকি আছে। মেডিকেল এবং সিকিউরিটি চেক শেষ হলেই কেবল আমি চাকরিতে জয়েন করতে পারবো। ভয় হল, কি জানি অতি উৎসাহ আর উত্তেজনায় ব্লাড প্রেশার বেড়ে গিয়ে মেডিকেলের পরীক্ষায় ফেল মারি কিনা। কিন্তু সেরকম কিছু হল না, সহজেই মেডিকেল এবং সিকিউরিটি পরীক্ষায় পাশ দিলাম।
মারুফ ভাইয়ের কাছে পরে শুনেছিলাম, ঐ চাকরিতে চুড়ান্ত ভাবে নির্বাচিত হওয়া দুজনের মধ্যে একজন নাকি শেষ পর্যন্ত জয়েন করেনি। অনেকদিন ঝুলিয়ে রেখে অবশেষে তিনি এই কোম্পানিতে জয়েন না করার সিদ্ধান্ত নেন। অতএব বদলি খেলোয়াড় হিসেবে আমি মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম, বদলি খেলোয়াড়ের যোগ্যতা আসল খেলোয়াড়ের সমান নয় বলে, আমার বেতন অপর সহকর্মীর প্রায় অর্ধেক ছিল। কিন্তু তার পরেও অনেক খুশি আর উৎসাহ নিয়ে মাস খানেক পরে আমি নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম। বেতন অর্ধেক হবার কারণেই কিনা জানিনা, নতুন অফিসের সহকর্মীরা কিন্তু আমাকে ঠিক সহজ ভাবে গ্রহন করলো না। পোশাকে-আশাকে, কথায় বা আচরণে আমি সেই নামী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরিজীবীদের সমগোত্রীয় ছিলাম না বলেই হয়ত এখানে আমার অভ্যর্থনাটা কিছুটা উপহাস সহকারে হল। প্রথম যেদিন এখানে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম সেদিন যে ছেলেটা আমাকে নিয়ে রসিকতা করে অন্যদের আমোদ দিয়েছিল, ইন্টারভিউয়ে ফার্স্ট হয়ে সে আমার অল্প কিছুদিন আগে এ কোম্পানীতে যোগ দিয়েছিল। জানিনা ঠিক কি কারণে আমি তার বিরাগভাজন হয়েছিলাম, ফাইন্যান্সের অন্য সহকর্মীদের মত আমি তার গুণমুগ্ধ ছিলাম না বলেই হয়ত, আমাকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ উপহাসে আমার এই সহকর্মী অন্য সকলকে মাতিয়ে রাখত। চাকরিটাকে আমি খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলাম, তাই এখানে যোগ দেবার পর থেকেই অতিমাত্রায় সিরিয়াস হয়ে গিয়েছিলাম। আমি অফিসে যেতাম সবার আগে, বের হতাম সবার পরে। কোন কাজের ডেড-লাইন এক সপ্তাহ পরে থাকলেও তিন দিনের মধ্যেই কাজ শেষ করে সুপারভাইজারের কাছে রিভিউয়ের জন্য পাঠিয়ে দিতাম। অনেকটা নিজের অজান্তেই আমার মনে হয়ত এই ভাবটা কাজ করেছিল যে, আমি যেহেতু আর সবার মত স্মার্ট নই, অতএব নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা দিয়ে সেটা আমি পূরণ করে দেবো। বলাই বাহুল্য আমার এই অতিরিক্ত নিষ্ঠা আমার সহকর্মীদের দৈনন্দিন হাসি ঠাট্টার বিষয় হয়েছিল। আমাদের পশ্চিমা ফাইন্যান্স চিফ যদিও আমাকে নিয়ে আমার সহকর্মীদের রসিকতায় কখনও কখনও আমোদ পেতেন, আমার ঐকান্তিক নিষ্ঠা কর্পোরেট পরিবেশে সবসময় মানানসই না হলেও এটাকে তিনি গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন। পরবর্তী এপ্রেইজাল বা মূল্যায়নের সময় তার চেষ্টাতেই আমার অর্ধেক বেতনের অর্ধেক কর্মচারী হওয়ার বৈষম্যটা দূর হয়েছিল। এখানে জয়েন করার পর থেকে বছর খানেক পর্যন্ত, যতদিন আমি শিখিনি যে উপহাসের জবাব উপহাস করেই দিতে হয়, অথবা বাঁকা কথার জবাব রুক্ষ ভাবেই ফিরিয়ে দিতে হয়, আমার দিন গুলো খুব নিঃসঙ্গ আর বেদনাদায়ক ছিল।
তবে দেশী মুরগির খামারের ক্ষুদ্র চাকর থেকে বিদেশী কোম্পানীর ক্ষুদ্র কিন্তু কিছুটা সৌখিন চাকরে উন্নিত হয়ে আমার জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছিল। তিন চার মাস পরে ছোট বোনের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে, আমার চিলেকোঠার এক রুমের বাসা ছেড়ে দিয়ে আম্মা আর ছোট দুই বোনকে নিয়ে সবাই মিলে তিন বেডরুমের একটা ছোট ফ্লাটে উঠে গিয়েছিলাম। ত্রিশ বছরেরও বেশী সময় মফস্বল শহরে সংসার-জীবন কাটিয়ে দেয়া আমার মা অবশেষে এই পোড়া ঢাকা শহরে বসবাস করতে এসে তার সবগুলো সন্তানকে একসাথে একই ছাঁদের নিচে পেয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর থেকে অনেক পাতাঝরা নিষ্ফল শীতের পরে সেবার বসন্তে আমাদের উঠোনের শুঁকনো বুড়ো গাছটায় আবার নতুন করে সবুজ কচি পাতা ধরেছিল। এখানে চাকরি করে কিছুকাল পরে আমি যথাক্রমে একটা ক্রেডিট কার্ড, লক্কড় ঝক্কড় টাইপ একটা পুরাতন ভাঙ্গা গাড়ি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পাশ দেওয়া মাঝারি মাপের একজন সুন্দরী স্ত্রীর অধিকারী হয়েছিলাম। এছাড়াও ঢাকা শহরে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা ২৫, ৪০ বা ১০১ পদের অখাদ্য ব্যুফে রেস্তোরাঁ ও মুরগিভাজার দোকান গুলো আমাদের জন্য তাদের দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। সারাদিন ব্যাংকের হিসাব মিলিয়ে বা পাওনাদারের টাকা পরিশোধ করে অফিসে সন্ধ্যার নাস্তায় যখন আমার সহকর্মীদের সাথে মুরগি ভাজায় কামড় দিতে দিতে শেয়ার মার্কেটের লাভ ক্ষতির হিসাব করতাম, তখন মনে হত, গরু হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেয়াটা কতই না আনন্দের.........।
(তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত)
প্রথম পর্ব: চাকুরি জীবন- বিষণ্ণ ছোলা ভাজা পর্ব: Click This Link
দ্বিতীয় পর্ব: চাকুরি জীবন - যখন দেয়ালে পিঠ: Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৪ রাত ১:৫০