somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চাকুরি জীবন - যখন দেয়ালে পিঠ

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছাত্রজীবনে জীবনের দুঃখ কষ্ট সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। সমাজ বদলে ফেলার সূক্ষ বৈজ্ঞানিক ও গভীর দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, জীবিকা অর্জনের মত মোটাদাগের বিষয়গুলো নিয়ে ভাববার সময় ছিল না। আমাদের ছাপোষা সংসারে প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধ, দেনাপাওনার হিসাব, ছোটখাট সুখ দুঃখ আর ভবিষ্যতের ভাবনা, মার্ক্সের বস্তুবাদ থেকে হেইজেনবা্র্গের অনিশ্চয়তাবাদ পর্যন্ত কঠিন সব তত্ত্ব দিয়ে একরকম মাটি চাপা দিয়েছিলাম। বস্তুবাদের বস্তুটা নিজের জীবনে কোথাও খুঁজে না পেলেও এবং আমার ভবিষৎ অনিশ্চয়তাবাদের বড় উদাহরণ হয়ে দাঁড়ালেও, শুধুমাত্র "বাদ" গুলোকে পুঁজি করে আজিজ মার্কেট থেকে সাহিত্যকেন্দ্রের ছাঁদ গরম করে রেখেছিলাম। উঠতি চিন্তাবিদ ও দেশ সেবকদের সাথে গভীর জ্ঞান আলোচনায় অংশ নিয়ে নিজেকে নব্য আঁতেলদের জায়গায় মোটামুটি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ভিত্তিক ক্ষুদ্র পড়ালেখা অনেক আগেই ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছিলাম। পরীক্ষার হলে গিয়ে সময় নষ্ট করার মত সময় আমার বেশি ছিলনা। যতটুকু সময় পেতাম পাবলিক লাইব্রেরী বা ব্রিটিশ কাউন্সিলে গিয়ে মনীষীদের লেখা পড়ে জ্ঞান সাধনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতাম। মনে মনে নিশ্চিত ছিলাম পৃথিবীতে বড় কোন কাজের জন্য এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয় পাশ দিয়ে কেরানীগিরি করা আমার কর্ম নয়।
দার্শনিক তত্ত্বের সাথে সংসার তত্ত্বের বড় পার্থক্য এই, সংসার তত্ত্ব আদ্যোপান্ত খুব স্থূল এবং নিরস একটা বিষয়। ওটা বোঝার জন্য তেমন বুদ্ধির দরকার হয়না, বরং বুদ্ধি থাকলেই তা বুঝতে দেরি হবার সম্ভাবনা। দেখবেন, যাদের বুদ্ধি বিত্ত নেই, তারা খুব তাড়াতাড়ি সংসারের নিয়মগুলো বুঝে নিয়ে অল্প বয়সে সংসারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আপনার যদি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অনেক ধন-সম্পদ বা ব্যাংকে জমানো টাকা না থাকে, তাহলে খুব সম্ভব জীবনধারণের জন্য আপনাকে শ্রম বিক্রি করতে হবে। আপনাকে একটা কিছু দিতে হবে, যার বিনিময়ে মাস শেষে আপনি কিছু টাকা পাবেন। সেই টাকায় আপনি বাড়িভাড়া শোধ করবেন, সপ্তাহের বাজার করবেন, বাচ্চার দুধ ও ডায়পার কিনবেন, মাকে ডাক্তার দেখাবেন, বিবাহ বার্ষিকীতে বা জন্মদিনে বউকে কোন একটা উপহার কিনে দেবেন, তবে এর চেয়ে বেশী কিছু নয়। আপনার যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই একটা পাশ দেওয়া থাকে, তাহলে জীবিকার বিনিময়টা হবে আপনার সময়ের সাথে। নিজের পুরো সময়টাকেই দিয়ে দিতে হবে বেচেঁ থাকার নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো জোগাড় করবার বিনিময়ে।
চাকুরীতে ঢোকার আগে আমার সময়গুলো ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পাবলিক লাইব্রেরী, বন্ধুদের আড্ডা, কবিতার খাতা, সাহিত্য আর দর্শনের পাতায় পাতায় ছড়ানো। শীতের শেষে শাহবাগ মোড়ে অশ্বথ গাছের জেগে ওঠা নতুন পাতায় বাতাসের আন্দোলন তখনও মনকে গভীর ভাবে ছুঁয়ে যেত। ক্যাম্পাসের বুড়ো আমগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঝড়ে পরা সূর্যের আলোয় জীবনকে যতটুকু দেখতে পেতাম, সেটা নিয়ে সুখী ছিলাম। হয়ত বিরক্তিকর আঁতেল আঁতেল দুর্গন্ধ একটু ছিল, কিন্তু মোটের উপর জীবনকে ভালোবাসতাম। চাকুরিতে ঢোকার পর জীবনের ছকটা পাল্টে গেল। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই অফিস, অফিস থেকে বাসায় ফিরে ঘুম, পরদিন আবার অফিস। দিনের পর দিন একই একঘেয়ে রুটিন। ছাত্র জীবনে নিজের পরিচয়টা ঠুনকো ছিল না। চাকুরিতে ঢোকার পর আসল পরিচয় টের পেলাম। বুঝলাম, আমার আগের পরিচয়গুলো ক্ষণস্থায়ী ছিল, আমার আসল পরিচয়- আমি মুরগির খামারের কর্মচারী। অনেকদিন অসাধারণ হওয়ার মিথ্যা ভান করেছি। যতদিন জীবিকা অর্জনের মত কঠোর বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনা ছিলনা, ততদিন শখের থিয়েটারে উঠতি বুদ্ধিজীবীর চরিত্রে অভিনয়টা মোটামুটি ভালই করছিলাম। মুরগির খামারের কর্মচারী হয়ে যেদিন থেকে জীবিকা শুরু করলাম, সেদিন বুঝলাম পৃথিবীটা ঠিক যেমন খুশি তেমন সাজার জায়গা নয়। আর আমার জন্য নব্য আঁতেলের পার্ট নয়, ভাগ্য বিধাতা অতি তুচ্ছ চাকরিজীবীর চরিত্রে অভিনয়ের পাট ঠিক করে রেখেছিলেন। ছাপোষা বেতনভুক্তদের দলে নিজেকে আবিস্কার করে দেখলাম, আমাদের ভাগ্য দার্শনিক তত্ত্বের উপর ততটা নয়, নির্ভর করে মুরগির ডিম পাড়ার মত সামান্য সব বিষয়ের উপরে।
এখানে থাকতেই জেনেছিলাম মুরগির সব ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানো যায় না, শুধুমাত্র যে ডিমগুলো সুদৃশ্য ও সুআকৃতির, সেগুলো থেকেই বাচ্চা হয়। যেসব মাসে খামারের মুরগিরা বেঢপ আকৃতির ডিম বেশি পাড়ত সেই মাসগুলোতে আমাদের মালিকদের মেজাজ খুব খারাপ থাকতো। আমরা তখন চেষ্টা করতাম তাদের সামনে না পড়তে বা তাদের সাথে কোন রকম কথা না বলতে। আমাদের দিনগুলো শুধু নয়, আমাদের বেতন বোনাসও নির্ভর করতো মুরগীর ডিম পাড়ার উপরে। প্রত্যেক ঈদের আগে আগে আমরা প্রার্থনা করতাম, অন্তত এই মাসটা যেন মুরগিরা সুআকৃতির ডিম বেশী পাড়ে। তবে সবসময় মুরগিদের নিয়মমাফিক ডিমপাড়া আমাদের ভাগ্যকে সমূহ বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারতো না। ক্ষুদ্র মানুষের জীবন ছোট বড় বহু দেবতার হাতে বাঁধা। কোন দিক থেকে কখন যে কোন দেবতার বিষ নিশ্বাসে নিশ্চিহ্ন হবো সেটা আগে থেকে ধারণা করা অসম্ভব। সে বছর আমাদের জন্য বার্ড ফ্লু নামক নতুন এক অভিশাপ অপেক্ষা করছিল। মুরগীর খামারগুলো একটার পর একটা এই রোগের জীবাণুতে ছেয়ে গিয়েছিল। বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়লে রাতারাতি অনেক মানুষের ভাগ্যে বিপর্যয় নেমে এল। সবরকমের চেষ্টা সত্ত্বেও আমাদের খামারের একটা অংশে বার্ড ফ্লু ছড়িয়ে পড়ল। মালিক পক্ষ থেকে কারখানার শ্রমিক সকলে ঝাঁপিয়ে পরলো আক্রান্ত না হওয়া মুরগিগুলো রক্ষা করতে। সকলের নিরলস চেষ্টায় কমাস পরে একটা সময়ে বার্ড ফ্লু নিয়ন্ত্রণে এল, কিন্তু ঠিক তখনই আমাদের জীবনে সত্যিকারের মহামারী দেখা দিল। মালিক পক্ষ থেকে নোটিশ এল, অনিবার্য কারণ বশত তারা লোক ছাটাই করতে বাধ্য হচ্ছে। সাথে সাথে কাউকে ছাটাই করা হল না, তবে আমাদের ছাত্র এমডি জানালেন, ধাপে ধাপে কাজটা করা হবে, আমরা যেন প্রস্তুত থাকি। বার্ড ফ্লু শুরু হবার পর থেকে আমাদের বেতন বোনাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নেহায়েত হিসাব বিভাগে কাজ করতাম বলে ম্যানেজারকে বলে কয়ে কিছুদিন পরপর বেতনের টাকা অল্প অল্প করে তুলতে পারতাম।
সপ্তাহখানেক পরে একদিন অফিসে এসে শুনতে পেলাম আমাদের এইচ আর বিভাগের দুজনকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। এইচ আর বিভাগে দুজন লোকই কাজ করতেন - একজন ম্যানেজার আর একজন তার সহকারী। এই সহকারীর সাথে আমার সুসম্পর্ক ছিল। আমরা প্রায়ই একসাথে বাজারের দিকটায় একটা খুব ছোট হোটেলে দুপুরে ডিম পরাটা খেতে যেতাম। মিয়া উদ্দিন আমাকে ডেকে বললেন, এবার আমাদের দুইজনের পালা, আমি কোন ব্যাবস্থা করেছি কি না। আমি তখনও কোন ব্যাবস্থা করতে পারিনি। বন্ধু বান্ধবকে চাকুরীর কথা বলে রেখেছিলাম। কিন্তু কারও কাছ থেকে কোন খবর পাচ্ছিলাম না, বরং কেউ কেউ তখন আমার ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছিল। এখানে চাকরিতে ঢোকার পর থেকে সুযোগ পেলেই বিভিন্ন জায়গায় চাকুরির দরখাস্ত করতাম। ফলাফল এই ছিল যে, প্রায় প্রতি শুক্রবারই সকালে আমাকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায়, ব্যাংকের বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে চাকুরির লিখিত পরীক্ষা দিতে যেতে হত। এর ফলে সদরঘাট থেকে মিরপুর পর্যন্ত বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও তাদের শিক্ষকদের সম্পর্কে আমার সাধারণ জ্ঞান অসাধারণ ভাবে বেড়ে গিয়েছিল।
একদিন আমার এক বন্ধু ফোন করে জানালো, তার এক পরিচিত ভাই হিসাব বিজ্ঞানের একটা বিষয় পড়ার জন্য শিক্ষক খুঁজছেন, আমি তাকে সময় দিতে পারবো কি না। ছাত্র জীবনের পুরোটা সময় গৃহশিক্ষকের কাজ করেছি। নিরুপায় হয়ে আবার শুরু করতে হল। আমার এই ছাত্র মারুফ ভাই আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড় ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ দিয়ে ভাল একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করতেন, পাশাপাশি রাতের ক্লাসে এমবিএ করছিলেন। তার এমবিএ তখন প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু হিসাব বিজ্ঞানের একটা বিষয়ে ফেল করায় তিনি কোন একভাবে এ যাত্রায় তাকে উদ্ধারের জন্য মাস্টার রেখেছিলেন। মারুফ ভাইয়ের বাসা আমাদের এলাকাতেই ছিল। শুক্র, শনিবার দুটো দিন সন্ধ্যায় তাকে পড়াতে যেতাম। আমাকে প্রথম দিন তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, হিসাব বিজ্ঞানের ঐ বিষয়ে কোন একভাবে একটা "সি" পেলেই তার চলবে। আমার কাজ তাকে শুধু "সি" পাওয়াতে সাহায্য করা। জীবনে বহু মাস্টারি করেছি, সবখানেই ছাত্র ছাত্রী থেকে অভিভাবক সবাই ছিল এ প্লাসের দাবীদার। জীবনে সেই প্রথম একজন ছাত্র পেয়েছিলাম যার চাওয়া নেহায়েত একটা "সি"। তবে মারুফ ভাইকে পড়ানো শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই বুঝলাম, তার লক্ষ্যটা বেশ বিবেচনাপ্রসূত হলেও ঠিক বাস্তবসম্মত নয়। বাস্তবে দেখা গেল আমার ছাত্র শিক্ষকের চেয়ে হাজারগুন বেশি ব্যস্ত। আমার পড়ানোর সময় থাকলেও তার পড়া বোঝার সময় নেই। মারুফ ভাই তখনো বিয়ে করেননি, তবে সুযোগ্য পাত্রীর সন্ধানে ছিলেন। প্রতিদিনই পড়া শুরু করার পনের বিশ মিনিট পরেই পাশের ড্রইং রুম থেকে ল্যান্ডফোন বেজে উঠত। মারুফ ভাই পাশের রুমে গিয়ে ফোন ধরে কিছুক্ষণ পরে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠতেন, আমার একটু দেরি হবে তুমি নেট ব্রাউজ করতে থাকো, আমি আসছি। আমি বসে বসে বিডি জবসের সাইটে ঢুকে চাকুরির দরখাস্ত করতাম অথবা সিভি পাঠাবার ঠিকানা কাগজে লিখে নিতাম। অনেকক্ষণ পরে কথা শেষ করে মারুফ ভাই ফিরে এসেই বলতেন:
- হ্যা বল, এই অংকটা যেন কিভাবে করতে হয়?
আমি তাকে নতুন করে বুঝাতে শুরু করলে প্রথম চার পাঁচ মিনিট তিনি অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে শুনতেন, তারপর বলে উঠতেন:
-নাহ, আজকে বাদ দাও, আজকে আর ভাল লাগছে না। কাল থেকে ভাল করে শুরু করতে হবে। চল বের হই, তোমাকে এগিয়ে দেই..
মারুফ ভাই বাসায় সিগারেট খেতেন না, আমাকে এগিয়ে দেয়ার অর্থ বাইরে গিয়ে হাঁটাহাটি করতে করতে সিগারেট খাওয়া।
ওদিকে আমার অফিসের পরিস্থিতি দিনকে দিন আরও বেশী খারাপ হতে শুরু করেছিল। একদিন অফিসে গিয়ে দেখতে পেলাম আমাদের মিয়া উদ্দিন, যে অত্যন্ত পরিপাটি হয়ে অফিসে আসেন এবং চামড়ার স্যান্ডেল পড়ে শার্ট ইন করে রাখেন, তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর শার্ট ইন ছাড়া। হঠাৎ তাকে দেখে মনে হল, হয়ত কোন কারণে তার প্যান্টের জিপার নষ্ট হয়ে গেছে, আর এ কারণেই তাকে নার্ভাস দেখাচ্ছে। ডেস্কে বসে অনেক রকম কানাঘুষা শুনতে পেলাম, কিন্তু কেউ পরিষ্কার করে কিছু বললো না। দুপুরের পর আমাদের ছাত্র এমডি তার অফিসে আমাকে ডাকলেন। সেদিন থেকেই আমাকে তিনি মিয়া উদ্দিনের কাজগুলো বুঝে নিতে বললেন। একাজে আমাকে এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হল। জানিয়ে দিলেন, এই সময়ের মধ্যে কাজ বুঝে নিতে না পারলে আমাকে বিদায় করে দেওয়া হবে, ব্যাপারটা আমি যেন সিরিয়াসলি নেই। মিয়া উদ্দিনকে কবে নাগাত বিদায় করে দেওয়া হবে এই প্রশ্ন করার সাহস পেলাম না, মাথা নিচু করে ডেস্কে ফিরে এলাম। সেদিন মিয়া উদ্দিনের সাথে কোন কথা হল না, চুপচাপ ডেস্কে বসে থেকে দিনটা কাটিয়ে দিলাম। চাকুরি-জীবনে সেদিনই প্রথম, সন্ধ্যায় মিয়া উদ্দিন আমার আগে অফিস থেকে বের হলেন। আমার মনে পড়ল, একদিন কি একটা কাজে মিয়া উদ্দিনের মোবাইলে ফোন করলে তার স্ত্রী ফোন ধরেছিলেন। পরিচয় দিতেই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে শান্ত সুমিষ্ট গলায় তিনি বলছিলেন যে আমার কথা তিনি অনেক শুনেছেন। মিয়া উদ্দিন তার বাসায় আমার গল্প করতে পারেন এটা ভাবিনি, খুব আবাক হয়েছিলাম। ফোনে কথা বলার সময় থেমে থেমে এক ধরণের চিৎকার শুনতে পেয়েছিলাম। পরে বুঝেছিলাম, মিয়া উদ্দিনের ছেলে চিৎকার করে পড়া মুখস্ত করছে। ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়ত তখন তার ছেলেটা। পরদিন সকালে মিয়া উদ্দিন আমাকে ডাকলেন। জানালেন, ম্যানেজমেন্ট তাকে এক মাসের নোটিস দিয়েছে, আমি যেন তার কাছ থেকে সব কাজ বুঝে নেই। তার কাছে কি কাজ বুঝে নিয়েছিলাম আজ আর তা মনে নেই। তবে মনে আছে, মিয়া উদ্দিনের ডেস্কের উপরে পড়ে থাকা রাশি রাশি ফাইল একটার পর একটা আমার ডেস্কের উপরে জড় হয়েছিল। এইসব স্তূপাকৃত ফাইলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি নিজেকে ঘৃণা করতে শিখেছিলাম।
মিয়া উদ্দিন ওখান থেকে চলে যাবার পর আমার মন ঐ অফিস থেকে উঠে গিয়েছিল। আরেকটা কোন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিলাম, কিন্তু কোথাও সুবিধা করতে পারছিলাম না। একদিন পত্রিকার পাতায় ওয়াক-ইন ইন্টারভিউয়ের বিজ্ঞপ্তি দেখে সিভি নিয়ে ভুতের গলির একটা অফিসে গেলাম। ওটা যে মিষ্টির দোকানের অফিস সেটা জানা ছিল না, ভেবেছিলাম হয়ত ভাল কিছু হবে। ওয়েটিং রুমে আরও প্রায় জনাবিশেক চাকরি প্রার্থীর সাথে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বসে ছিলাম। বিকেলের দিকে কেউ একজন এসে জানালেন, সেদিন আর ইন্টারভিউ হবে না, পরেরদিন আসতে বললেন। উপায় না দেখে একদিন আমাদের এলাকায় যে গার্মেন্টস গুলো আছে সেখানে খোঁজ নিয়ে তাদের হেড অফিসে দেখা করে এলাম। কেউ খুব একটা আশা দিল না, তবে সিভি রেখে যেতে বলল। একদিন ফোনে যোগাযোগ করে পল্টনের এক হোটেলে গেলাম কানাডিয়ান এক ইমিগ্রেশন ল-ইয়ারের সাথে দেখা করতে। তার সাথে দেখা করে ফটফট করে ভুল ইংরেজীতে অনেক কথা বলে এসেছিলাম, যদি কোন একভাবে কানাডা যাওয়ার ব্যাবস্থা হয়।

একদিন মারুফ ভাইকে পড়াতে গিয়েছি, তিনি বললেন তাদের অফিসে একটা জব সার্কুলার হয়েছে, ফাইন্যান্সে লোক নেয়া হবে, আমি আগ্রহী হলে যেন সিভি পাঠাই। তখন আমি যে কোন সুযোগ পেলেই সর্বশক্তি নিয়ে লাফিয়ে পড়তাম। সুযোগটা আমার যোগ্যতায় কুলোবে কিনা সেটা বোঝার ক্ষমতা ছিলনা। আমার দ্বারা ঠিক কোন কাজটা হবে আর কোনটা হবেনা বুঝতে পারতাম না। বন্ধুবান্ধব, সহপাঠীদের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে নিজের উপর বিশ্বাসটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, নিজের অজান্তেই হীনমন্যতায় ভুগতাম। ভাল কোন কোম্পানিতে চাকরির চেষ্টা আগে কখনো করিনি। আসলে সাহস করেই উঠতে পারিনি। আমার এক বিশেষজ্ঞ সহপাঠির কাছে শুনেছিলাম, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করতে হলে নাকি অনেক স্মার্ট হতে হয়। আজিজ মার্কেট আর সাহিত্য কেন্দ্রে ঘোরাঘুরি করে আমার চেহারা হয়ে উঠেছিল গ্রামের কলেজের বাংলা বা দর্শনের শিক্ষকদের মত, অতএব স্মার্ট ও সুদর্শনাদের সাথে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারবো ভাবিনি। মারুফ ভাই আমাকে সাহস জোগালেন, আমার সিভিও দেখে দিলেন।
কিছুদিন পরে একদিন সত্যি সত্যি মারুফ ভাইয়ের কাছ থেকে ধার করা টাই গলায় চাপিয়ে আমি সেই অফিসে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। স্মার্ট এবং সুদর্শনাদের সাথে চাকরির পরীক্ষায় অংশ নেয়া উপলক্ষে এলিফেন্ট রোডের দোকান থেকে নতুন জামা জুতো কিনেছিলাম। তবে নিজের পছন্দ অনুসারে নয়। মনে ভয় ছিল নিজের পছন্দের জামা কাপড়ে যদি আমাকে গ্রামের কলেজের মাস্টারের মত দেখায়। তাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ফ্যাশন সচেতন পাড়ার এক ছোট ভাইকে সঙ্গে করে দোকানে গিয়েছিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজি আর দামদস্তুর শেষে তার পছন্দ মত এক্সিকিউটিভ সাজের পোষাক কিনেছিলাম। সময়টা ছিল বর্ষাকাল- ঢাকা শহরের রাস্তা কাদা পানিতে একাকার। নতুন জুতো পায়ে দিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু রাস্তার কাদা আমার আসন্ন অভিসারের খবর জানতো না বলে, জুতো জোড়াকে কোনভাবেই বাঁচাতে পারছিলাম না। পকেটে পর্যাপ্ত টিস্যু পেপার নিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরপর লোকচক্ষুর আড়ালে টিস্যু পেপার ঘসে ঘসে জুতো সাফ করছিলাম। গুলশানে সেই অফিসে ঢোকার আগে ফুটপাতের চায়ের দোকানে দাড়িয়ে আরও একবার পানি দিয়ে ভাল করে জুতো জোড়া পরিষ্কার করে নিলাম। সিকিউরিটি ডেস্ক পার হয়ে বুকে ব্যাচ ঝুলিয়ে অফিসের রিসিপশনে ঢুকলাম। জমকালো সুসজ্জিত অফিস। দেয়ালে কারুকার্যময় নকশিকাঁথা ঝুলছে। আমার আগে থেকেই কয়েকজন খুব সপ্রতিভ ছেলে মেয়ে রিসিপশনের সোফায় বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। তাদের চেহারায় প্রবল আত্মবিশ্বাসের ছাপ, চোখ মুখ থেকে ঠিক মেধার দ্যুতি বের না হলেও হাবে ভাবে চৌকষ ভঙ্গি। তাদেরকে দেখে আমি একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম। রিসিপশন ডেস্কের পুতুল চেহারার, মাখন শরীরের মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে ঈষৎ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, "কি? ইন্টারভিউ ?" কথা শুনে মনে হল বাংলায় কথা বলে তিনি অভ্যস্ত নন, নেহায়েত আমার মত খাস বাংলা চেহারার কাউকে দেখে ইংরেজিতে প্রশ্ন করাটা সমীচীন মনে করলেন না। তার কাছে আগে থেকেই প্রার্থীদের নামের তালিকা ছিল। মনে ভয় ছিল আমার নামটা যদি লিস্টে না থাকে, তারা যদি ইতিমধ্যে জেনে যায় আমি একটা গেঁয়ো ভুত, ইংরেজিতে ভাল করে কথা বলতে পারিনা পর্যন্ত। কিন্তু দু তিনটা নামের পরেই আমার নাম খুঁজে পাওয়া গেলে স্বস্থি বোধ করলাম। সৌখিন কেতাদুরস্ত পরিবেশ এখানে, সব কিছু উজ্জ্ব্বল, পরিপাটি আর গুছানো। অনেকদিন এধরনের পরিবেশের সাথে আমার সম্বন্ধ নেই। সেকারনেই বোধহয় মনের মধ্যে কেমন অস্বস্তি বোধ করছিলাম। রিসিপশন ডেস্কের এক কোনায় সুন্দর করে সাজানো ফুলের তোড়া - আমাদের দেশী নয়, সবই বিদেশী ফুল। আমি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও বুঝলাম না, ফুলগুলো আসল নাকি নকল। এখান থেকে কয়েক হাত দূরেই ময়লা কাদার আবর্জনাময় ঢাকা শহর- সেখানে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ে, গাড়ির হর্ণের বিকট শব্দে, কর্কশতায় সকাল থেকেই শুরু হয়েছে লক্ষ মানুষের বেঁচে থাকার আর্তনাদ। এই কাচে ঘেরা অফিসে মানুষের আর্তনাদ নেই। বাইরের নিষ্প্রভ পৃথিবীর সাথে তুলনা করলে এখানে সব কিছু বড় বেশী রকমের উজ্জ্বল, সৌখিন, প্রাণবন্ত। স্বচ্ছ দরজার ওপারে এই অফিসে চাকরি করা লোকদের দেখতে পাচ্ছিলাম। তাদের আত্মবিশ্বাসী আচরণ, নির্ভার কথা বলার ভঙ্গি, উচ্চস্বর হাসি, পোষাকে চেহারায় সাচ্ছন্দ্যের ছাপ দেখে আমার খুব লোভ হল। মনে পরলো, সেমাসে তখনও বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারিনি। মাসের অর্ধেকেরও বেশী পার হয়ে গেছে কিন্তু তখনও বেতন পাইনি, কবে পাব তাও জানিনা। ছোট বোনের এইচএসসি পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের তারিখ দিয়েছে। পরীক্ষা শেষ হলে বোনটাকে ঢাকায় এনে কোচিংএ ভর্ত্তি করাতে হবে, সেও অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। এই চাকুরিটা যদি কোনভাবে পেতাম তাহলে ভাবনা ছিলনা। আম্মাকে নিয়ে আমরা তিন ভাইবোন ঢাকায় একসাথে কোথাও বাসা ভাড়া নিয়ে বেশ থাকতে পারতাম। মনে পড়লো, আমি অনেকদিন প্রাণ খুলে হাসি না, অন্যকেও হাসাতে পারিনা। আমার শুঁকনো মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মায়ের চোখে শুধু জল আসে, হাসি ফোটে না। বোনদের সাথে আমি শুধুই বেঁচে থাকার কঠিন বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলি। রসিকতা করে কিছু একটা বলতে গেলে তা ঠিক পুরনো দিনগুলোর মত জমে না। মাস গেলে পাওয়া বেতনের অংকটা এত বেশী ব্যাবধান তৈরি করে জীবনে, আশ্চর্য.........!
(দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত)
প্রথম পর্ব: চাকুরি জীবন- বিষণ্ণ ছোলা ভাজা পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৪:৫৫
৩৭টি মন্তব্য ৩৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×