somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চেতনার সংকট

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সকাল ৯:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চেতনার সংকট
-----ডঃ রমিত আজাদ

আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বেশি দিনের নয়। ইতিপূর্বে ছিল ‘রাজ্য’। রাজ্যের প্রতিষ্ঠা জনসমর্থনে হতো না। রাজ্যের প্রধান বাহুবলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সিংহাসনে আরোহন করতেন। রাজ্যে জনগণনের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোন মূল্য ছিল না। রাজার ইচ্ছাই ছিল আইন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে তিনি সভাসদদের পরামর্শ নিতেন। সেখানে জনগণের কোন অংশগ্রহণ থাকতো না। ঐতিহ্যগত কারণে জনতা রাজা ও সিংহাসনকে সম্মান করত।

এক সময় এই মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটল। জনগণ বুঝতে শুরু করলো তাদেরই অর্থপুষ্ট প্রতিষ্ঠানে তাদের অধিকার নেই। এই অসন্তোষ যতই বাড়তে থাকে, সিংহাসনের প্রতি সম্মান ততই কমতে থাকে। মানব সভ্যতার বিকাশে এই রকম একটি পর্যায়ে, নির্যাতিত ও নিগৃহিত প্রজাদের মধ্যে দানা বেঁধে ওঠা অপরিসীম গণ অসন্তোষ থেকে সৃষ্ট বিপ্লবের মাধ্যমে পতন হয়েছিল প্রবল প্রতাপশালী রোম সাম্রাজ্যের।

এই পতনের পেছনে কাজ করেছিল একটি চেতনা। যীশু খ্রীষ্টের প্রচারিত খ্রীষ্ট ধর্মীয় ‘চেতনা’। হ্যাঁ চেতনাই মানুষকে পশুকূল থেকে পৃথক করে। চেতনা জীবনকে অর্থবহ করে। বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। মানব সভ্যতার বিকাশের এক একটি যুগের সূচনায় কাজ করেছিল এক একটি চেতনা।

খ্রীষ্ট ধর্মীয় চেতনা এক সময় ইউরোপবাসীকে রোমক নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। আবার এই চেতনাকে পূঁজি করেই কিছুকাল পরে একদল মানুষ সৃষ্টি করল নির্যাতনের নতুন অধ্যায়। চার্চ হয়ে উঠল প্রধান সামন্ত। ধর্মীয় অনুশাসন মানুষকে বেঁধে ফেলল আষ্টেপৃষ্ঠে। এ পর্যায়ে প্রয়োজন হল নতুন চেতনার।

এই নতুন চেতনাটির ভিত রচিত হয়েছিল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যকার শতর্বষব্যপি যুদ্ধে (১৩৩৭-১৪৫৩)। এর দার্শনিক রূপ দিয়েছিলেন নিকোলো দি ভের্নাদো মেকিয়েভেলি (১৪৬৯-১৫২৭)। চার্চের অনুশাসন মুক্ত হয়ে জনতা কেন্দ্রিক সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠনের দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। পরবর্তীতে বডেন (১৫৩০-১৫৯৬) ‘সার্বভৌমত্বে’র ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আরো বলেন, ‘রাষ্ট্র হলো জনতার ক্ষমতা’। এই দর্শনগুলোই এক সময় ‘জাতীয়তাবাদী চেতনা’র উন্মেষ ঘটায় যার প্রবল বিকাশ ঘটে ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯) মধ্য দিয়ে। তখন থেকেই প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ।

জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগে জাতির সংজ্ঞাটি দেয়া প্রয়োজন। এই সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অনেক সমাজ বিজ্ঞানী থমকে দাঁড়িয়েছেন। কার্ল মার্কস সম্ভবত কোন সংজ্ঞাই দেননি। যা হোক, তার পরেও মোটামুটিভবে গৃহিত একটি সংজ্ঞা আছে। তা হলো, ‘যে বৃহৎ জনগোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলে, যাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে, যারা একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডের অধিবাসী এবং যাদের মধ্যে আবেগগত ঐক্য রয়েছে, সেই বৃহৎ জনগোষ্ঠী একটি জাতি।’

জাতি ও জাতিসত্তা বিষয়ক পার্থক্যমূলক আলোচনায় না গিয়ে উপরের সংজ্ঞাটিকে যথাযথ ধরে আমি পরবর্তী আলোচনায় প্রবেশ করছি।

‘জাতীয়তাবাদ’ জাতি ভিত্তিক একটি চেতনা। আদিম সমাজের গোত্র চেতনার নতুন রূপ। আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুগের ঊষালগ্নে সামন্ততান্ত্রিক খন্ড-বিখন্ডতা থেকে উঠে এসে অখন্ড রাষ্ট্র গঠনে এবং চার্চের অনুশাসন মুক্ত সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠনে, সর্বপোরি সিংহাসনের প্রভাব খর্ব করে জনতাকেন্দ্রিক পার্লামেন্ট ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে এই চেতনা বিশেষ ভুমিকা রাখে।

পরবর্তীতে এই চেতনাই উগ্র রূপ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদে পরিণত হয়। এই উগ্রতার নাম হয় ‘শোভিনিজম।’ শোভিনিজমের উপর ভিত্তি করে ইউরোপের কয়েকটি রাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ গড়ে তোলা শুরু করে। এমন একটি পর্যায়ে বাংলা ইংরেজদের উপনিবেশে পরিণত হয়। উল্লেখ্য যে, এ সময় বাংলায় কোন জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল না। তাই ইংরেজদের দূরভিসন্ধি বোঝা সবার পক্ষে সম্ভব হয়নি। যদিও বিচক্ষণ নবাব আলীবর্দী খান পৌত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ইংরেজদের মতি-গতি সম্পর্কে সাবধান করে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মসনদ দখলের লড়াইয়ে অন্ধ হয়ে নবাবের বেশীর ভাগ সদস্যই পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজের পক্ষ নিয়েছিল। জাতীয়তাবাদী চেতনা থাকলে সেদিন এই ভুল নাও হতে পারত।

পলাশীর পাপ মোচনের উদ্দেশ্যে মীরজাফর একবার এবং মীর কাসিম একবার ইংরেজের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ইংরেজ তখন এমনভাবে জাল বিস্তার করেছে, যে তা আর কাটা সম্ভব হয়নি। এই পর্যায়ে বাংলার বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে শুরু করেন জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রতিষ্ঠা করে গণজাগরণ সৃষ্টি না করে উপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। এভাবেই নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে স্বাধীনতার প্রতীক করে সৃষ্টি করা হয় বাংলার প্রথম জাতীয়তাবাদী চেতনা। এই চেতনার মূল মন্ত্র ছিল 'ইংরেজ, তুমি বাংলা ছাড়'।

ধীরে ধীরে ভারতের অন্যান্য জাতিগুলোও এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইংরেজ হটাও আন্দোলনে নামে। কিন্তু চতুর ইংরেজও কম যায় না। কখনও অস্ত্রের জোরে, কখনও সমান্তরাল চেতনার সৃষ্টি করে বিভেদ সৃষ্টি করে তারা আন্দোলনকে ভোঁতা করতে থাকে। ভারতবাসীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির মূল অস্ত্র হিসাবে তারা ব্যবহার করে ‘ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনা।’

ভারত ছাড় আন্দোলনের চরম পর্যায়ে গঠিত হয় রাজনৈতিক দল ‘কংগ্রেস’। রোম সাম্রাজ্যের একটি সভার নাম ছিল কংগ্রেস। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতাকামীদের সৃষ্ট এই দল। আসলে কংগ্রেস ছিল ইংরেজদেরই সমর্থনপুষ্ট একটি দল। এর প্রতিষ্ঠার পেছনে হাত ছিল লর্ড ডাফরিনের। পরবর্তীকালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আগত এম. করমচাঁদ গান্ধির নেতৃত্বে দলীয় রাজনীতি নতুন স্রোত পায়। তদুপরি কংগ্রেস তার বিশেষ উদ্দেশ্য অর্থাৎ উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার ব্রত থেকে বিচ্যুত হয়নি। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত ¯স্বাধীন হলে তা উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের শাসনাধীণ হয়ে যেতে পারে এবং তফসীলি সম্প্রদায় ও মুসলমানরা ইংরেজ আমলের মতই নির্যাতিত থেকে যাবে। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মুসলমান এলিট সম্প্রদায় এই কূটকৌশল টের পেয়ে নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে গঠন করেন ‘মুসলীম লীগ’। মুসলীম লীগ ছিল কংগ্রেসের কাউন্টার। ঢাকার শাহবাগে নবাব সলিমুল্লাহর এক ভবনে এই লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। নবাব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর, শেরে বাংলা মুসলীম লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। উল্লেখ্য, মুসলীম লীগের প্রতিষ্ঠার সাথে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কোন সম্পর্ক ছিল না। মুসলীম লীগে জিন্নাহর প্রবেশ অনেক পরে।

কংগ্রেস ও মুসলীম লীগের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে দু’টি ভিন্ন চেতনার বিকাশ হতে থাকে। বাংলায় তখন দুইটি সম্প্রদায় বসবাস। একটির সংখ্যাধিক্য পশ্চিমে ও অপরটি পূর্বে। তাঁদের ভাষা এক কিন্তু ধর্ম ভিন্ন। তাই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত পার্থক্যও আছে। এই পার্থক্যই চেতনাগত পার্থক্য এনে দেয়। ভৌগলিক ভাগাভাগির প্রশ্নও তুলে ধরে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনাকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন বাঙালীর রাজনীতির কথা বলেছিলেন কিন্তু তাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। কারণ যুগটি ছিল ধর্মীয় চেতনার যুগ। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ভাষাগত মিল ছিল কিন্তু চেতনাগত পার্থক্য ছিল। প্রবন্ধের শূরুতেই বলেছিলাম জাতি গঠনে আবেগগত ঐক্যের কথা। পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে ছিল আবেগগত অনৈক্য। তাই অখন্ড জাতি হিসাবে তাদের আত্মপ্রকাশ করা সম্ভব ছিল না।

ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের পর ভৌগলিক ভাগাভাগি নিশ্চিত হয়ে পড়ে। পূর্ব বাংলায় শক্তিশালী রূপ ধারণ করে একটি চেতনা--- ইসলাম ধর্ম। সেই সময়ের রাজনীতির সব উজ্জ্বল তারকা শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন, ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবাই ছিলেন এই চেতনায় উদ্বূদ্ধ। তাঁরা যেখানেই গিয়েছিলেন তাঁদের পেছনে জনতার ঢল নেমেছে। হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারে ক্লান্ত, নিঃশেষিত বাঙালী মুসলমানরা ইংরেজ মুক্ত, হিন্দু জমিদারদের শাসনমুক্ত একটি নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিল।

অবশেষে ধর্মীয় চেতনার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয় দু’টি পৃথক রাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তান। ৮৭২ টি ভাষাভাষী সম্পন্ন বহুজাতিক রাষ্ট্র ভারতে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী কোন চেতনা থাকার কথা নয়, ধর্মীয় চেতনাই তাদের মধ্যে আবেগগত ঐক্যের সৃষ্টি করেছে। অনুরুপভাবে বহুজাতিক রাষ্ট্র পাকিস্তানেও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার অবকাশ ছিল না। সেখানেও ইসলাম ধর্মই ছিল ঐ রাষ্ট্রের চেতনা। তদানিন্তন রাষ্ট্রপ্রধানরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে হামেশাই বলতেন যে, পাকিস্তান একটি চেতনাভিত্তিক রাষ্ট্র।

১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার ইতিহাসে একটি গুরত্বপূর্ণ অধ্যায়- একটি নতুন চেতনার জয়, একদল জালিমের উৎখাত। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল সংগ্রামের অবসান হয়নি। একদল জালিমকে রিপ্লেস করেছে আরেক দল জালিম। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বাংলার মানুষের ভূমিকা ছিল মুখ্য, মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ঢাকায়, লাহোর প্রস্তাব শেরে বাংলার, উপরন্তু পাকিস্তানের পক্ষে অত ভোট ব্রিটিশ ভারতের অন্য কোন প্রদেশে পড়েনি। অথচ কেন্দ্রীয় রাজধানী ঢাকায় হয়নি, কেন্দ্রীয় ক্ষমতা থেকে বাঙ্গালীদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়। বাংলা ভাষার অবমাননা মূলক জিন্নাহর ঘোষণায়, ১৯৪৭ এর চেতনার পরাজয় ঘটল। সারা পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় উঠল, বোঝা গেল '৪৭এর চেতনা নিয়ে বেশী দূর আগানো যাবে না। প্রয়োজন দেখা গেল নতুন চেতনার। উল্লেখ্য যে ভারতে হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা করা জনিত গান্ধীর ঘোষণায় পশ্চিম বঙ্গে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি।

’৪৭-এর চেতনা অকেজো হয়ে পড়ে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে। যে রাজনৈতিক তারকারা ’৪৭-এ পাকিস্তান গঠন করেছিলেন তারা সবাই-ই (খাজা নাজিমুদ্দিন বাদে) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। ২১ শে ফেব্র“য়ারী পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার স্পষ্ট সীমারেখা টেনে দেয় (প্রথমে মানসিক, পরে ভৌগলিক)। ২১ হয়ে উঠে আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। ইতিহাসের সমষ্টি ঐতিহ্য, কিন্তু ইতিহাসের সবটাই ঐতিহ্য নয়। ইতিহাসের ঐ অংশই ঐতিহ্য হয়ে যায়, যা অন্তর্গত হয়ে পড়ে চেতনার, দৃষ্টিভঙ্গির ও আচার আচরণের যা সতত প্রবাহমান। হ্যাঁ, ঐ চেতনার কারণে ২১ ঐতিহ্য হয়ে যায়। একুশ জন্ম দেয় নতুন চেতনার। চেতনাটি হলো ‘আমরা বাংলায় কথা বলি’।

এই চেতনাভিত্তিক পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন একসময় রুপ নেয় মহান মুক্তিযুদ্ধে। পরিশেষে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব বাংলার বাঙালীদের নিজস্ব রাষ্ট্র- ‘বাংলাদেশ’। আমাদের ইতিহাসে আরও একটি গুরত্বপূর্ণ সন- ‘১৯৭১। একাত্তুরে ’৪৭ এর চেতনার পুরোপুরি মৃত্যু ঘটে কিন্তু একুশের চেতনা আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে। একাত্তুরে আমরা শুরু করি নতুন যাত্রা। এই যাত্রার তো একটি চেতনা থাকবে। কি সেই চেতনা?

বাংলাদেশ নতুন রাষ্ট্র। নতুন রাষ্ট্রের থাকবে নতুন চেতনা। নতুন চেতনা নিয়ে হয়েছে সংকট- চেতনার সংকট। চেতনার প্রশ্নে দেশের দু’টি প্রধান দল দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে, আওয়ামী লীগ এই চেতনাকে বলেছে ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’, বি,এন,পি বলেছে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চেতনা ছিল, ’৪৭-এ চেতনা ছিল, ’৫২-তে চেতনা ছিল অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে রয়েছে চেতনার সংকট। এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। নতুন একটি চেতনার জন্ম পুরাতন একটি চেতনার মৃত্যু ঘটায়। কিন্তু একটি চেতনার মৃত্যু হলো, অথচ নতুন কোন চেতনার জন্ম হলো না, এতে চেতনাহীন এই সময়টিতে জাতি সম্মুখীন হয় চরম সংকটের। যতক্ষণ পর্যন্ত না বিশ্ববিক্ষণজনিত এই সমস্যাটির সমাধান না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্য কোন জাতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।

‘বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ’-এর প্রসঙ্গে আসা যাক। এই জাতীয়তাবাদ বলতে বুঝি, বাংলা ভাষাভাষীদের সংস্কৃত ও ঐতিহ্য ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। প্রথমতঃ বাংলা ভাষীরা শুধু বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতের আরো কয়েকটি প্রদেশে বসবাস করে। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু। এক সময় তারা ধর্মীয় চেতনার প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবিত ‘অখন্ড স্বাধীন বাংলা’ প্রতিষ্ঠা হতে দেয়নি। দ্বিতীয়তঃ তাদের সাথে আমাদের যেমন ধর্মে তেমনি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত পার্থক্য আছে। আমাদের হৃদয়ে আছে একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্ব বাংলাদেশের বাইরের কোন বাঙ্গালীর মধ্যে নেই।

ভারতের বাঙ্গালীরা ভাষা আন্দোলন করেনি। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে যে ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা সৃষ্টি করেছে তার সাথে বাংলাদেশের বাইরের বাঙ্গালীরা একাত্মতা ঘোষণা করেনি। তাদের আর আমাদের চেতনা এক হতে পারে না।

মুসলিম লীগের নামের সাথে ‘আওয়ামী' শব্দটা জুড়ে দিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেছিলেন সোহরাওয়ার্দী যার অর্থ জনতার মুসলিম লীগ, বাঙ্গালীর মুসলিম লীগ নয়। পরবর্তীতে ‘মুসলিম’ কথাটি বাদ দিয়ে শুধুই ‘আওয়ামী লীগ’ করা হয়। এই পরিবর্তন যথাযথ। ব্রিটিশ শাসন আমলের মত বিশেষত্ব প্রদর্শন করার উদেশ্যে ‘মুসলিম’ কথাটির ব্যবহার করার আর প্রয়োজন ছিল না। কারণ পাকিস্তানে মুসলমানরাই ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। কিন্তু নতুন নাম করণেও বাঙ্গালী কথাটি আসেনি, ‘আওয়ামী লীগ’ অর্থ ‘জনতার দল’ । স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল, বাংলাদেশের (পূর্ব বাংলার), অখন্ড বাংলার নয় ।


বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চেতনার প্রয়োজন অপরির্হায। এই চেতনার দু’টি প্রধান উপাদান- এক. সংখ্যা গরিষ্ঠের ধর্ম- ইসলাম; দুই. সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা-বাংলা। এছাড়া রয়েছে জাতীয় আবেগ সঞ্চারকারী উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট- দুই শতক দীর্ঘ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম।


অনেক বামপন্থী দল আত্মিক চাহিদা উপেক্ষা করে ভূ-গোলের উপর বেশী জোর দিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক দূরে। ইসলাম ধর্মের উৎপত্তি যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যে তাই বাংলাদেশে তা অকেজো এমন কথা তারা প্রচার করেন। কিন্তু তারা ভুলে যান নীতি বা আদর্শ ভূ-গোলের বাধা মানে না। বাংলাদেশের খুব কাছাকাছি উদ্ভূত বৌদ্ধ দর্শন গৃহীত হয়েছে সুদূর জাপানেও, আর জার্মানীতে সৃষ্ট কম্যুনিজমকে বাংলাদেশের বামপন্থীরা আঁকড়ে ধরেছেন। তাই অতিমুসলমান হতে গিয়ে অবাঙ্গালী হয়ে যাওয়া যেমন ঠিক নয়, তেমনি অতি বাঙ্গালী হতে গিয়ে অমুসলমান হয়ে যাওয়াও গ্রহণযোগ্য নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ১০ই জানুয়ারী ১৯৭২-এর ভাষণে বলেছিলেন, “.. ..আমি বাঙ্গালী, আমি মুসলমান, . . . .” তিনি দু’টো বিষয়ের উপরই সমান গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত অনেকে উল্লেখ করে থাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর কথা। তাদের চেতনা কি হবে? তাদের ভাষা বাংলা নয়, ধর্মও ইসলাম নয়। কিন্তু কয়েক শতক যাবৎ পূর্ব বাংলার অধিবাসী। এ দীর্ঘ সময়ে তাদের ও আমাদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অভিন্নতা এসেছে। তারাও আমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছে, একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। এই আবেগের উপর ভিত্তি করে কি একটি ঐক্য প্রতিষ্ঠা হতে পারে না?

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় চার দশক পার হয়ে গেছে। কিন্তু এই সময়ে আমরা খুব বেশী দূর এগুতে পারিনি। তুলনামূলক বিচারে পিছিয়েই পড়েছি। ধীরে ধীরে আমাদের অতিক্রম করে গিয়েছে থাইল্যান্ড, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, আর মধ্যপ্রাচ্যের কথা বাদই দিলাম। এর মূল কারণ- চেতনার সংকট। চেতনার প্রশ্নে আমরা দ্বিধা বিভক্ত হয়ে আছি। এই দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারলেই দেশ গতিশীলতা পাবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১১ সকাল ৯:০৪
২৬টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অণু থ্রিলারঃ পরিচয়

লিখেছেন আমি তুমি আমরা, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


ছবিঃ Bing AI এর সাহায্যে প্রস্তুতকৃত

১৯৪৬ কিংবা ১৯৪৭ সাল।
দাবানলের মত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
যে যেভাবে পারছে, নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। একটাই লক্ষ্য সবার-যদি কোনভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো - ছবি ব্লগ

লিখেছেন শোভন শামস, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৯

"পেইন্টেড লেডিস অফ সান ফ্রান্সিসকো", কিংবা "পোস্টকার্ড রো" বা "সেভেন সিস্টারস" নামে পরিচিত, বাড়িগুলো। এটা সান ফ্রান্সিসকোর আলামো স্কোয়ার, স্টেইনার স্ট্রিটে অবস্থিত রঙিন ভিক্টোরিয়ান বাড়ির একটি সারি। বহু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামহীন দুটি গল্প

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৫

গল্প ১।
এখন আর দুপুরে দামী হোটেলে খাই না, দাম এবং খাদ্যমানের জন্য। মোটামুটি এক/দেড়শ টাকা প্লাস বয়দের কিছু টিপস (এটা আমার জন্য ফিক্সড হয়েছে ১০টাকা, ঈদ চাদে বেশি হয়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজত্ব আল্লাহ দিলে রাষ্ট্রে দ্বীন কায়েম আমাদেরকে করতে হবে কেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:০৬



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) কেড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×