পূর্বের সারসংক্ষেপ: কানাডিয়ান স্কুলে ভর্তির পরে কাউন্সিলর আমাকে পুরো স্কুল ঘুরে দেখালেন আন্তরিকতার সাথে। তারপরে ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্কুল থেকে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম বাবা মার সাথে।
পূর্বের পর্বগুলোর লিংক:
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (১) - প্রথমবার প্রবাসে প্রবেশের অনুভূতি!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (২) - জীবনের গল্প শুরু হলো এইতো!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৩) - সুখে থাকতে কিলায় ভূতে! (কুইজ বিজেতা ঘোষিত)!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৪) - বাংলাদেশ ভার্সেস কানাডার দোকানপাট, এবং বেচাকেনার কালচার! (কুইজ সলভড)!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৫) - কেমন ছিল কানাডিয়ান স্কুলে ভর্তি হবার প্রস্তুতি পর্ব?!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৬) - কানাডিয়ান স্কুলে ভর্তির ইন্টারভিউ অভিজ্ঞতা!
তুষার দেশে এক বাংলাদেশী কিশোরীর দিনরাত্রি - পর্ব (৭) - কানাডার স্কুল ভ্রমণ এবং দেশীয় মফস্বলের স্কুলের টুকরো স্মৃতি!
পূর্বের সিরিজের লিংক: কানাডার স্কুলে একদিন এবং কানাডার স্কুলে একেকটি দিন
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
স্কুল থেকে ভীষনই আনন্দিত মনে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছি। যাবার সময়ে দম আটকে আসছিল পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে, কিন্তু ফেরার সময়ে খুবই সহজ মনে হচ্ছে পথটা। স্কুলের মানুষজনের আন্তরিকতায় প্রভাবেই হয়ত, হালকা মিষ্টি রোদময় পাহাড়ি এলাকাটাকে হুট করে বেশ নিজের মনে হলো।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে বাবা মা আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, "কাউন্সিলর কি কি বললেন? তুই ঠিকঠাক জবাব দিতে পেরেছিস সবকিছু?"
আমিও খুব ভাব দেখাচ্ছি, যে একা একাই বিদেশী কাউন্সিলরকে সামলেছি! ইংলিশে কথা বলেছি! কি কথা হয়েছে বলব না! আমি হাসছি, তারা হাসছে! এভাবে হাসতে খেলতে বাড়ির দরজার সামনে দাড়িয়ে সবাই অবাক হয়ে গেলাম।
দরজা খোলা, হালকা করে ভেড়ানো! আমরা প্রথমে একটু অবাক হয়ে পরক্ষনেই ভাবলাম ভুল ফ্ল্যাটের সামনে চলে এসেছি। বহুতলবিশিষ্ট ভবনটির সব গলি, সব ফ্ল্যাট একই রকম। নতুন নতুন ভুল হতেই পারে। সেটা ভেবে দরজার ফ্ল্যাট নাম্বারটা আবারো চেক করে দেখে চমকে উঠলাম! এটাতো আমাদেরই ফ্ল্যাট!
আমি আর মা বাবা মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে করতে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভেতরে গেলাম। কিচেনে গিয়ে দেখলাম, আমাদের এপার্টমেন্ট ম্যানেজার কিচেনের টেবিলটপে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে, আর অন্য আরেক লোক ঘরটির ব্লাইন্ডস বা পর্দা ঠিক করার কাজ করছে।
আমরা অবাক হয়ে গেলাম! আমরা বাড়িতে না থাকা অবস্থায় এরা ঢুকল কেন? কিভাবে?
বাবাকে দেখে এপার্টমেন্ট ম্যানেজার হেসে, "হ্যালো! হাই ইজ ইট গোয়িং!?" বললেন।
বাবা ওনাকে বলল, "আপনারা এখানে?"
তিনি বললেন, "তুমি বলেছিলে তোমার ফ্ল্যাটের ব্লাইন্ডসটা ঠিকমতো খুলছেনা, তাই ঠিক করতে চলে এলাম।"
বাবা বলল, "কিন্তু আপনি তো কোন টাইম দেননি, আগে থেকে বললে আমরা থাকতে পারতাম!"
উনি হেসে বললেন, "ডোন্ট ওয়ারি এবাউট ইট! ইটস ওকে!"
আরেহ কে কাকে ওকে বলে? আমরা কি সরি বলছি নাকি?
বাবা এবারে একটু গম্ভীর ভাবে বললেন, "কিন্তু আমাদের না জানিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে এভাবে ঢুকেছেন......."
তিনি এবারে ভুরু কুঁচকে ফেললেন, আমরা যে অস্বস্তিতে পড়েছি, সেটা বুঝতে পারলেন। তার মুখের হাসি সরে গেল, গম্ভীর হয়ে বললেন, "ডোন্ট ওয়ারি, আই এম নট গনা স্টিল ইওর স্টাফ! অনেকদিন ধরে কাজটি করছি! এই পুরো পাড়ার সব ফ্ল্যাটের দায়িত্ব আমার। আমি জানি আমার কাজ!"
সরল বিশ্বাসী কানাডিয়ানদের কেউ অবিশ্বাসের চোখে দেখলে ওনারা ভীষনই আহত হন। সারাক্ষন কথায় কথায় হাসতে থাকা কানাডিয়ানরা কখনো মুখ গম্ভীর করে ফেললে কেমন যেন অদ্ভুত লাগে! অবিনয়সুলভ কিছু ওদেরকে একদম মানাতেই চায়না।
ওনার বলার ভঙ্গিতে বাবা একটু চমকে, "ওকে ওকে!" বলে চলে আসলেন একটু দূরে দাড়িয়ে থাকা আমার আর মায়ের কাছে!
মা ইশারা করে জিজ্ঞেস করল কি কথা হলো?
এপার্টমেন্ট ম্যানেজারের কথাগুলো আমি বুঝতে পারিনি, ওনার ইংলিশ একসেন্ট একদম ধরতে পারতাম না। বাবা আস্তে আস্তে ওনার কথাগুলো জানালেন। বলতে বলতে ওনাদের কাজও শেষ হয়ে গেল, ওনারা চলে গেলেন।
কানাডায় এসে বেশ কিছু শহরে, ইভেন বেশ কিছু প্রভিন্সে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। অনেকবার ফ্ল্যাট পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সবখানেই এই নিয়মই দেখেছি। কোন কাজ থাকলে এপার্টমেন্ট ম্যানেজার এসে কয়েকবার নক করবেন দরজায়, বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পরেও যদি কেউ দরজা না খোলে তবে তার কাছে সব ফ্ল্যাটের চাবি থাকে। সেই চাবি দিয়ে ঢুকে পড়েন এবং ফ্ল্যাটের কোন কাজ থাকলে সেটা করে চলে যান!
ওনারা যাবার পরে মা তো ভীষনই বিরক্ত! বাবাকে বলছে, "তুমি "ওকে ওকে" বললে কিসে? এটা কেমন নিয়ম? যখন তখন লোকজন নিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়বে আমাদের অনুপস্থিতিতে!? বাহ! ভালোই রাজত্ব, লুটপাট করতে তো কোন কষ্টই করতে হবেনা!"
আর এপার্টমেন্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব নাহয় আছে, বুঝলাম। কিন্তু আরো যাকে সাথে করে আনছে সেও তো খারাপ হতে পারে। কিছু চুরি হয়ে গেলে? সবেধন নীলমনি কিছু টাকার ওপরেই এখানে জীবন চলছে, তোমার চাকরি পাবার আগে সেগুলোর কিছু হয়ে গেলে? আমরা এখানে বিদেশী, কেইবা সাহায্য করবে!?"
মা বলে চলল, "শুধুই কি টাকার ব্যাপার? ধরো আমি বা তোমার মেয়ে ঘুমিয়ে আছে, দরজার নক শুনতে পেলাম না। বাইরের কোন লোক বাড়িতে ঢুকে পড়ল! কেমন বাজে না ব্যাপারটা? প্রাইভেসিরও তো ব্যাপার আছে!"
বাবাও চিন্তায় পড়ে গেল মায়ের কথায়! মা বাবাকে বলল, "তুমি ওনাকে কড়া করে কিছু বলতে পারলে না?"
বাবা বলল, "আমি কি বলব? ওদের যা নিয়ম সে অনুযায়ী না থাকলে তো চলে যেতে হবে এখান থেকে। তখন কোথায় যাবে বলো!?"
মা আর কথা খুঁজে পেল না।
আমার সবাই কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকলাম। আমার মনে পড়ে গেল দেশের একটা ঘটনার কথা। একদিন আমি আমার কাজিনের সাথে দৌড়ে খেলে বেড়াচ্ছি। মামী ডাকল ইশারা করে। আমরা গেলাম, আমাদেরকে বলল, "ঘরে বসে থাক। একটুও নড়বি না আমি না আসা পর্যন্ত।" আমরা খুব বিরক্ত, খেলায় বাঁধা পড়ল! বসার ইচ্ছে নেই জানিয়ে দুজনেই চলে আসতে লাগছিলাম, তিনি আটকালেন, আর কড়া করে বসতে বললেন! মামী এভাবে কখনোই বলেন না, আমরা সিরিয়াস কিছু বুঝতে পেরে ভয়ে বসে পড়লাম।
একটু পরে ঘরে কাজের লোক এলো ঘর মুছতে। সে মুছে চলে গেল, আমরা বসে আছি তো আছি, ভীষন বোরড। বেশ কিছুক্ষন পরে মামী এলো, এসে বলল, "এখন তোরা যা, খেল। আসলে, মতির মায়ের চুরির অভ্যাস আছে, ড্রেসিং টেবিলে তো কিছু রাখাই যায়না, তোদেরকে পাহারায় বসিয়েছিলাম।"
আমরা বেশ অবাক হয়ে গেলাম! খালা চোর! আমাদের সাথে কত মজা করে সুন্দর ভাবে কথা বলে। যাই হোক, সেদিন থেকে আমি আর আমার কাজিন কেউ বলুক না বলুক, উনি এবং অন্য কোন কাজের মানুষ কাজ করলে নজর রাখতাম। শার্লক হোমস বনে গেলাম দুজনে, যদিও হাতেনাতে কখনোই ধরতে পারিনি কাউকে।
মিস্ত্রী বাড়িতে এলেও দেখতাম মা বা বাবা কেউ একজন দাড়িয়ে থাকত। একা একা ছাড়ত না। সন্দেহগুলো অমূলকও ছিলনা, অনেকসময়েই বাইরের কেউ কাজ করে যাবার পরে বাড়িতে ছোটখাট জিনিস মিসিং যেত!
নীরবতা ভেঙ্গে মা বলল, "চলো এখনই ব্যাংকে যাব। সব টাকা জমা দিয়ে আসব, আমি শান্তি পাচ্ছিনা। আমরা তো সারাদিন নানা কাজে বাইরে বাইরেই থাকি। কখন কি হয়! চলো।"
আমি ওদিকে স্কুলে ভর্তির চিন্তায় সারারাত ঘুমাইনি, খুবই ক্লান্ত। ঘুমিয়ে পড়ব এমন অবস্থা। মাকে বললাম, "মা তোমরা যাও, আমি একটু ঘুমাবো।"
মা বলল, "তোমার মেয়েটার কোন সেন্স হলো না! দেখলি না কি হলো? তোকে এখন একা রেখে যাব? টাকা পয়সা রাখতেই ভরসা পাচ্ছিনা, আর তুই তো আমাদের মেয়ে! চল! রেডি তো হয়েই আছিস, বের হয়ে যাই সবাই।"
মায়ের যেই কথা সেই কাজ। সবাই মিলে চলে গেলাম ব্যাংকে। ব্যাংকে গিয়ে মনে হলো, মিস্টার ওয়ার্ল্ড কম্পিটিশনে এসেছি! নানা ডেস্কে বসে থাকা অথবা আশেপাশে হাঁটতে থাকা একেকটা অফিসার যা হ্যান্ডসাম! নারী কর্মীরাও বেশ ফিটফাট, পরিপাটি মেকআপে বসে আছে। পুরুষগুলো বেশিরভাগই মারাত্মক লম্বা এবং নীল চোখ তো এখানে ডালভাত! আচ্ছা হ্যান্ডসাম এন্ড বিউটিফুল হওয়া কি ব্যাংকারদের জব রিকোয়ারমেন্টের মধ্যে পড়ে?
ওখানে গিয়ে রিসিপশনে বাবা কিছু কথা বলল, রিসিপশনিস্ট মহিলা একজনকে ফোন করলেন। মহিলা ফোনে কথা বলতে বলতে আমি আশেপাশে চোখ বোলাতে লাগলাম। ব্যাংকটি বেশি বড় ছিলনা, তবে বেশ ছিমছাম করে সাজানো ছিল। জায়গায় জায়গায় ইউনিক ডিজাইনের সোফা, চেয়ার। বাস্তবের চেয়েও বেশি বাস্তবিক বড় বড় কৃত্রিম ফুল, গাছ কোণায় কোণায়।
কথা শেষে আমাদেরকে সামনের একটি অফিসে যেতে বলা হলো। ছিমছাম ছোট অফিসটিতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম আরেক সুদর্শন পুরুষ বসে আছে। টেবিলে তেমন একটা ফাইলপত্র ছিল না, ভদ্রলোক কাজ টাজ তেমন করেন না মনে হয়!
দাড়িয়ে আমাদেরকে ওয়েলকাম করলেন। বললেন কি বিষয়ে সাহায্য লাগবে। বাবা সব বলল, তিনি নানা ডকুমেন্টস চাইলেন। সবই আমরা সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম, উনি বলা মাত্রই বের করে দেওয়া হলো। উনি বেশ খুশি হয়ে গেলেন। কম্পিউটারে আমাদের কিসব ডাটা এন্টার করালেন। খুব অল্প টাইমেই ব্যাংকের কাজটা হয়ে গেল। তেমন একটা অপেক্ষা করতে হলোনা।
বাসায় আসার পরেও মা মুখ গোমড়া করে রাখল। যখন তখন বাড়িতে লোক ঢুকে পড়তে পারে বিষয়টি মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। বাবা অনেক বোঝালো যে এতে যদি কারো ক্ষতি হতো তবে কখনোই এমন নিয়ম করত না ওরা। তুমি চিন্তা করোনা।
আমারো স্কুলে ভর্তি হবার আনন্দটা পানসে লাগছে, মায়ের মুুখে চিন্তা দেখলে আমার মাথার ঠিক থাকেনা। মাকে আমিও বাবার মতো বোঝাতে গেলাম, এবং বেশ ভালোমতো বকা খেয়ে ফিরে এলাম। বাইরের লোকের বকা ঘরের লোককেই খেতে হয়!
মন খারাপ করে রাতের বেলায় নিজ ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম একমনে। রাতের পাহাড় যে কি সুন্দর হয়! কানাডায় এসে বেশ কিছুদিন হবার পরেও আমার বিশ্বাস হয়না আমার ঘরের জানালা দিয়ে সহজেই এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্যে ডুবে থাকা যায়! আকাশটা নীল ও কালোর মিশেলে একটা অবর্ণনীয় রং এর আবরণে ঢাকা। রংটি আলো ও অন্ধকারকে একসাথে চোখের সামনে এনে দেয়! সেই আবছা উজ্জ্বল আকাশের নীচে গভীর কালো ত্রিকোণ আকৃতির উঁচু নিচু ছায়া। পাহাড়ের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে থাকে সূক্ষ্ণ সব প্রাকৃতিক কারুকাজ; সেসব শিল্প রাতের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে। পাহাড়ের বুকে নানা বাড়ি, এবং আশপাশ দিয়ে কতশত রাস্তা বয়ে যায়! বাড়ি, গাড়ির আলোগুলো দূর থেকে পাহাড়ের বুকে ছোটছোট তারার ফুলের মতো ফুটে আছে। ঘোরলাগা চোখে কতক্ষন যে তাকিয়ে আছি নিজেরও খেয়াল নেই। উফফ! সবকিছু এত অসহ্য সুন্দর কেন?
কানাডায় এসে এ পর্যন্ত প্রতিটি দিনই ঘটনাবহুল ছিল। এ কয়েকদিনেই কতকিছু দেখে ফেললাম যেন! কত রং, চলন, বলনের মানুষ আছে পৃথিবীতে। আর প্রকৃতি মাও অপরূপা সাজে শহরটিকে রাজরানী হয়ে আগলে রাখেন। অদ্ভুত সব নিয়ম কানুনের সাথেও পরিচয় ঘটছে। ঘুম নাকি একধরণের মৃত্যু! সে হিসেবে প্রতি রাতে মানুষ মরে এবং সকালে নতুনভাবে জন্ম নেয়। কে জানে! এই রাতের পরের নতুন জীবনের নতুন সূর্যটি কি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে........
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৩৫