somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কম খরচে আবার ভারত পর্ব-৭ ( আধিক্য কালকা থেকে সিমলা টয় ট্রেন-২)

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পরের পর্ব
অন্য পর্বগুলো
ক্ষণিকা

দার্জিলিঙের ট্রেনটি ১০ কিঃমিঃ বেগে চললেও সিমলার ট্রেনটির গতি ঘন্টায় প্রায় ২০ কিঃমিঃ। মাঝে মাঝে খুব সুন্দর ছোট ছোট স্টেশন। সেসব স্টেশনে মুখরোচক খাবার বিক্রি হচ্ছে। আমি তাই কিনে খাওয়া শুরু করলাম। একেকটি স্টেশনে ট্রেন থামে আর আমি টুকটাক এটা-ওটা কিনে খায়। প্রতিটি স্টেশনে খাবার পানির ব্যাবস্থাও আছে। কিন্তু সেগুলো হাতে ছোয়া যাচ্ছে না,কারণ সেগুলো সব বরফ গলা জল।





ট্রেনটি ছুটে চলার ফাকেই জংলি গাছপালা ছাড়িয়ে পাইন বন শুরু হলো। রাস্তার দু’ধারের ঝোপঝাড়ে রঙ-বেরঙের ফুল ফুটে আছে। আমার তো মনে হচ্ছে একটি পুষ্পক রথ আমাকে নিয়ে স্বর্গের পানে ধেয়ে চলেছে।




দুপুর একটার দিকে ট্রেন একটা পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম ইঞ্জিনের কি যেন সমস্যা হয়েছে। ঠিক করতে সময় লাগবে। অনেকক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে আছি এজন্য সেতু আর নিয়নের কাছে গেলাম বসার জন্য। গিয়ে দেখি তারা দুজনে ততোক্ষণে জমিয়ে ফেলেছে। আশেপাশের ছেলে ছোকড়া মেয়ে বুড়ো সবাই তদের দুজনের বিশেষ করে সেতুর গুনমুগ্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছে। সে দেখি হকারের কাছ থেকে এটা ওটা কিনে সবাইকে খাওয়াচ্ছে, আর মাঝে মাঝে উল্টোপাল্টা হিন্দিতে কি সব বলছে! পুরো বগির লোক হেঁসেই অস্থির।



ট্রেন অনেকক্ষণ থেমে আছে দেখে নিচে নামলাম। আর নামার পর মনে হলো ভাগ্যিস ইঞ্জিন নষ্ট হয়েছিল। রেলপথ ধরে সামনে কিছুদূর হেঁটে গেলাম। পুরো যাত্রাপথের সব জায়গায় দেখেছি, কিছুদূর পরপর কিছু লোক ট্রেন রাস্তা মেরামত করছে। আসলে এই দুর্গম রেলপথটি সবসময় সংস্কারের উপর রাখতে হয়। এখানে একজন রেলপথ মেরামতকারিকে পেলাম।



তাকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে এমন এক জায়গায় গিয়ে দাড়ালাম যেখান থেকে অবারিত দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একপাশে উঁচু পাহাড় আর একপাশে গভীর খাদ। দুপাশেই পাইনের ঘন বন। দূরের উঁচু পাহাড়গুলোকে সাদা মেঘ ঢেকে দিচ্ছে আবার পরক্ষণেই সেগুলিকে উধাও করে দিয়ে সূর্য ঝমকে উঠছে।



ঘন্টা দেড়েক পর আবার ট্রেনে উঠে বসলাম। দেখি আসর ততোক্ষণে জমজমাট। পুরো বগির সব যাত্রী সেতুর মজাদার কথা শোনার জন্য উৎসুক হয়ে আছে। সেতু ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে কিসব উল্টোপাল্টা বকছে আর পুরো ট্রেন কেঁপে কেঁপে উঠছে সবার হাঁসির ঠেলায়। ব্যাপারটা না দেখলে ঠিক কল্পনা করা যায় না। পাহাড়ি পথে একটা ট্রেন নষ্ট হয়ে গেছে যেখানে এক বাংলাদেশী পাগলের প্যাচালে পুরো ইন্ডিয়ান যাত্রী মত্তো হয়ে হো হো করছে, যাদের হো হোর ঠেলায় ছোট্ট এই ট্রেনটি যেকোন সময় কাত হয়ে পাহাড় থেকে খাদে পড়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে একটি মেয়ে দেখি সেতুর বিশেষ অনুরক্ত হয়ে গেছে। চেহারার মিল থাকায় আমি তাকে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সম্বোধন করায় সে আরো খুশি হয়ে উঠেছিল। মেয়েটি তার মা, ছোট ভাই রোহিত আর কাজিন পঙ্কজদার সাথে তারা দেবি স্টেশনে যাচ্ছে। সেখানেই তাদের বাড়ি। তারা সবাই সেতুর গুনমুদ্ধ ফ্যান। অন্য একজন যুবক দেখি সেতুকে আওরংজেব আওরংজেব বলে সম্বোধন করছে। আমি ভাবলাম আরে বাবা! এতো ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে যে নাম নিয়েও ঠাট্টা হচ্ছে। পরে শুনি সেতুর ভালো নাম হচ্ছে আওরঙ্গজেব। চুপি চুপি একটা গোপন কথা প্রকাশ করে দিই, এই যুবক কিন্তু পরে(ফেসবুকে) সুদর্শন নিয়নের বিশেষ ভক্ত হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছে ।





সেতুর এসব হাস্যকর কর্মকাণ্ডে আনন্দিত হয়ে তার সদ্য পরিচিত এক আন্টি আমাদের খাবার খেতে দিলো। পাপড় চাটনি আরো কি কি যেন। এরপর পুরো বগির সব যাত্রীই তাদের দুপুরের খাবার থেকে আমাদের ভাগ দেয়া শুরু করলো। সব ভেজ খাবার। আমরা খেয়ে শেষ করি তারা আবার দেয়, আবার শেষ করি আবার দেয়। তৃপ্তি সহকারে এতো খাবার খাওয়া হলো যে বলার নয়। আমি আমার বেশ কবার ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, আমাদের দেশে আমরা যেমন সহযাত্রীর সাথে বকবক করি এদেশের লোক তেমন করে না। এদেশের লোকজন সাধারণত সহযাত্রীর সাথে পরিচিত হতে অনাগ্রহী বোধ করে। তবে সেতু এমন একটা জিনিস যে সবাইকে আপন করে নিতে বাধ্য করেছে। এমনকি ভারতীয়রা তাদের দুপুরের খাবার থেকে ভাগ পর্যন্ত দিয়েছে। নাহলে আজ দুপুরে আমাদের না খেয়ে থাকতে হতো। আরো একটা কথা চুপি চুপি বলে রাখি,আমাদের প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সেতুকে দেশে ফেরত আসার পর এতোটা বিরক্ত করে যে সেতু তাকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য অস্থির হয়ে আছে। যেহেতু তারা আমাদের ভরপেট খাওয়ালো, আমাদেরও উচিৎ তাদেরকে কিছু খাওয়ানো। দেশ থেকে আসার সময়, খিদে লাগলে আমি যেন টুকটাক খেতে পারি এজন্য আমার বাবা আমাকে গাদাখানেক গজা কিনে দিয়েছিল। বগির সবাইকে সেই গজা বিলালাম। কেউ কেউ সেই গজা এতো পছন্দ করলো যে আরো কয়েকবার করে চেয়ে নিলো।



দুপুর তিনটার কিছু পরে পিছন থেকে একটা ইঞ্জিন এসে ট্রেনটাকে টেনে পিছনের স্টেশনে নিয়ে গেল। সেখানে নষ্ট ইঞ্জিনটাকে সরিয়ে ভালো ইঞ্জিনটা জোড়া লাগিয়ে আবার সিমলার দিকে চলা শুরু হলো।চারপাশের দৃশ্য সেইরকম মোহনীয়। মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্টেশনে থামছে। তারপর আবার চলছে। ব্রীজ আর সুড়ঙ্গ পার হচ্ছে সমানতালে। আর সুড়ঙ্গের ভিতরে ট্রেন ধুকলে সবাই আনন্দে সমানে চিৎকার করছে।



বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে ট্রেন হঠাৎ করে আরো উপরে প্রায় খাড়াভাবে ওঠা শুরু করলো। চারপাশ থেকে ছুটে আসা মেঘ ঘিরে ধরা শুরু করেছে। ঠান্ডার পরিমাণ হুট করে বেড়ে গেল। কাল অতো গরম থেকে আজকের এই মনোরম ঠান্ডায় এসে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেতু আর নিয়নের অবস্থা মোটামুটি কাইত! কারণ কাল সন্ধ্যায় তারা যে পাতলা হাফপ্যান্ট পরেছিল এখনো তাদের পরনে সেই জিনিসই রয়েছে।



হঠাৎ দূর থেকে সিমলা শহরটা দেখতে পেলাম। মেঘাচ্ছন্ন একটা আবহাওয়ায় শহরটিতে শেষ বিকেলের আলো পড়ছে। ব্যাপারটি একই সঙ্গে এতো সুন্দর আর অপার্থিব যে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৪
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×