“সম্প্রতি আমাদের পুরানো বাড়িটা ভেঙে ফেলা হলো। মালপত্র সরানোর সময় আমি আমার ঠাকুরদা স্বর্গীয় আনন্দ রায় চৌধুরির লেখা একটা ডায়েরি খুঁজে পেয়েছি। নিচের লেখাটি সেখান থেকে নেয়া। তারিখ ৩০শে মার্চ,১৯৩১ইং। নামটি অবশ্য আমার দেয়া, ক্ষণিকা।“
দুজনেরই একই কামরায় আসন পড়িয়াছিল। বাষ্পীয় রেলে চাপিয়া দার্জিলিং যাইতেছিলাম। শ্রেণীটি ছিল প্রথম এবং তাহাতে শুধুমাত্র আমরা দু’তরফই ছিলাম। তাহার সহিত ছিল দুইখানা বাসকো আর একখানা দাসী। আমি একাই ছিলাম। সদ্য বিলাত হইতে আইনের ডিগ্রী লইয়া আসিয়াছি। বিবাহের জন্য বাড়িতে পাত্রী খোঁজা আরম্ভ হইয়াছে। বঙ্গদেশে তো দেখি সুন্দরী, সুলক্ষণা, সুকন্ঠী, গৃহকর্মে সুনিপুনা ইত্যাদি বিশেষনে বিশেষায়িত কন্যার অভাব নাই! ঘটকের তোড়জোড় দেখিয়া মনে হইলো মুখশ্রী ও যোগ্যতায় আমিও বুঝি ততোটা মন্দ নই। কিন্তু এখনই ঐ দিল্লীকা লাড্ডু খাইতে আমার মত নাই। অতএব বাড়ি হইতে পলায়ন। একমাস ধরিয়া ভারত ভ্রমণ করিতেছি। এইবারকার উদ্দেশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন।
তীক্ষ্ণ শব্দে ভেঁপু বাজিয়া উঠিল আর রেলগাড়িটি প্ল্যাটফর্মের ব্যাস্ততাকে ছাপাইয়া সামনে এগুতে লাগিল। বাহিরের চাঞ্চল্যতা হইতে মুখ ফিরাইয়া তাহাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম। বয়স ২২-২৩ বছর। গোলাকার মুখে টানাটানা চক্ষু যাহাতে কিঞ্চিৎ কাজলের আভাস। তীক্ষ্ণ নাক। উপরের পাটির মুক্তোর মতো দাঁত নীচের ঠোঁটটাকে কিছুটা কামড়াইয়া আছে, যেখানে একখানি গজদন্ত তাহার অস্তিত্বকে সগর্বে জানান দিতেছে। বুঝিলাম ঠোঁট কামড়ানো তাহার মুদ্রেদোষ। পরনে সবুজ রঙের পুরোহাতা জামা আর সাদা রঙের ঢাকাই জামদানি। শাড়িটি পিরীলি ঠাকুর বাড়ির ধরণে কুঁচি দিয়ে পড়া। সাদা রঙের কাশ্মিরী শালখানি খুব আলতো ভাবে শরীরে জড়ানো। বুকে একখানা সোনার ব্রোচ। পায়ে কাপড়ের নকাশাদার ফুলতোলা জুতো। চুলগুলো হাতখোপা করিয়া বাঁধা যাহাতে অবহেলায় একখানা রুপোর কাঁটা গোঁজা রইয়াছে। শঙ্খ শুভ্র নিরাভরণ হাতে একখানা ইংরাজি নভেল, যা তাহার চোখের সম্মুক্ষে ধরা। একজন সুপুরুষ যুবক যে তাহার সম্মুখে উপবিষ্ট সে ব্যাপারে তাহার কোনরূপ চাঞ্চল্যই নাই। কতোক্ষণ বিভোর হইয়া তাহার দিকে তাকাইয়া ছিলাম জানি না। সম্বিৎ ফিরিল দাসীটির কথায়, তাহাকে কহিল,”কোনি দিদি, তুমার জলখাবার খাওনের টাইম হইছে“। বুঝিলাম তাহার নাম কনকচাঁপা। আর আমার বুকে তখন লক্ষ ভ্রমরের গুঞ্জন।
কিভাবে ৭ঘন্টা কাটিল জানি না। দার্জিলিং ইষটিশন আসিল। দাসীটি আগে নামিয়া একখানা কুলি ডাকিয়া বাসকো দুইখানা নামাইলো। ভীড় কমিলে কনকচাঁপা নামিলেন, আর তাহার পিছু আমি। একজন সৌম্যদর্শন বয়স্ক ভদ্রলোক আগাইয়া আসিল তাহাকে দেখিয়া,’welcome, welcome Mrs. মূখারজী। Welcome to our school. We are very proud to get you. বিশেষত আপনার মতো একজন বিদূষীকে teacher হিসেবে আমাদের মাঝে পেয়ে। আপনার মতো কিছু মানুষ এগিয়ে আসে বলেই তো আমরা বাবা-মা হারানো ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের এই Orphanage-কে এগিয়ে নিতে পারছি। যাই হোক, আশা করি আসবার পথে কোনরূপ অসুবিধা হয়নি। অনেকগুলি Project আছে আমাদের। বিধবা, অসহায় নারী, দুস্থ মাতা, বয়স্ক পুনর্বাসন.........
ভদ্রলোক আরো কি কি যেন বলিয়া যাইতেছিলেন। কিন্তু একখানা শব্দ যেন আমার কানে গরম শীশা ঢালিয়া দিল। গলার কাছে একরাশ কষ্ট দলা পাকাইতেছে। হা ঈশ্বর, তুমি এতো নিষ্ঠুর! মিসেস মূখারজি; তারমানে কনকচাঁপা বিধবা!