নদীর জন্য কান্নার উপলক্ষ্য প্রয়োজন। শুধু শুধু নিরালা কান্না বা মায়াকান্না নয়, নদীর জন্য তরল গরম জলের দরদী কান্না প্রয়োজন। নদীর জন্য কেউ কাঁদে না। গ্যাস, কয়লা, পানি নিয়ে সমাজবান্ধবেরা কাঁদতে পারলে নদীকে নিয়েও সহি তরিকায় কান্না প্রয়োজন। নদী মারা যাচ্ছে। নদীরা মারা যাচ্ছে। মুমূর্ষু নদীর পাশে বসে কিছু শোকাশ্র“ বিসর্জন দেয়া আমাদের একান্ত দরকার। হয়তো আমাদের সম্মিলিত কয়েক ঘটি শোকাশ্রু নদীর হত্যাকারীদের কলিজার পাষণ্ডতা বেকসুর করতে পারবে না, হয়তো বেদনার এ অল্প অশ্রু নদীর ক্ষীণ ধারাকে বেগবান করবে না; তবু আমাদের সমবেত শোকাশ্রু বাষ্প হয়ে উড়ে গিয়ে আকাশের গায়ে লিখবে নিজের মৃত্যুসংবাদ- ‘নদী বাঁচাও, নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে, নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।’
আগে মানুষ গর্ব করে বলতো আমি পদ্মাপাড়ের ছেলে, আমি সুরমাপাড়ের লোক, আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে ধানসিঁড়ি নদীর তীর দেখা যায়। এখন আর কেউ নদীর পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় না। নদী এখন পরিচিত কেউ নয়। কেউ বলে আমি অমুক নেতার এলাকার লোক, অমুক অভিনেতার বাড়ি আমাদের জেলায়, ওই টাকাওয়ালা আমার দূরাতো ভাই। নদীর জায়গা দখল করে নিয়েছে নেতা, অভিনেতা, টাকার ঋষীরা। নদী হয়ে গেছে অজ্ঞাতজন।
কী করবে মানুষ? কোন্ নদীর পরিচয়ে গর্ব করবে আর? কোথায় আছে আর নদী? নদীর বুকে আট মাসের পোয়াতির মতো জেগে আছে বুভুক্ষু চর। দখলের বিশাল লোহার পাইপ প্রতিদিন উগরে দিচ্ছে টনকে টন মরুভূমি। নদীর উদর থেকে বালি তুলে সেই বালি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে নদীরই ঘাড়ে। নদীকে বইতে হয় নিজের হৃদপিণ্ডের ভার। শহুরে মানুষের আধুনিক জীবনযাপনের স্তুপ স্তুপ বর্জ্য ট্রাকে ভরে প্রতিদিন গেলানো হচ্ছে নদীকে। সেই মরুভূমির উপর, স্তুপের উপর গড়ে উঠছে ইটের পাহাড়। সেই পাহাড়ে মানুষ থাকে।
ভারত বাঁধ দিয়ে আমাদের নদীকে পঙ্গু করেছে। আমরা প্রতিবাদ করেছি, প্রতিরোধ করতে পারিনি। রাগে, দুঃখে আমরা শপথ করেছি- ভারতের হাতে নদী হত্যা আমরা সহ্য করবো না, আমাদের নদীকে আমরা নিজহাতে হত্যা করবো। সোল্লাসে আমরা তাই করছি। নদীর বুকে বর্ষায় জল আসে। সে জল মানুষের তৈরি মরুভূমি ভেদ করে ভাসিয়ে নেয় দু’কূল। হয় প্লাবন। আসে ভাঙ্গন। নদীপাড়ের মানুষের ঘরবাড়ি, গেরস্থালি ভেসে যায় গর্জন তুলে। শহুরে মানুষের আরামের জন্য বিলীন করে দিতে হয় গ্রাম্যজীবনের জীবনযাপন।
নদীর জন্য কে কাঁদবে? রাজনৈতিক দলের গরজ হবে না। কারণ, নদী তাদের বিসম্বাদের মাঠ গরম করার তাকত রাখে না। অশীল বা কুশীল সমাজও কাঁদবে না। তারা কান্নার উপরই আছে। নিজের কান্না রেখে আরেকজনের জন্য কান্না ডাউনলোড করার রীতি নেই এ দেশে। সংবাদপত্র মাঝে মাঝে কাঁদে। যখন সে কান্নার করার মত আর কোন বেহুদা ছুতো না পায়।
তাহলে কেউ কি কাঁদবে না?
কাঁদবে
আরো কাঁদবে পাখি-নারী-মৃত্তিকা ও জল
সমুদ্র-কবিতা-ঋতু-কাশফুল-রূপালী ইলিশ ও নোঙর
আর কাঁদবে পানিসম্পদ মন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সীল মোহর
কেবল মানুষ কাঁদবে না
কারণ, মানুষ বিলাসের জন্য কাঁদে, ‘বিলাসী’র জন্য কাঁদে না।