ভূমিকম্প একটি অতর্কিত, প্রধান এবং ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ । কোন প্রকার পূর্বাভাস না দিয়েই খুব অল্প সময়ের ভেতর একটি জনপদ ধ্বংস করে দেওয়ার মত ক্ষমতা রাখে এই দুর্যোগ । এর সংজ্ঞা এবং উৎপত্তির কারণ আমাদের কমবেশি সবার জানা আছে, এ নিয়ে তাই বিশদ ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না । শুধু এটুকু উল্লেখ করতে চাই, সারা পৃথিবীজুড়ে ভূমিকম্প-উপদ্রুত কিছু বিশেষ এলাকা (earthquake belt) চিহ্নিত করা হয়েছে এবং বাংলাদেশ এর বাইরে নয় । নীচের ছবিটিতে red zone area সেই earthquake belt এর আওতায় বাংলাদেশের প্রধান উপদ্রুত এলাকাগুলো নির্দেশ করছে । zone 2 এবং zone 3 ও নিরাপদ নয় ।
নীচের ছবিটি বাংলাদেশের seismic conditions আরও সূক্ষ্মভাবে বুঝতে সাহায্য করবে -
ধরুন, ভূমিকম্প সংঘটিত হলো । এর অব্যবহিত পরপরই আমরা আশা করতে পারি না যে, প্রয়োজন অনুযায়ী সাহায্য তৎক্ষণাৎ পেয়ে যাব । যে কোন জরুরী অবস্থার জন্য সবার কিছু পূর্বপ্রস্তুতি থাকা একান্তভাবেই গুরুত্বপূর্ণ । এ যেন পরীক্ষা দিতে গেলাম কোন ধরণের প্রিপারেশান ছাড়া, সেইক্ষেত্রে মাথায় মুহুর্মুহু বাজ পড়ার অনুভূতিটুকু শুধু টের পাবো- আর কিছু চিন্তা করার সুযোগ থাকবে না । নিয়মিত পড়াশুনা যেভাবে যে কোন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে আমাদের মানসিক শক্তি দেয়- ঠিক তেমনি, দুর্যোগ -পূর্ব সতর্কতা আমাদেরকে মানসিক শক্তি বজায় রাখতে সাহায্য করবে । দুর্যোগ-পরবর্তী অন্ততঃ প্রথম ৭২ ঘন্টার জন্য কিছু পরিকল্পনা কিভাবে আগে থেকে নেয়া যায় চলুন দেখা যাক ।
নিম্নলিখিত ধাপগুলি আপনাকে ভূমিকম্পসহ যে কোন জরুরী অবস্থার জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করবে-
১। আপনার শহরের বাইরের একজন ব্যক্তিকে দুর্যোগ-পরবর্তী যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নির্ধারণ করুন । এমন কাউকে নির্বাচন করুন যিনি অন্য কোন শহরে বসবাস করেন । আমরা আশা করতে পারি যে দূরত্বের কারণে হয়ত তিনি একই দুর্যোগ দ্বারা প্রভাবিত হবেন না । আত্মীয়, বন্ধু, শুভাকাংখী-যে কেউ হতে পারেন তিনি । তাকে আপনার নিকট আত্মীয়স্বজনের নাম এবং যোগাযোগের নম্বর দিয়ে রাখুন । আপনার পরিবারের সব সদস্যকে নির্দেশনা দিয়ে রাখবেন বিশেষ পরিস্থিতিতে সেই ব্যক্তির সাথে যেন সবাই যোগাযোগ করে নিজ নিজ বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করে । সেই ব্যক্তি হবেন আপনাদের Contact point । প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোতে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নাও পেতে পারেন, তাই ল্যান্ডফোনের কথাও মাথায় রাখুন । যে কোন দুর্যোগের পরপর লোকাল ফোন- যোগাযোগ সুবিধার থেকে লং ডিস্ট্যান্স ফোন পরিসেবার পুনরুদ্ধার সাধারনতঃ তাড়াতাড়ি হয় ।
২। আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রগুলোর ফটোকপি করে কপিগুলো বিশ্বাসযোগ্য কোন ব্যক্তির কাছে বা ব্যাঙ্কে ডিপোজিট বক্সে রাখুন । পাসপোর্ট, ড্রাইভার লাইসেন্স, সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ড, দলিলপত্র , যে কোন গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক বিবৃতি, বীমা তথ্য, বিয়ের লাইসেন্স এবং চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র ইত্যাদি এতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে ।
৩। আপনার বাসায় দামি জিনিসপত্রের (যেমন দামি গয়না, ইলেক্ট্রনিক্স, শো-পিস ইত্যাদি) একটা তালিকা তৈরি করুন । লিখিতভাবে এবং সেইসাথে ফটোগ্রাফ অথবা ভিডিও করে রাখুন সেই জিনিসগুলোর । আপনার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রের সঙ্গে (২ নম্বর দ্রষ্টব্য) এই তথ্য একসাথে রাখুন ।
৪। আপনার পরিবারের সবাইকে এই পরিকল্পনায় যুক্ত করুন । তাদের সবাইকে ১,২,৩ এবং ৫ নম্বর সম্পর্কে অবহিত করুন । বাড়ী নির্মাণের সময় কিভাবে একে ভূমিকম্পবান্ধব করা যায় সে সম্পর্কে ইঞ্জিনীয়ারদের কাছ থেকে জানুন । উন্নত দেশগুলোর স্কুলে, অফিসে, বাসায় প্রতি ৬ মাসে/এক বছরে একবার হলেও ফায়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে আগুন আর ভূমিকম্পের ড্রিল প্রশিক্ষণ উৎসাহিত করা হয় । আগুন আর ভূমিকম্পে ঘরের ভেতর কোথায়, কোন শারীরিক ভঙ্গিতে অবস্থান নেয়া অপেক্ষাকৃত নিরাপদ, ভেতরে কতটুকু সময় আপনি পাচ্ছেন, কিভাবে-কখন ঘর থেকে বের হতে হবে, পরবর্তী করণীয় কি- এ সম্পর্কে সবাইকে প্রাথমিক ধারণা দেয়া এই ড্রিলের লক্ষ্য । স্বপ্রণোদিত হয়ে যে কেউ কর্মক্ষেত্রে বা স্কুলে এই ড্রিল প্রশিক্ষন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে পারেন । স্থানীয় রেডক্রস সোসাইটি এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে । ভূমিকম্পের প্রেক্ষাপটে আপনার কর্মক্ষেত্র/বাসায় কোন জায়গাটি নিরাপদ, কোন জায়গাটি ভয়ঙ্কর- তা জেনে নিন ।
৫। একটি দুর্যোগবান্ধব ইমার্জেন্সি সরবরাহ ব্যাগ (Disaster Supply Kit) তৈরি করুন । দুর্যোগ-পরবর্তী অন্ততঃ ৩ দিনের জন্য আপনার নিজের এবং আপনার পরিবারের জন্য অতি- জরুরি কি কি দরকার হতে পারে তার একটা তালিকা করুন । পরিকল্পনায় পরিবারের সদস্যদের সবার কথা মাথায় রাখতে হবে । সদস্যসংখ্যা বেশী হলে একাধিক ব্যাগ বানাতে হবে, তবে সব ব্যাগে যেন একইজাতীয় জিনিস থাকে। এর কারণ হল, সব সদস্য দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে একইসাথে সারাক্ষণ অবস্থান করবেন তার কোন গ্যারান্টি নেই । কিটটিকে হতে হবে সবার জন্য বহনযোগ্য, এরজন্য বেশী ভারী যাতে না হয়ে পড়ে খেয়াল রাখবেন । বৃদ্ধা মা থেকে অবোধ শিশুর বিশেষ চাহিদা- সব বিবেচনা করে এটি আপনাকে বানাতে হবে । আপনার বাসার মেইনডোরের পাশে সবার জন্য সহজে প্রবেশযোগ্য কোন স্থানে সেই দুর্যোগ কিট সংরক্ষণ করবেন । উপরের ৪ নম্বরের ক্ষেত্রে এই কিটটি নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়া প্র্যাকটিস করতে হবে। আপনার কর্মক্ষেত্র বা গাড়ির জন্যও এরকম কিট বানাতে পারেন । মাঝেমাঝে পেরিশ্যাবল আইটেমগুলোর মেয়াদ চেক করে তা ব্যবহার করে ফেলবেন এবং সেইসাথে আবার ব্যাগের ঘাটতিপূরণ (replenish) করবেন ।
কিট নির্মাণে যা যা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত তার একটা প্রাথমিক ধারণা এখান থেকে পাবেন:
-একটি ব্যাকপ্যাক
-পরিবারের সদস্যসংখ্যা হিসেবে তিনদিনের জন্য পর্যাপ্ত পানি (বোতলজাত)
-শুকনো খাবার যেমন বিস্কুট, মুড়ি, স্ন্যাকবার
-ফার্স্ট এইড কিট ও নির্দেশাবলী (প্রয়োজনীয় ওষুধ, স্যালাইন, এন্টিসেপ্টিক, ব্যান্ডেজ, ছোট কাঁচি, এজমা রোগীর ইনহেলার ইত্যাদি)
-কিছু নগদ টাকা
-গুরুত্বপূর্ণ ফোন নম্বর, টর্চলাইট, ছোট রেডিও ( ব্যাটারি পরিচালিত), ব্যাটারি, ডাস্ট মাস্ক
-শক্ত জুতা, একসেট কাপড়, প্লাস্টিক রেইন কোট, কম্বল বা স্লিপিং ব্যাগ
-ভারি গ্লাভস, all-purpose ছুরি, ছোট শাবল/হাতুড়ি, টেপ, দড়ি, রেডিও
-ব্যক্তিগত টয়লেট পেপার, মেয়েলি সরবরাহ, sanitizer, সাবান
-শিশু বা অক্ষম বৃদ্ধমানুষের জন্য বিশেষ-প্রয়োজনীয় আইটেম ( চোখের চশমা, শ্রবণযন্ত্র বা অন্যান্য অত্যাবশ্যক ব্যক্তিগত আইটেম )
-বর্জ্য/ স্যানিটেশনের জন্য কিছু প্লাস্টিক ব্যাগ ।
(সাহায্যঃ ইন্টারনেট এবং অন্যান্য)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৭:৩৫